নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জীবনের নিগূঢ় সত্যটি হচ্ছে, কখনো এমন কোনো আবেগকে প্রশ্রয় না দেয়া যা অশোভন।

মোস্তফা অভি

আমি ফেরী করি, আমি ফেরীওয়ালা।

মোস্তফা অভি › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প : "বাজপাখির পুনর্জন্ম" গোলাম মোস্তফা অভি

০৯ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ৯:০৩

সমুদ্র তটের উপর টুকরো মেঘের মতো ছায়াটা ঘুরপাঁক খায়। কখনো জলের ভিতর, কখনো তটে। ছায়াটা কুন্ডুলী পাঁকিয়ে ঘোরে। বাজ পাখিটা যখন তার দীর্ঘ পাখা প্রসারিত করে ওড়ে তখন ছায়াটা সমুদ্রতটে দীর্ঘ কাড়া হয়ে পড়ে। খাঁ খাঁ রোদ্দুরে ও একাকী ওড়ে সমুদ্রের তটে কখনো সমুদ্রের নীল জলের উপর। বেঁকে বেঁকে পাঁক খেয়ে উড়ে যায় জলের থেকে অনেকটা উপরে। নিচে তাকিয়ে ও সমুদ্রের ছোট এবং মাঝারি মাছের চলার গতি পরখ করে। বেশ ক'টি তা দেওয়ার পর ও হতাস হয়। কোথাও ও শিকার দেখতে পায়না। সমুদ্রের নীল জলে ও মাছ খুঁজে বেড়ায়। তীক্ষ্ণদৃষ্টি দিয়ে অতি সন্তর্পনে তাকায় নিচে, একেবারে নীল জলের গভীরে। যেখানে ঝাঁকবাঁধা মাছেরা খেলা করে। একসাথে সাঁতরে চলে, আবার ডুব দেয় সমুদ্র অতলে।

আজ বাজ পাখিটা অনেক পরিশ্রান্ত। প্রচন্ড রোদ একটুও বিরাম দেয়নি। এতটুকু ফুসরৎ পায়নি একটা ছোট সামুদ্রিক মাছের আশায়। উনচল্লিশ বছর বয়সের কোঠা অতিক্রম করেছে ক'দিন আগেই। সূর্যের প্রখর তাপ আর পাখাটা ছড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ উঁড়ে ও পরিশ্রান্ত। শেষে বাধ্য হয়েই বিশ্রাম নিতে হয়। তটের কাছে ছৈলা বনের আড়ালে ঝোপের আরো ভিতরে শিশু গাছটির ডালে। সেখানে বসে একবার চোখ ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখে নেয়। মাথাটা বাঁকিয়ে তাকায় কখনো সমুদ্রের নীল জলে, কখনো নিজের শরীরে। বাঁকা ঠোঁট দিয়ে বুকের নিচে খোটে। গলাটা ঘষে পালকের সাথে। নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে নেয় প্রকৃতির চিরকালীন স্বভাব। মনে মনে ভাবে নিজের অক্ষমতার কথা। ও এখন ক্লান্ত, বয়সের ভারে নুয্য। ধারালো ছুরির ফলার মতো ঠোঁট বাঁকা হয়ে গেছে। পাখনা আর আগের মতো সোজা করে উড়তে পারেনা। বাঁকা হয়ে বুকের সাথে মিশে যায় ডানা দুটো। নখগুলো হয়ে গেছে লম্বা আর নরম, ধার নেই আগের মতো। ভোতা কাস্তের আলের মতো আলগা হয়ে যায় নখগুলো। কোনো কিছু ধরে সামলাতে পারেনা। মাথাটা নুইয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে ভাবে অতীতের স্মৃতিগুলো।হারিয়ে যায় স্মৃতিময় সোনালী অতীতে।ওখন ওর বয়স ছিল কুঁড়ি। পাখায় ছিল ক্ষিপ্রতা, শরীরে ছিল প্রবল তেজ। শক্ত, বলীয়ান,ত্যাজী ছিল ডানাগুলো। সবুজ জলে ভেসে ওঠা মাছ দেখত দূর থেকেই। ক্ষিপ্র হয়ে ঝাপিয়ে পড়ত সাঁতরে চলা মাছের উপর। প্রচন্ড গতি নিয়ে বর্শার ফলার মতো বিদ্ধ করে দিতে মাছের শরীরে ওর ধারালো ঠোঁট। সূঁচের মতো নখগুলো ঢুকিয়ে দিত মাছের শরীরে। তখন পাখনা ছিড়ে বুকটা ফুটো হয়ে হৃদপিন্ডের মধ্যে ঢুকে যেত ধারালো নখ। মাছটি ছটফট করতো দু'পায়ের ফাঁকে, বাঁচার জন্য প্রণপনে কত রকমের চেষ্টা! কত রকমের লাফালাফি। কত ভাবে মোড়াতো মাথাটা ঘুরিয়ে। কখনো ছাড়িয়ে নিতে পারেনি নিজকে। মাছটাকে অসহায় করে পায়ের নখ আমুলে বিদ্ধ করে উঁড়ে উঁড়ে গাছের ডালে গিয়ে বসত। তারপর চলত ঠোঁটের কাজ। মাথাটা এদিকে ওদিকে ঘুরিয়ে ছুরির ফলার মতো ঠোঁট দিয়ে ঠোকর দিয়ে খেত টাটকা মাছ। বাতাসে ছড়িয়ে যেত তাজা মিষ্টি রক্তের গন্ধ। ছড়িয়ে পড়ত গাছের ডালে, পাতায়। সবুজ পাতার শিরা বেয়ে রক্তের ফোটা গড়িয়ে পড়ত নিচে। কখনো শিকারের তৃপ্তি নিয়ে নিজকে বিজয়ী মনে হত। উল্লাসে আয়োজন করে উঁড়ে বেড়াত সমুদ্র তটের থেকে দূরে সমুদ্রের আরো ভিতরে। যেখানে মাছ ধরার ট্রলার চলে সরীসৃপের মতো সমুদ্রের ঢেউয়ের তালে। তারপর একটু ক্লান্ত হলে জিরিয়ে নিত তটের কোনো গাছের ডালে পরম তৃপ্তিতে।
ওর সেই স্মৃতি এখন নোনা হয়ে গেছে সমুদ্রের জলের মতো। সাথের পুরুষ সঙ্গীটিও এখন নেই। একদিন ঝড়ের বিকেলে দুজনে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে গিয়ে বাতাসের ঝাপটায় পথ হারিয়ে ফেলে । পশ্চিমের পথ ধরে ওরা উঁড়ে যাচ্ছিল। সমুদ্র থেকে শাখা হয়ে বয়ে চলা পায়রা নদীটি পথে পড়ে। পায়রার কূল ঘেসে ওরা কোনো আশ্রয় খুঁজে পায়নি। উঁড়ে উঁড়ে পাখনায় বাতাসের ভাড়ে ক্লান্ত। তখন পুরুষ সঙ্গীটি পায়রার ওপাড়ে ফাতরার বনের দিকে উঁড়াল দেয়। সে ওপাড়ে ফাতরার বনে যেতে পেরেছিল কিনা তা জানা নেই। সেই থেকে বাজপাখিটি নি:সঙ্গ এবং একা। তারপর একা একা কেটেছে অনেক বছর। একসাথে ওড়া হয়নি কারো সাথে, শিকার নিয়ে খুনসুটি হয়নি কখনো। নিস্তব্ধ রাতে গাছের ডালে ও একা ঘুমায় । গভীর রাতে সমুদ্রের গর্জনে ভয় পেলে সঙ্গীটির কথা মনে করে অদৃশ্য কান্না করে। ভোরের বাতাসে সে নিজেকে সজীব করার চেষ্টা করে। শরীরটাকে একটু আবেগ দেওয়ার জন্য তটের জলের খুব কাছাকাছি হাঁটে। ঝাপটা দিয়ে আসা ঢেউয়ের জল পাখনায় ছুয়ে নেয়। রোদ উঠলেই শিকার খুঁজতে আকাশে ওড়ে।
বুভূক্ষু বাজপাখি ঘোলাটে চোখে সমুদ্রে তাকায়। তিনদিন গত হয়েছে একটা শিকারও পায়নি। চালাক উড়ুক্কু মাছ গা ভাসিয়ে শূণ্যে লাফিযে বেড়ায়, লোভ দেখিয়ে আবার সমুদ্রে ডুব দেয়। মাছগুলো চলে যায় অনেক গভীরে। হতে পারে সমুদ্রের নিচের শক্ত পাথরের কোল ঘেষে শেওলার আস্তরণের কাছে। সেখানে ওরা মন্থর গতিতে সাঁতার কাটে। বাজ পাখিটির চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে। কি করে মাছগুলো বাজপাখির আসা যাওয়া টের পায় কেউ জানেনা। হয়ত পাখির দীর্ঘ পাখনার ছায়া পড়ে নীল জলের তলে। নয়ত শরীরের কোন অঙ্গ দ্বারা বুঝে নেয় পাখির আসা যাওয়ার শব্দ। হয়ত তরঙ্গ ওদের সংকেত দেয়। না হলে একশ কুড়ি মাইল বেগে ছো মারা বাজ পাখির থেকে কি করে চালাক মাছগুলো নিজেদের বাঁচায়! বাজ পাখিটি তাই নিতান্ত অসহায়। বুকের লম্বা হাড়টি ওর বের হয়ে গেছে। পশমগুলি তৈলাক্ত চকচকে ভাব থেকে হয়ে গেছে ধূসর এবং তামটে। সামান্য বাতাসে বুকের পশম ছড়িয়ে যায় দু'দিকে। পায়ে জোড় নেই মোটেও, বাতাসের ঝাপটা এলে ডালে বসে থাকতে খুব কষ্ট হয়। খুব ক্লান্ত হয়ে মাথাটা বুকের একপাশে ডানার নিচে লুকিয়ে ঝিমায়। বাজপাখি আজ আরো বেশী ক্লান্ত।
ক্ষুধায় ক্লান্ত হয়ে পেট গুলিয়ে পানির মতো বমি করেছে গাছের ডালে। যে পাতা মাছের রক্তে রঞ্জিত হতো একদিন সে পাতায় ছড়িয়ে পড়ে বমন করা বিশ্রি সাদা নোনতা পানি। মাথাটা গোলায় ওর, ঢলো ঢলো হয়ে ডাল থেকে ছিটকে পড়ে যেতে চায় দেহটা। তবুও নিজেকে সামলায়। ক্লান্ত মনে নিজকে বাঁচানোর চেষ্টায় নতুন ফন্দি করে। সমুদ্রের পথ ছেড়ে ও জনপদে যাবার চিন্তা করে। গৃহস্থ ঘরের হাঁস মুরগীর ছানা মায়ের পেছনে আদূরে ভঙ্গিতে হাঁটে। ছোট পোঁকা মাকড় ঠোঁট দিয়ে খুটে খায়। সেখানে গেলে দু'একটা ছানা বাগে এনে ছোঁ মেরে উড়াল দিবে আকাশে। বেশী দূর ও যেতে পারবেনা ঠিক। সামান্য উঁচু গাছের ডালে বসে নখ দিয়ে ছানাটার পেট ছিঁড়ে খাবে। এটাই ওর বাঁচার পরিকল্পনা। অবশেষে ও বাতাসের সাথে ডানাটা মেলে ধরে। মন্থর গতিতে ডানা ঝাপটায়। পাখনা মেলতে পারেনা পুরোপুরিভাবে। এভাবেই বাজপাখি উঁড়ে চলে জনপদের দিকে।
বিকালের ম্লান রোদের আলো ওর চোখে পড়ে। সবুজ প্রান্তরের পথ ধরে ওড়ে উত্তরে। বির্স্তীণ ফসলের নগ্ন ক্ষেত খাঁ খাঁ করছে বহূদূর। আরো বহূদূরে রয়েছে মানুষের বসতি। সেখানে খড়ের ঘরে গৃহস্থরা সংসার পেতেছে। হাঁস মুরগির ছানা গুলো শুভ্র উঠানের কোনে এটা ওটা খোটায় ব্যস্ত। উঁড়তে উঁড়তে ও এসব কল্পনা করে। সে পথ আরো দূরে। সেখানে ও শেষ পর্যন্ত উঁড়ে যেতে পারবে কিনা ভাবে। হঠাৎ দেখে সমুদ্রের দিকে উঁড়ে যাচ্ছে একটি হেলিকপ্টার। ঠাঁ ঠাঁ শব্দে ওর বড় বিরক্ত লাগে। আকাশের বহূ নিচ দিয়ে উঁড়ে যাচ্ছে পাখার বাহনটি। মনে হলো, হেলিকপ্টারের পাখনাটি ওর পাখার উপর আঘাত করবে। গতিপথ পরিবর্তন করে বাজপাখি। বিলের মাঝে ছাড়া ভিটার পথ ধরে ও এগোয়। সেখানে বড় রেইনট্রি গাছের ডালের সাথে ধাক্কা খেয়ে নিজেকে সামলায় কোনো মতে। শরীর থেকে কয়েকটি পালক খসে গিয়ে বাতাসের সাথে পাল্টি খায়। ব্যাথাতুর চোখে উঁড়ে যাওয়া পালকের দিকে তাকায়। তখন হেলিকপ্টারটি সমুদ্রের কাছে চলে গেছে।
হামাগুরি দেওয়ার মতো চলে বাজপাখি । অবশেষে বিলের মাঝে একটা খড়ের ঘর আর ধবধবে সাদা উঠান দেখতে পায়। বাড়িটি খোলামেলা, সাধারণ। মনে হয় নতুন কোনো সদ্য বিবাহিত দম্পতি সেখানে ঘর বেঁধেছে। বাড়ির চারপাশে গাছপালা নেই মোটেও। তাই বাজপাখি ভরসা করতে পারেনা। কখনো বাড়ির উঠানের দিকে তাকায় কখনো বিস্তীর্ণ ফসলের খালি মাঠের দিকে । তারপর ভাবে, শিকার করতে পারলে এই বিলের কোথাও বসে আয়েশ করে খাবে। এবার ও বাড়ির উপরে কয়েকটি তা দিয়ে চোখ ঘুরায়। প্রথমে মা হাঁস মুরগি খোঁজে, কিন্তু সদ্য সংসার পাতা পরিবারটি হাঁস মুরগি এখনো পালন করা শুরু করেনি।
বাজপাখি আবার ওর গতিপথ পরিবর্তন করে। ডাইনের পথ ধরে আরো পূবে উঁড়তে শুরু করে। সামনে একটু পরপর গোল গাছের ঝোপ। আড়াল পেরিয়ে লম্বা তাল গাছের সাড়ি। উঁচু তাল গাছের মাথায় বিশ্রাম নিতে চায়। ওর ডানা ব্যাথা হয়ে গেছে। পালক ছিঁড়ে টনটনে ব্যাথাটা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। ও আর চলতে পারেনা। ওদিকে পশ্চিমাকাশে সূর্য হেলে পড়েছে সমুদ্রের তটের দিকে। দূরে সাড়ি সাড়ি গাছের আড়ালে একটু পরে টুপ করে র্সূযটা লুকিয়ে যাবে দিগন্তে। তখন এই জনপদ থেকে ওর নিজের আস্তানায় যাওয়া মুশকিল হবে। তবু ও উঁড়ে চলে খাবারের আশায় বিরামহীন আরো ধীরে।
সামনের বাড়িটি অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থের, বাড়িতে সবকটি ঘর টিনের ছাউনি। কাঁচা বাড়ির চারপাশে মাটির উঁচু কান্দি। কান্দির লাগোয়া বেড়ের কুয়ায় একটি মা মুরগী সতর্ক হচ্ছে। মাথাটা উঁচু করে আকাশের দিকে বারকয়েক তাকায়। সতর্ক শব্দ পৌছেঁ দেয় ছানাদের মাঝে। দূরে একটি ছানা কেঁচোর সাথে খেলা করছিল। সেখানে আর কোনো সহোদর নেই। ছানাটি একা, কখনো মুখে চি চি শব্দে ডাকে ভয়ার্ত হয়ে কেঁচোর শরীরে ঠোঁট দিয়ে ঠোকর মারে। তখন মা মুরগিটি বাজপাখির সংকেত পেয়ে ডানা মেলে দেয়। দূরের ছানাটি ডানার নিচে আসার আগেই বাজপাখি ঝাপিয়ে পড়ে। ওর শিকার করার জোড় নেই, একশ বাইশ মাইল গতি নেই ডানায় তবুও ও মনের জোড়ে ছোঁ মারে। দু'পায়ে নরম নঁখের ভিতর চেপে মুরগি ছানাটি নিয়ে ও আকাশে উঁড়াল দেয়। না, ও আর নিচ থেকে উপরে ওঠার শক্তি পায়না। উঁড়তে গিয়ে লুটিয়ে পড়ে। তবুও ওড়ে মনের শক্তিতে বাঁচার আশায়। অবশেষে সফল হয়। তবে কোনো উঁচু ডালে বসতে পারেনি। মা মুরগীটা ছানার জন্য ঝাপটায়। বাজপাখি তখন ক্ষীণ সাবকটির পেট ছিড়ে খেতে উদ্দত হয়। দীর্ঘ অনাহারে ওর গলা দিয়ে আহার নামেনা। ছানাটা এখনো চিঁ চিঁ করে ডাকছে। ছানাটির ছোট্ট শরীর বাঁকা ঠোঁট দিয়ে কায়দা করতে পারেনা । তবুও কোনো মতে ছিঁড়ে ছানাটির অর্ধ মৃত দেহ গোগ্রাসে গেলে। আহারের শেষ করতে পারেনি । দুর্বল পায়ের ফাঁক দিয়ে মাটিতে পড়ে যায় মৃত ছানাটির অর্ধাংশ। এঁটো মুখে ও নির্বাক বিক্ষত ছানাটির দিকে বুভূক্ষু তাকায়।
এবার ও আবার আকাশে ওঁড়ে। বিলের পথ ধরে প্রথমে ডানে তারপর গোলপাতার বনের ধারে জিরোয়। যেহেতু সেখানে ওর বসার মতো কোনো ডাল নেই তাই রাজ শাহী দরবারের বড় হাতপাখা নাড়ার গতিতে ওড়ে। প্রশারিত ডানায় ভর করে ফসলহীন মাঠে তাকায়। নির্জনা ফসলহীন প্রান্তরে কোথাও ওর সঙ্গী নেই। এই আকাশের শূণ্য পথে ও একা, শুধুই একা।
সমুদ্র পাড়ে পৌছঁতেই আঁধার ঘনিয়ে আসে। শরীরে প্রচন্ড তাপ অনুভব করে বাজপাখি। কখনো মনে হয় শরীর এলিয়ে দেয় ডালের উপর। দক্ষিণা সামুদ্রিক হাওয়া থেমে থেমে ওর গায়ে লাগে। শীতার্ত ভাব মনে হয, শরীর জড়োসরো হয়ে আসে। আবারও ও সঙ্গী পাখিটির নষ্টালজিয়ায় আড় চোখে তাকিয়ে ভাবে। ওর মনে হয়, এই পৃথিবীর কোনো প্রাণীর অকৃতজ্ঞ এবং অসভ্য আচরণে প্রকৃতি বিরূপ হয়। সমুদ্রের গভীর থেকে ধেয়ে আসে প্রচন্ড ঢেউ আর পাগলা ঘূর্ণি বাতাস। যাতে ধ্বংশ হয় অন্য প্রাণীকূলের সংসার। হারায় প্রকৃতির শোভা গাছপালা। রাস্তায়, বিলের ধারে, শস্য ক্ষেতের আলে পড়ে থাকে মৃত শবের সাড়ি। কিন্তু কোন প্রাণীর কৃতকর্মের ফল এই প্রলয়, বাজপাখি তা জানেনা।
রাতটা নির্ঘুম পার করেছে বাজপাখি। ভোরের আলোতে সে সমুদ্রতটে তাকায় ক্লান্ত প্রাণে, ঘোলাটে চোখে। পেটপুরে কিছু খেয়ে জীবন ধারণ করতে হবে ওর। বাঁকা ঠোঁটে, নরম নখে কোনো শিকার ও কায়দা করতে পারেনা। তবুও উদরপূর্তির সন্ধানে সমুদ্রতটে চোখ বুলায়। যদি সমুদ্র থেকে ভেসে আসা কোনো মাছ ওর চোখে পড়ে। হোক মাছটি অর্ধ পঁচা কিংবা চোখদুটো খেয়ে ফেলেছে অজ্ঞাত অন্য মাছ। তবুও বাঁচার তাগিদে নরম হয়ে যাওয়া মাছটি বাঁকা ঠোঁটে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। ভাগ্য ওর সহায় হয়নি মোটেও। চৌদ্দঘরি শেষ হয়ে দুপুরের চোখ ধাধানো রোদ দিগন্তে। নীল আকাশের ছায়া পড়ে সমুদ্রের পানি আরো নীল হয়েছে। সেখানে একঝাক মাছের উপর ও ব্যর্থ ছোঁ মেরেছে কয়েকবার। মাছ ও ধরতে পেরেছিল কিন্তু মাছেরা ওর বাঁকা ঠোঁটে আর নরম নখে আটকে যায়নি তাই জলের তলে তারা দ্বিগুণ উল্লাসে মাতে। অবশেষে সন্ধ্যা আসে। দিগন্ত রেখায় রাতের আগমনী ওর কাছে ভয়ের উদ্রেক ঘটায়। আজ রাতেই খারাপ কিছু হতে পারে ওর জন্য।হয়ত ক্ষুধায় কাতর হয়ে পানি বমি করে ডালপালা ভাসিয়ে পা ছেড়ে দিয়ে বালুর উপর পাখা ছড়িয়ে পড়ে থাকবে। ঝোপের আড়ালে থাকা শিয়াল এসে নিয়ে যাবে অর্ধ মরা দেহটি। বুকটা ছিঁড়ে কলিজা বের করে আয়েসে খাবে। নয়ত গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যাবে তটের শেষ ভাগে সমুদ্রের জলের কাছে। সেখানে ঢেউয়ের ওঠানামায় ওর শরীরও ওঠানামা করবে। মাথাটা জলের তলে যখন ডুবে যাবে বারকয়েক মাথাটা জাগানোর ব্যর্থ চেষ্টা করবে। তারপর আর কোনো অবশিষ্ট শক্তি না থাকায় মাথাটা ডুবে যাবে জলে। নি:শ্বাস বন্ধ হবার সময় কয়েকটা বুদবুদ পানি থেকে উপরে চলে আসবে। শেষ বুদবুদে বের হয়ে যাবে ক্লান্ত প্রাণ।
ভয়ার্ত রাত সামনে নিয়ে বাজপাখি ভাবে, এই নির্মম কষ্টের জীবন নিয়ে কি করে চলবে আগামী দিনগুলো! এর থেকে শেয়ালের পেটে চালান হলেই বেশ। নয়ত সমুদ্রের জলে। যে মাছেরা একদিন ওর ভয়ে ডুব দিত জলের অতলে। তারা তার পঁচা দেহটি ভাগ করে খাবে। পরম তৃপ্তিতে আর উল্লাসে।
রাত গভীর হয়। সমুদ্রের বাতাস তীরতীর করে গাছের পাতা নাড়ায়। মাঝে মাঝে দমকা বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে গাছের পাতা নেচে ওঠে। অদূরে শেয়ালগুলো কেঁয়া গাছের ঝোপে হুক্কাহুয়া ডাকে। ভয়ে গা ছম ছম করে। মনে হয় শেয়ালগুলো ওর আগাম মৃত্যুর খবর পেয়ে উচ্ছ্বাসে মেতেছে। একটা ছমছমে ভাব শরীরের প্রত্যক অঙ্গে হিম হয়ে বয়ে যায়। ঢলো ঢলো করে কোনো মতে ও রাতটা পার করে।
ভোরের আগে প্রকৃতি একেবারেই নীরব। শেয়ালের ডাক থেমে গেছে। বাতাস বন্ধ হয়েছে, প্রাণীর কোলাহল নেই কোথাও। সমুদ্র থেকে তীরের দিকে একটা ট্রলার সাপের মতো ধেয়ে আসছে। বাজপাখি তখন জীবনের পূর্ণতার মায়া ত্যাগ করে। সিদ্ধান্ত নেয় আত্মঘাতের। কিন্তু কি করে মরবে ও! নিজে নিজে মরার পদ্ধতি জানেনা। তবুও মরতে ওকে হবেই। যে কোনো উপায়ে, যেভাবেই হোক। ভাবনাটি মাথায় এসে ওর স্নায়ুতে গেঁথে যায়। বাঁচার সব চেষ্টা ও অগ্রাহ্য করে। তখন পূবের আলো ফুঁটেছে ধরায়। প্রকৃতি হেসে হেসে সূর্যকে স্বাগত জানায়।
এবার ও আর ধরে রাখতে পারেনি নিজেকে। পা দু'টো আসার হয়ে ডাল থেকে ছুটে গিয়ে শূণ্যে কয়েকটা পাঁক খেয়ে বালুর স্তুপে পড়ে যায়। গড়িয়ে যায় সমুদ্রের দিকে। অসার দেহটি একবার থামে তটের গর্তের কাছে। তখন ও আত্মঘাতের শেষ চেষ্টাটি করে। দু'পায়ে বাঁকা হয়ে সজোড়ে চেপে ধরে গলাটি। যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে যায় নিমিষেই। মৃত্যু কষ্টটা অনুভব করতে শুরু করেছে মাত্র তখনি শক্তিহীন পা'দুটো গলা থেকে আপনাই সড়ে যায়। চেপে ধরার মতো অত শক্তি পায়না পায়ে। চোখ মেলে তাকায় সামনের দিকে। অবিশ্বাস্য একটা দৃশ্য,যা ভাবেনি মোটেও। জলের ঢেউয়ে একেবারে কিনারায় বড় একটা মাছের মৃতদেহ ভাসছে। মুহূর্তে সব ভুলে যায় বাজপাখি। গায়ে ঝাকুনি দিয়ে হামাগুড়ি দেয় বালুর উপর। চলে যায় একদম মাছটির নিকটে, জলের কিনারায়।
নরম মাছের দেহটি ও সহজেই কায়দা করে ছেঁড়ে। বাঁকা ঠোঁট দিয়ে খুচিয়ে বের করে পেটের জঞ্জাল। তারপর আস্তে আস্তে ভক্ষণে ব্যস্ত হয়। জলের থেকে ডাঙায় কোনোমতে মাছটিকে তোলে। চারপাশে একটা কুকুরও দেখতে পায়না। অবিরাম চলছে ওর প্রতিযোগীতাহীন ক্লান্ত আহার। নিমিষেই উদর পূর্তি হয়ে যায় । তখন পূর্বদিক থেকে একজোড়া কুকুর আসে ঘেউ ঘেউ শব্দে ডেকে। কয়েকগজ দূর দিয়ে চলে যায়। মনে হয় তারা নতুন কোনো খাবারের সন্ধান পেয়েছে তাই কথা বলাবলি করে চলছে। হঠাৎ একটা কুকুর থমকে দাঁড়ায়, তারপর আরেকটা। বাজপাখি সমুহ বিপদ ভেবে নড়েচরে দাঁড়ায়। তারপর ও ছোট ছোট পায়ে বিক্ষত মাছের থেকে দূরে যেতে থাকে লাফিয়ে লাফিয়ে ক্লান্ত পায়ে। আরো কিছুদূর গিয়ে উঁড়তে চেষ্টা করে। মাটি থেকে আকাশে হাওয়া ভেসে ভেসে। অবশেষে ও সফল হয়, উঁড়ে যায় ওর পুরোনো আস্তানায় দীর্ঘদিনের পরম ভালোবাসার নীড়ে।
বাজপাখির শরীর মন চনমনে আজ। পালকের নিচে ঠোঁট ঘষে আর বুকের সাথে গলাটা মিলায়। চারপাশে তাকিয়ে দেখে প্রকৃতি কতো সুন্দর করে সেজেছে। একঝাঁক ছোট পাখি আকাশের পথে উঁড়ে যাচ্ছে। দূরে আরেকটি অস্পষ্ট পাখি আকাশের পথে শূণ্য ওঠানামায় ব্যস্ত। আকাশটা যেন নীল শাড়ীর আঁচল ছড়িয়ে বসে আছে। এত সুন্দর পৃথিবী ও আগেও দেখেছে। আজ ওর মনে হয় এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে কি করে চলে যাবে। উপায় কিছু একটা হোক বের করতেই হবে। এবার ও বিদ্রোহী হয়, আত্মপ্রত্যয়ে বাঁচার পথ খোঁজে। নিজেকে সবল করার উপায় খোঁজে। শেষে পড়ন্ত বিকেলে উপায় ঠিক বের করে ফেলে। সিদ্ধান্ত পাঁকা করে, আত্মঘাত নয়, সংগ্রাম ওকে বাঁচিয়ে রাখবে। আমূল পরিবর্তন করতে হবে নিজেকে। শ্রমে, যন্ত্রনায় আর আত্মবিশ্বাসে।
সিদ্ধান্ত নেয় ও পাঁকাপাঁকি করে। পাহাড়ী পাথরে ঠুকরে আর ঘষে ভেঙ্গে ফেলবে অভিসপ্ত ঠোঁট। নখগুলো আচড় দিয়ে ভাঙ্গবে পাথরের উপর। রঞ্জিত হবে সংগ্রামী রক্তে। তারপর পালকগুলো ছিঁড়ে ফেলবে একের পর এক। হয়ে যাবে ন্যাড়া আর অকর্মা।
গল্পটি ও জানে। একশ পঞ্চান্ন দিন অপেক্ষা করতে হবে নতুন জন্মের জন্য। তারপর নতুন পালক, নতুন নখ আর নতুন ঠোঁট নিয়ে হবে ওর পূণর্জন্ম। আবার ক্ষিপ্র গতি, আবার দিগন্তে পাখামেলে বীরের মতো উঁড়ে চলা। ফিরে পাবে নতুন যৌবন। ও আরো বাঁচতে পারবে অন্তত ত্রিশ বছর নির্বিঘ্নে নির্দিধায়।
আরেকটা নতুন প্রভাত এলো। আকাশ ঝলমলে রোদ,প্রকৃতিতে শান্ত এবং স্তব্ধতা বিরাজমান। বালুর উপর পড়ে থাকা মাছের অবশিষ্ট উচ্ছিষ্ট খেয়েছে বাজপাখি। সহজলভ্য মৃতমাছের অংশবিশেষ সমুদ্র পাড়ের কোনো প্রাণী ছিঁড়েও দেখেনি। এবার ওর দীর্ঘ পথ উঁড়ে চলার পালা। পাড়ি দিতে হবে প্রায় দু’শ মাইল সমুদ্রের তটের পথ ধরে। কখনো ডানে কখনো বায়ে। যেতে হবে সেই পাহাড়ী অঞ্চলে। যেখানে মাইলের পর মাইল জুড়ে শুধুই পাহাড়। সমুদ্রের কূল ঘেষে বেড়ে ওঠা পাহাড়ের উঁচুতে খুঁজে নিতে হবে আস্তানা। চারদিকে থাকবে পাহাড়ী জঙ্গলে ঘেরা। খুঁজে নিতে হবে একটু খোলা যায়গা। যেখান থেকে পরিষ্কার আকাশ দেখা যায়। শক্ত বড় পাথরের ফোকরে বাসা বানাতে হবে। তারপর শুরু হবে পূর্ণজন্মের চেষ্টা।
বাজপাখি নিজের বাসাটি ভালো করে দেখে নেয়। মনে হয এটাই ওর শেষ দেখা। সংগ্রামে আহত হয়ে যদি ও মরে যায় তবে আর ফেরা হবেনা এই নীড়ে। অথবা যদি পায় আরেকটি পুরুষ সঙ্গীর খোঁজ। ও উপলব্ধি করতে পেরেছে, দু'কারনে সবাই নিজের ঘর ছাড়ে। হয় ক্ষুধা থেকে বাঁচার জন্য খাদ্যের খোঁজে নয়ত, প্রিয়জনের সাথে ঘর বাঁধতে। এ কারনেই সবাইকে অসীম বন্ধুর পথে যাত্রা করতে হয়। কয়েকবার বাসাটির দিকে তাকিয়ে অদৃশ্য অশ্রুপাত করে। তারপর ও অসীম শূণ্যতার পথ ধরে যাত্রা করে।
কুয়াঁকাটা সমুদ্র সৈকতের পথ ধরে প্রথমে সে পূবের দিকে ওড়ে। সামনে কাকড়াঁর দ্বীপ। সেখান থেকে বায়ে গিয়ে বৌদ্ধদের প্রার্থনা মন্দির। মন্দির থেকে আরেকটু বায়ে সমুদ্র থেকে নিরবধি বয়ে চলা নদী। সেই নদীটি পাড় হয়ে অনেক কষ্টে। নদীটির মাঝপথে মনে হয় বাতাস ওকে গতিপথ থেকে সড়িয়ে নিচ্ছে। ডানা শক্ত করে ও পাখনায় হাল ধরে। অবশেষে পৌঁছে যায় নদীর অপর প্রান্তে। দুপুর নাগাদ ও একটানা ওঁড়ে। কোথাও বিশ্রাম নেয়নি মোটেও। ডানা শক্ত হয়ে গেছে,পা দুটো সোজা করে রাখতে পারেনা। এবার ওকে বিশ্রাম নিতেই হবে। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে সাড়ি সাড়ি গাছের অদূরে একটি তাল গাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় গাছটি আকাশ ছুঁতে চলেছে। ঝড়ের কবলে গাছটির মাথা যেন অর্ধনগ্ন। ও তাল গাছটির মাথায় গিয়ে বসে নিজ মাতৃভূমির দিকে ফিরে ফিরে তাকায়। হঠাৎ শৈশবের দিনগুলি তার মনে পড়ে। বেদনায় বুকটা হূ হূ করে ওঠে। যেখানে অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে আছে ওর মা এবং প্রিয় পুরুষ পাখিটির। চেতনার দ্রোহে ও মাথাটা নাড়ে। সব স্মৃতি পেছনে ফেলে আবার ও আকাশে ওড়ে। একদম পূবে আর দক্ষিণে।
ভোলা জেলা ও অতিক্রম করেছে বিকেলের আগেই। সন্ধ্যা হতেই নোয়াখালীর হাতিয়ায় পৌঁছে যায়। কয়েকটা দ্বীপ পাড়ি দিতে পারলেই ও গাছ গাছালির বন পাবে। সেখানে রাত্রি যাপন করবে বলে ঠিক করে নেয়।
দ্বীপগুলো অতিক্রম করে ও নতুন জনপদে আসে। সেখানে অনেক গৃহস্থের বাস। গাছ গাছালিতে পূর্ণ বাড়িঘর। সমুদ্র থেকে অনেকটা দূরে উঁচু বাঁধের পর জনবসতি গড়ে উঠেছে। পরিবেশটা দেখতে একদম আলাদা। ওর জন্মভূমির দৃশ্যপটের মতো নয়। এখানে ও রাত্রি যাপন করবে বলে ঠিক করে নেয়। পরের প্রভাতে নির্বিঘ্নে ওড়ার জন্য হলেও ওকে আহার করতে হবে। কিন্তু নিকস কালো অন্ধকারে বিদেশ বিভূঁইয়ে আহারের সন্ধ্যানে বের হবার সূযোগ এখন নেই। অন্ধকারটা বেশ চেপে বসেছে, নতুন পরিবেশে অচেনা জায়গায় ও আহারের চিন্তা বাদ দিয়ে বিশ্রামের ঠিকানা যোগাড় করাটাই প্রয়োজনীয় বলে মনে করে। অবশেষে জনপদের গৃহস্থ বাড়ির লম্বা দেবদারু গাছটির ডালে ও আশ্রয় নেয়।
আরেকটি প্রভাত , শিকারের কসরত করতে হলোনা মোটেও। রোদ উঠতেই বাড়ির মুরগী ছানাগুলো আঙিনার পাশে কীটপতঙ্গ খুটে খায়। দেবদারু গাছটির নিচের ডালে বসে ও একটি ছানাকে তাক করে । তারপর সূযোগ বুঝে ছোঁ মেরে ছানাটি নিয়ে ডালের উপর উঠে যায়। ছানাটির মা কক কক করে ডাকতে থাকায় গৃহস্থ্য ঘরের লোক এসে বাজপাখির উপর শুকনো গাছের ডাল নিক্ষেপ করে। ছানাটি মুখে নিয়ে ও পূবের পথে উঁড়াল দেয়। সুবিধামতো স্থান দেখে ছানাটি ছিঁড়ে আয়েসে খেয়ে নেয়।
সন্দীপ চ্যানেল পাড়ি দিতে ও সাহস করে উঠতে পারেনা। কি বড় নদী! উঁচু ডালের উপরে বসেও ওপার চোখে পড়েনা। শান্ত আবহাওয়ায়ও তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ। তবে পেটে যে খাবার পড়েছে তাতে উড়াঁল দেওয়া যায়। আবছা পূবের সীমানার দিকে তাকিয়ে ও সাহস করে উঁড়াল দেয়। পা'দুটো সোজা করে ঘুড়ির পাখার মতো ডানা মেলে। পথ যেন শেষ হয়না মোটেও। তবুও বাজপাখি উঁড়ে চলে গন্তব্যের পথে।
সাগরের মতো বিক্ষুব্ধ নদী পার হয়ে এপারে চলে এসেছে। এপারের প্রকৃতির চিত্র আগের মতো নেই। এখানকার বন বনানী আরো সবুজ আরো গাঢ়ো। ক্রমান্বয়ে উঁচু হয়ে উঠছে সমতল ভুমি। বাতাশ সহসা কম মনে হয়। সাড়ি সাড়ি গেওড়া বনে ছেয়ে আছে নির্জন এলাকা। লোকজনের কোলাহল নেই। চারদিকে নীরব নিস্তব্ধতা। ও আরো পথ ওড়ে, ডানা সোজা করে ঘূড়ির মতো। ছায়াটা বৃহত করে পাহাড়ে পড়ে। সামনে আরো দূর পর্যন্ত উড়ে যায়। এই পথ আরো দুর্গম এবং উঁচু। এখানে বসতি নেই, মানুষ নেই শুধু মাইলের পর মাইল বিস্তীর্ণ পাহাড়। লম্বা হয়ে পহাড় চলে গেছে দূর থেকে দুরান্তে। অচেনা সব গাছে ভরপুর পাহাড়গুলো।
বাজপাখি আরো ওড়ে, দিনের শেষ পর্যন্ত। বিকেলের শেষ আলোয় ও আশ্রয় খোঁজে চারদিকে। কোথাও নেই একটা বড় গাছ। এখানে বিষাক্ত সাপের ভয়, ভয় আছে পাহাড়ী প্রাণীর। যারা ওত পেতে শিকার ধরে। নিরাপদে থাকতে হলে ওকে উঁচু কোনো গাছ চাই। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ও উঁড়ে চলে বহূদূর।
সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগে মিরেরসরাই পার হয়ে ও আরো গভীর পাহাড়ের পথ ধরে ওড়ে। এবার ও উঁচু পাহাড়ের সন্ধান পেয়েছে। আধো আলোর কারনে দূর থেকে পাহাড়ের দৃশ্যটা ঠাহর করতে পারেনা তাই পাহাড়ের উঁচু পথ ধরে ঢাল বেয়ে বেয়ে ওড়ে। অন্ধকার নামতেই চলে যায় এখানকার সব থেকে উঁচু পাহাড়ের চুড়ায়। এখানটা গাছপালা শূণ্য এবং নির্জন। নিরাপদ মনে করে ও চুড়ার উপর নামে। চারদিকে তাকিয়ে গা ছমছমায় না। অদূরে পাশাপাশি দু'টি বড় পাথর দেখতে পায়। মাঝখানটা সামান্য ফাঁকা। সেখানে কয়েকটা শুঁকনো পাতা আর মরা লতা নিয়ে একটি বাসা বানায়। মাথার উপর চাঁদটা পূর্ণ বিকিরনে আলো ছড়াচ্ছে। ও মনে করতে চেষ্টা করে আজ কোন তিঁথি কিন্তু কিছুই মনে করতে পারেনা। তবে পূর্ণিমার আগে অথবা পরে হবে হয়ত ভাবে। এখানেই শুরু হয় ওর পূণর্জীবনের যুদ্ধদিনের নতুন নীড়।
পরের সকালটা ওর জন্য একেবারেই নতুন। চারদিকে তাকিয়ে ও অবস্থাটা ভালো করে বুঝে নেয়। কখনো পাহাড়ের ঢালে, কখনো পাশের পাহাড়ের চুড়ায়। খাবার সন্ধান কিভাবে করবে ভেবে পায়না। মনে মনে ভাবে, কষ্ট তাকে পেতেই হবে নতুন জন্মের প্রতীক্ষায়।
চারদিকে হেঁটে সরঞ্জাম জোগাড় করে থাকার যায়গাটা পোক্ত করে । খাবার জন্য পেয়েছে পাহাড়ী পাখির ডিম। সেটা পা দিয়ে খট করে ভেঙ্গে সাবার করে দেয়। তারপর ভাবে, এই কয়েকটা মাস ওকে পাহাড়ী পাখির ডিম খেয়েই বাঁচতে হবে। তবে আজ ওর ভাগ্য সুপ্রসন্ন। অদূরেই দেখে কয়েকটা অর্ধ মৃত সাপের বাচ্চা নিথর হয়ে পড়ে আছে। ঠোঁট দিয়ে ঠোকর মেরে অবস্থা বুঝে নেয়। বাচ্চাগুলোকে জড়ো করে বাসার থেকে দূরে নিয়ে রাখে। একটি মৃত সাপ বৎস পেটে চালান করে বেশ আয়েশে বাসায় ঘুমায়।
বিকেলটা বেশ ফুরফুরে। হালকা বাতাস এসে পালক নাড়িয়ে দিয়ে পাহাড়ী ঢাল বেয়ে চলে যায়। আকাশটা নীলে ভরা তাই মেজাজ ফুরফুরে লাগে। এই সময় ওর মনে সত্যটা উদয় হয়, কেন ওর এখানে আসা! অদূরে তাকিয়ে শক্ত পাথর দুটোকে দেখে পরখ করে নেয়। তারপর আর অপেক্ষা করেনা। বেকার দিন পার করে ও মোটেও বাঁচতে পারবেনা। একটা নতুন জীবন চাই, যে জীবনে আনন্দ আছে উচ্ছ্বাস আছে। দিগন্তে পাক খেয়ে ওড়া যায়। সজোড়ে শিকার করা যায়।
দেরী ও মোটেও করেনা। প্রথমে হালকা করে বাঁকা ঠোঁট পাথরে আছাড় মারে। আবার মারে, আবার। থেকে থেকে জোড়ালো ভাবে। শক্ত ঠোঁট ভাঙ্গেনা ওর। তবুও জোড়ে জোড়ে আছাড় মারে। প্রতিটা আছাড়ে তার মাথা গোলায়। শরীর ঝাকি দিয়ে ওঠে তবুও থামেনা ও। আরো জোড়ে ঠোঁট দিয়ে আঘাত করে পাথরে। এবার আরো জোড়ে। ধাক্কায় দেহটা ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয় ঠোঁট থেকে। প্রচন্ড ব্যাথায় সমস্ত শরীর ধরে যায়। ব্যাথায় কুকঁড়ে ও মনে মনে ভাবে এবার বুঝি সফল হতে চলেছে। উঠে দাঁড়াতে পারেনা বাজপাখি, তবুও দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। চোখ বন্ধ করে সজোড়ে আবার আঘাত করে পাথরে। বাঁকা ঠোঁটের সামনের অংশ ছিটকে পড়ে যায়। কড়াক করে চিৎকার দিয়ে ডেকে ওঠে বাজপাখি। রক্তাক্ত হয়ে যায় পাথর আর ওর চারপাশ। ভিরমি খেয়ে পড়ে যায় মাটিতে। তারপর আর জাগেনি পরের প্রভাতের আগে। চেতনা ফিরে সকালের আলোতে নিজেকে অনুভব করে। ওর পূণর্জন্মের প্রথম ভাগ শেষ করে ফেলেছে। কাছে জলের ধারা থাকলে নিজের চেহারাটা দেখে নিতে পারত। ঝরনার ধারা অনেক নিচে। সেখানে যাওয়ার মতো শক্তি নেই ওর। মনে মনে ঠোঁটহীন নিজের প্রতিবিম্ব ও চোখের সামনে দেখতে পায়।
ক'দিন যেতেই পাথরে ঘষে পায়ের নখ উপরে ফেলে। রক্তাক্ত হয়ে ও মৃতপ্রায়। চেতনা ফিরে পেলে পাখির ডিম খোঁজে। যেদিন যে কয়টি পায় খেয়ে বাঁচে। চোখের সামনে মৃত সাপের ছানা পঁচে দুর্গন্ধ ছড়ায়। ঠোঁটের দুরাবস্থার কারণে ও খেতে পারেনা। এভাবেই পার হয় ওর নির্মম র্নিজন বাসের দিনগুলো।
ঠোঁটের যন্ত্রনা আর নখের ব্যাথা শেষ হলে ও ডানার দিকে তাকায়। কেমন ধূসর আর ফ্যাকাসে হয়ে গেছে পালকগুলো। তেলতেলে ভাব আর নেই। রাগে, ঘৃণায় পা দিয়ে সজোড়ে চেপে ধরে একেকটা পালক। পালকগুলো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে শূণ্য আকাশের পথ ধরে উঁড়ে যায়। এভাবে নিজেকে ও নগ্ন করে। পশমহীন নগ্ন চেহারার দিকে ও তাকায়না কখনো। নিজেকে দেখতে বির্বণ, বিভৎস আর অসহায় লাগে। তারপর ওর দীর্ঘ অপেক্ষা। একশ পঞ্চান্ন দিন পর ও নতুন জীবন ফিরে পাবে। একদিন হবে ওর পূণর্জন্ম।
অনাহারে অর্ধাহারে দ্রোহে আর ফিকে হয়ে যাওয়া চিন্তায় বাজপাখি পার করে একশ পঞ্চান্ন দিন। পাহাড়ের নির্জনতায় একা নি:সঙ্গ জীবন পার করেছে নতুন জন্মের আশায়। ইচ্ছেগুলো বিবর্ণ হতে হতে মৃতপ্রায়। ঝড়ে, বৃষ্টিতে পাথরের কোটরে লুঁকিয়ে কোনোভাবে বাঁচিয়েছে মুমূর্ষু জীবন। তারপর ফিরে আসে একদিন সোনালী প্রভাত। নতুন পালকে ভরে যায় নগ্ন দেহটি। সূঁচের মতো নয়গুলো বেড়ে ওঠে একটা একটা করে। পূর্ণতা ফিরে পায়নি ঠোঁট। যেদিন ঘুম থেকে জেগে অনুভব করে সরু ঠোঁটের আচ। সেদিন পাহাড়ের চারদিকে আনন্দে নাচে। নিজের ভাষায় জানান দেয় প্রতিবেশী ছোট পাখিদের। অসীম আকাশের শূণ্যতায় তাকায় নতুন স্বপ্ন নিয়ে। স্মৃতিরা নড়ে ওঠে স্নায়ুতে, আরো পরিষ্কার এবং সজীব হয়ে। পাখায় অনুভব করে খিপ্রতা। নখ দিয়ে পাহাড়ী শক্ত মাটি খুচিয়ে পরখ করে। পাহাড়ী পথগুলি চিনে নেয়। শিকার সে করতে পারে এখন ছোটখাটো। তখনি দেখা দেয় আরেকটি পুরুষ বাজপাখি। ওর থেকে ছোট আর বয়সে নবীন। পরিচয়ের পর নতুন অনুভবে নতুন স্বপ্নে বিভোর হয় বাজপাখী। পূর্ণতা পায় পুরো স্বপ্ন, শরীর এবং মনে।
ছুরির ফলার মতো নতুন ঠোঁট আর তীক্ষ্ম ধারালো নখ। পাখায় প্রচন্ড ক্ষিপ্রতা অনুভব করে ও মাতৃভূমির স্মৃতিতে কাতর হয়। পশ্চিমে দিতে চায় দীর্ঘ উড়াল। যেখানে পার করেছে শৈশব, কৈশর আর সঙ্গী পাখিটির সাথে মিষ্টি দাম্পত্য। কিন্তু আগন্তুক পাখিটির সাথে ভাব জমে যায় নতুন উদ্যমে, নতুন পরিবেশে।
বাজপাখি বুঝতে পারেনা পশ্চিমের পথ ধরে সে সূর্যমুখী আকাশে উঁড়াল দেবে নাকি ওর থেকে অপরিনত নতুন সঙ্গীর সাথে ধর বেঁধে পাহাড়ী জীবনে অভ্যস্ত হবে। যাওয়া না যাওয়ার চিন্তার দোলাচলে বাজপাখি দ্বিধাগ্রস্থ। জীবনের সত্য সুন্দর পরিনতি পাবার জন্য ও পাহাড়ের আকাশে খ্রিপ্র গতিতে উঁড়ে বেড়ায়।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.