নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জীবনের নিগূঢ় সত্যটি হচ্ছে, কখনো এমন কোনো আবেগকে প্রশ্রয় না দেয়া যা অশোভন।

মোস্তফা অভি

আমি ফেরী করি, আমি ফেরীওয়ালা।

মোস্তফা অভি › বিস্তারিত পোস্টঃ

গুরু আমায় এ কোন পথে দাঁড় করিয়ে দিলেন

০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:২৪

কথাসাহিত্যিক প্রশান্ত মৃধা আমার শিক্ষক। তাঁর অসংখ্য স্মৃতি হয়ত আজীবন বহন করতে হবে আমায়। মাত্র পৌনে দু'বছর তিনি আমায় পড়িয়েছেন, তারপর চলে গেলেন কর্মের প্রয়োজনে। শুধু রেখে গেলেন জ্ঞানের স্পর্শ, নাড়িয়ে দিয়ে গেলেন তরুণ ছাত্রদের মনের জানালা। কবাট খুলে ভেতরে আলো প্রবেশ করতে থাকল ধীরে ধীরে। প্রায় দু'বছরে তাঁর কাছে যা শিখেছি তা আজ অমর হয়ে আছে।

দিনটা ছিল শনিবার। এর আগে বাংলা সাহিত্যের শিল্প ও অলংকার শাস্ত্রের পণ্ডিতজন মফিজ চৌধুরী স্যারের দু'একটা ক্লাস করেছি। গ্রাম্য সাধারণ স্কুল পড়ুয়া ছাত্র আমি, কী-ইবা জ্ঞান রাখি অলংকার শাস্ত্রের! ওসবের কিছুই মাথায় ঢোকেনি। তবে, সাহিত্য বলতে যা বুঝতাম তার বাইরে নতুন নতুন বিষয় বিস্মিত করেছিল আমাকে। প্রথম ক্লাসে বাল্মিকির শিকারে গিয়ে কবি হওয়ার গল্প শুনেছিলাম চৌধুরী স্যারের কাছে।

‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ/ যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতমঃ

জঙ্গলে গাছের ডালে একজোড়া ক্রৌঞ্চ-ক্রৌঞ্চী খেলা করছিল। ক্রৌঞ্চকে শিকারি তীর বিদ্ধ করলে ক্রৌঞ্চীর প্রিয়জন হারানো চিৎকারে বাল্মিকি বলে উঠলেন, আহা! ওই বেদনা-ই হৃদয় থেকে কাব্যের আকারে বেরয়। পরবর্তী তে বাল্মিকি হন মহাকবি এবং তাঁর অমর সৃষ্টি রামায়ণ বিখ্যাত মহাকাব্য।

রবিবার ক্লাস নেই, সোমবার সকাল। ক্লাসে বসে পরিচিত হচ্ছি সদ্য কলেজ পেরিয়ে আসা ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে। তখন ক্লাসে ঢুকলেন একজন তরুণ প্রভাষক। ছিপছিপে লম্বা, গৌরবর্ণ, মাথায় ঘনো চুল। খয়েরি ফ্রেমের চশমায় দারুণ দেখতে। তাঁকে দেখে বুঝতে বেগ পেতে হয়েছিল তবে ডায়সে দাঁড়াতেই বুঝলাম, আজ ক্রৌঞ্চমিথুনের গল্প নয়, অন্যকিছু শুনব। কী সেটা? জানি না। তবে অপেক্ষা করতে লাগলাম। তিনি আমাদের নাম জিজ্ঞেস করলেন, বেঞ্চের দু'সারির ফাঁক দিয়ে হেঁটে ছাত্রদের সামনের দুএকটা বইখাতা উল্টে দেখলেন। তিনি শুরু করলেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস দিয়ে। স্যার পড়াতেন বাংলা সাহিত্যের আধূনিক যুগ। তবে প্রসঙ্গক্রমে আদি যুগ, মধ্য যুগ হয়ে হালের আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং হাসান আজিজুল হক পর্যন্ত। ইতিহাস আজন্ম নীরস আমার কাছে, কিন্তু সেই ইতিহাস হয়ে উঠল আমার কাছে অমৃতপাঠ।

তিনি যা বলেন শুধু চেয়ে থাকি আর বিস্মিত হই। এত নতুন নতুন কথা, এত রস, এত সুরামিশ্রিত মোহ-মাদকতায় ভরা ইতিহাস কে শুনেছে আগে! যা বলেন তা-ই ভালো লাগে।

আমার বন্ধু শামীম বয়সে আমার থেকে বড়। সাহিত্য সম্পর্কে টুকটাক জানেশোনে ও। আমিতো মূর্খ কাঙাল। যা শুনি সব নতুন লাগে। বিস্ময়ে হা করে থাকি। শামীম ঠিক করল আমরা প্রতিদিন বিকেলে স্যারের কোয়ার্টারে যাব। আরো নতুন কিছু শিখব, তাঁর সান্নিধ্য পাব। শুনে কতটা পুলকিত হয়েছিলাম এখন বোঝানোর সাধ্য নেই।

রোজ করে স্যারের টিন সেটের দালানের কাছে বিকেল হলেই দুজন গিয়ে বারান্দার ফাঁক ঘেষে দাঁড়াতাম। চৌকিদার সফেজ মেয়া আমাদের দিকে ঘনোঘনো তাকিয়ে বলত, -পেয়ারা ছিঁড়না যেন বাছা। আমরা অমনি হুম বলে সফেজ মেয়ার ছোটখাট কঙ্কালসার দেহটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। সে চলে গেলে ফুলকড়া পেয়ারায় কামড় দিতে দিতে অপেক্ষা করতাম কখন ঘুম ভাঙে স্যারের।
তারপর স্যার উঠতেন, বিছানায় ছড়িয়ে থাকা বইগুলো একপাশে রেখে মুখহাত ধুয়ে বলতেন বড়বড় সাহিত্য এবং সাহিত্যিকের গল্প। তলস্তয়, কাফকা, গোর্কির নাম তাঁর কাছেই প্রথম শোনা। এর আগে জানতাম রবীন্দ্রনাথের উপরে বড় লেখক হয় নাকি! সতীনাথ ভাদুড়ী নামে যে বাংলা সাহিত্যে এত বড় লেখক আছেন, ওই সময় তিনি না জানালে আমার মত সাধারণের জানার কী সাধ্য! তারপর কত সময়, কত স্মৃতি পার করলাম আমরা।

স্যার হাতে লিখে খামে ভরে দিতেন, আমরা পত্রিকা অফিসে পোস্ট করতাম সেই লঞ্চঘাট। কদিন পরেই সেই লেখাটা যখন তখনকার নামকরা পত্রিকার পাতায় দেখতাম আনন্দ বিস্ময়ের সীমা থাকত না।

স্যারের সঙ্গে সন্ধ্যার পর শহরের রাস্তায় হাঁটতাম আর গল্প শুনতাম। কলেজ রোডের এক মুড়িঅলার থেকে ঠোঙ্গায় একটাকার মুড়ি কিনে দিতেন স্যার সঙ্গে এককাপ চা। সন্ধ্যার চা-মুড়ির নাস্তা এত সুখস্বাদের ছিল সে আর কোনো কালেও ফিরে পাওয়ার নয়।

তারপর অনেকবার স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছে। কথা হয় এখনো কিন্তু সেইসব দিনের সান্নিধ্যস্মৃতি জীবনের উজ্জ্বল ইতিহাস। আমি থেমে নেই, স্যারকে এখনো বিরক্ত করি হরহামেশা। কখনো ব্যস্ত থাকেন, কখনো শরীর ভালো নয় তবুও এটাওটা জানতে ফোন করি। বিরক্ত হন না, তিনি শেখান। সেই যে পনের বছর আগে সাহিত্যের গলিপথের পথ দেখিয়ে দিয়েছেন প্রশান্ত মৃধা, আজও সে পথ ধরে হাঁটছি।

প্রিয় শিক্ষক প্রশান্ত মৃধার প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:০১

রাজীব নুর বলেছেন: প্রশান্ত স্যার সহ সকল শিক্ষক ভালো থাকুক। সুস্থ থাকুন।

২| ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:০৭

এস এম ইসমাঈল বলেছেন: গুরুর প্রতি প্রনাম। আমার স্কুল জীবনেও এরকম একজন মহান ব্যক্তির শুভাগমন হয়েছিল। বেলাল বেগ স্যার। অত্যন্ত গুনী এ মহান ব্যক্তি বরতমানে আমেরিকায় প্রবাস জীবন যাপন করছেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.