![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সপ্তম শ্রেনীতে ভর্তি হয়েছি। নুতন স্কুল। জন্ম ১৯৭৩। একজন শহীদের নামে। ৭১ এ কালিহাতীর প্রথম শহীদ নাম জামাল উদ্দিন। তার নাম অনুসারেই শহীদ জামাল হাই স্কুল। স্কুল শুরু হয় জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে শেষ হয় বৈকালিক খেলাধুলায় । ব্যাপারটা অনেকটাই ঐচ্ছিক। খেলাধুলায় আগ্রহীরাই ঐ সময়টাতে স্কুলের আঙ্গীনায় থাকে সন্ধা নাগাদ।
আর এর পুরোভাগে থাকেন শিক্ষক মুহাম্মদ হযরত আলী। স্কুলের ফিজিক্যাল ইন্সট্রাকটর যাকে বলে শরীর চর্চা শিক্ষক। খুব ধার্মিক । পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। শরীর চর্চার শিক্ষক হলেও ক্লাস নিতেন বাংলা ও ইতিহাস।খুব মিশুক ও সদাহাস্য।ছাত্রদের সন্তান বা ভাইয়ের মত আদর করতেন।স্কুলের এক্সট্রা কারিক্যুলামের নেতৃত্ত্বে তিনিই থাকতেন।
নাটক গানবাজনা খেলাধুলার পাশাপাশি বাৎসরিক মিলাদ মাহফিল স্বরস্বতি পূজায় তার উপস্থিতি ও নেতৃত্ত্ব চোখে পড়ার মত।এতো গেল স্কুল আঙ্গীনার সমাচার। সামাজিক কর্মকান্ড এবং আচারে তার উপস্থিতি ছিল স্বরব।
প্রথম দিকে আমরা ছাত্ররা স্যারকে বুঝতে পারতাম না। এলাকায় যে কোন অনুষ্ঠানে স্যারের উপস্থিতি আমরা যারা ছোট ক্লাসে ছিলাম তাদের কাছে ছিল বিরক্তিকর ও ভীতিকর। আমরা মনে করতাম স্যার আমাদের অনুসরন করছেন এবং নজর রাখছেন আমাদের স্কুলের বাহিরের কর্মকান্ড নিয়ে। আমাদের ধারনা ছিল স্যারকে স্কুল থেকে এলাকার এবং স্কুলের ছাত্রদের কর্মকান্ড বিষয়ে অবগত করতে কতৃপক্ষ দায়িত্ত্ব দিয়েছেন। কারন স্কুলের গভর্নিং বডি এবং শিক্ষকরা বেশীর ভাগই ছিলেন ঐ প্রজন্মের যুবক এবং ৭১ এর মুক্তিযোদ্ধা এবং সংগঠক।
আগেকার দিনে গ্রাম বাংলায় স্কুল কলেজের খেলাধুলার প্রতিযোগীতা হতো ফি বছর। স্কুলের টিম যেত থানায় এবং থানা থেকে যেত জেলায় আবার জেলা খেকে কেন্দ্রে মানে ঢাকায়। স্কুলে হতো বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিতর্ক প্রতিযোগীতা আরও অনেক সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান।থানা থেকে ইন্সপেক্শন টিম আসতো প্রতিবছর ছাত্রদের মেধা এবং স্কুলের মান যাচাই করার জন্য। সেখানেও হজরত স্যার ছাত্রদের সহযোগিতা করতেন আচরনগত বিষয় নিয়ে মানে থানা কর্তৃপক্ষ আসলে তাদের সামনে কিভাবে দাড়াতে হবে কিভাবে কথা বলতে হবে আদাম ছালাম কিভাবে দিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
স্কুলের এসব অনুষ্ঠানের পাশাপাশি এলাকায় ঋতুভেদে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান হতো।যেমন যাত্রা নাটক, গ্রামে গ্রামে খেলার প্রতিযোগীতা বিশেষ করে হাডুডু, নৌকা বাইছ, লাঠি খেলা,ধর্মসভা, ওয়াজ মাহফিল, কীর্তন, সংকীর্তন, ঠংযাত্রা, সার্কাস, চৈত্রী সংক্রান্তি, বাউল গান, পালাগান, দূর্গাপূজা, ঈদ অনুষ্ঠান, বিভিন্ন মেলা আরও অনেক বিনোদনমূলক ও সামাজিক অনুষ্ঠান। এসব অনুষ্ঠান সবই আঞ্চলিক। পারফর্মাররা সবই বিভিন্ন গ্রামের । জাত পাত ধর্ম গোত্র বর্নের কোন ভেদাভেদ ছিল না।যদু মধু রাম শ্যাম আলী জব্বর মরতুজ কবীর প্রানেশ, রাজেস, রজত ভজন ফজল জলিল খলিল কাদের আফাজ নাজিম হারাধন মোল্লা মুন্সি ঠাকুর ব্রাহ্মন সবাই একই মঞ্চে অভিনয় করত এবং পারফর্ম করতো।ভাড়া করা কোন শিল্পীর কদর তখন ছিল না আর থাকলেও সামর্থের বাইরে।অনেক ছেলেকে মহিলা সেজে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখছি।অনেক পুরুষকে নাচতে দেখেছি মাহিলার রূপ ধরে।ঐ সময়ে এগুলোই ছিল বিনোদনের মাধ্যম এবং বাঙ্গালীয়ানা।
আর তার ফল আমরা পেয়েছি ভয়াবহ ৭১ এ। সবার বাড়ী সবার।সবার আঙ্গীনা সবার। যেখানেই নিরাপদ জায়গা সেখানেই সবার উপস্থিতি। মোল্লা বাড়ী ঠাকুর বাড়ী, মুচি পাড়া, পাটিতা পাড়া, খান বাড়ী শেখ বাড়ী কোন ভেদাভেদ ছিল না। বিপদের সময় সবার বাড়ী সবার জন্য উন্মোক্ত ছিল।নারী পুরুষ সবাই ছিল মানুষ এবং সবাই ছিল মানবতার এবং দেশের। একই ঘরে চলত নামাজ এবং পুজার্চনা।কি সুন্দর ছিল বাঙ্গালীর সহাবস্থান।যদিও দুই একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদে বাংলাদেশের সাধারন মানুষ সেটাই ধারন করে।স্বার্থান্বেষী মহল যুগে যুগেই থাকে যেটা কোন নিয়মের মধ্যে পড়েনা।
যা বলছিলাম, হযরত স্যার ছিলেন এমন একজন মানুষ অর্থাৎ এমন একজন বাঙ্গালী যার উপস্থিতি ছিল সব অঙ্গনে এবং স্বরব অংশগ্রহনমূলক। শুধু দর্শক হিসাবে নয়।খেলা ধুলায় মুখে থাকত বাঁশি।বিচারক হিসাবে থাকতেন অনেক জায়গায়। লাঠিখেলা নৌকা বাইছ ফুটবল খেলায় থাকতেন পার্ফরমার।অভিনয়ও করেছেন মাঝে মাঝে।
আমাদের ভুল ধারনাকে পাল্টে দিয়ে তিনি হয়েছিলেন সকলের কাছে গ্রহনযোগ্য একজন বাঙ্গালী। ধর্মসভা ,বাউল গান, ওয়াজ মাহফিল, ঠংযাত্রা, কীর্তন সব জায়গায় ছিল তার পদচারনা।আমরা তাকে কখনও দেখেছি শীতের রাতে কাঁথা মুড়ো দিয়ে যাত্রা অনুষ্ঠানে আবার টুপি মাথায় ধর্ম সভায় ও নামাজ আদায়ে। আবার কখনও দেখেছি কফিন কাধে গোরস্থানে । আবার কখনও সুহৃদের টানে শ্মশানে। তাকে দেখেছি মুক্তমনে এবং বাঙ্গালীর আদলে কীর্তন গাইতে এবং কুরআন তেলোয়াত করতে।
আমরা এমন মুক্তমনা এবং বাঙ্গালী হতে চাই সাজতে চাইনা।এটাই বাঙ্গালীত্ত্ব এবং বাংলাদেশ। সুন্দর বাংলাদেশের প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।মুক্তমনা হোক বাঙ্গলিী আদলে যেখানে “ধর্ম যার যার দেশটা সবার” ।জয় বাংলা।
©somewhere in net ltd.