![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]
সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যের আলো
ফকির ইলিয়াস
__________________________________________
আমরা একটি ঐক্য চাই। এই ঐক্য হতে হবে সকল সামাজিক অপশাসনের বিরুদ্ধে। এই ঐক্য হতে হবে সকল শোষণের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ আজ একটা চরম সংকটের মুখোমুখি। গুম, খুন, অপহরণ, নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি এগুলো চলছে হরদম। মানুষ ভীত। অনেকে মুখ খুলছেন না। ভয়ে নিজের প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম শংকিত।
আমরা জানি, প্রতিটি সমাজে সামন্তবাদ সোচ্চারই থাকে। কোথাও প্রকাশ্যে। কোথাও গোপনে। সুযোগ পেলেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। শক্তি পরীক্ষা করে। এ শক্তি পরীক্ষা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রীয় আইনের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এর প্রসার বেশ ব্যাপকই বলা যায়। এ সামাজিক সামন্তবাদের দস্যুতা বাংলাদেশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে কখনো নিরীহ মানুষের ওপর, কখনো নারীর ওপর, কখনো শিশুর ওপর।
একটি ঘটনা মনে পড়ছে। বাংলাদেশের উচ্চ আদালত রায় দিয়েছিল, বোরকা পরতে কোনো মহিলাকে বাধ্য করা যাবে না। নিঃসন্দেহে এ রায়টি ছিল একটি যুগান্তকারী রায়। কারণ কোনো মহিলাকে বোরকা পরিয়ে এক ধরনের মানসিক শাস্তি দেয়ার মতো মধ্যযুগীয় কাল এ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি যাপন করছে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, বোরকা ইস্যুটি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ালো কেন? তাহলে কী হচ্ছে বাংলাদেশে। ধর্মীয় তমদ্দুনের নামে বাংলাদেশে একটি মহল যত্রতত্র তাদের রাজনৈতিক মতবাদ প্রকাশে ব্যস্ত রয়েছে, তা কারো অজানা নয়। ফতোয়ার নামে দোররা মেরে বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা নতুন নয়। ছাতকছড়া গ্রামের নূরজাহান সেই কালের সাক্ষী হয়ে আছেন। এই যে ফতোয়াবাজরা তারাই ক্রমে দেশে উঠতি জঙ্গিবাদীদের ম“ দিয়েছে। তারা হরণ করেছে চিন্তার স্বাধীনতা, সৃজনশীল মত প্রকাশের স্বাধীনতা। সামাজিক বিবর্তনের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে সমাজের কাঠামো বিনির্মাণ। বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি ক্ষমতাসীন সরকারই প্রকারান্তরে মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে সখ্য বজায় রেখে ক্ষমতা স্থায়ীর স্বপ্ন দেখেছে। আর সে আস্কারা পেয়ে এসব সামন্তবাদী দস্যু সমাজের বিভিন্ন প্রাঙ্গণে তার দাঁত বসিয়েছে বারবার।
সামন্তবাদের চেহারার তীব্রতা আছে ‘সমাজের আধুনিক উচ্চ শ্রেণী’ বলে কথিত মানুষের মাঝেও। গৃহকর্তা কিংবা গৃহকর্তী কর্তৃক ‘কাজের মেয়ে’ খুনের ঘটনা বাংলাদেশে অহরহই ঘটছে। কাজের ছেলেরা এ ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে কম। ‘কাজের মেয়ে’রাই বেশি শিকার হচ্ছে। আর এসব নির্যাতনকারী উচ্চ শ্রেণীর মানুষরা আইনের ফাঁকফোকর গলে বেরিয়েও যাচ্ছে। কখনো তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এই যে পরাজয়, এই যে ব্যর্থতা গোটা সমাজের, গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থার। কারণ সমাজ তাদের রুখতে পারছে না।
বাংলাদেশে আরেকটি ব্যাধি সমাজকে ধ্বংস করতে প্রকট রূপ ধারণ করেছে। তা হচ্ছে বখাটেদের উৎপাত। ইভটিজিংকারীরা সব ধরনের লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে কলুষিত করছে জনজীবন। তাদের সংঘবদ্ধ উৎপাত নাকি কখনো কখনো পুলিশের মুখোমুখিও দাঁড়ায়। অপরাধী ধরতে গিয়ে পুলিশ হামলার শিকার হয়েছে, এখনো হচ্ছে। ভয়ে শঙ্কিত হওয়ার কথা, সমাজের স্খলন কি এভাবেই প্রজন্মকে আত্মঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে?
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিশ্ব শিশু দিবস, বিশ্ব নারী দিবস, বিশ্ব শ্রম দিবস ইত্যাদি অনেক দিবসই ঘটা করে পালন করা হয়। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী যে ইতিবাচক প্রভাব তা খুব কমই সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রতিফলিত হয়। না হওয়ার কারণ হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় আইনের বাধ্যবাধকতা প্রকৃত অপরাধী চক্রকে কঠিন শাস্তি দেয়ার বিধান নিশ্চিত করতে পারেনি। এই না পারার গ্লানি বাঙালি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবাহিত হয়েই চলেছে। সামাজিক দস্যুতা যে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে নেই, তা আমি বলছি না। দস্যুরা এখানেও মাঝে মধ্যে তাদের নখর দেখায়। কিন্তু ধরা পড়ে এবং তাদের কঠিন বিচারের মাধ্যমে সমুচিত শাস্তিও হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭২ সালে প্যাট্রিক লেমন নামের এক ব্যক্তি এরিজোনা অঙ্গরাজ্যে ধর্ষণ করেছিল। ২০১০ সালের মার্চ মাসে ডিএনএ টেস্ট দিতে গিয়ে ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে সে ধরা পড়েছে। দীর্ঘ ৩৮ বছর পর অপরাধী ঠিকই আটকা পড়ে আইনের হাতে। এই যে আইনের শক্ত হাত, একমাত্র তাই রাষ্ট্রের মানুষকে রক্ষাকবচ হয়ে সাহায্য করতে পারে।
সামাজিক সামন্তবাদ রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয় পেলে বীভৎস রূপ ধারণ করতে পারে যে কোনো মুহূর্তে। অতিসম্প্রতি সিলেটে ওসমানী মেডিকেল কলেজে একজন ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে। ছাত্রদল নেতা তৌহিদুল ইসলাম হত্যা মামলায় কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি সৌমেন দে কে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের আবু সিনা ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে কলেজ ছাত্রদলের আপ্যায়ন সম্পাদক তৌহিদুল ইসলামকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
দেশে ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের কতিপয় কর্মী যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে সে বিষয়ে কারো সন্দেহ নেই। তারা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির নামে মূলত বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নকেই যে কলুষিত করছে, তা প্রধানমন্ত্রী নিজেও খুব ভালো করে জানেন। তারপরও তারা এভাবে ছড়ি ঘুরানোর সাহস কেন পাচ্ছে? কোথা থেকে পাচ্ছে?
মনে রাখা দরকার যারা জঙ্গিবাদের নামে মাস্তানি করছে, আর যারা রাজনৈতিক পরিচয়ে সামাজিক সন্ত্রাস করছে, তাদের উভয়ের গন্তব্য কিন্তু একই। সমাজের শান্তি বিনষ্ট করা। একটি পক্ষ সরকারি ম“ পেলে অন্যপক্ষ যেনতেনভাবে সমাজের দখল নেয়ার জন্য মরিয়া হবেই। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ ছিল খালেদা-নিজামী’র চারদলীয় জোট সরকার। হাওয়া ভবন-নির্ভর বিএনপির শীর্ষ নেতানেত্রীরা চরম দুর্নীতি করেছিল বলেই জঙ্গিবাদী শক্তিটি সমান্তরালভাবে বেড়ে উঠতে পেরেছিল। তাই হুমকি-ধমকি না দিয়ে প্রকৃত অর্থেই মহাজোট সরকারের মধুলোভী ভ্রমরদের শায়েস্তা করা না গেলে বর্তমান সরকারের পালক খসে পড়তে বেশি দেরি নাও হতে পারে।
বাংলাদেশে সামন্তবাদী দস্যুতা ভিন্ন আঙ্গিকে আবির্ভূত হচ্ছে। আইটি ক্রাইম বাংলাদেশে খুব জঘন্যভাবে সংক্রমিত হচ্ছে। গোপন ওয়েবক্যাম স্থাপন করে অবৈধভাবে কারও ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করার অনেক ঘটনা পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। এতে অনেকের সংসার ভাঙছে। কেউ কেউ আত্মাহুতিও দিচ্ছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশে কঠোর আইন এখনো জারি করা হচ্ছে না। একটি জাতি যখন ডিজিটাল হওয়ার স্বপ্ন দেখে তখন তা হতে হয় চতুর্দিক থেকেই। নতুন ধরনের অপরাধ প্রবণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন ধরনের আইন প্রয়োগও জরুরি হয়ে পড়ে।
মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে আজ পর্যন্ত দ্বিগুণ হয়েছে বাংলাদেশের জনসংখ্যা। ভূমি বাড়েনি। বরং বাসস্থানের অন্বেষণ হরণ করছে ক্ষেতের জমি। তাই জনবহুল এ রাষ্ট্রে অভাব-অভিযোগ বাড়ছে। হয়তো আরও বাড়বে। তাই যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা, মননশীল সমাজ গঠন এবং আইনসিদ্ধ সামাজিক অবকাঠামো বিনির্মাণ ছাড়া এ সংকট থেকে মুক্তি সম্ভব নয়। এ সত্যটি বিশেষ করে দেশপ্রেমিক রাজনীতিকদের অনুধাবন করতে হবে।
খুবই বেদনার কথা যারা ইভটিজিং করে, যারা ফতোয়াবাজি করে তাদের বিরুদ্ধে পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় তীব্র প্রতিরোধ এখনো গড়ে উঠছে না। সমাজ সচেতন প্রতিটি মানুষের উচিত এসব দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধে কথা বলা। ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলা। সামন্তবাদের প্রথা যে বদলেছে তা অনুধাবন করতে হবে প্রজন্মকে। সে প্রথা এখন আর নেই। জমিদাররা শোষণ করেছে একভাবে আর এখন সমাজের তথাকথিত প্রতিপত্তিবানরা শোষণ করতে চাইছে অন্যভাবে। এ শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েই এ বাঙালি জাতি বারবার রক্ত দিয়েছে। মহান মুক্তিসংগ্রাম করেছে। কিন্তু আজ ঘুণাক্রান্ত হওয়ার কারণেই সামাজিক পতন রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু এ অচলায়তন ভাঙতেই হবে সম্মিলিত প্রয়াসে।
আমাদেরকে আলোর পথ খুঁজতে হবে। বিশ্ব সভ্যতার দিকে এগোচ্ছে। আদিমতার দিকে নয়। কথাটি খুব জরুরিভাবে এই প্রজন্মকে ভাবতে হবে। মনে রাখা দরকার সাময়িক হালুয়া-রুটির লোভে কেউ যদি সমাজকে বিনষ্ট করে, এর প্রভাব পড়বে উত্তর প্রজন্মের উপর।
----------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ॥ ঢাকা ॥ : ১৫/জুন/২০১৪ রোববার
©somewhere in net ltd.