![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]
সংস্কৃতির অভিবাসন, নিউইয়র্কের বইমেলা
ফকির ইলিয়াস
============================================
গেল সপ্তাহান্ত নিউইয়র্ক ছিল বইমেলার নগরী। ২০, ২১, ২২ মে -২০১৬ ছিল আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলা। আয়োজক- মুক্তধারা ফাউন্ডেশন। এবারের বইমেলা উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। জ্যাকসন হাইটসের পিএস-৬৯ স্কুলে শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া এই মেলা চলে ২২ মে রোববার রাত পর্যন্ত। ২০ মে সন্ধ্যায় জ্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজা থেকে শুরু হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। রং বেরংয়ের পোশাক পরে, ব্যানার- ফেস্টুন আর পতাকা হাতে, ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, নেচে-গেয়ে আর জাতীয় পতাকার ফিতা মাথায় বেঁধে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারী আমন্ত্রিত অতিথি, সংস্কৃতিপ্রেমী ও প্রবাসী বাংলাদেশিরা শোভাযাত্রাকে বর্ণাঢ্য করে তোলেন। স্থানীয় ৭৩ স্ট্রিট ও ৩৭ এভিনিউ হয়ে শোভাযাত্রা মেলা প্রাঙ্গণে এসে শেষ হয়। এরপর বেলুন উড়িয়ে ও ফিতা কেটে মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন কথাসাহিত্যক সেলিনা হোসেন। এ সময় দৈনিক ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও অনন্যা সম্পাদক এবং প্রকাশক তাসমিমা হোসেন, নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটে নিযুক্ত কনসাল জেনারেল মোহাম্মদ শামীম আহসান, সাহিত্যিক-সাংবাদিক আনিসুল হক, নাট্য ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, নাট্য ব্যক্তিত্ব জামাল উদ্দিন হোসেন, ভয়েস অব আমেরিকা বাংলা বিভাগের প্রধান রোকেয়া হায়দার, লেখক গুলতেকিন খান, ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন, সাংবাদিক-লেখক নাজমুন নেসা পিয়ারি, আমীরুল ইসলাম, সৈয়দ আল ফারুক, পত্রভারতীর প্রকাশক ত্রিদিব চ্যাটার্জি, প্রকাশক ফরিদ আহমেদ, অধ্যাপক আব্দুল সেলিম, মেলার আহ্বায়ক হাসান ফেরদৌস, মুক্তধারার কর্ণধার বিশ্বজিৎ সাহাসহ শত শত অভিবাসীর পদচারণায় ছিল মেলা মুখরিত।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বইমেলার আহ্বায়ক হাসান ফেরদৌস। এরপর আমন্ত্রিত অতিথিরা শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন। তারা তাদের বক্তব্যে বাংলাদেশের বাইরে এমন ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে বইমেলা আয়োজনের প্রশংসা করে বলেন, বাংলা ভাষা, বাঙালি পৃথিবীর যেখানেই থাকুক না কেন সেখানেই বাংলা বইয়ের পাঠক থাকবেই।
এবারের মেলায় বিশেষ পর্বটি ছিল- উদ্বোধনী দিনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সহযোদ্ধা ড. ডেভিড নেইলিনকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান। তাকে মঞ্চে উত্তরীয় পরিয়ে দেন মেলার আমন্ত্রিত অতিথি তাসমিমা হোসেন ও রামেন্দু মজুমদার। এই পর্বে সøাইড শো প্রদর্শন করেন ওবায়দুল্লাহ মামুন। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক খ্যাতিধন্য এই মার্কিন চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ওয়াশিংটনে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সে বছর জুলাই মাসে মেরিল্যান্ডের বালটিমোরে পাকিস্তানি অস্ত্রবাহী জাহাজ পদ্মা বন্দরে প্রবেশ করার বিরুদ্ধে যারা বিক্ষোভে অংশ নেন তাদের মধ্যে ড. নেইলিন ছিলেন অন্যতম। তিনি ১৯৬৮ সালে ঢাকার কলেরা হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় কলেরার প্রতিষেধক হিসেবে অরাল রিহাইড্রেশন থেরাপি আবিষ্কার করেন।
বইমেলার উদ্বোধনী দিনে উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল নতুন প্রজন্মের অংশ গ্রহণে অনুষ্ঠান ‘নতুনের কেতন’। এই পর্বে নবীন শিল্পীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন গুলতেকিন খান। এছাড়া ‘মুক্তধারার পঁচিশ বছর : ফিরে দেখা’ শীর্ষক আলোচনায় অংশ নেন ড. নূরননবী ও আনিসুল হক।
এবারের মেলার মূল মঞ্চের নাম ছিল ‘রফিক আজাদ মঞ্চ’। আর সেমিনার কক্ষটির নাম ছিল ‘ফায়সাল আরেফীন দীপন কক্ষ’। বিভিন্ন পর্বে আলোচনা করেন ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের প্রধান রোকেয়া হায়দার, নিউজার্সির প্লেইন্সবরো টাউনশিপের কাউন্সিলম্যান ড. নূরন্নবী, জাতিসংঘের জ্যেষ্ঠ অর্থনৈতিক কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম, জেনোসাইড একাত্তরের প্রদীপ রঞ্জন কর, ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন, অধ্যাপক আব্দুস সেলিম, ড. পার্থ ব্যানার্জি, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়, ফরিদ আহমেদ। এর আগে ‘লেখকের সামাজিক দায়িত্ব’ শীর্ষক এক আলোচনায় কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন ‘বাংলাদেশের ভষিষ্যৎ বিনির্মাণে’ কবি-লেখক-সাহিত্যিকদের আরো ‘জনসম্পৃক্ত’ হওয়ার আহ্বান জানান।
দৈনিক ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক তাসমিমা হোসেন ‘বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে’ প্রবাসীদেরও ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিপন্ন করতে বহুমুখী ষড়যন্ত্র চলছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শক্তিকে এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। নারীর ক্ষমতায়নে সরকারের আন্তরিকতাকে ফলপ্রসূ করতে প্রবাসীদেরও সোচ্চার থাকা দরকার,’ বলেন তিনি। সেলিনা হোসেন বলেন ‘ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীতেও গণতান্ত্রিক সব আন্দোলনে কবি-লেখক-সাহিত্যিকদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। জীবন বাজি রেখে এখনো তারা তাদের লেখনী অব্যাহত রেখেছেন। জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এ ভূমিকা আরো বাড়াতে হবে।’
‘নারী যখন লেখক : অসমান খেলার মাঠ’ শীর্ষক অন্য এক মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন লেখক আনিসুল হক, কবি গুলতেকিন খান প্রমুখ। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার ছিল ‘টেলিভিশন কি বাংলা সংস্কৃতি বিকাশে প্রতিবন্ধক?’ এই বিষয়ে আলোচনায় অভিনেতা রামেন্দু মজুমদার বলেন, বাংলাদেশের বেসরকারি গণমাধ্যমগুলোই বর্তমানে কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকা রাখছে। ‘বিটিভির অনির্ভরযোগ্য সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে সবাই বেসরকারি চ্যানেলের ওপর ভরসা রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। বাঙালি সংস্কৃতির লালন ও বিকাশেও সেসব গণমাধ্যম কার্যকর ভূমিকা রাখছে।’ একুশে পদকপ্রাপ্ত নাট্য ব্যক্তিত্ব জামালউদ্দিন হোসেন ‘সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী’র মালিকানাধীন টেলিভিশন চ্যানেলের ব্যাপারে দর্শকদের সচেতন হওয়ার তাগিদ দেন। তিনি বলেন ‘গণশত্রুরা যদি টিভির নিয়ন্ত্রক হয়, তাহলে বাঙালি সংস্কৃতির বিপক্ষে প্রচারণা চলবেই। দর্শকদেরকেও তাই ধর্মের নামে বর্বরতা চালাতে অভ্যস্ত গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণাধীন টিভি পরিহারের ব্যাপারে সজাগ হতে হবে।’
এবারের মেলায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার ছিল, ‘সমকালীন সাহিত্যে ছোটকাগজের ভূমিকা’। এর সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলাম আমি। এই সেমিনারে সভাপতি ছিলেন ‘ঘুংঘুর’ এর সম্পাদক হুমায়ূন কবির। আলোচক ছিলেন ‘শব্দঘর’ সম্পাদক মোহিত কামাল, কবি তমিজ উদদীন লোদী, কবি শামস আল মমীন, ‘কিশোর ভারতী’ সম্পাদক ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়, কবি সৈয়দ মামুনূর রশীদ, কবি মাহবুব লীলেন ও ডা. সজল আশফাক।
এবারের মেলাটি ছিল বেশ জমজমাট। তারপরও নানা জন, নানাভাবে খুঁত ধরার চেষ্টা করেছেন। যারা কখনো নিউইয়র্কের শিল্প-সাহিত্যের ধারে কাছেও এসে কোনো ছায়া মাড়াননি, তারাই প্রশ্ন তুলছেন বিভিন্ন জট পাকাতে। নিউইয়র্কে বইমেলার পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে এবার থেকে শুরু হওয়ায় ‘চ্যানেল আই-মুক্তধারা বইমেলা সাহিত্য পুরস্কার’-২০১৬ লাভ করেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। মেলার শেষ দিনে মূল মঞ্চ থেকে পুরস্কারপ্রাপ্ত গুণীজনের নাম ঘোষণা করা হয়।
বাঙালিরা অভিবাসে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বীজ বুনছেন, আলো ছড়াচ্ছেন। এটা গর্বের বিষয়। নিউইয়র্কে একটি সাংস্কৃতিক আবহ তৈরি হয়েছে এই বইমেলাকে ঘিরে। প্রচুর সংখ্যক তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ সেটাই প্রমাণ করছে। বাংলাদেশের লেখকদের বই কিনছে তরুণ-তরুণীরা। একটি জাতিসত্তা, তার সাহিত্য সংস্কৃতি শিল্প নিয়েই বাঁচে, তা দেশে হোক আর বিদেশে হোক। মুক্তধারা ফাউন্ডেশন ও এর কর্ণধার বিশ্বজিত সাহা যে বীজ বপন করেছিলেন তা এবার ২৫ বছর পূর্ণ করল। মানুষ এগোবে- এগোবে আমাদের সাহিত্যের সৌন্দর্য, এ প্রত্যাশা আমরা করেই যাচ্ছি।
--------------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ শনিবার, ২৮ মে ২০১৬
©somewhere in net ltd.