![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]
আল জাজিরা’র ভিডিও ফুটেজ ও সাঁওতাল উচ্ছেদপর্ব
ফকির ইলিয়াস
----------------------------------------------------------------------------
আল জাজিরা টিভির একটি ভিডিও ফুটেজ আবার বিশ্বব্যাপী আলোচনায়। দৃশ্যটি আল জাজিরার একটি প্রতিবেদনের। তাতে দেখা যাচ্ছে- বাংলাদেশ পুলিশের কয়েকজন সদস্য সাঁওতাল বস্তিতে আগুন দিচ্ছেন। গত ৬ নভেম্বর ২০১৬ গাইবান্ধার সাহেবগঞ্জে চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ও সাঁওতালদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় সাঁওতালদের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের খবরও প্রকাশিত বিভিন্ন গণমাধ্যমে। এ ঘটনার জন্য সাঁওতালরা স্থানীয় গ্রামবাসীকে দায়ী করেছিলেন। কিন্তু এ ভিডিও পাল্টে দিয়েছে সকল ধারণা। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা’য় প্রচারিত এক ফুটেজে দেখা যায়-পুলিশ সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছে।
আল জাজিরা দাবি করেছে, বারবার চেষ্টা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার মন্তব্য তারা পায়নি। ইউটিউব চ্যানেলে ‘বাংলাদেশ সাঁওতাল ট্রাইব ফাইটিং অথরিটিজ ইন অ্যা ল্যান্ড ডিসপিউট’ শীর্ষক ভিডিও ক্লিপসটিতে জাতিগোষ্ঠীটির বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। ২ মিনিট ২০ সেকেন্ড ব্যাপ্তির ওই ভিডিওতে ৩৮ সেকেন্ডে একজন পুলিশ সদস্যকে একটি ঘরে আগুন জ্বালাতে দেখা গেছে। তিনি আগুন জ্বালাতে ব্যর্থ হওয়ায় তাকে সাদা পোশাকধারী দুই ব্যক্তি সহায়তা করছেন। এ ভিডিওটি বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে আসার পর, সেটি সঠিক নয় বলে দাবি করেছে স্থানীয় পুলিশ। তবে একইসঙ্গে তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা বলছে।
চিনিকলের বিরোধপূর্ণ জায়গা থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদের ঘটনা নিয়ে আল-জাজিরা টেলিভিশনে যে প্রতিবেদন প্রচার হয়, সেখানে ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, সাঁওতালদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হচ্ছে। সাঁওতালদের বসতির পাশেই দাঁড়িয়ে অনেক পুলিশ গুলি করছে এবং কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ছে। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে তাদেরই মধ্য থেকে মাথায় হেলমেট এবং বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরা একজন পুলিশ সদস্য সাঁওতালদের বাঁশ এবং ছনের তৈরি ঘরের কাছে গিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। মুহূর্তেই আগুন ধরে যায় এবং পাশের ছনের ঘরগুলোতে তা ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে সিভিল ড্রেসে কয়েকজনকে জনকে দেখা যাচ্ছে।
গাইবান্ধার পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, পুলিশ বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়নি। এরপরও তারা ভিডিওটি খতিয়ে দেখবেন। তিনি বলেছেন, ‘আগুন লাগার খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে গিয়েছে। আগুনের পাশে হয়তো পুলিশকে দেখা যেতে পারে। কারণ পুলিশ আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছে। এবং পুলিশ দমকল বাহিনীকে ডেকেছিল।’
তিনি আরো বলেন- ‘দমকল বাহিনীও সেখানে গিয়েছিল। ততক্ষণে হয়তো ছোট ছোট কিছু ঘর পুড়ে গেছে। ফলে পুলিশের আগুন লাগানোর বিষয় সঠিক নয়। এরপরও ভিডিওটি খতিয়ে দেখা হবে।’
এদিকে সেখানকার সাঁওতালদের একজন নেতা সেলিমন বাস্কে বলেছেন, ‘পুলিশের সঙ্গে যখন সংঘর্ষ হচ্ছিল তখন, একপর্যায়ে আমাদের চোখের সামনেই প্রথমে পুলিশ আমাদের ঘরে আগুন দেয়। ভিডিওর ছবি সঠিক এবং আমরা মামলাতেও তাই বলেছি।’
এখানে উল্লেখ করা দরকার, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান এবং আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সদস্যরা ইতোমধ্যে গোবিন্দগঞ্জে ঘটনাস্থলে গিয়ে সাঁওতালদের নিয়ে গণ-শুনানি করেছেন। সাঁওতালরা তীর ধনুক এবং লাঠি নিয়ে সেই শুনানিতে অংশ নিয়েছিলেন। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেছেন, মামলা থাকায় ভয়ের কারণে তারা তীর ধনুক নিয়ে শুনানিতে আসার কথা তাদের জানায়। তিনি আরো বলেন, সাঁওতালদের উচ্ছেদের ঘটনা আইনগতভাবে হয়নি। কারণ যথাসময়ে নোটিশ না দিয়ে উচ্ছেদ করা হয়েছে। শুনানি থেকে তারা এ চিত্র পেয়েছেন।
এদিকে, উচ্ছেদের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠনের ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনের আদেশে সাঁওতালদের ‘বাঙালি দুষ্কৃতকারী’ বলা হয়েছিল, এ নিয়ে এক রিট মামলায় হাইকোর্টের তলবে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক আদালতে হাজির হয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন।
এখানে যে বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া দরকার, তা হলো সাঁওতালরা বাংলাদেশের নাগরিক। তাদের এভাবে উচ্ছেদ কিংবা নির্যাতন করা হবে কেন? পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে, সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রামের ১ হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি ১৯৬২ সালে অধিগ্রহণ করে রংপুর চিনিকল কর্তৃৃপক্ষ আখ চাষের জন্য সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার গড়ে তুলেছিল। সেই জমি ইজারা দিয়ে ধান ও তামাক চাষ করে অধিগ্রহণের চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ তুলে তার দখল ফিরে পেতে আন্দোলনে নামে সাঁওতালরা।
যে প্রশ্নটি আসছে, কে চুক্তি ভঙ্গ করেছে ? সরকার, না জনগণ? যদি সরকার করে থাকে তাহলে মানুষের উপর এমনভাবে হামলা হলো কেন?
চুক্তি ভঙ্গ করার কারণেই সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মে বিরোধপূর্ণ চিনিকলের জন্য অধিগ্রহণ করা ওই জমিতে কয়েকশ’ ঘর তুলে সাঁওতালরা বসবাস শুরু করেন। গত ৬ নভেম্বর চিনিকল কর্তৃপক্ষ জমি উদ্ধার করতে গেলে সংঘর্ষ বাঁধে। সংঘর্ষের সময় সাঁওতালদের বাড়িঘরে লুটপাট হয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায়। ওই ঘটনায় নিহত হন তিন সাঁওতাল, আহত হন অনেকে।
অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, একটি ‘স্বার্থান্বেষী মহল’ জমি উদ্ধার করে দেওয়ার কথা বলে সাঁওতালদের সংগঠিত করে চিনিকলের জমিতে অস্থায়ী স্থাপনা তৈরি করিয়েছিল। ওই জমি অবৈধ দখলমুক্ত করতেই উচ্ছেদ অভিযান চালাতে হয়েছে। উচ্ছেদের পর মাদারপুর গ্রামের গির্জার সামনে যে মাঠে অনেক সাঁওতাল আশ্রয় নিয়েছেন, সেখানে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান রিয়াজুল হক বলেছেন- সংবিধান অনুযায়ী এদেশে সাঁওতাল, গারো, চাকমা, হিন্দু, মুসলিম সকলের সমান অধিকার। কিন্তু সাঁওতাল পল্লিতে সরকারি উদ্যোগ ‘যথেষ্ট হয়নি’।
‘চিনিকল বন্ধ কিংবা অন্য কোনো কারণে মিলের জমি যদি লিজ দিতে হয়, তবে তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সাঁওতালদের দিতে পারতো। কিন্তু কোনোভাবেই প্রভাবশালীদের দেওয়া ঠিক হয় নাই’ কথাগুলো যোগ করেছেন তিনি।
বাংলাদেশে আদিবাসীদের বিভিন্নভাবে কারা নির্যাতন করছে? এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া দরকার। চিনিকলের জমি থেকে সাঁওতালদেরকে উচ্ছেদের ঘটনায় স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ ও উপজেলার চেয়ারম্যান আবদুল লতিফের হাত আছে বলে অভিযোগ করেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। তারা জানিয়েছেন, সাঁওতালদের উচ্ছেদ করা হলেও চিনিকলের ওই এলাকায় জায়গায় সংসদ সদস্যের ১৫টি পুকুর রয়েছে। রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করে এ অভিযোগ করে নির্মূল কমিটি। ওই জমি থেকে সাঁওতালদের শতাধিক বাড়িঘর উচ্ছেদ করা হয়। এ সময় তাদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এ ঘটনার তদন্তে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শামসুল হুদার নেতৃত্বে একটি দল পাঠায় নির্মূল কমিটি। কমিটির স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে গণশুনানিও করে তারা। এ অভিজ্ঞতাই তারা সাংবাদিকদের জানাচ্ছেন।
বিচারপতি শামসুল হুদা বলেন, ‘গোবিন্দগঞ্জের হামলায় এমপি ও চেয়ারম্যানের জড়িত থাকার বিষয়টি মদদ ছিল স্পষ্ট’। তিনি বলেন, ‘চুক্তিতে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে আখ চাষ না হলে সে জমির মালিকদের ফেরত দিতে হবে। কিন্তু দেওয়া হচ্ছে না।’
বিরোধপূর্ণ জমিতে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার সমালোচনা করে শামসুল হুদা বলেন, ‘এটা কি বাংলাদেশ-ইন্ডিয়ার বর্ডার যে তারকাটা দিয়ে বেড়া দিতে হবে। এটা মানবাধিকারের চরম লংঘন।’
সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন করা, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন এবং আলাদা সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠনের দাবিও জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে। সেই সংবাদ সম্মেলনে শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘২০১২ সালে রামুতে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যায়নি।’ তিনি বলেন, ‘হামলাকারী যে দলেরই হোক না কেন, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আমরা দাবি করেছিলাম। দাবি করেছিলাম তাদের সম্পত্তি যেন বাজেয়াপ্ত করা হয়। কিন্তু কোনোটাই তো হয়নি বরং তারা পুলিশের দুর্বল চার্জশিটের কারণে সবাই জামিনে বেরিয়ে গেছে। হামলার শিকাররা মামলা প্রত্যাহারও করে নেয়। আমরা একই দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর ও গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে।’
শাহরিয়ার কবির বলেন, নাসিরনগরে মাদ্রাসা থেকে মৌলবাদীরা ও হেফাজতিরা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়েছে। ব্যবহার করেছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে।’
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর হামলার নিন্দা জানিয়ে শাহরিয়ার কবির বলেন, জামায়াত ও পাকিস্তান মিলে রোহিঙ্গাদের ব্যবহারের চেষ্টা করছে। জামায়াত রোহিঙ্গাদের তালিকা করে জিহাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করছে। ২০০৬ সালে এরকম ১৭টি জিহাদি সংগঠনের কথা প্রকাশ করা হয়েছিল বলেও উল্লেখ করেন শাহরিয়ার।
ইসলামী ব্যাংক জঙ্গিদের জিহাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে অভিযোগ করে শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘জামায়াতের নিয়ন্ত্রণে ও পাকিস্তানে বসে থাকা কুদ্দুসের নেতৃত্বে হরকাতুল জিহাদ আরাকান সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।’
বাংলাদেশের জন্য এগুলো খুবই ভয়াবহ সংবাদ। এমনভাবে নিগৃহীত হওয়ার জন্য মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেনি। সকল জাতি-ধর্মের মানুষের রক্ত সেদিন একাকার হয়ে গিয়েছিল। তাহলে আজ আদিবাসীরা এমনভাবে রক্তাক্ত হবে কেন?
আল জাজিরার এ ফুটেজের সত্যতা খতিয়ে দেখা দরকার। কারা এর নেপথ্যে ছিল তা শ্বেতপত্র আকারে প্রকাশ করা দরকার। বাংলাদেশে এখন চলছে ভোগ-বিলাস-দখলের খেলা। সরকারি উষ্ণতা গায়ে নিয়ে যারা দখলদারি করছে- তাদের ব্যাপারে সরকারকে কঠোর হতে হতে হবে। এদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। তা না করতে পারলে আমাদের বিজয়ের চেতনা বারবারই মুখ থুবড়ে পড়বে। আর শক্তিশালী হবে এর প্রতিপক্ষ।
------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক খোলাকাগজ ॥ ঢাকা ॥ ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬ সোমবার
©somewhere in net ltd.