![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লাতিন আমেরিকার দক্ষিন অংশের পশ্চিম প্রান্তে, প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বদিকে অবস্থিত শীর্ণদেশ চিলি।দেশের পূর্ব সীমান্তে আন্দিজ পর্বতমালা আর্জেন্টিনার সাথে সীমানা নির্ধারন করেছে।উত্তরে আতকামা মরুভূমি-বিশ্বের শুষ্কতম অঞ্চল।স্পেনীয় সেটলাররা দেশটির নামকরণ করেন চিলি(স্পেনীয় উচ্চারন চিলে) কারন দেশটির আকৃতি ঠিক মরিচের মতই।কেউ কেউ চিলিকে তুলনা করেছেন তরবারির সাথে।যার হাতল ঝলকে উঠেছে শুষ্ক আতকামা মরুভূমির উজ্জ্বল রৌদ্রলোকে এবং সুতীক্ষ্ণ অংশটি স্পর্ষ করেছে দক্ষিন মেরুর বরফ স্তরকে।আবার অনেকের চোখে দেশটি প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল ঘেঁষে উত্তর-দক্ষিনে ৪২৭০ বর্গমাইল এলাকা বিশিস্ট একটি লম্বা ফিতার মত প্রসারিত ভূখণ্ড। চিলির মোট আয়তন ৭৫৬৯৫০ বর্গ কিলোমিটার বা ২,৯২,২৫৭ বর্গমাইল।
সুদুর অতীতে চিলিতে প্রায় একডজন দেশীয় উপজাতির মানুষ বাস করত।দেশের উত্তরাংশের মানুষরা খুব ভাল হাতের কাজ(হস্তশিল্প) জানতেন।এরা প্রাক-ইনকা সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।মাপুচে সংস্কৃতির মানুষরা বাস করত ছোয়াপা নদী ও চিলে দ্বীপের মধ্যবর্তী ভূভাগে।এরা ছিল মূলত চাষী সম্প্রদায়ের লোক।আর ছিল পেটাগেনিয়ান সংস্কৃতির মানুষ,মূলত বিভিন্ন নোমাডিক উপজাতির মানুষরা এই সংস্কৃতির অন্তর্ভূক্ত ছিল।এরা শিকার করত, মাছ ধরত।
ইনকা সংস্কৃতি ক্রমশ বিস্তারলাভ করেছিল চিলির উত্তরাংশে, মধ্যচিলিতে এই সংস্কৃতি জোরাল প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছিল মাপুচে বীরযোদ্ধাদের দ্বারা।শেষপর্যান্ত ইনকা ও মাপুচে সংস্কৃতির মধ্যে সীমান্ত ভাগ হয়ে গিয়েছিল লরকাই নদীর মাধ্যমে।
চিলির সীমান্তে প্রথম যে ইওরোপীয় নাবিকের পদার্পণ ঘটে তাঁর নাম ফার্দিনান্দ ম্যাগেলান।১৫২১ সালের ১ নভেম্বর তিনি চিলিতে পৌছান মূলত: সোনা-রুপার খোঁজে।তবে চিলির আবিস্কারকর্তা হিসাবে আনুষ্ঠানিক সম্মান দেয়া হয় দিয়েগো ডি আলমাগরাকে।তিনি ছিলেন ফ্রান্সিস পিজারোর অভিযান সংগী।ইনকা সভ্যতার দক্ষিন ভাগের নুভা টেলডোর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল তার ওপর।অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে তিনি ১৫৩৭ এ মধ্য চিলিতে এসে পৌছান।খুব একটা সোনা রুপার সন্ধান তিনি পাননি।এলাকার জনগন ছিল হতদরিদ্র এবং তাদের জীবনযাত্রার মানও ছিল তাঁর কাছে হতাশা জনক।
অল্পকিছুদিন পর স্পেনীয় সেনা প্রধান পেড্রো ডি ভালডিভিয়া মধ্য চিলিতে অভিযান চালান।তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেন দক্ষিন ভূ-ভাগে উপনিবেশ বিস্তারের সম্ভাবনার কথা।১৫৪২ সালে তিনি প্রতিষ্ঠিা করেন সান্তিয়াগো ডি ন্যুভা এক্সট্রিমাদুরা বা আজকের সিান্টিয়াগো শহরটি যা এখন চিলির রাজধানী।স্পেনীয় ঔপনিবেশিক শাসন কালেও চিলির উত্তর ও মধ্যভাগ ছিল পেরু রাজবংশের শাসনাধীন আর দক্ষিনাংশে যথারীতি অ্যারাউকানিয়ানদের আধিপত্য বজায় ছিল প্রায় উনবিংশ শতাব্দী পর্যান্ত।
১৮১০ সালে চিলি স্বাধীনতা ঘোষনা করে যদিও স্পেনীয় বাহিনী পুনরায় ক্ষমতা দখল করে ১৮১৪ সালে।এরপর আর্জেন্টিনা ও চিলির মিলিত বাহিনী স্পেনীয়দের চুড়ান্তভাবে পরাজিত করে এবং চিলি স্বাধীনতা লাভ করে ১৮১৮ খ্রীস্টাব্দের ১২ই ফেব্রুয়ারী।চিলিই লাতিন আমেরিকার মধ্যে প্রথম দেশ যেখানে সংসদীয় গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রচলিত আছে সেইে উনবিংশ শতক থেকেই।১৯২৫ সালে চিলির নতুন সংবিধান প্রবর্তিত হয়।
সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের উর্বর ভূমি দক্ষিন আমেরিকার দেশ চিলিতেও সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বারে বারে।আবার মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের নাকের ডগায় বলে চিলিকে এই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য মাশুলও গুনতে হয়েছে যথেস্টই।তবে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত চিলিতে কোন সামরিক ক্যু (coup) ঘটেনি, যা ছিল লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় ব্যতিক্রম। ১৯৭৩ সালে চিলির জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দে সিআইয়ের মদদপুস্ট চিলিয়ান সেনাবাহিনীর হতে নির্মমভাবে নিহত হন।চিলিতে চালু হয় জান্তা পিনোশের একনায়কতন্ত্র।হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মী গুম খুনের স্বীকার হন।সান্তিয়াগোর কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ে নেক্কারজনক হামলাকরে প্রায় চারশ ছাত্রকে হত্যাকরে জান্তাবাহিনীর সৈন্যরা।সামরিক জান্তার প্রথম বছরের সময়কালেই চিলিতে ৩০,০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়,স্বামীহারা হন ২২,০০০ মহিলা,আর অনাথ হয় ৭৭,০০০ শিশু।পিনোশে জান্তার নির্মম অত্যাচারের স্বাক্ষী হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে সান্তিয়াগোর ন্যাশনাল স্টেডিয়াম।যেটি সে সময় পরিনত হয়েছিল সামরিক জান্তার কারাগারে।অভ্যুত্থান ঘটে যাওয়ার পর সান্তিয়াগোর মাপোচা নদী ও সানকার্লোস খাল প্রবাহমান মানুষের রক্তে লালবর্ন ধারন করেছিল।চিলির লুথারপন্থী চার্চের প্রধান হেলমুট ফ্রেনজ ব্যক্তিগতভাবে নিজে নদী থেকে সত্তরটি ভাসমান মৃতদেহ উদ্ধার করেন।সবচেয়ে মজার কথা হলো সেই সময় আধুনিক স্থাপত্যের/শিল্পকলার কিউবিজম খ্যাত শাখার কিছু গুরুত্বপূর্ন বই সেনাবাহিনী নস্ট করে দেয় এ বিবেচনায় যে, এগুলিতে নিশ্চয়ই কিউবার বিপ্লবের কথা বলা আছে।আলেন্দে সরকারের পতনে ও বন্ধু আলেন্দের মৃত্য সংবাদে আরেকজন মানুষ অসুস্থ হয়ে পরেছিলেন, তিনি হলেন চিলির জনপ্রিয় কবি পাবলো নেরুদা।অসুস্থ নেরুদাকে সেই সময় কারফিউ ভেঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বাঁধা দেয় সেনাবাহিনী।শেষে বহুকস্টে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তিকরা হলেও সেই রাতেই তিনি মারা যান।পোস্টমর্টেমের নামে তাঁর দেহটিকে বিশ্রিভাবে কাটাকাটি করেছিল সেনাবাহিনী।১৯৭৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সান্তিয়াগোর রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ মিছিলে শামিল হয়েছিলেন তাদের প্রিয়কবি,বিশ্ববরেণ্য নেরুদাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।
সদ্য প্রয়াত কলাম্বিয়ার লেখক গেব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তখন লিখেছিলেন-চিলির এই পর্বটি ঐতিহাসিক বিবরনীতে গাঁথা থাকবে এমন একটা কিছু হিসাবে যা আমাদের সবাইকে যন্ত্রনাবিদ্ধ করবে।
১৯৭৩ সালে যে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করে ,তার প্রধান হিসাবে আগাস্টা পিনোশে ১৯৮৯ সালে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের আগ পর্যন্ত চিলি শাসন করে। একুশ শতকের শুরুতে এসে এখনো চিলি সামরিক শাসনের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।।
©somewhere in net ltd.