![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]
বিজেপির বিজয় ও বিশ্বরাজনীতির আগামী
ফকির ইলিয়াস
__________________________________
যা মনে করা হচ্ছিল সেটাই হয়েছে। ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে। আমি আমার একটা লেখায় আগেই বলেছি, বিজেপি ভারতে ক্ষমতায় এলেও তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। ভারতের রাজনীতি অনেকটা আমেরিকার মতো। যে দলই ক্ষমতায় যাক না কেন- প্রায় একই নীতিই অনুসরণ করে। খবর বেরিয়েছে, লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বিপুল বিজয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে চলা নরেন্দ্র মোদিকে বিভিন্ন রাজ্যের নেতারা অভিনন্দন জানালেও এখনো তা করেননি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মোদিও তাকে ফোন করেননি, যদিও রোববার তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার সঙ্গে কথা বলে রাজ্যের উন্নয়নে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে গুজব রটেছে ব্যর্থতার দায় নিয়ে সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী নিজ নিজ দলীয় পদ থেকে সরে দাঁড়াতে পারেন। হয়তো শেষ পর্যন্ত তারা তা করবেন না। কারণ নিজেদের দলকে আরো সংকটে ঠেলে দেয়া হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। নির্বাচনে ভরাডুবির পরে কংগ্রেসে আস্থার সংকটে রয়েছেন দলের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী ও সহসভাপতি রাহুল গান্ধী। লোকসভায় ৫৪৩ আসনের মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র ৪৪টি আসন। গত ৩০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে জয়ী হয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। কংগ্রেসের এই পরাজয়ের পর থেকে ভারতীয় গণমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে সোনিয়া ও রাহুল পদত্যাগ করছেন। দলের সভানেত্রী ৬৭ বছর বয়সী কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী নির্বাচনে আস্থা রেখেছিলেন ছেলে রাহুলের ওপর। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারে তার ছোট বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী যে ভূমিকা রেখেছেন, এতে অনেকে এমনটা ভাবছেন যে প্রিয়াঙ্কা রাহুলের চেয়ে ভালো করতে পারতেন। এটাই ভারতের রাজনীতির সৌন্দর্য। সেখানে দায় নেবার মানসিকতা রাজনীতিকদের গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে যা এখনো হয়নি। পরাজয় মেনে নিয়ে বাংলাদেশের কোনো বড় রাজনীতিকই নীতিনির্ধারণ থেকে সরে দাঁড়াননি।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুভেচ্ছা ফোন করেছেন নরেন্দ্র মোদিকে। লোকসভা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পাওয়া ভারতের ভাবী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টিকে (বিজেপি) টেলিফোনে অভিনন্দন জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে ওই টেলিফোন আলাপের পর বাংলাদেশ নিয়ে বিজেপির অবস্থানে কোনো পরিবর্তন হয়নি। উপরন্তু ভারতের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় বাংলাদেশ ও ভারতের কয়েকটি চুক্তিবিরোধী অবস্থান সুস্পষ্ট করেছে বিজেপি।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় দুই রাষ্ট্রের সরকারের মধ্যে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার বিপরীতে নিজেদের অবস্থান সুস্পষ্ট করেছে বিজেপি। হাসিনা ও তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স সরকারের ব্যর্থতায়ও হতাশ। ভারতের পার্লামেন্টে চুক্তিটি দৃঢ়ভাবে অনুমোদন পাবে, এমন আশা করেছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু, মূলত বিজেপি ও আঞ্চলিক অসম গণপরিষদের বিরোধিতার কারণেই সেটা সম্ভব হয়নি।
আসামের বিজেপি ইউনিটের প্রেসিডেন্ট সর্বনন্দ সোনোওয়াল বলেন, ‘আমি নিশ্চিত বাংলাদেশকে আসামের ভূমি অন্যায্যভাবে দিয়ে দেয়ার চুক্তি কখনই দৃঢ়ভাবে অনুমোদন করবে না বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকার।’ এদিকে নতুন লোকসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের (টিএমসি) ৩৪ জন পার্লামেন্ট সদস্য থাকায়, মোদি সরকারের পক্ষে ভারত-বাংলাদেশ তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তির ব্যাপারেও পুনরায় আলাপ-আলোচনা শুরুটা কঠিন হবে। সবমিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনে জিতে আসা বিজেপি নিজেদের স্বার্থ হাসিলেই ব্যস্ত থাকবে অন্তত আগামী দুবছর। প্রতিবেশীর প্রতি তাদের দৃষ্টি আগের সরকারের মতোই থাকছে। আমরা জানি এখনো বাংলাদেশের নাকের ডগার ওপর ঝুলে আছে টিপাইমুখ বাঁধ। বাঁধটি নির্মাণের মাধ্যমে ভারত তাদের একতরফা স্বার্থই দেখছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ভারত চাইছে, বরাক নদীর পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে টিপাইমুখের এই বাঁধের মাধ্যমে কাছাড় সমতলে সেচ সুযোগ বাড়াবে। কিন্তু এর প্রভাবে বাংলাদেশের কী ক্ষতি হবে তা মোটেই তাদের বিবেচনায় নেই। এই বাঁধের মাধ্যমে ভারত কতো কিউসেক পরিমাণ পানি আটকাবে তাও তারা বলছে না। যদিও তারা বলেছে, এই বাঁধের মাধ্যমে তারা বছরে ছমাস পানি আটকে রাখবে।
আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের বাঁধ নির্মাণে ব্যর্থতার উদাহরণই বেশি। এর একটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের টেটন ড্যাম। এটি ছিল ৯০ মিটার উঁচু। অথচ বাঁধটি মাত্র এক ঘণ্টা পঁচিশ মিনিটে ভেঙে যায়। পেরুর হুয়াক্কাটো বাঁধটি ছিল অনেকটা টিপাইমুখ বাঁধের মতোই ১৭০ মিটার উঁচু। তা ভূমিধসের কারণে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই ভেঙে যায়।
শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতের মনিপুরেও এই বাঁধের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত তৈরি হয়েছে। যদিও ‘নিপকো’র কারিগরি সমীক্ষায় বলা হয়েছে এই বাঁধ প্রজেক্ট ভারতের জন্য ৪০১.২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। যা থেকে মনিপুর সরকার ৪০/৪৫ মেগাওয়াট ফ্রি বিদ্যুৎ পাবে। এই বিদ্যুতের জন্য মনিপুরের ২৯৩ বর্গ কিলোমিটার জায়গা ওয়াটার রিজার্ভের নিচে চলে যাবে। যার মধ্যে থাকবে ৪৭৬০ হেক্টর বাগান, ২০৫৩ হেক্টর ধানি জমি। এ ছাড়া মনিপুরের ৭২৫১ বর্গ কিলোমিটার বনের মধ্যে ১৭৮.২১ বর্গ কিলোমিটার বন চিরতরে হারিয়ে যাবে। এই লাভ-ক্ষতির পরিমাণটি ভারত সরকার জনসমক্ষে প্রকাশ করছে না।
আগেই বলেছি, বিজেপি সরকার, কংগ্রেসের রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজগুলোই করবে। তাই বাংলাদেশের খুব একটা আশাবাদী হবার সুযোগ নেই। এটা তো সত্য, মনমোহন সিং চাইলে অনেক চুক্তিই বাস্তবায়ন করতে পারতেন। তিনি করেননি কেন?
আরেকটি খুনের ঘটনা ঘটেছে সীমান্তে। বেনাপোলের পুটখালী সীমান্তে সিরাজুল ইসলাম (৪০) নামে এক বাংলাদেশীকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ। গেলো রোববার গভীর রাতে পুটখালীর বিপরীতে ভারতের আংরাইল সীমান্তে এ ঘটনা ঘটে। নিহতের স্বজনরা জানান, সিরাজুল ইসলামসহ একদল গরু ব্যবসায়ী রোববার গভীর রাতে ভারত থেকে গরু নিয়ে পুটখালী সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ফিরছিল। এ সময় ভারতের আংরাইল বিএসএফ ক্যাম্পের সদস্যরা তাদের ধাওয়া করলে অন্যরা পালিয়ে গেলেও সিরাজুল ইসলাম ধরা পড়ে বিএসএফের হাতে। তাকে ক্যাম্পে নিয়ে রাইফেলের বাঁট দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে বিএসএফ। এরপর মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে তাকে সীমান্তে ফেলে রাখে। সঙ্গে থাকা কয়েকজন সঙ্গী লাশ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিয়ে আসে।
এই যে অমানবিক ঘটনাবলী ঘটছে, এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। অথচ ভারত বিশ্বে মানবতার অন্যতম প্রবক্তা। ভারতের সামনে এখন প্রধান কাজ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে নিজেদের অর্থনীতি মজবুত করা। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক দুই বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতা নরেন্দ্র মোদি ভারতের নিভু নিভু অর্থনীতিকে পুনরায় চাঙ্গা করতে পারবেন এবং মোহচ্যুত- রাডারবিহীন যুক্তরাষ্ট্র-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নকুন উৎসাহ বা প্রাণাবেগ জোগাতে সক্ষম হবেন।
মার্কিন দুই বিশেষজ্ঞ জেমস সি ক্ল্যাড ও ব্রেন্ট স্কোক্রফট ‘ফরেইন পলিসি’ ম্যাগাজিনে লিখেছেন, মোদি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সেই সম্পর্ক নতুন করে হালে পানি পেতে পারে। এশিয়ায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন ডেপুটি এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব ডিফেন্স ক্ল্যাড লিখেছেন, মোদি যুগ হয়তো যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ককে বাস্তববাদীভাবে নতুন করে ছাঁচে ঢেলে গড়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। তারা লিখেছেন, মোদি তার নির্বাচনী প্রচারণায় বলেছিলেন, চীনের ব্যাপারে সতর্ক থাকার ক্ষেত্রে দিল্লির নিজস্ব কারণ রয়েছে। তারা আরো লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয় দেশই একটি দৃঢ় ও অবশ্যম্ভাবীভাবে একটি আরো সংযত অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে পারে এবং সেটা করা উচিত।
আরেকটি সংবাদ ইতোমধ্যে আলোচনায় এসেছে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নতুন দপ্তর চালু করতে বলেছেন ভারতের হবু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এজন্য স্বরাষ্ট্র সচিব অনীল গোস্বামীকে ‘দ্রুততম সময়ের’ মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি বিশেষ দপ্তর চালু করতে বলেছেন তিনি। তবে বিজেপি’র অন্য নেতারা বলছেন, অবৈধ অভিবাসীদের ঠেকানোর অধিকার রয়েছে ভারতের। যারা এখানে এসে ভারতীয়দের কাজের সুযোগ নিয়ে নিচ্ছে। আজমল কাসাবের মতো সন্ত্রাসীদের দেশে ঢুকতে না দেয়ার অধিকার ভারতের রয়েছে। ওসব নেতারা বলছেন- নরেন্দ্র মোদি মনে করেন, ভারতেরও যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা থাকা দরকার যাতে সন্ত্রাসী তৎপরতা এবং আসামে সংঘটিত অভিবাসীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষের পুনরাবৃত্তি ঠেকানো যায়।
যে যাই বলুক না কেন, মনে রাখতে হবে একটি আগ্রাসন ঠেকাতে আরো বহুমুখী আগ্রাসনের জন্ম যেন না দেয় ভারত। তা করা হলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তি বিনষ্ট হতে পারে। ভারত এই সময়ে বিশ্বরাজনীতির একটি অন্যতম ফ্যাক্টর। ভারতকে বাদ দিয়ে কোনো উন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশ নিজেদের আগামী ভাবতে পারছে না। সেই ভারত যদি কট্টরবাদীদের চারণভূমি হয়- তাহলে প্রকারান্তরে মৌলবাদই আশকারা পাবে। নরেন্দ্র মোদি ও তার দলকে তা ভাবতে হবে। কারণ ভারতের ইতিহাসে গোঁড়ামি তো কম লিখিত হয়নি। বেরিয়ে আসতে হবে সেই বলয় থকে। যা গোটা বিশ্বের মানুষের জন্যই হবে কল্যাণকর। প্রতিবেশীদের জন্য তো বটেই।
-----------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ : ২৪/মে/২০১৪ শনিবার প্রকাশিত
©somewhere in net ltd.