নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আলোর আয়না এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্য নয়।লেখা অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]

ফকির ইলিয়াস

এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]

ফকির ইলিয়াস › বিস্তারিত পোস্টঃ

কর্নেল তাহেরের স্বপ্নের শোষণমুক্ত বাংলাদেশ ও বাস্তবতা

১৯ শে জুলাই, ২০১৪ সকাল ৭:৪৮







কর্নেল তাহেরের স্বপ্নের শোষণমুক্ত বাংলাদেশ ও বাস্তবতা

ফকির ইলিয়াস

______________________________________________



২১ জুলাই কর্নেল আবু তাহেরের শাহাদতবার্ষিকী। কর্নেল আবু তাহের শুধু একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক। তিনি শোষণমুক্ত বাংলাদেশ চেয়েছিলেন। তাঁকে নির্মমভাবে, প্রহসনের বিচারে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। তা কার্যকর করা হয়েছিল ২১ জুলাই ১৯৭৬ ভোররাতে।

তিনি যে শেষ চিঠিটি লিখেছিলেন- তার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরতে চাই। তিনি লিখেছিলেন-

‘আমাকে কেউ হত্যা করতে পারে না। আমি আমার সমগ্র জাতির মধ্যে প্রকাশিত। আমাকে হত্যা করতে হলে সমগ্র জাতিকে হত্যা করতে হবে। কোনো শক্তি তা করতে পারে? কেউ পারবে না।

আজকের পত্রিকা এলো। আমার মৃত্যুদ- ও অন্যদের বিভিন্ন শাস্তির খবর ছাপা হয়েছে প্রথম পাতায়। মামলার যা বিবরণ প্রকাশ করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা। রাজসাক্ষীদের জবানবন্দিতে প্রকাশ পেয়েছে আমার নেতৃত্বে ৭ নভেম্বর সিপাহী বিপ্লব ঘটে, আমার নির্দেশে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হয়। আমার দ্বারা বর্তমান সরকার গঠন হয়। সমগ্র মামলায় কাদেরিয়া বাহিনীর কোনো উল্লেখই ছিল না। এডভোকেট আতাউর রহমান, জুলমত আলী ও অন্যরা যারা উপস্থিত ছিলেন, তারা যেন এই মিথ্যা প্রচারের প্রতিবাদ করেন ও সমগ্র মামলাটি প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। আমি মৃত্যুর জন্য ভয় পাই না। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক ও চক্রান্তকারী জিয়া আমাকে জনগণের সামনে হেয় করার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। আতাউর রহমান ও অন্যদের বলবো, সত্য প্রকাশ তাদের নৈতিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে তারা যদি ব্যর্থ হন, তবে ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না। তোমরা আমার অনেক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, আদর নিও।’

তাহের বীরের মতোই কথাগুলো লিখে গিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন তাঁর হত্যাকারী কে। কর্নেল আবু তাহের বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত সমাজ চেয়েছিলেন। আমাদের জানা আছে, দেশে দেশে মুক্তিকামী সকল ব্যক্তিত্বের সমস্ত শুভ কর্মের বিরোধিতা করে শোষক শ্রেণী। নির্যাতিত হতে হয়, প্রাণ দিতে হয় শোষক শ্রেণীর হাতে এ সকল স্বপ্নতাড়িত মানুষদের। আর বিচারের নাম করে চূড়ান্ত অবিচার, জবরদস্তির মাধ্যমে বিচারকে গ্রাস করা ইতিহাসে কম নেই। তাহেরের বিচারে বিচার ছিল না, সেটি ছিল প্রহসনের বিচার। ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাইয়ের গোপন সামরিক ট্রাইব্যুনালের প্রহসনমূলক বিচারের রায়ে ২১ জুলাইয়ে ফাঁসির দড়িতে জীবন দিতে হয়েছিল তাঁকে। ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বরে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনা কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনীসমূহের সিপাহি ও প্রগতিশীল গণতন্ত্রমনা অফিসারবৃন্দ রাজপথে জনতার কাতারে শামিল হয়ে সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান সংগঠিত করেছিলেন। অভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। সে লক্ষ্য বাস্তবায়িত হতে পারেনি। কারণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা অভ্যুত্থানী সিপাহি জনতার পক্ষ ত্যাগ করে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দেশীয় অনুচরদের পক্ষাবলম্বন করেছিল। এরপরে এরাই মৌলবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশে একাত্তর-পূর্ববর্তী একটি কালো শক্তিকে বলিয়ান করার চেষ্টা করেছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী হায়েনাদের হাতে মন্ত্রিত্ব তুলে দিয়েছিল। তাহের হত্যাকা-কে ধামাচাপা দেয়ার জন্য অনেক কিছুই সেদিন করেছিল সামরিকজান্তারা। তৎকালীন হংকং থেকে প্রকাশিত ‘ফার ইস্টার্ন ইকোনোমিক রিভিউ’ পত্রিকার দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ-কে তাহেরের গোপন বিচার প্রকাশ করার দায়ে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। কিন্তু সত্য গোপন থাকেনি। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বিচারিক রায় প্রকাশই হয়েছিল।

বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মোঃ জাকির হোসেনের আদালতে ২০১১ সালের ২২ মার্চ দেয়া কর্নেল তাহের হত্যাকাণ্ডের রায়ের পূর্ণাঙ্গরূপ ২০ মে ২০১৩ সোমবার প্রকাশিত হয়েছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরের মৃত্যুর ৩৪ বছর পর সামরিক ওই বিচারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১০ সালের ২৩ অগাস্ট হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহের, ভাই আনোয়ার হোসেন, আরেক ভাইয়ের স্ত্রী ফাতেমা ইউসুফ। প্রকাশিত রায় থেকে এই জাতি জেনেছে, কর্নেল আবু তাহেরকে হত্যার পরিকল্পনা করেই সামরিক আদালতে তার বিচার সাজিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দেশের রাজনীতির ওই যুগসন্ধিক্ষণে গোপন আদালতে ওই বিচারকে অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের অভিমতে এ কথা বলা হয়েছে। মাননীয় আদালত বলেছেন, তৎকালীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনায় মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার তাহেরকে বিচারের নামে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছিল। আদালত রায়ে বলেছেন, জিয়া জীবিত না থাকায় তার বিচার সম্ভবপর না হলেও সরকারের উচিত হবে এই হত্যার জন্য দায়ী কেউ জীবিত থাকলে তাকে খুঁজে বের করে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা। আদালত আরো বলেছেন, কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদ- এই কারণে হত্যাকা- যে, ট্রাইব্যুনাল গঠনের অনেক আগেই জেনারেল জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদ- প্রদানের মনস্থির করেন। এই মামলায় অন্যতম প্রমাণ হিসেবে খ্যাতিমান সাংবাদিক লরেন্স লিফশুজের বক্তব্য এবং বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদের লেখা বিবেচনায় আনা হয়েছে।

ব্যারিস্টার মওদুদের ‘ডেমোক্রেসি অ্যান্ড চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট : এ স্টাডি অব পলিটিক্যাল অ্যান্ড মিলিটারি ইন্টারভেনশন ইন বাংলাদেশ’ বইয়ের উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়েছে, বইয়ে লেখক মওদুদ আহমদ অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যক্ত করেছেন যে, এই বিচারের ট্রাইব্যুনাল গঠনের অনেক আগেই জেনারেল জিয়াউর রহমান পাকিস্তান ফেরত সামরিক অফিসারদের তুষ্ট করার জন্য কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেয়ার মনস্থির করেছিলেন। আমরা জানি, ইতিহাসের গতি কোনোভাবেই মিথ্যা দিয়ে চাপিয়ে রাখা যায় না। সত্য প্রকাশিত হয়। হতেই হয়। তা না হলে মনুষ্য জাতি নির্ভীক চিত্ত নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে না। পরবর্তী প্রজন্ম সৎ সাহস নিয়ে দাঁড়াতে পারে না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যে জিয়াউর রহমানকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করেছিলেন কর্নেল তাহের, সে তাহেরকে তথাকথিত গোপন বিচার, সামরিক কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে ফাঁসি দেয়া হয় এবং রায় প্রদানের পর চরম বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিয়ে মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে রায় কার্যকর করা হয়।

পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে, ১৫ আগস্টের নির্মমতম হত্যাকা-ের পর সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘সো হোয়াট, ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার’। সে সময়ে বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ঘাতক চক্র জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা ক্ষমতার পালাবদলে ডানপন্থী মৌলবাদী শক্তিকে সার্বিক পুনর্বাসনে ছিল সর্বাত্মকভাবে তৎপর।

জিয়াউর রহমান প্রথমে যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন, যদি তা পালিত হতো তবে সৈয়দ নজরুল ইসলামই ক্ষমতাসীন হতেন। বিদ্রোহী সেনাসদস্যদের তাৎক্ষণিক বন্দী করা সম্ভব হতো। ওদের বিচার হতো। কিন্তু দেখা গেলো খুব দ্রুতই তার মতামত থেকে সরে আসেন জিয়াউর রহমান। তিনি হাত মেলান খুনি ডালিম-রশীদ-হুদা চক্রের সঙ্গে। যদিও ডালিম-ফারুক চক্র পরে টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছে, তারা জিয়াকে আগেই ১৫ আগস্টের ক্যুর কথা জানিয়ে রেখেছিল। ষড়যন্ত্রকারী মীরজাফর খন্দকার মোশতাকের শাসন সেজন্যই ছিল খুব ক্ষণস্থায়ী। প্রকৃত কুশীলবরা বেরিয়ে এসেছিল হ্যাঁ-না ভোটের মাধ্যমে। খুনিদের বিদেশে পাঠানোর নিশ্চয়তা প্রদান করে রাষ্ট্রক্ষমতা পাকাপোক্ত করার সব ব্যবস্থাই করতে তৎপর ছিলেন জিয়াউর রহমান।

কর্নেল আবু তাহের মূলত ভয়ের কারণ ছিলেন সেই ক্ষমতালিপ্সুদের। তারা জানতো তাহের বেঁচে থাকলে তাদের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে। তারা ক্ষমতায় টিকে নাও থাকতে পারে। সে কারণেই প্রহসনের বিচারের আয়োজন করে তাহেরসহ অন্যান্য দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকদের হত্যা করেছিল স্বৈরশাসক জিয়া সরকার। তাহেরের সঙ্গে জিয়ার বৈরিতার প্রধান কারণ ছিল তাহের মৌলবাদী রাজাকার শক্তির সঙ্গে কোনো আঁতাত মেনে নিতে চাননি। আর জিয়া সেই আঁতাতই করতে চেয়েছিলেন। যার কুফল আজো ভোগ করছে গোটা জাতি। গোটা বাংলাদেশের মানুষ। কর্নেল তাহের হত্যাকা- কেন বেআইনি ঘোষণা হবে না- তা দাবি করাটা ঐতিহাসিক এবং নৈতিক দায়িত্বও ছিল বটে। তাহের এ বাংলাদেশের গণমানুষের স্বপ্ন পূরণে ছিলেন অগ্রণী সৈনিক। যুদ্ধাহত হওয়ার পরও তার উদ্যম ও স্পৃহার কোনো কমতি ছিল না। বাংলাদেশে মৌলবাদী শক্তির দাপট বাড়াবার মূল কারণ হচ্ছে, ক্ষমতায় যাওয়া ও টিকে থাকা। আমরা মিডিয়ায় দেখছি, বিলাতে তারেক রহমান আবার সক্রিয় হয়ে অনেক আবোল-তাবোল কথা বলা শুরু করেছেন। এটা গোটা দেশবাসীই জানেন, মতলব তাদের অন্যখানে। তারা চায় ঘোলাজলে মাছ শিকার করে পুরো জাতির একাত্তরের বিজয় ইতিহাসটাকেই পাল্টে দিতে। একাত্তরে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে। আমরা দেখেছি, যেসব রাজাকার-আলবদর ঘাপটি মেরে বসেছিল, তারা প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসে পঁচাত্তরের নির্মম হত্যাকা-ের পর। কালো চশমা পরা সেই জেনারেল কি তার জীবদ্দশায় কখনো বলেছিলেন, তিনি স্বাধীনতার ঘোষক? না, বলেননি। একজন মহানায়কের পক্ষে একজন সৈনিক সে ঘোষণা পাঠ করেছিলেন মাত্র। তিনিই তাই ঘোষক হয়ে গেলেন? অন্যের চিঠি কেউ পাঠ করে শোনালে, সে কি চিঠির লেখক হয়ে যায়? না, হয় না।

জে. জিয়া সেই স্বৈরশাসক যিনি ক্ষমতায় যাবার জন্য চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে তারই একজন ত্রাণকর্তা কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলান। শত শত সেনা অফিসারকে হত্যা করেন, গোপনে- বিনা বিচারে। সেসব কথা বাংলার মানুষ ভুলে যাননি। যাবেনও না কোনোদিন। এই সেই জিয়া, যিনি বলেছিলেন- প্রেসিডেন্ট ইজ ডেড, সো হোয়াট? ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার! তার আসল চরিত্র ক্রমশ প্রকাশ হতে থাকে। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ ঘটানো হয় নির্মমতম জেল হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য ছিল, এরা যদি জেল থেকে বেরিয়ে রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করে তোলেন!

জেনারেল সফিউল্লাহ যা পারেননি, সেই পাল্টা অভ্যুত্থানে এগিয়ে আসেন সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ। তিনি বুঝতে পারেন, জিয়াই সেই নেপথ্যের নায়ক, যে ঘোলাজলে মাছ শিকার করে সুবিধা নিতে চাইছে। তিনি যে অভ্যুত্থানটি ঘটিয়েছিলেন, তা স্থায়িত্ব পেলে দেশ আবার জাতির জনকের চেতনায়ই ফিরে যেতো। মাত্র ছ’দিনের মাঝে ঘটে যায় অনেক ঘটনা। খালেদ মোশাররফ ও অন্যান্য দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসাররা ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদেই করেছিলেন এই পাল্টা অভ্যুত্থান।

এখানে যে বিষয়টি আরো প্রাসঙ্গিক, তা হচ্ছে- এ সময়ে দেশের সমাজতন্ত্রপন্থীরা মনে করেন দেশটি তার মূলধারা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদÑ এ পরিচালিত হোক। এই চেতনা নিয়ে এগিয়ে আসেন কর্নেল তাহের। তিনি খালেদ মোশাররফ গ্রুপের হাতে বন্দী জিয়াউর রহমান ও তার অনুসারীদেরকে মুক্ত করে আনেন। এই ঘটনাটিই ঘটে ৭ নভেম্বর। প্রতিবিপ্লবী খুনি চক্রের নেতা জিয়া মুক্ত হয়েই পাল্টা অভ্যুত্থানের জোর তৎপরতা চালান। শুরু হয় সকল দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা হত্যা। কতোজন সৈনিক হত্যা করা হয়েছিল সেদিন? সে সময়ে? সেই খুনের ষড়যন্ত্র থেকে রেহাই পাননি স্বয়ং কর্নেল তাহেরও। তাঁকেও ফাঁসি দেয়া হয় প্রহসনের বিচারের নামে। কি ছিল তার অপরাধ? তিনি জিয়াকে মুক্ত করার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন?

জিয়া জানতেন, তাহের বেঁচে থাকলে তার সামরিকীকরণ প্রকল্প ব্যাহত হতে পারে। ৭ নভেম্বর যদি খালেদ মোশাররফরা জয়ী হতেন, তাহলে আজ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট অন্যরকম হতো। ডানপন্থী মদতপুষ্ট জাতীয়তাবাদী আর রাজাকার চক্ররা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঘাপটি মেরে বেড়ে উঠতে পারতো না।

এই দেশে এভাবে বৃদ্ধি পেতো না জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিস্তার। রাজাকার শাহ আজিজ, মশিউর রহমান যাদু মিয়া, আব্দুল আলীম, খান এ সবুরের মতো কুখ্যাত রাজাকারদেরকে কেবিনেটে টেনেছিলেন, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। আর তার জায়া খালেদা জিয়া নিজামী-মুজাহিদ নামের দুই কুখ্যাত রাজাকারকে মন্ত্রী বানিয়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী সাধনায় সিদ্ধি লাভে ব্রত হন!

যারা জাতির জনক শেখ মুজিবের নাম মুছে দেয়ার চেষ্টা করছে, তারা নতুন নয়। এরা সেই পরাজিত শক্তি। এরা সেই দানব- যারা আজো লাখো শহীদের রক্তকে, লাখো মা-বোনের সম্ভ্রমকে তুচ্ছ-তাচ্ছল্য করে। জিয়া স্বাধীনতার ঘোষকÑ এর চাইতে নির্লজ্জ মিথ্যাচার বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কিছুই নেই। জিয়া একজন সেক্টর কমান্ডার। এটাই তার শুরুর পরিচয়। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।

দেশে এখনো মৌলবাদী শক্তি সক্রিয়। তারা যা করছে- তা এই জাতির জন্য, এই ধর্মীয় চেতনাবোধ সম্পন্ন মানুষদের জন্য কল্যাণকর কিনা তা ভাবতে হবে।

তাহের এ দেশের মানুষের জন্য কী ভাবতেন- তা তাঁর রচনাবলী থেকেই জানা যায়। তিনি তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন- “আমি একটি সোনার বাংলার চিত্র দেখেছি। চিত্র দেখার শুরু ১৯৬৮ সাল থেকে। এই চিত্র কল্পনায় কেটেছে বহু বিনিদ্র রাত্রি। এই চিত্র আমাকে রোমাঞ্চিত করেছে, উত্তেজিত করেছে। এই কল্পনায় বারবার মনে হয়েছে জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আমি এক অসীম শক্তির অধিকারী। সমস্ত জীর্ণতাকে ভেঙে ফেলে এই চিত্রকে রূপ দিতে সক্ষম। এ চিত্র আমাকে সাহস জুগিয়েছে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে আমি জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়েছি। বাংলার মানুষের নিবিড় সংস্পর্শে এসে আমি দেখেছি তাদের উদ্যম, কষ্ট সহিষ্ণুতা, শৃঙ্খলা ও দেশপ্রেম। আমি জেনেছি বাংলার এই অশিক্ষিত, প্রতারিত জনগণই হচ্ছে প্রকৃত প্রগতিশীল। তারাই বাংলার সুপ্ত শক্তি। বাংলার এই জনগণকে আমি আমার চিত্র কল্পনায় অংশীদার করতে চাই। আমি চাই তারা গভীরভাবে এই চিত্র উপলব্ধি করুক। বোমাঞ্চিত হোক, উত্তেজিত হোক। তাদের শক্তির পূর্ণ প্রকাশের মাধ্যমে ইতিহাসের জাদুঘরে বন্দী ধনে ধান্যে পুষ্পেভরা সোনার বাংলাকে মুক্ত করুক।

আমার সোনার বাংলা অনাহার, অশিক্ষা, শোষণ, রোগ, যন্ত্রণায় ভরা বিশৃঙ্খল গ্রাম সমষ্টি নয়। এতে নেই শহরের উলঙ্গ জৌলুষ, পুঁতিগন্ধময় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, মনের সংকীর্ণতা। আমার সোনার বাংলা প্রকৃতির স্বাভাবিক স্বচ্ছতায় সমৃদ্ধ একটি সম্পূর্ণ প্রকাশ। এই বাংলার চিত্র সম্পূর্ণরূপে নদীভিত্তিক। নদীর সতেজ প্রবাহ আজ স্তিমিত। আমার সোনার বাংলায় নদী সতেজ, প্রাণবান। এর দুপাশে বিস্তীর্ণ উঁচু বাঁধ। বাঁধের ওপর দিয়ে চলে গেছে মসৃণ সোজা সড়ক, রেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ লাইন। বাঁধের উভয় পাশের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত গ্রামগুলো উঠে এসেছে বাঁধের ওপর। গড়ে ওঠা এই জনপদ মানব সভ্যতার একটি অপূর্ব সৃষ্টি।” [‘সোনার বাংলা গড়তে হলে’- নিবন্ধের অংশ]

এ দেশে কর্নেল তাহের নতি স্বীকার করেননি। তাঁর শঙ্কাহীন চিত্ত এ দেশের কোটি প্রজন্মের প্রেরণা হয়ে আছে। তাই কেউ তাহেরের আদর্শ নিয়ে মিথ্যা লিখলে, কিংবা মিথ্যা গলাবাজি করে বক্তৃতা-বিবৃতি দিলে তা এই প্রজন্ম মেনে নেবে না। তাহের আছেন, তাহের থাকবেন, বাংলার কোটি কোটি মানুষের প্রাণে প্রাণে।

----------------------------------------------------

দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ : ১৯/ জুলাই /২০১৪ শনিবার

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.