নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আলোর আয়না এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্য নয়।লেখা অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]

ফকির ইলিয়াস

এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]

ফকির ইলিয়াস › বিস্তারিত পোস্টঃ

একাত্তরের প্রত্যয় ও মানবতাবাদের বাংলাদেশ

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ৮:৪৫



একাত্তরের প্রত্যয় ও মানবতাবাদের বাংলাদেশ
ফকির ইলিয়াস
======================================
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস চলে গেল। বিজয়ের আলোয় আবারো ঝলসে উঠল বাংলাদেশ। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস এলেই আমার একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের কথা মনে পড়ে। তিনি অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। নিউইয়র্কে তার সঙ্গে আমার দীর্ঘ আড্ডা হয়েছিল। কথা হয়েছিল বিভিন্ন প্রসঙ্গে। তার ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। তিনি বারবার শহীদ মুনীর চৌধুরীর কথা বলতেন। বলতেন, ভাইয়ের অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করতে চাই। সেই চেতনায় কাজ করেছিলেনও। তার আরেক ভাই ছিলেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। ছোটবোন ফেরদৌসী মজুমদার। জাতির জনক কবীর চৌধুরীকে শিক্ষা সচিব করেছিলেন। তার প্রধান কাজটি ছিল সমাজের সংস্কার। কথায় কথায় তিনি বারবার বলতেন, মানবতাবাদী বাংলাদেশের কথা।

তার চাওয়া ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ থাকবে না। আর এই কারণেই তার শত্রুর সংখ্যা ছিল অনেক। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কীভাবে মানুষের জয় হবে? হেসে বলেছিলেন, যখন মানুষ জয় করার বিদ্যা শিখবে। বলেছিলাম, কী সেই বিদ্যা! বলেছিলেন, জেগে ওঠার প্রত্যয়। এই প্রত্যয় নিয়ে কি প্রজন্ম এগোতে পারছে? প্রশ্নটি আমি বারবার করি নিজেকেই। যদি না পারে, কেন পারছে না?

প্রিয় পাঠক, চলুন অতীতের দিকে ফিরে তাকাই। ১৩ ডিসেম্বর ২০১১ মঙ্গলবার জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী চিরবিদায় গ্রহণ করেন। ওই একই দিন বিভিন্ন চ্যানেলে কুখ্যাত ঘাতক গোলাম আযমের একটি সাক্ষাৎকার দেখেছিল দেশ-বিদেশের কোটি বাঙালি। এই সাক্ষাৎকার নিতে বেশ কিছু তরুণ সাংবাদিক বন্ধুকে গোলাম আযমের সামনে বসে থাকতে দেখেছিলাম আমরা। তারা বেশ কিছু প্রশ্নও করেছিলেন।

গোলাম আযম এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই প্রমাণ করতে পারবে না এই সরকার। গো. আযম আরো বলেছিলেন, এত দিন পর বিচারের চেষ্টা কেন? এই আওয়ামী লীগ সরকার তো আগেও ক্ষমতায় ছিল। আমি অবাক হয়ে দেখেছিলাম, আমার কোনো সাংবাদিক বন্ধু এর জোর প্রতিবাদ করলেন না। তারা বললেন না, এখনো নাৎসীদের বিচার হচ্ছে। আরো বহুদিন পর্যন্ত হবে। অপরাধীর বিচারের কোনো সময়সীমা নেই। থাকতে পারে না। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চালু আছে। অনন্তকাল থাকবে। বাংলাদেশ অন্য কোনো গ্রহের দেশ নয়। এসব কথা সেদিন কোনো সাংবাদিকই গোলাম আযমকে বলেননি। কেন বলেননি- এই প্রশ্নটি আমি আজো করতে চাই।

আমরা ভুলে যাইনি, এই প্রজন্ম তো শহীদ রফিক-জব্বার- বরকত-সালাম, সেলিম-জাহিদ-দেলওয়ার-নূর হোসেন- বসুনিয়ার উত্তরাধিকারী। তারা সেই ঋণ শোধে রুখে দাঁড়ালেন না কেন? কণ্ঠের শক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করলেন না কেন? মনে রাখা দরকার, শুধু পেশাগত দায়িত্বই সমাজ বিনির্মাণ ও সত্য প্রতিষ্ঠার একমাত্র শক্তি নয়। কথামালার ব্যাপৃতি ঘটিয়ে, বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে সত্য বের করে আনাও একটি অন্যতম কর্তব্য। কবীর চৌধুরী সেই চেতনা জাগাতে চেয়েছিলেন প্রজন্মের মাঝে। তিনি জীবনের গোটা সময়ই কাজে কাটিয়েছেন। বলেছেন, সৃষ্টির ধারা থেমে থাকতে পারে না। বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দোরগোড়ায় অনুবাদের মাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। বারবার বলেছেন, বাংলাদেশে ১৪ ডিসেম্বর তৈরি করে এই রাষ্ট্র কাঠামোকে পঙ্গু করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০১৬-এর বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যারা তাদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা তুলে দিয়েছে, তারাও সমান অপরাধে অপরাধী। যুদ্ধাপরাধীদের যেমন বিচার হয়েছে, এদের বিচারও বাংলার মাটিতে ইনশাল্লাহ হবে।’ জার্মানিতে এখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের অপরাধীদের বিচার হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলতে থাকবে, এই বিচার শেষ হবে না। ‘যতই কৌশল আর ষড়যন্ত্র করুক না কেন, তাদের কেউ রক্ষা করতে পারবে না। কারণ, এটা ন্যায়সঙ্গত পথ। ন্যায় ও সত্যের জয় সব সময় হয়, হবে।’ যোগ করেন তিনি। আমাদের মনে আছে, ১৯৭১ সালে যে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, যাদের নেতাকর্মীরা সক্রিয়ভাবে যুদ্ধাপরাধে অংশ নিয়েছিল বলে আদালতে প্রমাণিত হয়েছে, সেই দলটিই ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর আবার বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার পায়।

শেখ হাসিনা বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের যারা লালন-পালন করেছে, যারা রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে, যারা তাদের হাতে লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত পতাকা দিয়েছে, তারাও সমান অপরাধী। তিনি বলেন- ‘এদের বিচার হতে হবে। আমি মনে করি, সময় এসে গেছে, দেশবাসীকে সোচ্চার হতে হবে।’ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে নিজামীর রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘একাত্তরে ন্যক্কারজনক ভূমিকার পরও এই যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেওয়া ছিল ‘লাখো শহীদদের প্রতি চপেটাঘাতের’ শামিল।’ এখনো যুদ্ধাপরাধীরা তাদের ফণা দেখাচ্ছে। সেই হায়েনা আশরাফুজ্জামান খান এখন আমেরিকায়, খান মঈনুদ্দীন ইংল্যান্ডে এখনো বহাল তবিয়তে আছে। এদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে সরকারকে তৎপর থাকতে হবে। বিজয়ের বাংলাদেশে আজ চারিদিকে মুখ থুবড়ে পড়ছে মানবতাবাদ। নাসিরনগর, গাইবান্ধায় আজ যে আক্রমণ হচ্ছে- তা কিসের আলামত? শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আওয়ামী লীগের আলোচনা অনুষ্ঠানে শহীদ চিকিৎসক আলীম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী বলেছেন, ‘আমি আপনাদের কাছে জানতে চাই, আপনারা যদি সোনার বাংলা আর বঙ্গবন্ধুর আদর্শের লোক হন; তাহলে মুক্তিযোদ্ধার গায়ে কীভাবে রডের বাড়ি পড়ে?’

গত ১৮ অক্টোবর ২০১৬ ঝিনাইদহের শৈলক‚পায় জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা মুক্তার আহমেদ মৃধার ওপর হামলার প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ দলটির নীতিনির্ধারকদের সামনেই এ প্রশ্ন তুলে ধরেন তিনি। উল্লেখ্য, মুক্তার মৃধার পরিবারের অভিযোগ, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সংসদ সদস্য আব্দুল হাই এবং শৈলক‚পা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোনা সিকদারের অনুসারীরাই সেই সন্ধ্যায় ওই হামলা চালিয়েছিল। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের কাছে এই ফরিয়াদ গোটা দেশবাসীর। ক্ষমতার উষ্ণতায় আপনারা দয়া করে ন্যায়নীতি ভুলে যাবেন না। বাংলাদেশ আজ অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে গেছে। এর আরেকটি প্রমাণ আমরা সদ্য পেয়েছি। পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতাপ্রত্যাশী বেলুচিস্তানের নেতা মীর সুলেমান দাউদ জান আহমেদজাই বাংলাদেশ সরকারের সমর্থন চেয়েছেন। ‘কালাতের খান’ উপাধিতে পরিচিতি স্বেচ্ছা নির্বাসিত এই বেলুচ নেতা বলেছেন, ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানের ‘দখলদারিত্বে’ আছেন তারা। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এক সাক্ষাৎকারে আহমেদজাই বলেছেন, ‘তারা (পাকিস্তান) তোমাদের (বাঙালি) সঙ্গে যে নিষ্ঠুরতা করেছে, সেই একই কাজ আমাদের সঙ্গে করছে।’

বেলুচিস্তানের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাতে ২০০৭ সাল থেকে ব্রিটেনে অবস্থান করছেন আহমেদজাই। সেখান থেকেই তিনি ঢাকায় এসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের একটি সেমিনারে অংশ নিতে। তিনি বলেছেন, বেলুচিস্তানের ২৫ হাজারের বেশি মানুষ নিখোঁজ এবং দশ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত। প্রথম মানুষ নিখোঁজ হয়, তারপরে তাদের পাওয়া যায় জঙ্গলে নির্যাতিত, বুলেটবিদ্ধ। হ্যাঁ, আমি আজো মনে করি বাংলাদেশকে ১৯৪৭ সালেই মুক্ত হওয়া উচিত ছিল পাকিস্তানের খপ্পর থেকে। এই বেলুচ নেতা বলেছেন- ‘এ ক্ষেত্রে আপনারা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন আমরাও সে ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি। আপনারা ভাগ্যবান আপনাদের জাতির জনকের জন্য, যিনি নিজেকে উৎসর্গ করতে পেরেছিলেন এবং আপনারা নিজেদের দেশ পেয়েছেন।’ সেই বাংলাদেশটিকে সুরক্ষা করা সবার দায়িত্ব। আমার মনে পড়ছে আজ থেকে বিশ বছর আগে একটি কবিতা লিখেছিলাম এ রকম-

‘আর কত মৃত্যু হলে নগরে ঘোষিত হবে মহামারী,

আর কত ভাঙন এলে আমরা তাকে বলবো মহাপ্রলয়!

আর কত শিশু রক্তাক্ত হলে আমরা তাকাবো

খোলা আকাশের দিকে। কিংবা আর কত নারী ধর্ষিতা

হলে আমরা খুঁজবো আততায়ী হায়েনার নখ!’

কবিতার এমন পঙ্ক্তি আমরা অনেকেই আজো লিখছি। কিন্তু আমাদের সমাজ, আমাদের মনন পরিশুদ্ধ হচ্ছে কি? এই দেশের সিংহভাগ মানুষ মনে করেন, অসাম্প্রদায়িকতার দেশে জঙ্গিবাদের কখনোই ঠাঁই হবে না। ধর্মপ্রাণ মানুষরা এ বিষয়ে সজাগ রয়েছেন। তারা বাংলাদেশকে ভালোবাসেন। এ দেশের প্রতিটি নাগরিক জঙ্গিবাদকে মানবতার শত্রু বলে মনে করেন। বাংলাদেশের জন্য, বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ হচ্ছে, বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেসকোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক এই সংস্থা অতি সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে এই স্বীকৃতির কথা জানিয়েছে।

ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় শেষ হওয়া ইউনেসকোর ‘স্পর্শাতীত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবিষয়ক আন্তঃরাষ্ট্রীয় কমিটি‘র (ইন্টার গভর্নমেন্টাল কমিটি অন ইনট্যানজিবল হেরিটেজ) ১১তম সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আমাদের জাতিগত এই ঐক্যের ঐতিহ্য ধরে রাখতে হবে। আমাদের সংস্কৃতিতে মানবতাবাদের বীজ বপন করে যেতে হবে। মনে রাখা দরকার, একটি মহল এখনো বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে খুব সচেতনভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এদের বিষয়ে প্রজন্মকে সচেতন থাকতে হবে।
----------------------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ শনিবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৬

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.