![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]
আমাদের বিশ্বাসগুলো যেভাবে জিম্মি হচ্ছে
ফকির ইলিয়াস
=====================================
একটি জরিপ আমাদের আবার আশান্বিত করেছে। বাংলাদেশে গত নভেম্বর থেকে তিন মাসে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থাশীল মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, এমনটাই উঠে এসেছে নিয়েলসন-বাংলাদেশের এক জরিপে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) জন্য এই জরিপ করে দিয়েছে নিয়েলসন-বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টির নেতা জন ম্যাককেইনের নেতৃত্বে পরিচালিত আইআরআইকে ডানপন্থিদের একটি হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেন অনেকে।
গত ৪ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে চালানো এই জরিপে দেশের আটটি বিভাগের সব জেলার শহর ও গ্রামাঞ্চলের দুই হাজার ৫৫০ জনের মতামত নেয়া হয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীরা সবাই ১৮ বছর ও তার বেশি বয়সের। জরিপে দেখা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫৭ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থা জানিয়েছেন। একই প্রতিষ্ঠানের গত বছর ৩০ অক্টোবর থেকে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে চালানো জরিপে ক্ষমতাসীন দলকে আস্থায় রেখেছিলেন ৪৮ শতাংশ। এবার ২৫ শতাংশ বিএনপির প্রতি আস্থার কথা জানিয়েছেন, যেখানে আগের জরিপে তাদের পক্ষে রায় ছিল ২৪ শতাংশের।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৭৩ শতাংশের মতে, বাংলাদেশ সঠিক পথেই এগোচ্ছে। এই হার গত নভেম্বরের তুলনায় ৯ শতাংশ এবং বিগত দুই বছরের তুলনায় ৩৮ শতাংশ বেশি। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৮৩ শতাংশ বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে ‘খুবই ভালো’ বা ‘কোনো রকম ভালো’ বলেছেন। আর ৭৭ শতাংশ বলেছেন, দেশ রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল বলে তারা মনে করছেন।
দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী বেশিরভাগ মানুষ। ৭২ শতাংশ বিশ্বাস করেন, আগামী বছর তাদের ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে। আর দেশ রাজনৈতিকভাবে আরো স্থিতিশীল হচ্ছে বলে মনে করছেন ৬৫ শতাংশ। অর্থনীতি ও নিরাপত্তাকে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা মনে করছেন অধিকাংশ। গত নভেম্বরের তুলনায় এই জরিপে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন মানুষের হার ৮ শতাংশ বেড়ে ২১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সমান সংখ্যক ব্যক্তি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে অর্থনীতির কথা বলেছেন।
সমস্যা হিসেবে দুর্নীতিকে চিহ্নিত করেছেন ৯ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ৪৫ শতাংশ ঘুষ দেয়ার কথা বলেছেন চাকরি পেতে। এরপরে পুলিশকে ঘুষ দেয়ার কথা বলেছে ১১ শতাংশ। এবারই প্রথম সংস্থাটি জরিপে বাংলাদেশে চরমপন্থা নিয়ে মতামত নিয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৫৩ শতাংশ বাংলাদেশে রাজনৈতিক চরমপন্থাকে বড় সমস্যা বলেছেন। অন্যদিকে ৪৪ শতাংশের মতে, ধর্মীয় চরমপন্থা খুব বড় সমস্যা। একটি বিষয় আমরা দেখছি, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তাহলে এত হানাহানি ঘটছে কেন বাংলাদেশে। কেন মানুষের বিশ্বাস নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে রাজনীতির প্রতি?
বিশ্বে আরেকটি সংবাদ আলোড়ন তুলেছে। তা হলো ‘পানামা পেপারস’। মোসাক ফনসেকা নামে পানামার একটি আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ফাঁস হওয়া ১ কোটি ১৫ লাখ গোপন নথি বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছে। ফাঁস হওয়া এসব নথিতে বিশ্বের শতাধিক ক্ষমতাধর মানুষ বা তাদের নিকটাত্মীয়দের বিদেশে টাকা পাচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তালিকায় দেখা গেছে, চীন, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরবের মতো ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান বা তাদের আত্মীয় এসব অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। শুধু রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানরাই নন, বিশ্বখ্যাত ফুটবলার লিওনেল মেসি থেকে ভারতীয় চিত্রনায়িকা ঐশ্বরিয়া রাই। তালিকায় আছে অনেকেরই নাম। আছেন অমিতাভ বচ্চনও। মেক্সিকোর মাদকসম্রাট বা সন্ত্রাসী সংগঠন হিজবুল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগের কারণে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কালো তালিকায় থাকা ব্যবসায়ীরাও বাদ যাননি এ তালিকা থেকে।
এখন পর্যন্ত প্রকাশিত নথিতে বাংলাদেশের কারো নাম নেই। তবে আগামী মে মাসে সম্পূর্ণ নথি প্রকাশ করা হলে বাংলাদেশের কারো নাম আছে কি না, জানা যাবে। এর আগে আইসিআইজে ২০১৩ সালে অর্থ পাচারের একই ধরনের তালিকা প্রকাশ করেছিল। সেখানে বাংলাদেশের ৩৪ জনের নাম ছিল। তাদের মধ্যে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীরাও ছিলেন।
দুর্নীতিতে যাদের নাম এসেছে তাদের মাঝে আছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরোশেঙ্কো, আলা মুবারক (মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের ছেলে), ইরাকের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আলাওয়ি, সৌদি বাদশাহ সালমান, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট ও আবুধাবির আমির শেখ খলিফা বিন জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান, আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিগমুন্ড গুনলাগসন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সার্গেই রলডুগিন, কাতারের সাবেক আমির শেখ হামদ বিন খলিফা আল থানি, চীনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লি পেংয়ের কন্যা লি জিয়াওলিন, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের জ্ঞাতি ভাই রামি ও হাফিজ মাখলুফ, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমার ভাইপো ক্লিভ খুলুবুস জুমা, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের তিন সন্তান মারিয়াম সফদর, হাসান নওয়াজ ও হুসাইন নওয়াজ। একটি বিষয় আমরা দেখলাম, অর্থ চুরিতে সমাজতন্ত্রী, কালো-সাদা, বাদশাহ, গণতন্ত্রী সবাই এক কাতারে। ধনী কিংবা গরিব দেশের রাষ্ট্রনায়করা একই কাজটি করেছেন! বিশ্ব এভাবেই এগোচ্ছে এক চরম অবিশ্বাসের দিকে।
এই ঘটনার পরপরই তোলপাড় শুরু হয়েছে বিশ্বে। পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর পদত্যাগ করেছেন আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিগমুন্ড গুনলাগসন। পানামার একটি ল’ ফার্মের গোপন নথি ফাঁসের পর এই প্রথম কোনো মন্ত্রীর পদত্যাগের ঘটনা ঘটল। কৃষিমন্ত্রী এখন নতুন প্রধানমন্ত্রী হবেন। কয়েকটি প্রতিবেদনে এ কথা জানা গেছে বলে জানিয়েছে বিবিসি। বিশ্বের ধনী আর ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা কোন কৌশলে কর ফাঁকি দিয়ে কিভাবে গোপন সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তা বেরিয়ে এসেছে ফাঁস হওয়া নথিতে। এতে করে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন ওইসব ব্যক্তি। নথি অনুযায়ী, আইসল্যান্ডের গুনলাগসন একটি বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে দেশের ব্যাংকগুলোতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছেন, যা তিনি গোপন করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ অভিযোগের মুখে তিনি প্রেসিডেন্টকে পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার আহ্বান জানালেও প্রেসিডেন্ট তা প্রত্যাখ্যান করেন। বিবিসি বলছে, ফাঁস হয়ে যাওয়া নথির বরাতে দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রী সিগমুন্ড গুনলাগসন ও তার স্ত্রী ২০০৭ সালে উইনট্রাস নামের কোম্পানিটি ক্রয় করেন। ২০০৯ সালে দেশটির পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হওয়ার সময় তিনি প্রতিষ্ঠানটি থেকে পাওয়া লভ্যাংশের কথা গোপন করেছিলেন। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী গুনলাগসনের স্ত্রী আনা সিগুরলাগ পালসডোটিরের সই করা একটি নথিতে দাবি করা হয়েছে, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কোম্পানিটির মাধ্যমে বিনিয়োগ করা হয়েছে।
এ নিয়ে জোর গলায় কথা বলা শুরু করেছে ভারত সরকার। কারো বিরুদ্ধে অন্যায় কোনো কার্যক্রমের প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার সঙ্গে আলোচনার পর অর্থমন্ত্রী ওই তদন্তের নির্দেশ দেন। আইসিআইজের সঙ্গে ওইসব ফাইলের যৌথভাবে তদন্ত করছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। ফাঁস হওয়া রিপোর্টে বলা হয়েছে, অফসোর হোল্ডিং বা উপক‚লীয় প্রতিষ্ঠানে অবৈধভাবে অর্থ বিনিয়োগ করেছেন ভারতের মেগাস্টার অমিতাভ বচ্চন, তার পুত্রবধূ ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন, ডিএলএফ চেয়ারম্যান কেপি সিং ও তার পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য, ইন্ডিয়াবুলসের মালিক সমীর গেহলাউট, এপোলা টায়ারের ওঙ্কার সিং কানওয়ার ও বিনোদ আদানির ভাই গৌতম আদানি। ওই তালিকায় রয়েছে ফুটবলের এ সময়ের জনপ্রিয় খেলোয়াড় লিওনেল মেরি নাম। তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে তার পরিবার। ওদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনকে জড়িয়ে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তা প্রত্যাখ্যান করেছে ক্রেমলিন। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দমিত্রি পেসকভ বলেছেন, পুতিন, রাশিয়া, আমাদের দেশ, আমাদের স্থিতিশীলতা, আসন্ন নির্বাচনকে প্রধান টার্গেট করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সে যাই হোক, এভাবে অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানদের কুকর্মও শিগগিরই বেরিয়ে আসবে হয়তো বা। জানা যাবে তাদের নেপথ্য ফিরিস্তি। আমরা খুব আশ্চর্য হয়ে দেখছি, এসব নেতারাই বিশ্বে শান্তি-সম্প্রীতি-আলোকিত প্রজন্মের কথা বলছেন। তারা আমাদের রক্ষক। কিন্তু আসলেই কি তারা আমাদের প্রজন্মকে রক্ষা করতে পারছেন? কিংবা চেষ্টা করছেন? দেশে কিংবা বিদেশে সবখানেই এখন দখলদারদের রাজত্ব। তারা গণমানুষকে শোষণ করছেন। এর অবসান কোথায়? আমরা এখন ডিজিটাল শোষণের শিকার। তা এই কয়েক মাসের বিভিন্ন ঘটনা প্রমাণ করছে। আজ মানুষকে চোখ খুলে দাঁড়াতে হবে। সাহস নিয়ে কথা বলতে হবে। এ ছাড়া আর কি ই বা করার আছে!
----------------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ শনিবার, ৯ এপ্রিল ২০১৬
©somewhere in net ltd.