![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]
বাংলাদেশে চোরাগুপ্তা আক্রমণের ধারাবাহিকতা
ফকির ইলিয়াস
---------------------------------------------
গেল ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে বাংলাদেশের বিভিন্ন চ্যানেলে অনুষ্ঠান দেখছিলাম। মনে পড়ে গেল ১৯৭৫ সালের কথা। মেজর ডালিম, বাংলাদেশ বেতারের দখল নেয়ার পর, বলেছিল- ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। কায়দাটা ছিল ওই একই, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। একটি অনুষ্ঠানে এই ২০১৬ সালেও ডালিমের সেই ঘোষণাটি আবার শুনলাম। কী দাম্ভিক উচ্চারণ! ওরা ভেবেছিল, মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করলেই আওয়ামী লীগ শেষ হয়ে যাবে। বাংলাদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শেষ হয়ে যাবে।
শেখ হাসিনা-শেখ রেহানা সেদিন স্রষ্টার কৃপায় বেঁচে গিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা বিদেশ থেকে এসে হাল ধরেছিলেন বহুধা বিভক্ত আওয়ামী লীগের। আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজটি সহজ ছিল না। সেই কাজটিই করেছিলেন তিনি। সামরিক জান্তারা চেপে বসেছিল জগদ্দল পাথরের মতো। তা সরানোর কাজটিও সহজ ছিল না। সেই কাজের দিকেও এগিয়ে ছিলেন শেখ হাসিনা। জাতির জনককে চোরাগুপ্তা প্রক্রিয়ায় হত্যা করা হয়েছিল। এর বিচার ঠেকাতে যা যা করা দরকার করেছিলেন জিয়াউর রহমান। এই চোরাগুপ্তা হত্যার কাজটি পাকাপোক্ত হয়েছিল সামরিক জান্তাদের হাতে। কালের আবর্তনে অনেক কথাই এখন বেরিয়ে আসছে। লন্ডন থেকে তরুণ প্রজন্মের সাংবাদিক তানভীর আহমেদের একটি লেখায় আমরা জানতে পারছি- ‘শশাঙ্ক ব্যানার্জীকে থামিয়ে দিয়ে জানতে চাইলাম, জিয়াউর রহমানকেই টার্গেট করে রাওয়ালপিন্ডির সামরিক কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধু হত্যা পরিকল্পনার ছক আঁকছেন, ১৯৭৩ সালেই এই সিদ্ধান্তে তিনি কেমন করে পৌঁছেছিলেন?
ব্যানার্জী বলতে শুরু করলেন, ‘রাওয়ালপিন্ডির সামরিক গোয়েন্দা ও জেনারেলরা অ্যাবোটাবাদের যে প্রশিক্ষণ শিবিরে ট্রেনিং নিয়েছেন জিয়াউর রহমানও একই স্থানে প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। তাছাড়া জিয়াউর রহমান এর আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতেই কর্মরত ছিলেন। তাই পাকিস্তানি গোয়েন্দা ও জেনারেলদের জন্য জিয়াউর রহমান ছিলেন একটি ভালো অপশন। ১৯৭৩ সালের দিকে ভারতে একটি গুজব চলছিল যে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ, এই দুই সংস্থা মিলে শেখ মুজিবের হত্যার পরিকল্পনা করেছে। আর সেই সময়ে জিয়াউর রহমান ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তাছাড়া ভারতীয় গোয়েন্দা সূত্র থেকে আমরা জানতে পেরেছিলাম জিয়াউর রহমান ওয়াশিংটনে গিয়ে পাকিস্তানি মিলিটারি অ্যাটাশের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, অথচ জিয়াউর রহমান আমার সঙ্গে (শশাঙ্ক ব্যানার্জী) লন্ডনে বৈঠকের সময় কিন্তু নিজে থেকে বলেননি তার সঙ্গে আইএসআই-এর বৈঠক হয়েছে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে আমি জানতে চাইলে জিয়াউর রহমান স্বীকার করেন, তিনি পাকিস্তানি মিলিটারি অ্যাটাশের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন।’ ভারতীয় ক‚টনীতিক শশাঙ্ক এস ব্যানার্জীর লেখা ‘ইন্ডিয়া, মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ লিবারেশন অ্যান্ড পাকিস্তান’ (অ্যা পলিটিক্যাল ট্রিটিজ) গ্রন্থটির ১৬তম অধ্যায়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রসঙ্গে শশাঙ্ক ব্যানার্জী লিখেছেন, ‘১৯৭৩ সালে লন্ডনে যুদ্ধখেলায় যুক্ত হয়েছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান।’
জিয়ার শাসনামলে মোট ১৯টি ক্যু হয়েছিল। জিয়াউর রহমানের সাড়ে পাঁচ বছরের শাসনামল ছিল খুন গুম আর রক্তপাতময় শাসন। সরকারি হিসাব মতে, শুধুমাত্র ৭৭ সালেই ১১৪৩ জন সৈনিককে মৃত্যুদণ্ড দেন জিয়া। জিয়া জাসদ সমথর্ক বা যাদের সমথর্ক সন্দেহ করা হয়েছে এমন সিপাহিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন ক্যাঙ্গারু কোর্ট মার্শাল করে। জিয়ার ইচ্ছায় ১৯৭৮ সালে বাজিতপুরের পাঁচজন রাজনৈতিক কর্মীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, তাদের আপিল গ্রহণ করা হয়নি। রাজশাহীর জেলে আব্দুল গনি, কুমিল্লায় জয়নুল আবেদিন এবং ঢাকা জেলে হাবিলদার মতিন ও মতি মিয়া নিহত হন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৮১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত জাসদের প্রায় ১৫০০ কর্মী হত্যার শিকার হন। জিয়ার শাসনামলে আওয়ামী লীগের ৩৫১ জন নেতাকর্মী নিহত হন। ১৯৭৬ সালে জানুয়ারি মাসে ৬২ হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে আটকে রাখা হয়েছিল কারাগারে। ১৯৮০ সালে রাজশাহী ও খুলনা জেলে পুলিশের গুলিবর্ষণে ৫০ জন রাজনৈতিক কর্মী নিহত হন। জিয়ার শাসনামলে অনেক বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীকে গুম করা হয়! তাছাড়া রাজনৈতিক বন্দিদের গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে পেটানো এবং লজ্জাস্থানে লোহা-বরফ-কাঠ ঢুকানোসহ বিভিন্ন অমানুষিক নির্যাতন করা হয়।
এরকম অনেক তথ্য রয়েছে, জিয়ার অপশাসনের। সেই জিয়ার বিএনপি এখনো চোরাগুপ্তা আক্রমণের মদদ দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এখনো ভুলে যায়নি ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের কথা। যে দিনটিকে তুলনা করা যায় একাত্তরের কোনো দিনের সঙ্গে। ২১ আগস্ট, বাংলাদেশের ইতিহাসে বারুদ আর রক্তমাখা বীভৎস রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞের দিন। মৃত্যু-ধ্বংস-রক্তস্রোতের নারকীয় গ্রেনেড হামলার একটি ঘৃণ্য চক্রান্তের দিন এটি। শোকাবহ-রক্তাক্ত আগস্ট মাসেই আরেকটি ১৫ আগস্ট ঘটানোর টার্গেট থেকে ঘাতক হায়েনার দল গ্রেনেড দিয়ে রক্তস্রোতের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সমাবেশ স্থলে। টার্গেট ছিল এক ও অভিন্ন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণ নেতৃত্বশূন্য ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করতেই ঘাতকরা চালায় এই দানবীয় হত্যাযজ্ঞ। জাতির সামনে আবারো স্পষ্ট হয়ে ওঠে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ স্পৃহা। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকার সময়ই খোদ রাজধানীতে দিনে প্রকাশ্যে চালানো হয়েছিল এই ভয়াল ও বীভৎস গ্রেনেড হামলা।
ঘাতকদের প্রধান লক্ষ্য ছিলেন শেখ হাসিনা। পরিস্থিতির তাৎপর্য বুঝতে পেরে, ট্রাকে অবস্থানরত নেতারা ও শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তারা মানবঢাল রচনা করে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন বঙ্গবন্ধুর এই কন্যাকে। নেতা ও দেহরক্ষীদের আত্মত্যাগ ও পরম করুণাময়ের অশেষ রহমতে অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আরেকটি রক্তাক্ত ১৫ আগস্ট ঘটাতে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে উপর্যুপরি ১৩টি গ্রেনেড মেরেই ক্ষান্ত হয়নি ঘাতকরা। গ্রেনেডের আঘাতে পরাস্ত করতে না পেরে ওইদিন শেখ হাসিনার গাড়িতে ঘাতকরা ছুড়েছিল বৃষ্টির মতো গুলি। একেবারে পরিকল্পিত ও টার্গেট করা ঘাতকদের নিক্ষিপ্ত গুলি ভেদ করতে পারেনি শেখ হাসিনাকে বহনকারী বুলেটপ্রæফ গাড়ির কাচ। শেখ হাসিনাকে আড়াল করে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে জীবন বিলিয়ে দেন তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী ল্যান্স কর্পোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ।
আজ বাংলাদেশে জঙ্গিদের মহিলা টিমও তৈরি হয়েছে। এরা কারা? কে তাদের নেপথ্যে? হলি আর্টিজান কিংবা শোলাকিয়ায় কারা এমন হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে? বাংলার মাটি থেকে এসব চক্রান্তকারীকে সমূলে বিনাশ করতেই হবে। কারণ এরা সুযোগ পেলেই মুছে দিতে তৎপর হবে আমাদের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিক অগ্রযাত্রা। প্রজন্মকে বিষয়গুলো বুঝতে হবে, কেন পেছন দুয়ার দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার সুযোগ খোঁজা হয়। কেন ওরা ’৭১-কে বলে ‘গণ্ডগোলের বছর’। দেশে আইনি শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে এসব বিচার কাজ শেষ করতেই হবে। এর নেপথ্যে কারা ছিল তা বের করে আনতে হবে। দাবিটি গোটা বাঙালি জাতির। যারা বুকে একাত্তরকে লালন করেন। আগেই বলেছি, চোরাগুপ্তা হত্যার একটা ধারাবাহিকতার শিকড় খুঁজতে হবে। তা বের করতে না পারলে প্রজন্মের মুক্তি সম্ভব নয়।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ ২০ আগস্ট ২০১৬ শনিবার
©somewhere in net ltd.