![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম বেদনা, বিষ জ্বালা, চির লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের
আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,
চিত চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম প্রকাশ কুমারীর !
আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল করে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালবাসা তার কাকন চুড়ির কন-কন ।
...
মহা- বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়ুগ কৃপাণ ভীম রণ, ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
আমি চির বিদ্রোহী বীর –
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির !
প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের শুভ জম্মদিন । তিনি ১৮৯৯ সালের ২৪শে মে পৃথিবীতে আসেন ।
কাজী নজরুল ইসলাম অগ্রণী বাঙালি কবি, বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় এবং জাতিয় বাঙালি কবি, তিনি সঙ্গীতজ্ঞ, সংগীতস্রষ্টা, দার্শনিক, যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত । তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক ও দেশপ্রেমী । পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ দুই বাংলাতেই তার কবিতা এবং গান সমানভাবে সমাদৃত। তার কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তার কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ ।
বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা এবং তার গুরুত্ব অপরিসীম । একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় এবং অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সবসময় ছিলেন সোচ্চার । তার কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে । অগ্নিবীণা হাতে তার প্রবেশ ধূমকেতুর মতো তার প্রতিটি প্রকাশ । যেমন লেখাতেন বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে কাজেও ছিলেন তিনি বিদ্রোহী কবি ।
বিদ্রোহী কবি কাজীনজরুল ইসলাম ।
তার জন্ম এবং মৃত্যু বার্ষিকী বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে দুই বাংলাতে প্রতি বৎসর উদযাপিত হয়ে থাকে ।
নজরুল এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । তার প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয় । তিনি স্থানীয় এক মসজিদে সম্মানিত মুয়াযযিন হিসেবে কাজও করেছিলেন । কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটার দলের সাথে কাজ করতে যেয়ে তিনি কবিতা নাটক এবং সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন । ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিলেন । এসময় তিনি কলকাতাতেই থাকতেন । এসময় তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন ।
প্রকাশ করেন বিদ্রোহী এবং ভাঙার গানের মত কবিতা ধূমকেতুর মত সাময়িকী । জেলে বন্দী হওয়ার পর লিখেন রাজবন্দীর জবানবন্দী, এই সব সাহিত্যকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। ধার্মিক মুসলিম সমাজ এবং অবহেলিত ভারতীয় জনগণের সাথে তার আত্মার সম্পর্ক ছিল । তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালবাসা ও মুক্তি এবং বিদ্রোহ ।
ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও তিনি লিখেছেন । ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলা কাব্যে তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন । এটি হল ইসলামী সঙ্গীত তথা গজল, এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃষ্ট শ্যামাসংগীত এবং হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেছেন ।
নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা এবং অধিকাংশে সুরারোপ করেছেন যেগুলো এখন নজরুল সঙ্গীত বা নজরুল গীতি নামে আমাদের কাছে পরিচিত ও জনপ্রিয় । মধ্যবয়সে তিনি পিক্স ডিজিজে আক্রান্ত হয়েছিলে । এর কারনে তাকে অমৃত্যু সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়েছিল ।
একই সাথে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন । বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৭২ সালে তিনি সপরিবারে ঢাকা আসেন । এসময় তাকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয় । এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন ।
নজরুলের জীবনের চলার পথঃ
নজরুলের জন্ম এবং প্রাথমিক জীবন
১৮৯৯ সালের ২৪শে মে ১৩০৬ বাঙলা সাল ১১ই জ্যৈষ্ঠ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন । চুরুলিয়া গ্রামটি আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া ব্লকে অবস্থিত । পিতামহ কাজী আমিন উল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয়া পত্নী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান হলেন কাজীনজরুল ইসলাম । তার বাবা ছিলেন স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম ।
তারা ছিলেন তিন ভাই এবং দুই বোন । তার সহোদর তিন ভাই ও দুই বোনের নাম হলঃ সবার বড় কাজী সাহেবজান, কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন, বোন উম্মে কুলসুম। কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল দুখু মিয়া । তিনি স্থানীয় মক্তবে মসজিদ পরিচালিত মুসলিমদের ধর্মীয় স্কুল কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন । ১৯০৮ সাল যখন তার পিতার মৃত্যু হয় তখন তার বয়স ছিল মাত্র নয় বছর ।
পারিবারিক অভাব অনটনের কারণে তার শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্থ হয় এবং মাত্র দশ বছর বয়সে তাকে নেমে যেতে হয় জীবিকা অর্জ্জনের কর্মে । এসময় নজরুল মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উক্ত মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন । একই সাথে হাজী পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের মুয়াযযিন আযান দাতা হিসেবেও কাজ শুরু করেন । এইসব কাজের মাধ্যমে তিনি অল্প বয়সেই ইসলাম ধর্মের মৌলিক আচার অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান যা পরবর্তীকালে তার সাহিত্যকর্মকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছে । তিনিই বাংলা সাহিত্যে ইসলামী চেতনার চর্চা শুরু করেছেন বলা যায় ।
মক্তব, মসজিদ এবং মাজারের কাজে নজরুল বেশি দিন ছিলেন না । তিনি বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি লেটো বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান এবং নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমান নাট্যদল দলে যোগ দেন । তার চাচা কাজী বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট ওস্তাদ ছিলেন এবং আরবি ফার্সি এবং উর্দূ ভাষায় তার দখল ছিল । তাছাড়াও বজলে করিম মিশ্র ভাষায় গান রচনা করতেন ।
ধারণা করা হয় বজলে করিমের প্রভাবেই নজরুল লেটো দলে যোগ দিয়েছিলেন । এছাড়া ঐ অঞ্চলের জনপ্রিয় লেটো কবি শেখ চকোর গোদা কবি এবং কবিয়া বাসুদেবের লেটো ও কবিগানের আসরে নজরুল নিয়মিত অংশ নিতেন । লেটো দলেই সাহিত্য চর্চা শুরু হয় । এই দলের সাথে তিনি বিভিন্ন স্থানে যেতেন তাদের সাথে অভিনয় শিখতেন এবং তাদের নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন । নিজ কর্ম এবং অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্য অধ্যয়ন শুরু করেন । একইসাথে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অর্থাৎ পুরাণসমূহ অধ্যয়ন করতে থাকেন ।
সেই অল্প বয়সেই তার নাট্যদলের জন্য বেশকিছু লোকসঙ্গীত রচনা করেন । এর মধ্যে রয়েছে চাষার সঙ, শকুনীবধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ, কবি কালিদাস, বিদ্যাভূতুম, রাজপুত্রের গান, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ এবং মেঘনাদ বধ । একদিকে মসজিদ, মাজার ও মক্তব জীবন, অপর দিকে লেটো দলের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের অনেক উপাদান সরবরাহ করেছে । নজরুল কালীদেবিকে নিয়ে প্রচুর শ্যামা সঙ্গিত ও রচনা করেন, নজরুল তার শেষ ভাষনে উল্লেখ্য করেন
কেউ বলেন আমার বানী যবন কেউ বলেন কাফের । আমি বলি ও দুটোর কোনটাই না । আমি শুধু হিন্দু মুসলিম কে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি । গালাগালি কে গলাগলি তে পরিণত করার চেষ্টা করেছি ।
১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন । লেটো দলে তার প্রতিভায় সকলেই যে মুগ্ধ হয়েছিল তার প্রমাণ নজরুল লেটো ছেড়ে আসার পর তাকে নিয়ে অন্য শিষ্যদের রচিত গানঃ
আমরা এই অধীন, হয়েছি ওস্তাদহীন,ভাবি তাই নিশিদিন, বিষাদ মনে, নামেতে নজরুল ইসলাম, কি দিব গুণের প্রমাণ । এই নতুন ছাত্রজীবনে তার প্রথম স্কুল ছিল রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল এরপর তিনি ভর্তি হন মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে যা পরবর্তীতে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন নামে পরিচিতি লাভ করে । মাথরুন স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন কুমুদরঞ্জন মল্লিক যিনি সেকালের বিখ্যাত কবি হিসেবেও পরিচিত ছিলেন । তার সান্নিধ্য নজরুলের অনুপ্রেরণার একটি উৎস । কুমুদরঞ্জন স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে নজরুল সম্বন্ধে লিখেছেন
ছোট সুন্দর ছনমনে ছেলেটি, আমি ক্লাশ পরিদর্শন করিতে গেলে সে আগেই প্রণাম করিত। আমি হাসিয়া তাহাকে আদর করিতাম। সে বড় লাজুক ছিল।
যাহোক, আর্থিক সমস্যা তাকে বেশী দিন এখানে পড়াশোনা করতে দেয়নি । ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয় । প্রথমে যোগ দেন বাসুদেবের কবিদলে
এর পর একজন খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলের চা রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন । এভাবে বেশ কষ্টের মাঝেই তার বাল্য জীবন অতিবাহিত হতে থাকে । এই দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লাহ র সাথে তার পরিচয় হয় । দোকানে একা একা বসে নজরুল যেসব কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন তা দেখে রফিজউল্লাহ তার প্রতিভার পরিচয় পান । তিনিই নজরুলকে ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন ।
১৯১৫ সালে তিনি আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণী থেকে পড়াশোনা শুরু করেন । ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এখানেই পড়াশোনা করেন । ১৯১৭ সালের শেষদিকে মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষার না দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন । এই স্কুলে অধ্যয়নকালে নজরুল এখানকার চারজন শিক্ষক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন । এরা হলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী চেতনা বিশিষ্ট নিবারণচন্দ্র ঘটক, ফার্সি সাহিত্যের হাফিজ নুরুন্নবী এবং সাহিত্য চর্চার নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ।
নজরুলের সৈনিক জীবনঃ
১৯১৭ সালের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন । প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় যান । প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন । তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ সালের শেষভাগ থেকে ১৯২০ সালের মার্চ বা এপ্রিল পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর ।
এই সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক কর্পোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন । উক্ত রেজিমেন্টের পাঞ্জাবী মৌলবির কাছে তিনি ফার্সি ভাষা শিখেন । এছাড়া সহসৈনিকদের সাথে দেশী বিদেশী বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীতের চর্চা অব্যাহত রাখেন । গদ্য পদ্যের চর্চাও চলতে থাকে । করাচি সেনানিবাসে বসে নজরুল যে রচনাগুলো সম্পন্ন করেন তার মধ্যে রয়েছেঃ বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী তার প্রথম গদ্য রচনা, মুক্তি প্রথম প্রকাশিত কবিতা । গল্প: হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে, কবিতা সমাধি ইত্যাদি।
এই করাচি সেনানিবাসে থাকা সত্ত্বেও তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন । এর মধ্যে রয়েছে প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ভারতী, মানসী, মর্ম্মবাণী, সবুজপত্র, সওগাত এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা । এই সময় তার কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং ফার্সি কবি হাফিজের কিছু বই ছিল । এ সূত্রে বলা যায় নজরুলের সাহিত্য চর্চার হাতেখড়ি এই করাচি সেনানিবাসেই । সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন ।
এ সময় নজরুলের বাহিনীর ইরাক যাবার কথা ছিল । কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় আর যাননি । ১৯২০ সালের যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয় । এর পর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন ।
নজরুলের সাংবাদিক জীবন এবং বিয়েঃ
যুদ্ধ শেষে কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন । তার সাথে থাকতেন এই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমদ এখান থেকেই তার সাহিত্য সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয় । প্রথম দিকেই মোসলেম ভারত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছিল ।
এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস বাধন হারা এবং কবিতা বোধন ও শাতইল আরব, বাদল প্রাতের শরাব, আগমনী, খেয়া পারের তরণী, কোরবানি, মোহরর্ম এবংফাতেহা ই দোয়াজ্দম্, এই লেখাগুলো সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রশংসিত পায় । এর প্রেক্ষিতে কবি এব সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মোসলেম ভারত পত্রিকায় তার খেয়া পারের তরণী এবং বাদল প্রাতের শরাব কবিতা দুটির প্রশংসা করে একটি সমালোচনা প্রবন্ধ লিখেন । এ থেকেই দেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সমালোচকদের সাথে নজরুলের ঘনিষ্ঠ পরিচয় শুরু হয় ।
বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে কাজী মোতাহার হোসেন, মোজাম্মেল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, আফজালুল হক প্রমুখের সাথে পরিচয় হয় । তৎকালীন কলকাতার দুটি জনপ্রিয় সাহিত্যিক আসর গজেনদার আড্ডা এবং ভারতীয় আড্ডায় অংশগ্রহণের সুবাদে পরিচিত হন অতুলপ্রসাদ সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, শিশির ভাদুড়ী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মেলন্দু লাহিড়ী, ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ প্রমুখের সাথে । ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে তিনি শান্তিনিকেতনে যেয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করেন ।
তখন থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল । কাজী মোতাহার হোসেনের সাথে নজরুলের বিশেষ বন্ধুত্ব গড়ে উঠে ।
তরুণ নজরুলের ছবি
১৯২০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই ১২ তারিখে নবযুগ নামক একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া শুরু করে । অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেরে-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক এই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন ।
ঐ বছরই এই পত্রিকায় মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে ? শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন যার জন্য পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং নজরুলের উপর পুলিশের নজরদারী শুরু হয় । যাই হোক সাংবাদিকতার মাধ্যমে তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান ।
একইসাথে মুজফ্ফর আহমদের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতি বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছিলেন । বিভিন্ন ছোটখাটো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবিতা ও সঙ্গীতের চর্চাও চলছিল একাধারে । তখনও তিনি নিজে গান লিখে সুর দিতে শুরু করেননি । তবে ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গীতজ্ঞ মোহিনী সেনগুপ্তা তার কয়েকটি কবিতায় সুর দিয়ে স্বরলিপিসহ পত্রিকায় প্রকাশ করছিলেন ।
এর মধ্যে রয়েছেঃ হয়তো তোমার পাব দেখা, ওরে এ কোন স্নেহ-সুরধুনী সওগাত পত্রিকার ১৩২৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় তার প্রথম গান প্রকাশিত হয় । গানটি ছিলঃ বাজাও প্রভু বাজাও ঘন। ১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাসের দিকে নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে পরিচিত হন । তার সাথেই তিনি প্রথম কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন। আর এখানেই পরিচিত হন প্রমীলা দেবীর সাথে যার সাথে তার প্রথমে পরিণয় ও পরে বিয়ে হয়েছিল ।
তবে এর আগে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয় আলী আকবর খানের ভগ্নী নার্গিস আসার খানমের সাথে । বিয়ের আখত সম্পন্ন হবার পরে কাবিনের নজরুলের ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাধে । নজরুল ঘর জামাই থাকতে অস্বীকার করেন এবং বাসর সম্পন্ন হবার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান । তখন নজরুল খুব অসুস্থ ছিলেন এবং প্রমিলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন । এক পর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ।
নজরুল সাম্যবাদের একজন অগ্রদূত ছিলেন । তিনি মুসলিম হয়েও চার সন্তানের নাম হিন্দু এবং মুসলিম উভয় নামেই নামকরন করেন । যেমনঃ কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ বুলবুল, কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ ।
নজরুলের বিদ্রোহী জীবনঃ
তখন দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি করে । নজরুল কুমিল্লা থেকে কিছুদিনের জন্য দৌলতপুরে আলী আকবর খানের বাড়িতে থেকে আবার কুমিল্লা ফিরে যান ১৯ জুনে এখানে যতদিন ছিলেন ততদিনে তিনি পরিণত হন একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীতে । তার মূল কাজ ছিল শোভাযাত্রা এবং সভায় যোগ দিয়ে গান গাওয়া । তখনকার সময়ে তার রচিত ও সুরারোপিত গানগুলির মধ্যে রয়েছে "এ কোন পাগল পথিক ছুটে এলো বন্দিনী মার আঙ্গিনায়, আজি রক্ত-নিশি ভোরে, একি এ শুনি ওরে, মুক্তি কোলাহল বন্দী শৃঙ্খলে" প্রভৃতি । এখানে ১৭ দিন থেকে তিনি স্থান পরিবর্তন করেছিলেন । ১৯২১ সালের নভেম্বর মাসে আবার কুমিল্লায় ফিরে যান । ২১ নভেম্বর ছিল সমগ্র ভারতব্যাপী হরতাল এ উপলক্ষে নজরুল আবার পথে নেমে আসেন অসহযোগ মিছিলের সাথে শহর প্রদক্ষিণ করেন আর গান করেন" "ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী" নজরুলের এ সময়কার কবিতা, গান এবং প্রবন্ধের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব প্রকাশিত হয়েছে । এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে বিদ্রোহী নামক কবিতাটি । বিদ্রোহী কবিতাটি ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় এবং সারা ভারতের সাহিত্য সমাজে খ্যাতিলাভ করে । এই কবিতায় নজরুল নিজেকে বর্ণনা করেনঃ
আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম বেদনা, বিষ জ্বালা, চির লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের
আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,
চিত চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম প্রকাশ কুমারীর !
আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল করে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালবাসা তার কাকন চুড়ির কন-কন ।
মহা- বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত ।
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়ুগ কৃপাণ ভীম রণ, ভূমে রণিবে না
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত ।
আমি চির বিদ্রোহী বীর –
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির !
১৯২২ সালের ১২ই আগস্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করে । এটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো । ১৯২০-এর দশকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন এক সময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় । এর পরপর স্বরাজ গঠনে যে সশস্ত্র বিপ্লববাদের আবির্ভাব ঘটে তাতে ধূমকেতু পত্রিকার বিশেষ অবদান ছিল। এই পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,
কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু ।
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
পত্রিকার প্রথম পাতার শীর্ষে এই বাণী লিখা থাকতো। পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের কবিতা আনন্দময়ীর আগমনে প্রকাশিত হয়। এই রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় ৮ নভেম্বর পত্রিকার উক্ত সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। একই বছরের ২৩ নভেম্বর তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং একই দিনে তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর তাকে কুমিল্লা থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। ১৯২৩ সালের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দী হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে এক জবানবন্দী প্রদান করেন। চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে এই জবানবন্দী দিয়েছিলেন। তার এই জবানবন্দী বাংলা সাহিত্যে রাজবন্দীর জবানবন্দী নামে বিশেষ সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করেছে। এই জবানবন্দীতে নজরুল বলেছেনঃ
আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী । তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত । আমি কবি,আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সেবাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে ।
১৬ জানুয়ারি বিচারের পর নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় । নজরুলকে আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় । এখানে যখন বন্দী জীবন কাটাচ্ছিলেন তখন ১৯২৩ সালের ২২শে জানুয়ারি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার বসন্ত গীতিনাট্য গ্রন্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন । এতে নজরুল বিশেষ উল্লসিত হন । এই আনন্দে জেলে বসে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতাটি রচনা করেন ।
নজরুল অসুস্থতা এবং চিকিৎসাঃ
১৯৪০ সালে ৪২ বছর বয়সী নজরুল
নবযুগে সাংবাদিকতার পাশাপাশি নজরুল বেতারে কাজ করছিলেন। এমন সময়ই অর্থাৎ ১৯৪২ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন । এতে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন । তার অসুস্থতা সম্বন্ধে সুষ্পষ্টরুপে জানা যায় ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে । এরপর তাকে মূলত হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করানো হয় । কিন্তু এতে তার অবস্থার তেমন কোন উন্নতি হয়নি । সেই সময় তাকে ইউরোপে পাঠানো সম্ভব হলে নিউরো সার্জারি করা হত। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি ।
১৯৪২ সালের শেষের দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন । এরপর নজরুল পরিবার ভারতে নিভৃত সময় কাটাতে থাকে । ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তারা নিভৃতে ছিলেন । ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে কবি ও কবিপত্নীকে করাঁচির এক মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয় । এই উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল নজরুলের আরোগ্যের জন্য গঠিত একটি সংগঠন যার নাম ছিল নজরুল চিকিৎসা কমিটি, তাছাড়া তৎকালীন ভারতের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি সহযোগিতা করেছিলেন । কবি চার মাস করাঁচিতে ছিলেন ।
এরপর ১৯৫৩ সালের মে মাসে নজরুল ও প্রমীলা দেবীকে চিকিৎসার জন্য লন্ডন পাঠানো হয় । মে ১০ তারিখে লন্ডনের উদ্দেশ্যে হাওড়া রেলওয়ে স্টেশন ছাড়েন । লন্ডন পৌঁছানোর পর বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তার রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন । এদের মধ্যে ছিলেনঃ রাসেল ব্রেইন, উইলিয়াম সেজিয়েন্ট এবং ম্যাককিস্ক তারা তিনবার নজরুলের সাথে দেখা করেন ।
প্রতিটি সেশনের সময় তারা ২৫০ পাউন্ড করে পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন । রাসেল ব্রেইনের মতে নজরুলের রোগটি ছিল দুরারোগ্য বলতে গেলে আরোগ্য করা ছিল অসম্ভব । একটি গ্রুপ নির্ণয় করেছিল যে নজরুল ইনভল্যুশনাল সাইকোসিস রোগে ভুগছেন । এছাড়া কলকাতায় বসবাসরত ভারতীয় চিকিৎসকরাও আলাদা একটি গ্রুপ তৈরি করেছিলেন । উভয় গ্রুপই এই ব্যাপারে একমত হয়েছিল যে, রোগের প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসা ছিল খুবই অপ্রতুল ও অপর্যাপ্ত । লন্ডনে অবস্থিত লন্ডন ক্লিনিকে কবির এয়ার এনসেফালোগ্রাফি নামক এক্স-রে করানো হয় । এতে দেখা যায় তার মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব সংকুচিত হয়ে গেছে ।
ড: ম্যাককিস্কের মত বেশ কয়েকজন চিকিৎসক একটি পদ্ধতি প্রয়োগকে যথোপযুক্ত মনে করেন যার নাম ছিল ম্যাককিস্ক অপারেশন। অবশ্য ড: ব্রেইন এর বিরোধিতা করেছিলেন ।
এই সময় নজরুলের মেডিকেল রিপোর্ট ভিয়েনার বিখ্যাত চিকিৎসকদের কাছে পাঠানো হয় । এছাড়া ইউরোপের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও পাঠানে হয়েছিল । জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসার্জন অধ্যাপক রোঁয়েন্টগেন ম্যাককিস্ক অপারেশনের বিরোধিতা করেন । ভিয়েনার চিকিৎসকরাও এই অপারেশনের ব্যাপারে আপত্তি জানান ।
তারা সবাই এক্ষেত্রে অন্য আরেকটি পরীক্ষার কথা বলেন যাতে মস্তিষ্কের রক্তবাহগুলির মধ্যে এক্স-রেতে দৃশ্যমান রং ভরে রক্তবাহগুলির ছবি তোলা হয় সেরিব্রাল অ্যানজিওগ্রাফি কবির শুভাকাঙ্খীদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাকে ভিয়েনার চিকিৎসক ডঃ হ্যান্স হফের অধীনে ভর্তি করানো হয় । এই চিকিৎসক নোবেল বিজয়ী চিকিৎসক জুলিয়াস ওয়েগনার-জাউরেগের অন্যতম ছাত্র । ১৯৫৩ সালের ৯এ ডিসেম্বর কবিকে পরীক্ষা করানো হয় ।
এর ফলাফল থেকে ড. হফ বলেন যে, কবি নিশ্চিতভাবে পিক্স ডিজিজ নামক একটি নিউরন ঘটিত সমস্যায় ভুগছেন । এই রোগে আক্রান্তদের মস্তিষের ফ্রন্টাল ও পার্শ্বীয় লোব সংকুচিত হয়ে যায় । তিনি আরও বলেন বর্তমান অবস্থা থেকে কবিকে আরোগ্য করে তোলা অসম্ভব । ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর তারিখে কলকাতার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা ভিয়েনায় নজরুল নামে একটি প্রবন্ধ ছাপায় যার লেখক ছিলেন ডঃ অশোক বাগচি- তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য ভিয়েনায় অবস্থান করছিলেন এবং নজরুলের চিকিৎসা সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন ।
যাহোক, ব্রিটিশ চিকিৎসকরা নজরুলের চিকিৎসার জন্য বড় অংকের ফি চেয়েছিল যেখানে ইউরোপের অন্য অংশের কোন চিকিৎসকই ফি নেননি । অচিরেই নজরুল ইউরোপ থেকে দেশে ফিরে আসেন । এর পরপরই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধান চন্দ্র রায় ভিয়েনা যান এবং ড. হ্যান্স হফের কাছে বিস্তারিত শোনেন । নজরুলের সাথে যারা ইউরোপ গিয়েছিলেন তারা সবাই ১৯৫৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর রোম থেকে দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন
নজরুলের বাংলাদেশে আগমন এবং শেষ দিনগুলোঃ
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালিদের বিজয় লাভের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে । ১৯৭২ সালের ২৪ মে তারিখে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয় । বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন । কবির বাকি জীবন বাংলাদেশেই কাটে ।
বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে । বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তনে তাকে এই উপাধি প্রদান করা হয় । ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে । একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয় । একুশে পদক বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্মানসূচক পদক হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে ।
এরপর যথেষ্ট চিকিৎসা সত্ত্বেও নজরুলের স্বাস্থ্যের বিশেষ কোন উন্নতি হয়নি । ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে কবির সবচেয়ে ছোট ছেলে এবং বিখ্যাত গিটার বাদক কাজী অনিরুদ্ধ মৃত্যুবরণ করে । ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে । জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে ।
১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন । নজরুল তার একটি গানে লিখেছেন, "মসজিদেরই কাছে আমায় কবর দিয়ো ভাই, যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই" কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী তাঁর সমাধি করা হয় ।
তাঁর জানাজার নামাযে ১০ হাজারের মত মানুষ অংশ নেয়। জানাজা নামায আদায়ের পর রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, রিয়াল এডমিরাল এম এইচ খান, এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ, মেজর জেনারেল দস্তগীর জাতীয় পতাকা মন্ডিত নজরুলের মরদেহ বহন করে সোহরাওয়ার্দী ময়দান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গনে নিয়ে যান । বাংলাদেশে তাঁর মৃত্যু উপলক্ষ্যে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালিত হয় । আর ভারতের আইনসভায় কবির সম্মানে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয় ।
ছবি তথ্যঃ ইন্টারনেট ।
নজরুল জীবনে নারী ও প্রেম; ড. আবুল আজাদ ।
রফিকুল ইসলাম; কলকাতার সাহিত্যম্ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত নজরুল শ্রেষ্ঠ সংকলনে এই প্রবন্ধটি সংযুক্ত আছে।
কৃতজ্ঞতাঃবাংলাপিডিয়া
২৬ শে মে, ২০১৫ রাত ১১:৪৪
কালের সময় বলেছেন: ধন্যবাদ ভাল থাকুন শুভকামনা থাকলো ।
২| ২৪ শে মে, ২০১৫ বিকাল ৩:২৩
ইমতিয়াজ ১৩ বলেছেন: শুভ জন্মদিন দুখু মিয়া।
২৬ শে মে, ২০১৫ রাত ১১:৪৬
কালের সময় বলেছেন: ধন্যবাদ ইমতিয়াজ ভাই । ভালো থাকুন । শুভ রাত্রী ।
©somewhere in net ltd.
১|
২৪ শে মে, ২০১৫ দুপুর ২:৪০
আমি বন্দি বলেছেন: শুভ নজরুলজয়ন্তী