![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভালো মানুষ হিসেবে বাঁচতে চাই, ভালো থাকাটাই ভালোবাসি।
রহিম গাজী চিৎ হয়ে খাটে শুয়ে আছেন। শীতকাল তাই সিলিংয়ে ঝুলে থাকা ফ্যান ঘুরছে না। রহিম গাজী একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন, ইদানিং এই ফ্যানটার দিকে তাকালে তার ঝুলে পরতে ইচ্ছা করে। যেনোতেনো ঝুলাঝুলি না, একদম গলায় গামছা পেঁচিয়ে ঝোলা। কিন্তু কেন? রহিম গাজীর টাকার অভাব নাই। চাইলে তিনি পাঁচশ টাকার কচকচা নোট দিয়ে তিনতলা বিল্ডিং তুলে ফেলতে পারবেন। টাকাই সর্ব সুখের মূল বলে রহিমের ধারনা। তবে এই মূহুর্তে তিনি কোনো সুখ পাচ্ছেন না। তার থিউরি ভুল হচ্ছে। রহিম সাহেব আতঙ্কিত অবস্থায় মোবাইল হাতে নিচ্ছেন। তার শরীর ঘামছে, শীতের মধ্যে শরীর ঘামানো কোনো ভালো লক্ষণ না। রহিম সাহেব ডাক্তারকে ফোন দিবেন কিনা ভাবছেন। না, এখন ডাক্তারের চেয়ে ইলেক্ট্রিসিয়ানের দরকার বেশি। ফ্যান যদি না থাকে তাহলে ঝোলাঝুলির চিন্তা আর আসবেনা। ফ্যানের বদলে কি ব্যবহার করা যেতে পারে? রহিম সাহেব এসি সহ্য করতে পারেননা। গরম আসলে টেবিল ফ্যান ব্যবহার করা যেতে পারে।
.
রিধি রহিম সাহেবের একমাত্র মেয়ে। তার কোনো পুত্র সন্তান নেই। তবে এতে রহিম সাহেবের কোনো আক্ষেপ নেই। তিনি মেয়েকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। রহিম সাহেবের স্ত্রী লিভার ফেইলিয়রে মারা গেছেন। তবে লোক মুখে শোনা যায় শ্বশুরের একমাত্র উত্তরাধিকারিণীকে তিনি ঠান্ডা মাথায় খুন করেছেন। পরে ডাক্তারকে পয়সা দিয়ে ভুয়া ডেথ সার্টিফিকেট বের করেছেন। রহিম সাহেব এসব আমলে নেন না, তবে তার স্ত্রীর মৃত্যুর দুই মাস পর ড. খন্দকার রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। তখনই জলটা ঘোলা হয়। রহিম সাহেব ফ্যান খুলেছেন। এখন অবশ্য কোনো ঝামেলা নেই। তবে একেবারে নেই বললে ভুল হবে। রহিম সাহেব এক সপ্তাহে দুইবার এটেম্প্ট টু সুইসাইডের ভয়াল স্বপ্ন দেখছেন। এটা কোনো ভালো কথা না।
.
মাজেদুল ইসলাম হাই স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রিধি। রিধি অসম্ভব রূপবতী। তবে রহিম সাহেব কিংবা তার স্ত্রী দুজনই ভয়াল কুৎসিত। রিধি মাঝেমাঝে সন্দেহ করে, তার পিতামাতারা আসল কিনা? রিধি এবার নাইনে উঠবে। সুমন আসার কথা। সুমন রিধিকে পড়ায়। সুমনকে সে সামনাসামনি আপনি করে বলে। তবে, মনেমনে তুমি করে বলতে ভারী ভাল্লাগে। উঠতি বয়সী প্রেম বড়ই মিষ্টি। অমৃতের চেয়েও মিষ্টি। রহিম সাহেব সুমনকে দেখতে পছন্দ করেন না। এই ছেলেকে তার মেয়ে, অসম্ভব ভালোবাসে বলেই তিনি সুমনকে চোখের বালি করে রেখেছেন। তবে, তাড়াতে পারছেন না রিধির কারনে। কারণ, রিধি সুমন ব্যতীত কারো কাছে টিউশন নিবে না। সুমন অবশ্য এতে তেমন বিচলিত না। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের কোনোকিছুতে কোনোকিছু আসে যায় না। সুমন হচ্ছে তেমন।
.
রহিম সাহেব বারান্দায় বসে আছেন। বারান্দার সামনে পরিবেশটা অসম্ভব সুন্দর। বারান্দার সামনে বাগানের ছত্র ছায়া বারান্দাকে সবুজাভ করে রেখেছে। রহিম এখানে বসে নিয়মিত একটা করে সিগারেট খান। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে তিনি হারিয়ে যান। তারপর বমি বমি আসে। তিনি সিগারেট ফেলে দেন। রহিম সাহেব কখোনই সিগারেট অর্ধেকের বেশি শেষ করতে পারেন না। তবুও তিনি এই সময়টাকে পছন্দ করেন। নির্জন নিরালা। তবে এখন বারান্দা আর নির্জন রইলো না। রিধি একটা তোতাপাখি নিয়ে এসেছে। খাঁচায় ভরে তাকে বারান্দার গ্রিলের সাথে ঝোলানো হয়েছে। সারাক্ষণ সে 'সুমন স্যার আই লাভ ইউ' করে চলছে। রহিম সাহেব জানেন তার মেয়েই এই প্রশিক্ষণ দিয়েছে, সুমনকে খুশি করার জন্য। রহিম সাহেব মহা বিরক্ত হলেও কিছু বলছেন না। ঘুড়ি যতই উড়ুক নাটাই কিন্তু তার হাতেই। এইমাত্র পাখি বলে উঠলো, 'রহিম আমাকে বাঁচাও!' রহিম সাহেব চমকে উঠলেন। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তিনি কি ভুল শুনলেন? পাখিটা এখন বলছে 'সুমন স্যার আই লাভ ইউ!
রহিম গলায় গামছা পেঁচিয়ে ঝুলে গেছেন। পায়ের নিচে রাখা চেয়ারটা লাথি মেরে ফেলে দিয়েছেন। এখন তার পায়ের তলায় মাটি নেই দশা। রহিমের চোখ যেন অক্ষিকোটর থেকে বের হতে চাইছে। মুখ দিয়ে রক্ত বের হবে হবে ভাব তবে বের হচ্ছে না। রহিম সাহেবের মনে হতে লাগলো, অাত্মহত্যায় কোনো সুখ নেই। তিনি নির্বোধের মতো কাজ করেছেন। হুট করে ঝুলে পরাটা ঠিক হয় নাই। এই যন্ত্রণা সহ্য করা সহজ না। মৃত্যু আসলেই জটিল প্রক্রিয়া। রহিম সাহেব চিৎকার করলেন 'বাঁচাও'। আশ্বর্যভাবে তার কণ্ঠস্বর তোতা পাখির মতো শোনাচ্ছে। তিনি তোতা পাখির মতো বলে উঠলেন, 'সুমন স্যার আই লাভ ইউ'। স্বপ্ন বড়ই আশ্বর্যকর বিষয়। কোনো আগা মাথা নাই। যাহাই আগা তাহাই মাথা। রহিম গাজী হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তিনি ভয়ানক স্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছেন। খারাপ স্বপ্ন দেখে জেগে উঠলে প্রাণে আনন্দের সঞ্চার হয়। রহিম সাহেবের তাই হচ্ছে। তিনি আনন্দিত হচ্ছেন। স্বপ্নের অস্থিরতায় তিনি ঘামিয়ে গেছেন, এখন অবশ্য রিল্যাক্স লাগছে। রহিম সাহেব ঘরে বসেই সিগারেট ধরালেন। বারন্দায় যেতে সাহস পাচ্ছেন না। বারান্দায় গেলে বজ্জাত তোতা পাখিকে দেখতে হবে। রিল্যাক্স করতে হলে সিগারেট দরকার বলে তিনি মনে করেন। রহিম সাহেব কখনো অর্ধেকের বেশি সিগারেট শেষ করতে পারেন না। তবে আজকে করলেন।
.
সুমন ড্রয়িং রুমে বসে আছে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে। রিধি এখনো আসছে না। ড্রয়িং রুমে পড়ানো নীতি আজকে থেকেই শুরু হয়েছে। নীতির প্রয়োগ করেছে রহিম গাজী। রিধি এই নতুন প্রথা মানতে পারছে না। তবে রহিম সাহেবের সাথে উচ্যবাচ্য করে লাভ নাই। রিধি টেলিফোনে রহিম সাহেবের সাথে কথা বলছে।
-সুমন স্যারকে তুমি ড্রয়িং রুমে পড়াতে বলেছ?
-আমি তেমন কিছু বলিনি, তবে কিছু একটা বলেছি সত্য।
-কী বলেছ তা কি বলা যাবে?
-সব কথা সবাইকে বলা যাব তা তো না!
-কিন্তু ড্রয়িংরুমে পড়তে আমার অসুবিধা হয়।
-প্রথম প্রথম হবে পরে ঠিক হয়ে যাবে। পড়াশোনা খোলামেলা জায়গায় করতে হয়, তবেই ব্রেন খোলে। দেখোনা যত বড় ইনিস্টিটিউট তত উন্নত পড়াশোনা। আমি ঠিক করেছি, বাড়ির সামনে ছাউনি পেতে দেব। তোমরা উন্মুক্ত পরিবেশে লেখা পড়া করবে, জ্ঞানের পরিধি বাড়বে।
রিধি বুঝলো তর্ক করে কোনো লাভ নেই। সিস্টেম বদলাতে হবে।
.
রিধি ড্রয়িং রুমে এসে দেখলো সুমন ঘুমোচ্ছে। এতোটা নিঃসঙ্কোচে লোকটা ঘুমিয়ে পরতে পারে তা তার জানা। রিধি ঠিক করলো বসে বসে সুমনকে দেখবে। যতক্ষণ না সুমনের ঘুম ভাঙ্গে। ততক্ষণ দেখবে। এমনি যদি সারা জীবন চলে যেত। রিধির ইচ্ছে করছে, সুমনকে ছুঁতে। হটাৎ রিধির চোখ ভাসিয়ে জল আসছে। কিন্তু কেন? পছন্দের মানুষকে ছুঁয়ে দেখা কি অপরাধ?
.
এনায়েত মিঞা, জালাল এন্টারপ্রাইজের এসিসন্ট্যান্ট ম্যানেজার। রহিম সাহেব অফিসে ঢোকা মাত্র তার অবৈতনিক কাজ হচ্ছে, রহিম সাহেবের কেবিনে ঘন ঘন অাসা যাওয়া করা। রহিম সাহেব এনায়েত মিঞাকে জঘন্য ভাবে অপছন্দ করেন। লোকটা ভয়াবহ চাটুকার। চাটুকার লোক অবশ্য বর্জনীয় বলে রহিম সাহেব বিশ্বাস করেন। তবে এনায়েতকে বর্জন করা মুশকিল। এনায়েত তার শ্বশুর বাড়ির লোক। ফরিদার দূরসম্পর্কের চাচাতো ভাই। ফরিদা রহিম সাহেবের মরহুমা স্ত্রী। এনায়েত সম্পর্কে ঘুষ নেয়া বিষয়ক একটা অভিযোগ এসেছে। ব্যাপারটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে গুপ্তচর দিয়ে। একবার প্রমাণ মিললেই হবে। তখন দূরের কিংবা কাছের, কোনো চাচাতো ভাই-ই বিবেচনা করা হবে না। পত্রপাঠ বিদায় করতে হবে। এ ব্যাপারে দ্বায়িত্ব পালন করছে, অফিসের পিয়ন সিরাজ খাঁ। সিরাজকে রহিম সাহেব অন্ধ বিশ্বাস করেন।
.
সুমনের ঘুম ভেঙ্গেছে। এমন উদ্ভট পরিস্থিতিতে যে কেউ-ই ব্যাপক ইতস্ততায় পরে যেত। তবে সুমনের ব্যাপার আলাদা। ঘুমের মধ্যে সে দারুণ স্বপ্ন দেখেছে। একটা রাজকুমারী তার প্রেমে পড়েছে। সুমন বিষাক্ত সাপের কামড়ে অাধমরা হয়ে খাটে শুয়ে আছে। বাস্তব হলে, রাজার বাড়িতে খাট ব্যাপারটা বেমানান লাগতো। তবে স্বপ্ন বলে মানিয়ে গেছে। রাজকুমারী কাঁদছে আর একটু পর পর তার কপালে চুমু খাচ্ছে। স্বপ্ন শেষ। সুমন ঘুম ভেঙ্গে অনুভব করলো, কেউ নিশ্চয়ই তাকে চুমু খেয়েছে। খুব আলতো করে। তবে, কে? বারান্দা থেকে তোতা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। 'সুমন স্যার অাই লাভ ইউ'। সুমন ভাবছে এটাও বোধ হয় স্বপ্ন। তার চোখ জ্বালা করছে। জ্বর হবার পূর্ব লক্ষণ। পাখিটা অাবারও ডাকলো, 'সুমন স্যার অাই লাভ ইউ'। না এটা পাখির গলা না। সুমনের চোখ বুজে আসছে, হয়তো সে জ্ঞান হারাচ্ছে।
রহিম সাহেব দড়িবাবার দরবারে। দরবার বলতে হাওয়ার মা বস্তির মাঝের ঘরটা। চারদিকে লাল কাপর দিয়ে বেড়াকে দরবার সাজ দেয়া হয়েছে। দড়িবাবা আসনের পেছনেই তিন ফিট বাই দুই ফিটের ফ্রেমে অনন্ত জলিলের ছবি টাঙানো। ছবির মোজেজা হলো, দড়ি বাবা এবং অনন্ত জলিল দু'জনেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে সক্ষম। রহিম সাহেবের ডাক পড়তেই তিনি বাবার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলেন। সিরাজ খাঁ বলেছে বাবার চোখে চোখে না তাকাতে। তবে রহিম সাহেব অানমনা হয়ে বাবার চোখে চোখ রেখেছেন। এর ফলাফল নিয়ে তিনি চিন্তিত। দড়িবাবা রহিম সাহেবের মাথায় হাত রাখলেন। তারপর মাস্টার, পাখি আর গলায় দড়ি এই তিনটি শব্দ উচ্চারণ করলেন। রহিম সাহেব ঘাবড়ালেন। দড়িবাবার ক্ষমতা সম্পর্কে তার শ্রদ্ধা চলে আসলো। তারপর সিরাজ খাঁর নির্দেশে বাইরে বেড়িয়ে গেলেন।
-বুঝলাম না, আমার বিপদ গুলো উনি জানলেন কিভাবে?
-স্যার, ওনার ক্ষমতা অনেক। গায়েবী জগতের লগে ওঠা বসা।
-এখন সমাধানতো কিছু বললো না।
-সমাধান আসতে দুইদিন। বাবায় দড়ি দিবো। সেইটা কোমরে বাঁইধা রাখতে হইবো। ব্যাস্।
-কি? কোমরে?
-হ স্যার এইটাই নিয়ম। যত বড় সমস্যা তত মোটা দড়ি।
-দড়ি বাঁধতেই হবে?
-হু, কোনো অপশান নাই। স্যার হাদিয়া বের করেন বিদায় লই।
-কত?
-দশ হাজার সবাই দেয়। আপনেরে পছন্দ করছে, মাত্র পাঁচ দিলেই হইবো।
রহিম সাহেব টাকাটা দিলেন। সিরাজ খা টাকাটা নিয়ে ঝুপরির ভেতরে গেল। তারপর তাকে হাসি মুখে বের হতে দেখা গেল।
.
সুমন চলে যাবার পর থেকেই রিধি দরজা লাগিয়ে বসে আছে। খবরটা রহিম সাহেবের কানে গেছে। তিনি এ নিয়ে মহা বিরক্ত। জানা গেছে, সুমন চলে যাবার পর থেকেই রিধি ক্রন্দনরত। সালেখা বলেছে, রিধি মারে দেখছি কানতেছে স্যার। ঐ মাস্টার ব্যাটা কিছু করলো নাতো? রহিম সাহেব চিন্তা করছেন। এখনই মোক্ষম সময়। হতচ্ছাড়াকে রাম ধোলাই দিয়ে তাড়ানো যাবে। দোষ সত্য কি মিথ্যা বিবেচনার সময় এখন না। বেদম মার বিদায় দিতে হবে।
.
রহিম সাহেব অফিসে ঢোকার পর থেকে অফিসে উত্তেজনা ছড়িয়ে গেছে। এনায়েত মিঞাকে মাত্রাতিরিক্ত খুশি মনে হচ্ছে। রহিম সাহেব দড়ি বাবার দেয়া দড়ি কোমরে বেঁধেছেন। তার সমস্যা অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে তাকে জাহাজী দড়ি রেফার করা হয়েছে। দড়ি কোমরে ঝোলানো মুশকিল। তবে সিরাজকে দেখা যাচ্ছে রহিম সাহেবের সার্বিক সহযোগিতায়। সিরাজ দুই হাতে দড়ি মাজা অদ্যি ধরে রেখেছে। তবে ব্যাপারটা তেমন সুখকর বলে মনে হচ্ছে না। নিচু হয়ে দড়ি তুলে রাখতে গিয়ে সিরাজের পিঠ ধরে গেছে। রহিম সাহেবও তেমন মজা পাচ্ছেন না। অবশ্য কোমরে দড়ি পেঁচিয়ে রাখা কখনো অানন্দের ব্যাপার হতে পারে না। রহিমের ইচ্ছা হচ্ছে সিরাজ খাঁকে লাথি মেরে তাড়িয়ে দেয়। তবে সেটা এখনই করা সম্ভব না। সিরাজকে দিয়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ সাড়িয়ে নিতে হবে। তারপর লাথিটা মারা যেতে পারে।
.
রিধি বারান্দায় বসে আছে। এই মুহূর্তে তোতা পাখিকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা শিখিয়ে দিতে হবে। রিধি শেখাচ্ছে, "রিধি লাভস্ ইউ এন্ড সি কিস্ড ইউ"। রিধি মনে মনে ঠিক করলো ব্যাপারটা ঠিক হবে না। তোতাপাখি দিয়ে কথা বলালে কাজ হবে না। ডিরেক্ট একশনে যেতে হবে। রিধি গ্রিল ধরে দাঁড়ালো। আজ সুমন আসবে না। হয়তো আর কখোনো না। দুপুরের কড়া রোদ পড়েছে রাস্তায়, তবে গাছ গাছালির জন্য রোদটা বারান্দা পর্যন্ত আসতে পারেনি। রিধি শুনতে পাচ্ছে পাখিটা বলছে, রিধি লাভস্ ইউ, সি কিস্ড ইউ। পাখির স্মৃতিশক্তি রিধিকে ব্যাথিত করলো।
.
আজ পাঁচ দিন হলো সুমন মেস থেকে বের হয়নি। সুমনের রুমমেট রহমত তালুকদার। পেশায় স্কুল শিক্ষক। রহমতই রিধির টিউশনিটা তাকে দিয়েছে। সুমন এবার অনার্স ফাইনাল দিবে। রহমত তালুকদার বলল, বাবাজির শরীর এখন কেমন?
-ভালো।
-উত্তরটা হইলো না বাবাজি। বলবা আল্লাহর রহমতে ভালো। এই দুনিয়ার সব কিছুর মালিকই তিনি। তেনার হুকুম ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না। রিধির বাসা থেইক্কা খবর আসছিলো। তোমারে তলব করছে।
সুমন চিকন দৃষ্টিতে তাকালো রহমতের দিকে। রহমত বলে চলল, বড়লোক পরিবার বুঝলা বাপজান। একটু দেইখা চলবা। মানুষের টাকা হইলে মানুষ আবার মানুষ থাকে না।
সুমন শেষ কথা গুলো ঠিক ধরতে পারলো না। টানা পাঁচ দিন আবদ্ধরুমে থেকে তার গা ঘিনঘিন করছে। সুমন বের হলো। বাইরে উজ্জ্বল রোদ। রোদ প্রখর হলেও গায়ে নরম হয়ে পরছে। বেশ ভালো লাগছে সুমনের। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায় সেটা ঠিক করা যাচ্ছে না। রিধির বাসায় যাওয়া যেতে পারে। না, সময়টা মধ্য দুপুর। শিক্ষক হতে হলে সময় জ্ঞান থাকা দরকার। সুমন ঠিক করলো বিনার বাসায় যাওয়া যায়। বিনা সুমনের কাছের বান্ধুবি। বিনার বাসায় অনেকদিন যাওয়া হয় না। অনেক দিন পর কোথাও গেলে খালি হাতে যাওয়া ঠিক না। সুমন ঠিক করলো এক প্যাকেট দুধ নিয়ে যাবে। এর আগেরবার দুধের অভাবে বিনা তাকে চা দিতে পারেনি। দুধ ছাড়া কি চা হয় না? নাকি বিনা...থাক।
.
সন্ধ্যা নেমে আসলে দড়ি খুলতে হয় এটাই বাবার নিয়ম। রহিম সাহেব বিরক্ত হয়ে বসে আছেন। সিরাজ খাঁ কাচু মুখ নিয়ে তার সামনে বসা। রহিম সাহেবের কির্তিকলাপ নিয়ে অফিসে রবরব উঠে গেছে। এনায়েত নাকি অফিসের সবাইকে চা খাইয়েছে। ঠিক কতজন হতে পারে সেটা জানা যায় নি। এনায়েতের এসিস্ট্যান্ট শায়লা বলেছে। শায়লা মেয়েটার ভরাট শরীর। রহিম সাহেব সাহেব শায়লাকে এড়িয়ে চলেন। এই মেয়ের চরিত্র নিয়ে তার সন্দেহ আছে। সিরাজ গলা ভেঙ্গে ভেঙ্গে বললো, স্যার আমারে কি আপনে তাড়ায়ে দিবেন? রহিম সাহেব বিরক্তমুখে উত্তর দিলেন, তাড়াবো এটা ঠিক। শুধু তাড়াবো না, লাথি মেরে তাড়াবো। সিরাজ রসবোধ নিয়ে বললো,'স্যার, আপনি বড়ই রসিক মানুষ। হাহাহা'। রহিম সাহেব ঝুঁকে এসে বললেন, 'তুমি বয়সে আমার বড়। তবুও বলছি, আমি রহিম গাজী ভালো মানুষ না। কুকর্ম করে আজ এতো ব্যাংক ব্যালেন্স করেছি। তোমাকে অবশ্যই তাড়ানো হবে। লাথি মেরে তাড়াবো, তবে লাথিটা কোথায় মারবো বুঝতে পারছি না। সেজন্য আপাতত বেঁচে গেছো। Now, out of sight। চোখের সামনে থেকে যাও। সিরাজ খাঁকে নিচু মাথায় বের হতে দেখে এনায়েত রহিম সাহেবের কেবিনে ঢুকলো। রহিম সাহেব বিড়বিড় করে বলছেন, out of sight, out of sight, out of shight.
সুমন সোফায় বসা। কয়েক বছর আগেও ঠিক এমন ছিলো না ঘরটা। চুন খসে গেছে, সিলিং ফ্যানটা ঘুরবার সময় ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করছে। আর বিনা, চোখের নিচে কালো দাগ, গায়ের রং গাঢ় শ্যামলা ধারণ করেছে। সুমন ভাবতে লাগলো, তার ভোঁতা পর্যবেক্ষণ শক্তি বিনার কাছাকাছি এলে চঞ্চল হয়ে ওঠে। বিনা পাশের ঘরে। তার মা শয্যাশায়ি। বিনার জীবনে মা ছাড়া আপন বলতে কেউ নেই। বাবা খুব ছোট থাকতেই সন্ন্যাসী বনে গেছেন। সেটা অতীত। অতীত থেকে শেখার কিছু না থাকলে সেটা ঝেড়ে ফেলতে হয়। বিনা সেটা পারে না। সে তার অতীত আকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। এমন কি হতে পারে! সুমন তার অতীত। বিনা লজ্জিত ভঙ্গীতে বললো, অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম তোমাকে। আশা করি বসে থাকতে তুমি কখনো বিরক্ত হও না। সুমন মাথা নাড়লো। বিনা অভিযোগের সুরে বললো, কেন আসতে গেলে আবার। তোমাকে তো মুক্তি দিয়েছি। সুমন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চেয়ে রইলো। বিনা করুণ সুরে বললো, তুমি কখনও বুঝোনি, আজও বুঝবে না। তুমি থাকলে আমার কষ্ট বাড়বে। চলে যাও। আর কোনোদিন এসো না। সুমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে বিনার দিকে তাকোলো। সে এখন ভাবছে, দুধ ছাড়া কি চা হয় না?
.
পুলিশ সুপার খালেদ মোর্শেদ রহিম গাজীর খুুব ঘনিষ্ঠ। তার সাথে রহিম সাহেবের বাক্যালাপ হচ্ছে।
-হ্যালো রহিম সাহেব। শুনলাম আপনি নাকি কোমরে দড়ি ঝুলায়ে ঘুরছেন? আসামীদের কোমড়ে দড়ি ঝুলিয়ে হাজতে নেয়া হয়। হাহাহাহা বুঝতেই পারছেন কি বলতে চাচ্ছি।
রহিম সাহেব বিরক্তবোধ করছেন। কোমরে দড়ি ঝোলানো ব্যাপারটা সবার কানে যাবে এটা তিনি জানতেন। তবে এ নিয়ে খালেদ মোর্শেদ রসিকতা করবে তা তিনি ভাবতেই পারেননি। মনে মনে কুত্তা বলে সম্বোন্ধন করলেন, তারপর গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করলেন, 'কী দরকারে ফোন দিয়েছ?'
-দরকারটা আমার না, বলতে পারেন আপনার নিজের জন্যই।
-ঝেড়ে কাঁশো।
-আপনার স্ত্রীর চিকিৎসকের বক্তব্য নেয়া হয়েছে। খুব ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে ফরিদা ম্যামকে।
রহিম সাহেব ঘামতে শুরু করলেন, স্ত্রীর উপর বিরক্ত হয়ে ডাক্তার নেওয়াজকে নিয়ে তিনি কিছু একটা চিন্তা করেছিলেন তবে পরে তা বাদ দিয়ে দিয়েছেন। তবে কি ডাক্তার শালা নিজে বাঁচতে গিয়ে তাকে ফাঁসিয়েছেন? রহিম সাহেব অন্যমনস্ক হয়ে বললেন, শালা! ওপাশ থেকে উত্তর আসলো, কাকে শালা বললেন? রহিম সাহেব ফোন কেটে দিলেন। আর বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, "সব শালা, all are brother in law"
.
রহিম সাহবে চিন্তিত। অতি টেনশনে তার শরীর ঘামে। তবে আজ ঘামছে না। কিন্তু কারণটা ধরা যাচ্ছে না। অবশ্য এটা নিয়ে ভাববার সময় এখন নাই। ড. খন্দকার মারা গেছেন সড়ক দূর্ঘটনায়। তবে ড. নেওয়াজ বেঁচে আছে। বেঁচে আছে বলেই, এই ব্যাটা সম্ভবত গুটি চালছে। তবে লোকটার মাথা মোটা। এর পেছন অবশ্যই শক্তিশালী হাত আছে। রহিম সাহেব জানেন হাতটা কার! এনায়েত মিঞা এতটা ধুরন্দর! ভাবতেই, রহিম সাহেবের গা হিম হয়ে যাচ্ছে। রহিম সাহেব দুই ডাক্তারকে নিয়ে সম্পত্তি হাতাবার একটা নীল নকশা করেছিলেন। কিন্তু পরে সেটা বাতিল করা হয়। ফরিদার মৃত্যুর পেছনে রহিম সাহেবের কোনো হাত নেই। তবে সেটার প্রমাণ করবে কে? সিরাজ খাঁ লাথির ভয়ে পালিয়েছে। ব্যাটা একটা ছাগল। রাগের মাথায় রহিম সাহেব লাথির কথা বলেছিলেন তবে সেটা বাস্তবে কখনোই করতেন না। ক্লাস ফাইভে থাকতে তার পায়ের ক্যালসিয়াাম শুকিয়ে যায়। ডাক্তার তাকে তখন থেকেই সকল প্রকার লাথালাথি প্ররিহার করতে নির্দেশ দিয়েছেন। রহিম সাহেব সেই নির্দেশ পালন করেছেন। রহিম সাহেব বিশ্বস্থ কাউকে খুঁজে পাচ্ছেন না। সবাই অর্থালোভে কাজ করে, টাকা ছাড়া এদের গলা দিয়ে ভাত নামে না। অর্থালোভীদের বিশ্বাস করা যায় না। সুমন কে বিশ্বাস করা যেতে পারে। কিন্তু সুমন কোথায়? রহিম সাহেব তার ড্রাইভার লিয়াকতকে নির্দেশ দিলেন বিকালের মধ্যে সুমনকে খুঁজে আনতে।
.
আজ চার দিন হলো সুমন বিনার বাসায় পরে আছে। বিনা সুমনকে বসার ঘরে বিছানা করে দিয়েছে। সে সেখানে দিনের বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটায়। বিনা সুমনকে অসম্ভব ভালোবাসে। তবে অভাবের সংসারে ভালোবাসার দাম নাই। বিনা ব্যাপারটা সুমনকে বোঝাতে পারছে না। তার টিউশনির অল্প কয়েক টাকায় মা-মেয়ের চলে যায়। তবে তিনজনকে টেনে নেওয়াটা খুবই দুঃসাধ্য। দুপুর দুটা, বিনা টিউশনির জন্য বের হবে। সুমন বিনার ঘরে ঢুকল। তার মা বিছানায় মৃতের মতো পরে আছে। সুমন জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে বললো বিনা আমি তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চাই। বিনা বুঝলো কথা গুলো এখানে বলবেনা সুমন। বিনা বাড়ির সামনের রাস্তায় এসে দাঁড়ালো। সুমন বিনার মুখোমুখি।
-আমি জানি আমার এখানে থাকাতে তোমাদের কষ্ট হচ্ছে।
-কষ্ট হচ্ছে সেটাতো কখোনো বলিনি। বরং আমি যেটা চাই, না বলতেই তুমি সেটা করছো।
-আমি করছি আমার নিজের জন্য। আমি অনার্স ফাইনাল দিচ্ছি না।
-কি বলছো এসব?
-হুম। আমার কথাগুলো শোনো। আমি আজকেই চলে যাবো। আমার খোঁজে কিছুদিন পর এখানে পুলিশ আসবে।পুলিশ কেনো আসবে সেটার ব্যাখ্যা এখন দিচ্ছি না। তবে তুমি কোনো অবস্থাতেই ঘাবড়াবে না। আমি আবার ফিরে আসবো। তুমি আমার জন্য অপেক্ষার করবে।
বিনার সুমনের কথা গুলো ঠিক ধরতে পারছিলো না। বিনা কি উত্তর দিবে। ভাবতে না ভাবতেই সুমন হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল। পড়ন্ত দুপুরে একটা মেয়ে সীমাহীন কৌতুহল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দৃশ্যটা সুন্দর।
.
হোটেল ক্যালিফোর্নিয়ার দোতালার কেবিনে এনায়েত আর শায়লা। দুজনেই অনাবৃত। এনায়েতের বুকে শায়লার মাথা। আঙ্গুল দিয়ে এনায়েতের বুকের পশম নাড়তে নাড়তে শায়লা বলল, ঐ বুড়োর একটা মেয়ে আছে না?
-হুম
-ও যদি পরে প্রতিবাদ করে?
-নাহ্, বাচ্চা মেয়ে। কি বলবে ও? রহিম গাজী আমার জালে পেঁচিয়ে গেছে। ছাড়াবার যতই চেষ্টা করবে ততই আটকাবে। হাহাহাহাহা!
এনায়েতের হাসি থেমে গেলো দরজার ওপর আঘাতের শব্দে। হুড়মুড় করে দরজা ভেঙ্গে ঢুকে পরলো একদল পুলিশ। শায়লা বিছানার চাদর টেনে নিজেকে ঢাকার চেষ্টা করছে। পুলিশ সুপার খালেদ মোর্শেদ, 'অবৈধ শারীরিক সম্পর্কের দায়ে আপনাকে এরেস্ট করা হলো।' এনায়েত মৃদু স্বরে প্রশ্ন করলো, কে ইনফর্ম করলো। মোর্শেদ গম্ভীর হয়ে বললো, আপনার স্ত্রী।
.
পত্রিকার হেডলাইন পড়ে, রহিম সাহেবের চোখ ছানাবড়া। জালাল এন্টারপ্রাইজের সহকারী ম্যানেজার অবৈধ যৌন মিলনের দায়ে গ্রেফতার। ছবিতে এনায়েতকে অর্ধোলঙ্গ দেখা যাচ্ছে। রহিম সাহেব খুশিতে মরে যাবেন কিনা ভাবছেন। এমন সময় সালেখা রুমে ঢুকলো, স্যার মামনিরে খুইজ্জ্যা পাইতেছি না। রহিম সাহবে ব্যাস্ত ভঙ্গিতে বললো, কি বলো এসব?
-হ স্যার, মামনি স্কুলে যায় নাই। তেনার সব বান্ধুবির বাসায় খোঁজ নেয়া হয়েছে। মামনি কারোর বাসায়ই যায় নাই।
মানুষ একত্রে এক ধরনের অনুভূতি নিতে পারে। তবে দুই বিপরীতমুখী অনুভূতির সম্মুখীন হলেন রহিম গাজী। তার গলার স্বর ক্রমশ নেবে গেলো। রহিম সাহেব সম্ভিত হারালেন।
সোনাখালির সরু খাল দিয়ে ট্রলারটা বয়ে চলছে। উদ্দেশ্য নতুন বাজার ঘাট। ট্রলারে পঁচিশ জনের মতো যাত্রী। সবাই -ই বারেবারে রিধির দিকে তাকাচ্ছে। রিধি দুই হাত প্রসারিত করে মাথা উল্টো করে জলে চুল ভেজাচ্ছে। উজ্জ্বল আকাশের দিকে তাকাতে না পেরে চোখ বন্ধ করে আছে। দুই জন বোরকা পরিহিত মহিলা পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। এমন অদ্ভুত দৃশ্য তারা কখনো দেখেনি বোধ হয়। ট্রলার নিয়ন্ত্রক সতর্কবাণী দিচ্ছে, আফা গাছ দেইখেন, এই পানি ভালা না, বাড়িতে যাইয়া মাতা ধুইয়েন, আফা মাতা দেইখা নামান। সুমন দু পাশের বিস্তৃত সবুজ জঙ্গল দেখছে আনমনা হয়ে। তার পাশে বসা দাড়িওয়ালা বয়স্ক লোক অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা সুমনের ভালো লাগছে না। সে বিরক্তবোধ করছে। কি অদ্ভুত! সে কখোনো বিরক্ত হয় না। তবে আজ হচ্ছে। রিধি ভেজা চুল নিয়ে উঠে বসলো। তারপর অনর্গল বলল, 'Its an awesome experience, thank you! and I love you, Ridhi loves you!'
ট্রলারে বসা মানুষগুলো রিধির কথা সম্পূর্ণ না বুঝলেও, আই লাভ ইউ কথাটার মানে সবাই জানে। সবাই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিধি এবং তার স্যারের দিকে। সুমন জানতো এমন কিছু ঘটবে। ব্যাপারটাকে কিভাবে সামাল দেওয়া হবে তাও ঠিক করা হয়েছিল। সবকিছু সব সময় প্ল্যান মোতাবেক হয় না। এখনও হচ্ছে না। সে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। টলাৎ টলাৎ জল ছাঁপিয়ে ট্রলার এগিয়ে যাচ্ছে। সূর্য ডুবিডুবি করছে। দুই পাড়ে গজিয়ে ওঠা বাঁশগুলো যেন পরস্পর চুুমু খাচ্ছে। বিস্তৃত লাল আকাশ এখন আর দেখা যাচ্ছে না। রিধি খেয়াল করলো, তার চোখ বেয়ে শাখা নদীর মত জল গড়িয়ে থুতনীতে জমছে। হায়রে আবেগ।
.
রহিম সাহেব চেয়ারে বসে আছেন। তার সামনে একটা মেয়ে বসা। গায়ে হলুদ রঙের শাড়ি। গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের শাড়ি পড়ে মেয়েটা চলে এসেছে। বোঝাই যাচ্ছে এই শাড়ি ছাড়া তার কোনো ভালো শাড়ি নেই। মেয়েটার গায়ের রঙ শ্যামলা। কিছু কিছু মেয়ে আছে যাদের চেহারার গঠন অমায়িক হয়। এদের রূপ রঙ দিয়ে নির্ণয় সম্ভব না। এই মেয়ে তেমন। মেয়েটার নাম বিনা। রহিম সাহেবের ড্রাইভার বিনাকে খুঁজে নিয়ে এসেছে। জানা গেছে সুমন উধাও হবার আগে এই মেয়ের কাছেই ছিল। রহিম সাহেব কথা শুরু করতে পারছেন না। মেয়েটার চেহারা তার পূর্বপরিচিত। খুব পরিচিত। কিন্তু কীভাবে?
-তুমি কে?
-বিনা।
-সুমন তোমার কে হয়?
-বন্ধু। খুব কাছের বন্ধু।
-শুনেছি তোমার মা অসুস্থ। বাসায় মাত্র একটা রুম। সুমন সেখানে থেকেছে কিভাবে?
প্রশ্নটা শুনে বিনার চোখে জল চলে আসলো। রহিম সাহেব বিব্রত বোধ করছেন। কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। বিনা শাড়ির আচলে চোখ মুছছে। তবে নতুন শাড়ি জলটা শুষতে পারছে না। বিনার মুখ চোখের পানিতে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে। দৃশ্যটা অদ্ভুত। একটা মেয়ে কান্না মুছতে চাচ্ছে কিন্তু সেটা মুছা না হয়ে লেপালেপি হয়ে যাচ্ছে। রহিম সাহেব মনে করতে পারলেন। মেয়েটার চেহারা বরকতের সাথে মিলে। বরকত তার ছেলেবেলার বন্ধু। বরকত তার একটা বড় রকমের উপকার করেছে। উপকারটা কি, সেটা রহিম সাহেবের মনে আসছে না। মনে আসার দরকার নেই। এখন দরকার রিধি সুমনকে খোঁজা। শোনা গেছে তারা বড় বিপদে আছে। দড়িবাবার গায়েবি মাধ্যমে খবরটা জানা গেছে। তবে এর সত্যতা নিয়ে রহিম সাহেব চিন্তিত।
.
রাঘু শিকদার নতুন বাজার ঘাটে নৌকা ভিড়িয়েছে। রাঘুর কথা শুনে ঘাট এখন জনমানব শূন্য। রাঘু ব্যাপারটা নিয়ে বিরক্ত। রাঘু কুখ্যাত ডাকাতদের একজন। তার নাম বাতাসে আঁচ পেলেই লোকজন দম নেয়া বন্ধ করে দেয়। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা মজার হলেও এখন অবশ্য মজাদার নয়। নাম শুনেই মানুষ পালালে ডাকাতি করবে কাদের? রাঘু ঘাটের পাটাতনে ইজি চেয়ার নিয়ে বসে আছে। দূর থেকে ট্রলার আসার শব্দ শোনা যাচ্ছে। রাঘু মুচকি হেঁসে বললো, "শিকার আয়া হ্যায়"
রাঘুর দলবল নৌকাটিকে ঘেরাও করলো। নৌকার সব যাত্রীকে ঘাটের ওপর দাঁড়া করানো হলো। মেয়েদের এক দিকে, পুরুষদের একদিকে। রিধির কাছে ব্যাপারটা দারুণ লাগছে। পূর্বে সে ডাকাতির অনেক গল্প শুনেছে। তবে আজ চাক্ষুষ দেখছে। তার মুখে মুচকি হাসি। সুমনের পাশে দাড়িওয়ালা লোকটা দাড়ানো। সে থরথর করে, কাঁপছে। ''লা হাওলা বাঁচাও আল্লা" বলে বিড়বিড় করছে। সুমন বিরক্ত বোধ করছে। উল্টাপাল্টা ছন্দে লোকটা বানানো দোয়া পড়ছে আবার মুখে দাড়ি।
রাঘু বিরক্ত মুখে বসে আছে। যেমন লুট আশা করেছিল তেমন কিছুই পাওয়া যায় নাই। রাঘু রিধির দিকে তাকিয়ে আছে।
ওই মাইয়্যা নাম কি তোমার?
আমার নাম রিধি।
কার লগে আইছো?
রিধি আঙ্গুল দিয়ে সুমনের দিখে তাঁক করলো। পছন্দের মানুষের নাম মুখে নিতে নেই। রিধি কুসংস্কারে বিশ্বাসী না। তবে এই সংস্কারটা তার ভালো লাগে।
তোমার বাবায় কি করে?
আমার বাবা নেই।
ওই মাইয়্যা ভুড়ং ভাড়ং করবা না। কাইটা নদীতে ফালাইয়া দিমু। তোমার বাপ নাই মানে কি?
আমার বাবা নাই মানে বাবা নাই। আমি পিতৃহীন।
রাঘুর মেজাজ চরমে উঠে গেছে। ডাকাত হলেও রাঘু মিথ্যা শুনতে পারে না। রিধি মিথ্যা বলছে। রাঘু রিধিকে চেনে।
ওই এই মাইয়্যা আর পোলাডারে উপরে তোল, আর হুজুরডারে খালাস কর। বাকি গুলারে অর্ধেক পানিতে নামাইয়া বাইন্ধা রাখ যেন নড়তে না পারে। সুমন আর রিধিকে ট্রলারে তোলা হলো। ট্রলারে উঠানোর সময়ে রিধি খেয়াল করলো দাড়িওয়ালা লোকটা ঘাটের উপর পরে আছে। সুমনকে বাধা হয়েছে। রিধিকে নিচের কামরার ভেতর আটকে রাখা হয়েছে।
.
রহিম সাহেবেরর ঘুম ভাঙলো মধ্যরাতে। তিনি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্নটা এরকম।
স্বপ্নে রহিম সাহেব তার- স্ত্রী, বাবা এবং মাকে দেখেছেন। তাদেরকে দেখা যাচ্ছে বসে বসে লুডু খেলতে। জোড়া জোড়া খেলছেন। রহিম সাহেবের মা এবং তার স্ত্রী এক জোড়া। আর রহিম সাহেবের বাবা একাই এক জোড়া। লুডু খেলা ভাগ্যের খেলা। রহিম সাহেবের বাবার লাক খুব খারাপ তিনি বারবার পুট পাচ্ছেন। পুট মানে এক। রহিম সাহেবের মা ও স্ত্রী সমানে দুই ছক্কা পাঁচ করে পাচ্ছেন। রহিম সাহেবের বাবা রহিম সাহেবকে ডাকছেন। তিনি আপন ভাগ্য নিয়ে অসন্তুষ্ট। তাই ছেলের সহযোগীতা কামনা করছেন।
মৃত মানুষ ডাকতে দেখলে বুঝতে হবে মৃত্যু সন্নিকটে। রহিম সাহেবের কান্না পাচ্ছে। তিনি খুব দ্রুত মারা যাবেন। তার এত সম্পত্তির কিছুই ভোগ করতে পারলেন না, ভাবতেই চোখ ভাসিয়ে জল আসছে। রহিম সাহেব সিগারেট টানছেন। তার মনে হচ্ছে এইটাই তার শেষ সিগারেট। তারপরই মৃত্যু। লাস্ট পাফ টু ডেথ। রহিম সাহেব বিড়বিড় করছেন "Last puff to death!"
.
বিনার বাসায় কখনো মেইল আসে না। তবে আজ এসেছে। বিনা খামটি খুললো। একটা কাগজ ও একটা চেক।
স্নেহের বিনা,
তোমার বাবা বরকত আমার খুব কাছের বন্ধু ছিলেন। বরকত আমাকে জমের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। খুব ছোট বেলায় আমি একবার কুয়ায় পড়ে গিয়েছিলাম। কুয়ায় পড়ে গিয়ে আমি হাবুডুবু খাচ্ছি। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আমি ভেবেছিলাম সেটাই আমার শেষ দিন। তবে বরকত আমাকে বাঁচিয়েছিল বলে আজও এই রহিম টিকে আছে। তোমার বাবা আমাকে কীভাবে বাঁচিয়েছিল জানো? সে বলেছিল, ওরে বোকা কুয়ার দেয়ালে উপরে ওঠার জন্য আংটা দেয়া। সেটা ধরছিস না ক্যান? আমি সেদিন পণ করেছিলাম জীবনে বরকতের সাহায্যের প্রতিদান দিবোই। তবে সেই সুযোগ পাই নাই এতো দিন। তবে এখন পেয়েছি। আজ জানলাম তোমার মা অসুস্থ। আমি তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবো। চিঠির সাথে চেক দিয়েছি। সেটায় মন মতো অঙ্ক বসাও। আমার অঢেল টাকা। দেয়ার মতো কেউ নাই। তোমার বন্ধু আমার কন্যাকে নিয়ে পলায়ন করেছে। শোনা গেছে তারা রাঘু ডাকাতের কব্জায়। রাঘু আমাকে চিঠি দিয়েছে। তুমি আগামী সন্ধ্যায় আমার সাথে দেখা করো।
তোমার চাচা রহিম।
.
সুমনের যক্ষা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রাঘু বিরক্ত নিয়ে ছেলেটাকে দেখছে। কাঁশির সাথে রক্ত বের হচ্ছে। মনে হয় আয়ু শেষ। রাঘুর মনে হলো ছোকড়াকে ছেড়ে দেবে। তবে এখনই ছাড়া যাবে না। ঢাকায় চিঠি পাঠানো হয়েছে। রহিম গাজীকে ফোন দিতে বলা হয়েছে। নগদ দশ লাখ দিলেই ছেড়ে দেয়া হবে। রাঘু ঠিক করেছে এই টাকাটা পেলেই সে ডাকাতি ছেড়ে দেবে। রিধি সুমনের পাশে বসে আছে। দূরের আকাশে কতগুলো গাংচিল উড়ে যাচ্ছে। গাংচিলেরা কোথায় যাচ্ছে। রিধির ইচ্ছা করছে সুমনকে নিয়ে উড়ে চলে যেতে। তবে সেটা সম্ভব না। সে গাংচিল না।
.
রহিম সাহেব সবার জন্য একটা করে চিঠি লিখবেন বলে ভাবলেন। মৃত্যুর আগে সবার জন্য চিঠি লিখে যাওয়াটা তার কাছে ইন্টারেস্টিং বলে মনে হচ্ছে। কার কার নামে চিঠি লিখবেন সেটা ঠিক করা হলো। প্রথমে সিরাজ খাকে লেখা যেতে পারে।
চিঠি লেখা হলো না। রহিম সাহেব এখন তোতাপাখিকে কথা শেখাচ্ছেন। রহিম লাভস্ ইউ অল! Rahim loves all.
তোতাপাখি কিছু শিখছে বলে মনে হচ্ছে না। তবে রহিম সাহেব নিরাশ হচ্ছেন না। মৃত্যুর আগে ধৈর্য্য শক্তি বেড়ে যায়। তিনি বিড়বিড় করে যাচ্ছেন " Rahim love you all" রহিম সাহেব খেয়াল করলেন তার বিছানায় বসে তিনজন লুডু খেলছে।
.
সুমন এবং রিধিকে মুক্ত করে দেয়া হলো। রাঘু ডিক্লেয়ার করলো সে আর ডাকাতি করবে না। এ ব্যাপারে তার চ্যালাপ্যালারা খুব খুশি বলে মনে হচ্ছে। তারা হয়তো রাঘুর নাম বেঁচে খাবে। রাঘু তার বাবার কাছে চলে যাবে। রাঘুর বাবা হচ্ছে সিরাজ খাঁ। রাঘুর আসল নাম রসুল খাঁ।
.
বিনা চেয়ারে বসে আছে। তার মায়ের কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়েছে। কিডনি দিয়েছে বরকত। বরকতকে খুঁজে এনেছে রহিম সাহেব। বরকত এবং সুমন বারান্দার বেঞ্চে বসা। সুমন এবং বিনার বিয়ের বন্দোবস্তো চলছে। রহিম সাহেব সব দ্বায়িত্ব নিয়েছেন। রিধিকে ব্যাপক প্রফুল্ল দেখাচ্ছে দেখে রহিম সাহেব বিস্মিত হয়ে যাচ্ছেন।
(৩ দিন পর)
সুমন পাঞ্জাবি উল্টো পড়ে ফেলেছে। সে ব্যাপারটা নিয়ে খুব বিব্রত বোধ করছে। একটু পরই তার বিয়ে। সবাই দেখে ফেলেছে যে, জামাই উল্টো পাঞ্জাবী পড়েছে। রহমত মাস্টার তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। অর্থাৎ ব্যাপারটকে রসিকতা হিসেবে ধরা হয়েছে। সুমন রসিকতা ককরে না। তবে আজ ভুলবশতঃ করে ফেলেছে, মন্দ কি! বিনাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। কিন্তু সেটার রহস্য ধরা যাচ্ছে না। বিয়ের দিন কি মেয়েদের রূপ বেড়ে যায়? উল্টো পাঞ্জাবী পড়া বর দেখে অতিথিদের মধ্যে একটা আমেজ সৃষ্টি হয়েছে। রহিম সাহেব সুমনের পাশে বসে সবাইকে দেখছেন। তার খুব ভালো লাগছে। আরো ভালো লাগতো যদি বিয়েটা রিধির হতো। রিধি হটাৎ সড়ে দাঁড়িয়েছে ভাবতেই রহিম সাহেবের কপালে ভাঁজ পড়লো। রাত বাড়ার সাথে সাথে বাড়ি খালি হতে শুরু করেছে। সুমন এবং বিনার জন্য গেস্ট রুমটা গুছিয়ে দেয়া হয়েছে। সুমনের থাকার জায়গা নেই। বউ নিয়ে তো মেসে ওঠা যায় না। সুমন সকালে উঠেই গ্রামে চলে যাবে। যদিও রহিম গাজী সুমন বলেছে এখানেই থেকে যেতে কিন্তু সুমন রাজি হচ্ছে না।
.
রিধি বারান্দায় বসে আছে। রাত গভীর। আজ তার ঘুম নেই, ঘুম ফাঁকি দিয়েছে। তোতাটা একটু পর পর বলে উঠছে "Sir I love u!" রিধি ব্যাপারটা নিয়ে খুবই বিরক্ত। ইচ্ছে হচ্ছে পাখির গলা চাপ দিয়ে ধরে। কিন্তু সেটা করা ঠিক হবে না। অকারণে জীব হত্যা ঠিক না। সকাল হলে তোতাটাকে ছেড়ে দেয়া হবে। কিন্তু সকাল কখন হবে। রিধির চোখ বেয়ে অকারণ জল পড়ছে। আজ ককি তার চোখে জোয়ার এসেছে। মনে হচ্ছে একটু পরে, চোখের জলে জলোচ্ছ্বাস হবে। কি অদ্ভুত কল্পনা। এই রাত যে দীর্ঘতম রাত হতে যাচ্ছে। আচ্ছা, সুমন এখন কি করছে? কথাটা ভাবতেই রিধির গলা কেঁপে উঠলো। তার ইচ্ছা করছে চিৎকার করে কাঁদে। বিয়ের দিন বিয়ের কন্যা কাঁদবে। সে তো বিয়ের কন্যা না।
.
(সুমন ও বিনার বিয়ের চারদিনের মাথায় রহিম সাহেব পরলোকগমন করেন। রিধি এমেরিকা চলে যায় তার কয়েক মাস পরে। সুমন গ্রামে চলে এসেছে। বিদ্যাসাগর বিদ্যানিকেতনের অংক শিক্ষক হিসেবে সে চাকরি করছে।)
©somewhere in net ltd.