![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মানব উন্নয়ন
মানব উন্নয়নে আমরা এ প্রসঙ্গে লেখা শুরু করার আগে প্রথমে মানব উন্নয়ন বলতে কি বুঝায় এ বিষয়টা জেনে নেয়া আবশ্যক। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। পৃথিবীতে অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে মানুষই জ্ঞানে-গুনে সবার সেরা। এ শ্রেষ্ঠত্বের জন্য বিশ্ব জয় করার নিমিত্বে ছুটে চলেছে গ্রহ থেকে গ্রহ্ন্তারে। এ জ্ঞানের বদৌলতে আজ মানুষ চাদে পাড়ি জমিয়েছে পৌছেছে মঙ্গল গ্রহে।
কোন এক সমাজে যদি গুটি কয়েক মানুষের সম্পদের পাহাড় , আকাশ চুম্বি অট্টালিকা, রাতের লাল নীল আলোর মাঝে মদ ভর্তি গ্লাসের টুং টাং শব্দ, পরনে দামি মখমলের কাপড় , কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে এসি গাড়িতে করে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে দৌড়ানো অন্যদিকে সেই সমাজের অধিকাংশ মানুষ পেটে ভাত নেই, মাথা গোজার ঠাই নেই, না খেয়ে মরছে অনাহারে অর্ধাহারে। ক্ষিধের জ্বালায় ডাস্টবিনের মধ্যে কুকুরের সাথে কামড়া কামড়ি করে খাবার সংগ্রহ করছে। থাকার জায়গা না থাকায় জীবনের ঝুকি নিয়ে, রোদ, ঝড় , কিংবা প্রচন্ড শীতের মধ্যেও রাস্তার আইল্যান্ডে কুন্ডুলী পাকিয়ে পড়ে থাকে। লজ্জা নিবারনের জন্য যে সমাজের মেয়েরা গায়ে জাল জড়িয়ে রাখে। পেটের তাড়নায় বই খাতার পরিবর্তে যে সমাজের শিশুদের হাতে ইট ভাংগা হাতুড়ি কিংবা ঠেলাগাড়ীর হাতল। এমন সমাজ চিত্র দেখে আপনি কী বলবেন? আপনি কি একে উন্নত সমাজ বলবেন? বলবেন কি এ সমাজ একটি আদর্শ সমাজ? নিশ্চয়ই না।
মানবউন্নয়ন বলতে শুধু মাত্র একজন মানুষ কিংবা গুটি কয়েক মানুষের আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া কিংবা আকাশ চুম্বি সুরম্য অট্টালিকার মালিক হওয়া আর নাইট ক্লাবে গিয়ে মদের গ্লাসে শব্দ তুলে, সিগারেটের ধোয়ায় মানুষের বিবেককে ধোয়াচ্ছন্ন করে কোমরে ঢেউ তোলাকে বুঝায় না। মানব উন্নয়ন বলতে গোটা মানব গোষ্ঠির উন্নয়ন কে বোঝায়। সেখানে কিছু লোক বিদেশি রেষ্টুরেন্টে চাইনিজ এর মধ্যে নাক ডুবিয়ে রাখবে আর অন্য দিকে কিছুলোক ডাষ্টবিনে কুকুরের সাথে ভাগাভাগী করে খাবার সংগ্রহ করবে, কিছুলোক অট্টালিকার উপরে এসি ঘরে সোনার খাটে ঘুমাবে অন্য দিকে ঝড়ের মধ্যে কিংবা প্রচন্ড শীতে কিছু লোক রাস্তার আইল্যান্ডে পড়ে থাকবে তা হতে পারে না। মানব উন্নয়নের কথা চিন্তা করতে গেলে শুধু মাত্র নিজের কিংবা নিজের পরিবার , সমাজ, দেশ, কিংবা ধর্ম এ সমস্ত সংকির্ন মানসিকতা থাকলে চলবে না। মানব উন্নয়ন বলতে গোটা মানব গোষ্টির উন্নয়নকে বুঝায়। কে মুসলিম , কে হিন্দু , কে চাকমা, কে গারো , কে কোন জেলার, কিংবা কোন বংশের তা বিবেচ্য বিষয় নয়। এখানে মূল বিষয় আমরা মানুষ কাজ করতে হবে মানুষের কল্যানে।
কোন আমের ক্ষেতে গুটি কয়েক আমগাছ যদি আকারে অনেক বড় হয় আবার সেই গাছের নিচেই যদি অসংখ্য ছোট ছোট আমের চারাগাছ থাকে তবে এমন ক্ষেতকে আমের বাগান বলা চলেনা। তেমনি কোন সমাজে গুটি কয়েক মানুষ যদি অনেক ধনী হয়, সম্পদ শালী হয়, যে তার ধন সম্পদের হিসাব নিজেই জানেনা অপর দিকে তার নিচতলায় মানুষ পেটের জ্বালায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকে, দু পায়ে দাড়ানোর শক্তি যার নাই এমন সমাজকে উ্ন্নত সমাজ বলা যায় না। যখন ক্ষেতের সবগুলো গাছ সমান সুযোগ নিয়ে বেড়ে উঠবে সবগুলো গাছের পানি, আলোবাতাস, পাওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ থাকবে এবং সবগুলো গাছ এক সাথে বেড়ে উঠবে তখনই তাকে বাগান বলা যাবে। তেমনি সমাজের সকল মানুষ যখন বেচে থাকার জন্য তাদের চাহিদা মোতাবেক পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা পাবে, শান্তিতে খেয়ে পরে বেচে থাকার অধিকারটুকু নিশ্চিৎ করতে পারবে তখনই সে সমাজকে উন্নত সমাজ বলা যাবে।
এখন প্রশ্ন করতে পারেন নিজের খেয়ে কেনই বা বাপু আমি অন্যের গীত গাইতে যাবো? আমি আমার নিজের কথা চিন্তা না করে কেনই বা অন্য দশ জনের কথা চিন্তা করবো?
উত্তরে আমি বলবো কৃতজ্ঞতাবোধের জন্য দায়িত্ব বোধের জন্য।
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ বা সংঘবদ্ধ হয়ে বসবাস করা মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট। শুধু মাত্র মানুষ নয় জঙ্গলের বাঘ, ভাল্লুক, হরিন, হাতি , জিরাফ এরাও কিন্তু জঙ্গলে দলবেধে চলে। আকাশে পাখিরা ঝাকবেধে ওড়ে। পানিতে মাছেরা ঝাকবেধে ছোটে। কোন হিংস্র প্রানী আক্রমন করলে দলবেধে তা প্রতিহত করার চেষ্টা করে। কোন শিকার ধরলে সবাই মিলে ভাগ করে খায়। মানুষও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রাচীন কালথেকে মানুষ সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করছে। একে অন্যের সুখ দুঃখের অংশিদার হয়েছে। এক সাথে শিকার ধরেছে, ভাগ বাটোয়ারা করে খেয়েছে। সময়ের ঘুর্নিচাকায় মানুষের জীবন মানও ঘুরে এখন সভ্যতার যুগে এসে দাড়িয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে এ পর্যন্ত মানুষ যদি মানুষের সহয়তায় এগিয়ে না আসতো, পরষ্পর পরষ্পরের সহযোগী না হতো তাহলে মানুষের বেচে থাকাই দুষ্কর হয়ে যেত। একটা শিশু জন্ম গ্রহন করার পর থেকে শুধু মাত্র তার মা-বাবার লালন পালনেই বড় হতে পারে না। তার লালন পালন তার বেড়ে ওঠার পেছনে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা, পাড়া পড়শী, সমাজ তথা দেশের মানুষের বিরাট অবদান রয়েছে। আপনার কথাই চিন্তা করুন আপনি যখন ছোট ছিলেন সব সময়ই আপনার পিতা মাতা আপনাকে কোলে তুলে রেখেছে বিষয়টি এমন নয়। আপনার পড়শীরাও আপনাকে কোলে নিয়েছে, আদর করেছে, আপনার দেখাশোনা করেছে। আপনি যাতে করে পানিতে না যান, আগুনে হাত না বাড়ান, রাস্তার উপরে গাড়ীর নিচে না পড়েন এ বিষয়ে কারা আপনার দেখাশোনা করেছে? যদি বা কোন শিশু পানিতে পড়ে, তখন পরশীরা ই তো সবার আগে ছুটে আসে শিশুটিকে বাচানোর জন্য। আপানার ছোট বেলায় আপনার পরশীরাই আপনার খেলার সাথী হয়েছিল আপনার মানসিক বিকাশের জন্য। আপনাদের বাড়ীতে চোর, ডাকাত পড়লে, আগুন লাগলে কারা এগিয়ে আসে আপনার সাহায্যে ? আপনার পরশীরাই। আবার হয়তো ছোটবেলায় আপনি স্কুলে যাবার সময় রাস্তা ভাংগা থাকার কারনে পার হতে পারছিলেন না তখন কাধে করে ওপাড়ে পৌছে দিয়ে কে আপনাকে পড়ালেখা করার সুযোগ করে দিয়েছিল? আপনার মাতৃভাষা; যে ভাষায় আপনি আপনার মাকে ডাকেন নিজেদের জীবন দিয়ে কারা সে ভাষাকে আপনার মুখে ফিরিয়ে দিয়েছে? দেশে আপনার স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠা,নিজের অধিকার নিয়ে বেচে থাকার জন্য জীবন দিয়ে যুদ্ধ করে কারা আপনাকে স্বাধীন দেশ দিয়েছে? নিশ্চয়ই আপনার সমাজ আপনার দেশের মানুষেরা। তাদের এ আত্মত্যাগের কি কোন মূল্য নেই ? তাদের জন্য কি আপনার কোন দায়বদ্ধতা নেই? তাদের এ ত্যাগের জন্য কি আপনার মোটেও কৃতজ্ঞতাবোধ নেই? সেই কৃতজ্ঞতা ব্ধো সেই দায়িত্ব বোধ থেকেই আপনি শুধু মাত্র আপনার নিজের কথা চিন্তা না করে আপনার সমাজের কথা ভাববেন, আপনার দেশের কথা ভাববেন, গোটা মানব উন্নয়নে মানব কল্যানের কথা ভাববেন।
একজন কৃষক তার গাছের পরিচর্যাকালে পর্যাপ্ত পরিমান পানি সর্বরাহ করেন। আলো বাতাসের দরকার পড়লে আগাছা কেটে আলো বাতাসের ব্যবস্থা করেন। গাছে যাতে পোকা না ধরে সে জন্য বালাই নাশকের ব্যবস্থা করেন। ঝড়ে যাতে গাছ পড়ে না যায় সে জন্য গাছের গোড়ায় মাটি দেন, গাছের গোড়ায় শক্ত খুটি গেড়ে বেধে দেন। গরু ছাগলে যাতে গাছটি খেয়ে না ফেলে এ জন্য ক্ষেতের চারপাশে বেড়াদিয়ে গাছকে রক্ষা করেন। গাছের পেছনে কৃষকের এই যে মেহেনত, এই যে হাড় ভাংগা পরিশ্রম! গাছ ও তার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে ফুলে ও ফলের ভারে নুইয়ে পড়ে কৃষকের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। বনের বৃক্ষ হয়ে যদি এই ভাবে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে পারে তবে আমরা মানুষ হয়ে আমাদের যারা পরিচর্যা করেছে, সুন্দরভাবে বেচে থাকার পরিবেশ তৈরী করে দিয়েছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মানব উন্নয়নের জন্য কাজ করতে পাররো না।
আবার অনেকে সমাজের তথা দেশের মানুষের এই ত্যাগ তিতিক্ষার কথা ভুলে অকৃতজ্ঞের মতো তার প্রতি সমাজ ও দেশের তথা মানবতার সকল আকাঙ্খাকে জলানজলি দিয়ে সন্ন্যাস অথবা বৈরাগ্যকে গ্রহন করে। স্বার্থপরের মতো সে সমাজ তথা মানবতার প্রতি তার দায়িত্ব কর্তব্য ভুলে গিয়ে নিজের মেধা ও যোগ্যতার কবর রচনা করে। সে মানবতার কল্যানে কোন কাজেই আসে না। এমন ব্যাক্তিকে আসলে মানুষ বলা যায় না। মানুষের ধর্ম হয় সে মানব কল্যানে কাজ করবে নয়তো মানবতা ধংশের জন্য কাজ করবে। হয় সে ভাল কাজ করবে নয়তো মন্দ কাজ করবে।,তাকে যেটাই হোক একটা কিছু করতেই হবে। ভাল অথবা মন্দ , কল্যান অথবা অকল্যান এ দুয়ের মাঝামাঝি থাকার কোন স্থান নাই। মিথ্যা বলা মাহা পাপ। হয় মানুষ সত্য বলবে অথবা মিথ্যা বলবে। আর যে মানুষ কথাই বলেনা সে সত্যবাদীও নয় মিথ্যাবাদীও নয়। তেমনি যে মানুষ মানবতার কল্যানে কাজ করেনা অকল্যানেও কাজ করেনা শুধু সন্ন্যাসী হয়ে বসে থাকে সে আসলে মানুষই নয় সে অকর্মান্য অকালকুষ্মান্ড। সুতরাং এ কথা পরিষ্কার মানুষ তার মানবতাবোধের প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে মানব উন্নয়নে কাজ করবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে গোটা মানব সমাজ যদি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী হয়। সমাজের উচু ও নীচু স্তরের মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য যদি কমে যায়। সকলে খেয়ে পরে বেচে থাকতে পারে । এমন সমাজকে কি আপনি উন্নত সমাজ বলবেন? হয়তে বলবেন হ্যা অথবা বলবেন না। কিন্তু আমি বলবো না এমন সমাজ কে উন্নত সমাজ বলা যায় না। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই কোন সমাজের উন্নয়নের পরিচায়ক নয়। সমাজ উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি প্রয়োজন সাংস্কৃতিক, মানসিক ও জ্ঞান-গরিমার উন্নতি। শুধুমাত্র মানব উন্নয়ন মানব উন্নয়ন বলে চিৎকার চেচামেচী করে কিংবা টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে বসে জ্ঞান গর্ভ আলোচনার খৈ ফুটালেই মানব উন্নয়ন হয়না। মানব উন্নয়ন করতে গেলে আলোচনার পাশাপাশি কাজে হাত দিতে হয়।
©somewhere in net ltd.