![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালির সম্প্রীতি সাধনা
আবদুল্লাহ আল আমিন
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে তিনযুগ পর সংবিধানে প্রতিস্থাপন করা হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আইন, ২০১১-এর মাধ্যমে বাহাত্তরের সংবিধানের এ অনুচ্ছেদগুলো ফিরিয়ে আনা হয়। সংবিধানের প্রস্তাবনার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে প্রতিস্থাপিত হয়েছে, ‘আমরা অঙ্গিকার করিতেছি যে, যে সব মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদ দিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল Ñ জাতীয়বাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এ সংবিধানের মূলনীতি হইবে।’ ধর্মাশ্রয়ী দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অপ-দর্শন ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে বাঙালি সংগ্রাম করে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন করে। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণকারী বীর বাঙালির স্বপ্ন ছিলঃ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, শোষণহীন, শিল্প-বিজ্ঞান মনস্ক ও ভবিষ্যৎমুখী। বাঙালির সেই স্বপ্ন সাধনা পূরণ এবং একটি শোষণহীন ন্যায়ানুগ ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাহাত্তরে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করার জন্য সংবিধানের চার মূলনীতির উপর আঘাত হানা হয়। পঁচাত্তর-উত্তর ক্ষমতাসীন এবং তাদের সহযোগী মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িকতাবাদী তথাকথিত মডারেটরা সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্তি ছড়ায় ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে। ধর্মনিরপেক্ষতা বিরোধীরা ধর্মপ্রাণ মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, ধর্মনিরপেক্ষতা আর ধর্মহীনতা এক ও অভিন্ন। তারা আরও বিভ্রান্ত ছড়ায় যে, নাস্তিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে কোনই পার্থক্য নেই। আর তথাকথিত মডারেটদের দাবী হচ্ছে যে, ধর্মনিরপেক্ষতা পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তা প্রসূত একটি ধারণা যা বাংলাদেশের মানুষের জীবন সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের পরিপন্থী। অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, ধর্মনিরপেক্ষতা পশ্চিমা আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার সোনালী ফসল। ষোড়শ শতকে রেনেসাঁর প্রভাবে ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজ সংস্কৃতি সম্পর্কে যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিক মূল্যবোধ এবং সৃজনশীল যুক্তিবাদী মানসিকতার উদ্ভব হয়, এসবের প্রভাবে নব যুগের সূচনালগ্নে জন্ম লাভ করে লোকায়ত বাদ বা ধর্মনিরপেক্ষতা। রাষ্ট্রদর্শন হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার উন্মেষ রেনেসাঁ স্নাত ইউরোপে একথা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু মানবিক ও সামাজিক দর্শন হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা যাকে আমাদের দর্শনের আলোকে অসাম্প্রদায়িকতা বলে থাকি, তা নিয়ে কয়েক শতাব্দী আগেই ভেবেছেন এদেশের কবি, সাধক, মরমিরা। তাঁরাও ভেদবুদ্ধিহীন, মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্রগঠনের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। মরমি ভাবুকতার অগ্রগণ্য সাধক লালন সাঁই উচ্চারণ করেছেন :
‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে
সেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে।’
লালনের এ গানে আমরা পাই বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও আসাম্প্রদায়িকতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি চ-ীদাস অবশ্য লালনের আগেই বলেছিলেন : ‘শুন’হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’
চ-ীদাসের সমসাময়িক নববৈষ্ণব ধর্মের প্রর্তেক চৈতন্যদেবও উচ্চবর্ণের ধর্ম ব্রাক্ষ্মণ্যবাদ ত্যাগ করে প্রেমভক্তিবাদী মানবিক ধর্ম প্রচার করেছেন। এই মানবিক ধর্মে উদ্বুদ্ধ হয়ে চন্ডাল, মুচি, নমঃশূদ্র, অস্ত্যজ-অস্পৃশ্য সহ অনেক মুসলমান তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছে। সূফি প্রবর্তনার সাধকদের মতের সাথে চৈতন্যদেব- চন্ডীদাসের মতের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সূফি দরবেশ ইসলামের সাম্য-মৈত্রীর বাণী প্রচার করতে গিয়ে মূলতঃ প্রেম ও মানবিকতার বাণী প্রচার করেছেন। যদিও তারা ধর্মের ভাষা, প্রতীক রুপক ও উপমা ব্যবহার করে গান বেঁধেছেন, কবিতা রচনা করেছেন। তবুও তাঁরা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ধর্ম নিরপেক্ষ। অসাম্প্রদায়িক ও ভেদবুদ্ধিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষে প্রেম ও মানবতার বাণী সবচেয়ে বেশি করে প্রচার করেছেন বাংলার বাউল সাধকরা।
‘ভেদ বুদ্ধিহীন মানবতার উদার পরিসরে, সাম্য ও মানবতার সুউচ্চ মিনারে বসেই বাউলেরা সাধনা করে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাধকের ও দর্শনিকের সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে তারা সাম্য ও মানবতার বাণী প্রচার করে।’ (আহমদ শরীফ, ‘বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য,’ ১ম খন্ড, পৃষ্ঠাঃ ৩৮০)
সাধক, দরবেশ, বাউলদের প্রেম মানবিকতা ও ধর্মীয় সম্প্রীতির বাণী দর্শনকে আপন আত্মায় ধারন করে যিনি মানবপ্রেম, পরমতসহিষ্ণুতা, সৌহার্দের বাণী গানে ও কবিতায় উচ্চারণ করেছেন তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি বলেছেন:
‘গাহি সাম্যের গান Ñ
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রিশ্চান।’(সাম্যবাদী)
তিনি আরও বলেছেন :
‘নেইকো এখানে শাস্ত্রের ভেদ ধর্মের কোলাহল,
পাদরী-পুরুত-মোল্লা-ভিক্ষু এক গ্লাসে খায় জল।
হেথা স্রষ্টার ভজন-আলয় এই দেহ, এই মন
হেথা মানুষের বেদনায় তাঁর দুঃখের সিংহাসন।’(সাম্যবাদী)
(আবদুল কাদির-সম্পাদক, সাম্যবাদী, নজরুল রচনা সমগ্র, ১ম খন্ড ন-স, ১৯৯৬, বাংলা একাডেমী, ঢাকা. পৃ: ২২৩-২৪৭)
চৈতন্য-চ-ীদাস-লালন ও অন্যান্য মরমিদের উত্তরসুরী হিসেবে নজরুল নিজেকে মানব সম্প্রীতির সাধনায় যুক্ত করেছেন এবং সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিকতার মর্মবাণীকে আত্মস্থকরে সুন্দরের স্তবগান গেয়েছেন। আমাদের সমাজ সাংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য, ভাবনা মধ্যযুগ থেকেই ছিল অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক। তবে এ ভূখন্ডের রাজনীতি বারবার সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় ভেদবুদ্ধির দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। আমাদের রাজনীতির সাথে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা যুক্ত করেছে ক্ষমতাশীন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী এবং তাদের সহযোগী ধর্ম ব্যবসায়ী ফেরেব্বাজরা। ১৯০৫ সালে অখন্ড বাংলাকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করে বাঙালির আত্মপরিচয়কে সর্বপ্রথম সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করায় ইংরেজরা এবং রাজনীতিতে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রবক্তা ও পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টারা ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। শুধু তাই নয় বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের ঐতিহ্যকে মুছে ফেলার জন্য নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে। এসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এ ভূখন্ডের মানুষ সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ জানায় ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতীয়তাবাদের মৃত্যুঞ্জয়ী চেতনা জন্ম হয় এবং পূর্ব বাংলায় অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রসার ঘটে। এ প্রক্রিয়াতেই ছাত্রলীগের পর ছাত্রইউনিয়ন ও গণতন্ত্রী দল এর মত অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তির অভ্যুদয় ঘটে এবং আওয়ামীলীগের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বর্জন করা হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণয়নকালে আওয়ামী লীগ গণপরিষদে রাষ্ট্রের ইসলামী করণের প্রতিবাদ জানায়। রাজনীতির পাশাপাশি সংস্কৃতি ক্ষেত্রে একটা উদার, অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী, জীবনমুখী ধারা বিকাশ লাভ করতে থাকে। আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চিন্তাধারার স্ফূরণ ঘটে। সেই সাথে পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল ধারাটি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফলে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের চক্রব্যুহের মধ্যেও উদ্দীপনার সাথে উদযাপিত হয় রবীন্দ্র জন্ম শতবর্ষ, স্বীকৃত হয় বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের ঐতিহ্য; স্বীকৃত হয় লালন-হাসান-রবীন্দ্রনাথ এবং পহেলা বৈশাখ।’ এ স্বীকৃতির কোনটা এল সরকারি ঘোষণাপত্রে, কিন্তু তার সত্যিকার ক্ষেত্র হলো পূর্ব পাকিস্তানী মুসলমান মধ্যবিত্তের বিস্তীর্ণ মানসলোকে।’ (বদরুদ্দীন উমর, মুসলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা, তৃ-স, ১৯৮০, পৃ: ৩১)
এর প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালে রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেন। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরে ছাত্রলীগ এবং ১৯৭১ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে ছাত্র ইউনিয়ন পাকিস্তানকে একটি ‘ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ হিসেবে গড়ে তোলার দৃঢ় অঙ্গীকার ও প্রত্যয় ব্যক্ত করে। ‘বাংলাদেশ যে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে মুক্তিযুদ্ধের কালে আমাদের নেতারা সেকথা অনেকবার বলেছিলেন। শুধু প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ নন, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান, এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোস্তাক আহমদও একাধিক বক্তৃতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় তিন নীতির গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ঘোষণা দিয়েছিলেন।’ (সাত বিশিষ্ট নাগরিক ভাবনাঃ ‘তবু কেন রাষ্ট্রধর্ম’। প্রথম আলো: ১৫জুলাই ২০১১, পৃষ্ঠা: ১৩) একান্তরের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের অভূদয়ের লগ্নে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশের মাটিতে আর কোন সাম্প্রদায়িকতা মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাতৃভাষাকে মুক্ত করতে যুদ্ধ করেছে। নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে স্তব্ধ করা যাবেনা।’ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি কেবল অস্ত্রশস্ত্র, কামান বন্দুক, গোলাবারুদ দিয়ে যুদ্ধ করেনি। অস্ত্রের ছাড়াও অনেক উপাদান, চিত্রকর্ম, পোস্টার, লিফলেটও ব্যবহার করা হয়েছে শত্র“র বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ সরকারের আর্ট ও ডিজাইন বিভাগের শিল্পীদের ভূমিকা ছিল সাহসী ও প্রত্যয়দীপ্ত। তাঁদের এইসব শিল্পকর্মে ও পোস্টারে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক আত্মপরিচয় ব্যক্ত হয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশিত, ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি’- এই পোস্টারটি পাওয়া যায়। পোস্টারটি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশ ও সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি সৃষ্টিতে পালন করেছে অনন্য ভূমিকা।
পাকিস্তান আমলের বিভিন্ন রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালের সংবিধানে জাতীয়বাদসহ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়। বাংলাদেশের সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র অন্তর্ভূক্তিকরণ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আকস্মিক ইচ্ছার ফল নয়। এ ভূখন্ডের জনগনের সুদীর্ঘকালের লড়াই সংগ্রাম ও লালিত স্বপ্নের সোনালী ফসল, বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের মহান নেতাদের দিকনির্দেশনার ফল। বাংলাদেশকে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আমাদের সংবিধান প্রণেতারা রক্তের অক্ষরে রাষ্ট্রপরিচালনার তিন নীতি সহ ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে সন্নিবেশ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, কেবল বাংলাদেশের সংবিধানেয় নয়, আরোও অনেক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছে।
‘২০০৯ সালের এক হিসেবমতে ১৩টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সংবিধানে সুনির্দিষ্টভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটির উল্লেখ ও ব্যাখ্যা আছে। দেশগুলো হচ্ছে ঃ আজারবাইজান, বারকিনো, ফাসো, চাদ, গায়না, কাজাখস্তান, কসোভা, তাজাকিস্তান, কিরগিস্তান, মালি, নাইজার, সেনেগাল, তুরস্ক ও তুর্কেমেনিস্তান। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর কোনটিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের অজুহাত তুলে কোন রাষ্ট্রধর্মের বিধান রাখেনি বা সংবিধানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মগ্রন্থ থেকে বাণী নিয়ে তা সংবিধানে যুক্ত করেনি।’ (শান্তনু মজুমদার, ‘সামাজিক শক্তি ও ধর্মনিরপেক্ষতা’। প্রথম আলো : ২-জুলাই ২০১১, পৃষ্ঠা: ১২)।
অথচ জনগণের মতামতকে তোয়াক্কা না করে হঠাৎ করে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করা হয়, পরবর্তীকালের ক্ষমতাশীনরা তাদের ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থ-চরিতার্থ করার জন্য রাষ্ট্রধর্মের বিধান প্রবর্তন করে। বাংলাদেশে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে সন্নিবেশিত হয়নি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান আদিবাসী নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ মিলিত সংগ্রামের যে গৌরবময় ইতিহাসের রচনা করেছে, তারই প্রেক্ষিতে ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা স্টেট-চার্চ বা ধর্ম-রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বের ফসল নয়, আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা বাঙালির হাজার বছরের সম্প্রীতি সাধানার ফসল। বাংলাদেশের মত বহু ধর্ম, মত, পথের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে একটি বিশেষ ধর্মকে মর্যাদা দেওয়া যায় না। এতে করে যাদের ধর্ম রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা পেল না, তারা হতাশ হতে পারে। রাষ্ট্রের প্রতি তাদের আনুগত্য স্বতস্ফূর্ত হবে না এবং রাষ্ট্রের জাতীয় সংহতি বিনষ্ট হবে।
দীর্ঘ তিন যুগ পর পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ফিরে এসেছে ধর্মনিরপেক্ষতা। এ এক অতুলনীয় আনন্দ গৌরবের বিষয়। গৌরব এ জন্যই যে, এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরে এলো, ফিরে এলো সত্যিকারের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, কারণ গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা পরস্পর পরিপূরক। আর উদার ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে অবশ্যই অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হতে হয়। কেবল অসাম্প্রদয়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রই গণতন্ত্র, সুশাসন, আইনের অনুশাসন, মানবাধিকার, যুক্তিশীলতা ও মুক্তিচিন্তা প্রতিষ্ঠা করতে পারে। পরিবর্তিত ও বৈরী প্রতিবেশে বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার অন্তর্ভূক্তিকরণ নিঃসন্দেহে একটি মহৎ উদ্যোগ। বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সংবিধানেই কিছু সীমাবদ্ধতা ও স্ববিরোধীতা থাকে, বাংলাদেশের সংবিধানও সম্পূর্ণরূপে বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। তবে আমরা যে ধর্মনিরপেক্ষতার মতাদর্শ ফিরে পেলাম, তা কোন ভাবেই চ্যালেঞ্জবিহীন অবস্থায় নেই। ধর্মনিরপেক্ষতা বিরোধীরা তিন যুগ ধরে ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে বিষোদগার করে চলেছে। এই মতাদর্শকে বিশুদ্ধ রূপে টিকিয়ে রাখতে এবং সকল নাগরিকের ধর্মের অধিকার সুনিশ্চিত করতে হলে ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল সামাজিক শক্তিকে সামাজিক ও সংস্কৃতিক পরিম-লে ব্যাপকভাবে কাজ করতে হবে। সেই সাথে বাঙালির হাজার বছরের লোকায়ত দর্শন ও সম্প্রীতি সাধনার মন্ত্রকে সমাজদেহ ও মননের গভীরে প্রোথিত করতে হবে।
আবদুল্লাহ আল আমিন
লোকগবেষক ও প্রাবন্ধিক।
©somewhere in net ltd.
১|
১৫ ই জুন, ২০১৫ বিকাল ৩:৩৯
ছাসা ডোনার বলেছেন: ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি’ আসুন আমরা সবাই মিলে গড়ে তুলি আদর্শ এই সমাজ। সবাই হাতে হাত কাধে কাধ মিলিয়ে একসাথে কাজ করি।আসুন আমরা সেইসব নেতাদের ধীক্কার দেই যারা জনগনকে ভূল বুঝিয়ে বিপথে নেওয়ার চেস্টা করে। সবার উপরে মানুষ সত্য তার উপরে নাই।