![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]
প্রয়োজনের জন্য ভাষা, ভাষার প্রতি প্রজন্মের আগ্রহ
ফকির ইলিয়াস
::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::
বাংলাদেশই বাংলা ভাষার চারণভূমি হিসেবে টিকে থাকবে। কথাগুলো বলছেন বাংলা ভাষাভাষি অনেক প্রাজ্ঞজন। অথচ এ বাংলাদেশেই এখন অনেকগুলো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। অভিভাবকরা জানেন ও বোঝেন— তাদের সন্তানদের বিশ্বমাত্রার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গড়ে তুলতে হবে।
ভাষাবিদ্যায় পারদর্শী হওয়ার কথা ভাবলে আমরা যে চিত্রটি প্রথমেই দেখি, তা হচ্ছে একটি অগ্রসরমান প্রজন্মের ভবিষ্যত্। তা নির্মাণে প্রয়োজন নিরলস অধ্যবসায়। একটি প্রজন্ম শক্তিশালী হয়ে দাঁড়াতে দুটি বিষয়ের প্রয়োজন পড়ে খুব বেশি। প্রথমটি হচ্ছে সত্ভাবে সমাজের অবকাঠামো নির্মাণ। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সমকালের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কর্মপরিধির ব্যাপ্তি ঘটানো। কাজ করতে হলে একটি যোগ্য কর্মীবাহিনীর প্রয়োজন পড়ে, যারা তাদের মেধা ও মনন দিয়ে কাজ করবে নিরন্তর।
জ্ঞানার্জনে ভাষা একটি ফ্যাক্টর তো বটেই। কারণ মানুষ না জানলে, সেই তথ্য-তত্ত্ব এবং সূত্রগুলোকে নিজের জীবনে, সমাজজীবনে প্রয়োগ করতে পারে না। সে জন্য প্রয়োজন পড়াশোনা। পড়াশোনা করতে হলে শিক্ষার প্রয়োজন। প্রয়োজন সেই ভাষাটিও রপ্ত করা। বাংলাদেশের নিরক্ষর মানুষ প্রয়োজনীয় অক্ষরজ্ঞান পেলে নিজেদের জীবনমান যেমন বদলাতে পারবেন, তেমনি পারবেন সমাজের চিত্রও বদলে দিতে। একজন শিক্ষিত মা-ই পারেন একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিতে। আমরা সে কথাটি সবাই জানি এবং মানি।
ভাষার যত রকম প্রয়োজনীয়তার সংজ্ঞা আমরা তুলি না কেন, প্রধান কথাটি হচ্ছে একটি জাতিকে শিক্ষিত করে তোলার গুরুত্ব। মানুষ সুশিক্ষিত হলেই তার জ্ঞান খুলবে— সে উদার হবে, সত্ কাজগুলো করবে। এটাই নিয়ম। পাশ্চাত্যে আমরা উচ্চশিক্ষিতের যে হার দেখি, ওই জনশক্তিই রাষ্ট্র গঠন, পরিচালনায় একটি বিশেষ ভূমিকা রাখছে— তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
আমার এক বন্ধু নিউইয়র্কের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। পোলিশ এ বন্ধুটির সঙ্গে আমার নানা বিষয়ে কথা হয়। সমাজবিদ্যার এ শিক্ষক আমাকে বারবার বলেন, শক্তিশালী ভাষাই বিশ্বে পুঁজির আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ করছে। তার কথাটি মোটেই মিথ্যা নয়। নিউইয়র্ক তথা গোটা উত্তর আমেরিকার একটি বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা নরটন অ্যান্ড কোম্পানির বেশ কয়েকজন কর্ণধারের সঙ্গে ‘ভাষা ও সাহিত্য’ বিষয়ে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হয়েছে। তারা একবাক্যে বলতে চান, মুনাফার লোভেই তারা মহাকবি ওমর খৈয়াম, জালালুদ্দিন রুমী থেকে নাজিম হিকমত, রবীন্দ্রনাথ কিংবা মাহমুদ দারবিশের রচনাবলিকে ইংরেজিতে অনুবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, নিজস্ব আঙ্গিকে। তারা তা ইংরেজিতে ছাপিয়েছেন। বাজারজাত করেছেন। এতে বিশ্বসাহিত্যে ওসব মহত্ লেখক যেমন আদৃত হচ্ছেন কিংবা হয়েছেন, তেমনি তাদের বই বিক্রি করে আয় হয়েছে লাখ লাখ ডলারও।
বাংলা ভাষার সন্তান বাঙালি জাতি। জাতিসত্তা থেকে এ চেতনা আমরা কোনও মতেই সরাতে পারব না। পারার কথাও নয়। কিন্তু এই বলে আমরা অন্যভাষা রপ্ত করব না বা করার আগ্রহ দেখাব না; তা তো হতে পারে না।
এখানেও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তির বিষয়টি আগে আসে খুব সঙ্গত কারণে। ভারতের কেরালা ও তামিলনাড়ু নামে দুটি অঙ্গরাজ্যের কথা আমরা জানি। কেরালা অঙ্গরাজ্যের মানুষ দুটি ভাষা জানেন বিশেষভাবে। একটি কেরালাদের নিজস্ব ভাষা মালেআলাম আর অন্যটি ইংরেজি। সেখানে হিন্দির তেমন দাপট নেই। একই অবস্থা তামিলনাড়ুতেও। তারা তামিল এবং ইংরেজি ভাষায় দক্ষ। বিদেশে চাকরি নিয়ে কেরালা-তামিল থেকে যারা আসেন, তাদের দেখলে মনে হয় ইংরেজি যেন তাদের মাতৃভাষাই। তাদের লক্ষ্যটি হচ্ছে, ভাষার আলো গ্রহণ করে একজন দক্ষ আইন প্রফেশনাল কিংবা টেকনোলজিস্ট হওয়া। আর সে জন্য তারা ইংরেজিকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেন স্কুলজীবন থেকেই।
স্যাটেলাইট টিভির বিভিন্ন চ্যানেলে বাংলাদেশের বইমেলার ওপর অনুষ্ঠানগুলো প্রতিদিনই দেখি। মনে পড়ছে একবার একটি অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম, একজন লেখক তার বইয়ের প্রচার করছেন একটি লাইভ অনুষ্ঠানে। তার গ্রন্থের বিষয়— কীভাবে আলুর অধিক ফলন করা যায়। বিষয়টি চমকপ্রদ। বর্তমান বিশ্বে আলু চাষের প্রতিযোগিতা চলছে। খাদ্য হিসেবে পাশ্চাত্যে বিভিন্ন আইটেমের আলুখাদ্য জনপ্রিয় হলেও প্রাচ্যে তা জনপ্রিয় করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমি মনে করি একজন শিক্ষিত কৃষক ক্ষুদ্র আকারে তার নিজের অধিক ফলন অভিজ্ঞতা বিষয়টি হাতে লিখে, কম্পোজ করিয়ে অন্যদের মাঝে বিতরণ করতে পারেন। বিষয়টি ক্ষুদ্র হলেও প্রধান দিকটি হচ্ছে একজন শিক্ষিত কৃষকই তা পারবেন। আর সে জন্যই শিক্ষার বিষয়টি আগে আসছে। শিক্ষিত হলেই মনের প্রখরতা বাড়ে। আর শিক্ষাগ্রহণ করা যায় জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত।
কয়েক বছর আগে আমরা ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের কয়েকটি কৃষিফার্ম সফর করতে গিয়েছিলাম। ফ্লোরিডায় বেশকিছু ফার্ম আছে, যেগুলোর সব কর্মীই স্প্যানিশ ভাষাভাষী। এরা ইংরেজি একটি অক্ষরও জানেন না। সেখানে কৃষিবিষয়ক সরকারি পুস্তিকাগুলো স্প্যানিশ ভাষায়ই বিতরণ করা হয় সরকারি উদ্যোগে।
হ্যাঁ, ভাষার আলো ছড়িয়ে দিতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা উদ্যোগের প্রয়োজন খুবই জরুরি। বাংলাদেশের ভেতরে আদিবাসী ভাষার অনেক কবি, সাহিত্যিক, মনীষী, চিন্তাবিদ, দীক্ষক আছেন যাদের নামটি পর্যন্তও হয়তো আমরা জানি না। তাদের চিন্তা-চেতনা যদি বাংলায় রূপান্তরিত হত তবে বাংলা ভাষাভাষীরা হয়তো তা জেনে উপকৃত হতে পারতেন। একই দেশের ভেতরেই আছে অনেক ভাষা। আর এক বিশ্বে কত ভাষা আছে তা জানার সুযোগ হয়তো সব মানুষের পুরো জীবনেও আসবে না।
আমি সবসময়ই রূপান্তরে বিশ্বাস করি। রূপান্তরই হচ্ছে ফিরে আসা, অনূদিত হওয়া কিংবা বিবর্তিত হওয়া। বিবর্তন না হলে নতুনের উন্মেষ ঘটে না। তুলনামূলক আলোচনা ছাড়া জানা যায় না বিশ্বের ভাষার নান্দনিক বিবর্তন কীভাবে ঘটছে। লক্ষ করেছি, চলতি সময়ে বইমেলায় বেশকিছু দুর্লভ প্রাচীন ভাষা ও সাহিত্য যেমন চর্যাপদ, সিলেটি নগরী, আদিবাসী শ্লোক নিয়ে বেশ কাজ হয়েছে। আজকের লেখকরা বাংলা ভাষায়ই লিখছেন ক্যারিয়ার গড়াবিষয়ক বই। ওপরে কীভাবে উঠবেন। চাকরির সিঁড়ি কীভাবে নির্মাণ করবেন। ভাষা প্রয়োজনেই শেখে মানুষ।
নিউইয়র্কের একজন নতুন প্রজন্মের বাঙালি-মার্কিন আইনজীবীকে জানি— যিনি তার পেশাগত কারণেই শিখে নিয়েছেন বাংলা ভাষা, বাংলা অভিধান তালাশ করে।
এগুলো আশার বিষয়। আমি মনে করি এসব উত্স সন্ধানই প্রজন্মকে স্বনির্ভরতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি সাধনের পাশাপাশি ভাষা ও সাহিত্য অঙ্গনেও এগিয়ে যাবে স্বপ্নের বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে এখন বইমেলা চলছে। বই প্রকাশিত হতে শুরু করেছে লন্ডন, নিউইয়র্ক থেকেও স্থানীয় বাংলা প্রকাশনীর মাধ্যমে। কারণ বাংলা কম্পোজ এখন খুবই সহজ।
বিভিন্ন ভাষার বেশ কিছু অনুবাদগ্রন্থ ইতোমধ্যে বেরিয়েছে। বাংলাদেশের প্রকাশকরা অনুবাদ গ্রন্থের প্রতি যত মনোযোগী হবেন, ততই লাভ বাংলা ভাষার। বাংলা সাহিত্যের। মূল কথা হল, সাহিত্যের রস আস্বাদন করা। তা যদি ইংরেজিতেও হয় ক্ষতি কী?
ভাষার আলো গ্রহণের একটা প্রতিযোগিতা চলছে আজকের বিশ্বে, নিজেকে টিকিয়ে রাখার কারণেই। বাঙালি প্রজন্ম তা থেকে পিছিয়ে থাকবে কেন?
________________________________________________
দৈনিক আমাদের সময় ॥ ঢাকা ॥ বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪॥
©somewhere in net ltd.