![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]
ত্যাগের মহিমা, উৎসবের আলো ও মানবিক জীবন
ফকির ইলিয়াস
============================================
আরেকটি ঈদুল আজহা আমাদের জীবনে এলো। এলো ত্যাগের মহিমা নিয়ে। ত্যাগ মানেই সুখ-দুঃখ ভাগাভাগির নীতিবাক্য। শান্তির প্রয়োজনে মানুষকে এসব নীতি মেনে চলতে হয়। আইন করে সব নীতি মানুষকে শেখানো যায় না। কিছু কিছু বিষয় আছে বিবেক প্রসূত। প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নেয়ার যে প্রয়োজন তা মানুষ জন্মেই শিখে। মানুষ শিখে নেয়, আকাশের দিকে তাকাবার সাহস। সূর্য থেকে আলোস্নানের প্রেম। মৃত্তিকা থেকে সবুজ আহরণের পর্ব।
ঈদুল আজহায় মুসলমানেরা ত্যাগের দীক্ষা নেন। যে নির্দেশ পালন করতে গিয়ে হজরত ইব্রাহিম নিজ পুত্র হজরত ইসমাইলকে (আ.) কুরবানি দিতে এগিয়ে এসেছিলেন তা ছিল একটি পরীক্ষা। তিনি সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। হজরত ইব্রাহিমের (আ.) এই ত্যাগের আদর্শকে স্মরণ করার জন্য বিশ্বজুড়ে মুসলিম সম্প্রদায় প্রতি বছর ঈদুল আজহায় হালাল পশু কুরবানি দিয়ে থাকেন। কিন্তু তারা মনের পশু কুরবানি দিতে পারেন কি? যদি পারতেন তাহলে আজকের বিশ্বে এত হিংসা কেন? এত বিভেদ কেন? এত হানাহানি কেন?
আমি খুব সামান্য মানুষ। খুব সহজভাবে ধর্মে মানবিক বিষয়গুলো বিবেচনা করি। ইসলামের ইতিহাস আমাদের কি শিক্ষা দেয়? তা কি আমরা মনে রাখি সবসময়? আমরা কি ভুলে গেছি, মহানবী (সা.)-এঁর বিদায় হজের ভাষণের কথা।
৯ জিলহজ দশম হিজরি মহানবী মুহাম্মাদ (সা.) শুক্রবার ফজরের নামাজ আদায় করে সূর্যোদয়ের পর মিনা হতে আরাফাহ ময়দানের পূর্বদিকে নামিরা নামক স্থানে তাঁবু স্থাপন করা হলে, সেখানে পৌঁছে দুপুর পর্যন্ত সেই তাঁবুতে অবস্থান করেন। জুমার নামাজ আদায় করে তিনি কাসওয়া নামক উষ্ট্রীর ওপর আরোহণ করে আরাফার সন্নিকটে ‘আরনা’ প্রান্তরে উপস্থিত হয়ে প্রায় এক লাখ বিশ হাজার লোকের সমাবেশে তাঁর ঐতিহাসিক বিদায় হজের খুতবা বা ভাষণ প্রদান করেন। তাঁর প্রতিটি বাক্যই রাবিয়া বিন উমাইয়া বিন খালাফ (রা.) কর্তৃক পুনরাবৃত্তি হয়েছিল। নামাজ আদায় করার পর আল্লাহকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেছিলেন-
হে মানবমণ্ডলী! তোমরা আমার কথাগুলো মন দিয়ে শ্রবণ কর; কেননা, আমি এ বছরের পর এ স্থানে তোমাদের সঙ্গে পুনরায় নাও মিলিত হতে পারি। আগত ও অনাগতকালের হে মানবমণ্ডলী! যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা তোমাদের প্রভুর সঙ্গে মিলিত না হচ্ছো তোমাদের রক্ত ও তোমাদের ধন-সম্পদ এই দিন ও এই মাসের মতোই পবিত্র। নিশ্চয়ই তোমরা তোমাদের প্রভুর সঙ্গে মিলিত হবে, যখন তোমাদের প্রভু তোমাদের কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন এবং আমি তোমাদের তাঁর সংবাদ পৌঁছে দিয়েছি। তিনি বলেন, হে মানবমণ্ডলী! তোমরা আমার কথাগুলো অনুধাবন কর নিশ্চিত করে বুঝতে। তোমরা শিক্ষা পেয়েছ প্রত্যেক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই, সব মুসলমানই এ ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। এটা কোনো মানুষের জন্যই অবৈধ নয়। অনুমতি ব্যতীত অন্যের জিনিস গ্রহণ করবে না। সুতরাং কেউ কারো প্রতি অবিচার করো না।
তিনি বলেছিলেন, সাবধান! ধর্ম সম্বন্ধে বাড়াবাড়ি করো না। এই বাড়াবাড়ির ফলে তোমাদের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। তোমরা ধর্মভ্রষ্ট হয়ে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়া ও রক্তপাতে লিপ্ত হয়ো না। তোমরা পরস্পর পরস্পরের ভাই। হে মানববৃন্দ! কোনো দুর্বল মানুষের ওপর অত্যাচার করো না, গরিবের ওপর অত্যাচার করো না, সাবধান! কারো অসম্মতিতে কোনো জিনিস গ্রহণ করো না। সাবধান! মজুরের শরিরের ঘাম শুকাবার আগেই তার মজুরি মিটিয়ে দিও। তোমরা যা খাবে ও পরবে তা তোমাদের দাস-দাসিদের খেতে ও পরতে দিও। যে মানুষ দাস-দাসিদের ক্ষমা করে ও ভালোবাসে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন ও ভালোবাসেন। এই ছিল মহামানবের শিক্ষা। সেই শিক্ষা কি পালিত হচ্ছে আজকের সমাজে? না, হচ্ছে না। যদি হতো, তাহলে আজ একটি পক্ষ অন্য ধর্মের মানুষের ওপর হামলে পড়ত না।
সিলেটের ইসকন মন্দিরে হামলা করা হয়েছে। নামাজে থাকা অবস্থায় মন্দিরে বাদ্যযন্ত্র বাজানোয় অনেকের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। নামাজ শেষ হওয়ার পর ‘অতি উৎসাহী’ কিছু লোক মন্দিরের বাইরে গিয়ে ঢিল ছোড়ে। বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করা যেত। আক্রমণ করে এভাবে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটানো হবে কেন?
পূজামণ্ডপে হামলা বাংলাদেশে একটি প্রাত্যহিক বিষয়। আর ক’দিন পরই শুরু হচ্ছে দূর্গাপূজার উৎসব। চলতি বছরেরই কয়েকটি সংবাদ আমরা আবারো পড়তে পারি।
১. কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় সরস্বতী পূজামণ্ডপ ভাঙচুর করেছে দুষ্কৃতকারীরা। গতকাল সোমবার সন্ধ্যার পর মধ্যবাজারের স্বর্ণকারপট্টির সন্নিকটে গৌরচাঁদ কর্মকারের বাড়ির সামনে সরস্বতী পূজামণ্ডপ নির্মাণাধীন অবস্থায় একদল দুষ্কতকারী হামলা চালায়। এ সময় পূজামণ্ডপ ভাঙচুরসহ মণ্ডপ নির্মাণকারী শ্রমিকদের বেধড়ক মারধর করে। ভেড়ামারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ভেড়ামারা থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। [মঙ্গলবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ প্রকাশিত সংবাদ ]
২. কক্সবাজারের ১০টি মন্দিরে ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে হামলা চালানোর হুমকি দিয়ে চিঠি দিয়েছে আইএস। ডাকযোগে জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের প্রধান কার্যালয়ে এই চিঠি পাঠানো হয়। এই ঘটনার পর সদর মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি এডভোকেট রণজিত দাশ।
এডভোকেট রণজিত দাশ জানান, ডাকযোগে পাঠানো চিঠিটি বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টার দিকে তার হস্তগত হয়। চিঠিটি হাতের লেখা। চিঠিতে জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে উদ্দেশ্য করে হত্যার হুমকি দেয়া হয়।
চিঠিটি হুবহু তুলে ধরা হলো ‘বাংলাদেশ পূজা উদযাপন কমিটি কক্সবাজার। আইএস জঙ্গি সংগঠন। আগামী ৩০ শে জুলাইয়ের মধ্যে কক্সবাজারের সর্বপ্রথম মন্দিরে হামলা চালাবো। বাহ্ম মন্দিরে, এরপর কালিবাড়ি, ইসকন মন্দির, কৃষ্ণনন্দ ধাম, শংকর মঠে বড় ধরনের হামলা চালাবো, রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম। আমরা যতদিন পর্যন্ত হিন্দুরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে না ততদিন পর্যন্ত এ জিহাদ চলবে। ’
[জুলাই ১৫, ২০১৬ প্রকাশিত সংবাদ]
এই হলো বাংলাদেশের খণ্ডচিত্র। মানুষ আজ জিম্মি হয়ে পড়ছে মানুষের কাছে। রহিত হয়ে যাচ্ছে মানবিক চেতনা। আমরা জানি, যে কোনো ধর্মীয় প্রার্থনা কিংবা উৎসব মানুষকে নত হতে শেখায়। কিন্তু আজকের বিশ্বের মানুষ উগ্রবাদিতার দিকে এগোচ্ছে কেন? তা থামানো যাবে কিভাবে?
আজ প্রয়োজন সব সামাজিক শক্তির সম্মিলিত উদ্যোগ। মানবিক চেতনা জাগরিত করেই কেবল এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে। বিশ্ব পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আজ যেটা সবচেয়ে জরুরি তা হচ্ছে মানবিক সহনশীলতা। সংলাপের মাধ্যমে প্রজন্মকে জাগানো। ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। অন্য ধর্ম, অন্য সংস্কৃতির মানুষকে জানার চেষ্টা। তার জন্যই প্রয়োজন পরিশুদ্ধ জ্ঞানার্জন। মানবিক বোধ জাগরিত করার একটা বড় ক্ষেত্র হচ্ছে প্রতিদিনের শিক্ষা। মানুষ মূলত প্রকৃতির ছাত্র। বিষয়টি মনে রাখতে পারলেই তার অহঙ্কার দমিত হবে এবং অনুধাবন করা যাবে, রক্তের বিনিময়ে আর যাই হোক বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।
-----------------------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ শনিবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬
©somewhere in net ltd.