নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অপ্রিয়বক্তা।

অন্তর্জাল পরিব্রাজক

অসাধারণ নই, সাধারণ এক মানুষ।

অন্তর্জাল পরিব্রাজক › বিস্তারিত পোস্টঃ

আসুন..... আর্জেন্টিনাকে জেনে নিই।

১৭ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১০:২১



আর্জেন্টিনা। দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম বৃহৎ একটি দেশ। মেসির দেশ, ম্যারাডোনার দেশ। আসুন এদেশটি সম্পর্কে জেনে নিই আমরা।
আর্জেন্টিনার অফিশিয়াল নাম ‘আর্জেন্টাইন রিপাবলিক’ ( স্প্যানিশে রিপাব্লিকা আরজেন্তিনা’)। এর আয়তন ১০,৭৩,৫০০ বর্গমাইল বা ২৭,৮০,৪০০ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ৪ কোটি ৫০ লক্ষ ৯৯ হাজার ৮৯০ জন। আয়তনের ভিত্তিতে আর্জেন্টিনা পৃথিবীর ৮ম বৃহত্তম দেশ এবং এটি দক্ষিণ আমেরিকার ২য় বৃহত্তম। এর উত্তরে রয়েছে ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে এবং বলিভিয়া, পূর্বদিকে চিলি এবং পশ্চিম এবং দক্ষিণে দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগর। এর রাজধানী বুয়েনোস আইরেস । আর্জেন্টিনা ২৩ টি প্রদেশে বিভক্ত।
আর্জেন্টিনায় প্রথম মানুষের পা পড়ে প্রায় ১০,০০০ বছর পূর্বে, পেলিওলিথিক আমলে। অনেক পরে ১৬শ শতাব্দীতে স্পেনীয়দের আগমন ঘটে আর্জেন্টিনায়। ইউরোপীয়দের আগমনের পূর্বে আর্জেন্টিনা ছিল খুব স্বল্প জনবসতির একটি দেশ, যেখানে বিভিন্ন আদিম এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির মানুষের বসবাস ছিল। উরুগুয়ের প্রত্নতাত্বিক রাউল কাম্পা সোলের আদিম অধিবাসীদের তিনটি দলে ভাগ করেছেন। প্রথম দলটি ছিল মূলত শিকারি এবং খাদ্য সংগ্রাহক শ্রেণীর। তাদের মধ্যে তখনো মৃৎশিল্প বিকশিত হয়নি। দ্বিতীয় দলটি ছিল তারা যাদের মধ্যে মৃৎশিল্প এবং কৃষিকার্য বিকশিত হয়েছিল এবং তাদের মধ্যেও শিকারি এবং খাদ্য সংগ্রাহকরা ছিল। এরা মূলত পাতাগনিয়া এবং পাম্পা অঞ্চলে বসবাস করতো। তৃতীয় দলটিতে ছিল চারুয়া, মিনুয়েন এবং গুয়েরানিয়েসরা। এছাড়া অন্যান্য প্রধান জাতিগোষ্ঠীদের মধ্যে ছিল তিয়েরা দেল ফুয়েগোর ওনাসরা, বীগল চ্যানেল এবং কেপ হর্নের মধ্যে অবস্থিত দীপপুঞ্জের ইয়ামানারা, পাতাগনিয়ার তেহুয়েলচেসরা,চাকোর গুয়াইকুয়েরেস এবং উইচিসরা এবং লিতোরালে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা। গুয়েরানিয়েসরা দক্ষিণ আমেরিকার ব্যাপক অংশে বিস্তৃতি লাভ করলেও তারা মূলত আর্জেন্টিনার উত্তর-পূর্ব অংশে বসবাস করতো। তোবা এবং দিয়াগুইতারা যাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল চালচাকুই এবং কুইলমেসরা, বসবাস করতো মূলত উত্তরাংশে এবং সে অংশে যেটা বর্তমান কর্দবার অন্তর্গত। চারুয়া (মিনুয়েনরা যাদের অন্তর্গত), ইয়ারোস, বোহানেস এবং চানাসরা মূলত এন্ত্রে রিওস এবং বুয়েনোস আইরেস অঞ্চলগুলোতে বসবাস করতো।
যখন স্পেন এবং পর্তুগাল দেখতে পেল যে নতুন আবিষ্কৃত আমেরিকা আসলে ভারত নয় বরং একটি নতুন এবং অজানা মহাদেশ তখন তারা নিজদের মধ্যে তোর্দেসিলাস চুক্তি সম্পন্ন করে, যার মাধ্যমে দক্ষিণ আমেরিকার পূর্ব অংশের একটি পর্তুগালের জন্য এবং বাদ বাকি অংশ স্পেনের জন্য বরাদ্দ রাখে। তখনো আমেরিকার বেশিরভাগ অঞ্চলই অজানা রয়ে গিয়েছিলো এবং অনেক অভিযানকারীরা আমেরিকাতে অভিযান চালানোর পরিবর্তে পূর্ব ভারতীয় ভূখণ্ডে পৌঁছোবার পথ খুঁজছিল।পর্তুগীজ অভিযাত্রী ফার্দিনান্দ মাগিলান আরও দক্ষিণে অভিযান চালান এবং প্রথমবারের মতো সমুদ্রপথে পুরো বিশ্বকে একচক্কর দিয়ে আসেন। আমেরিকায় অভিযাত্রীরা অনেক অজানা জায়গায় অভিযান চালান, তারা রিও দে লা প্লাতা অভিযান করে আরও পশ্চিমে গিয়ে এশিয়াতে আসার পথ খুঁজেন। আর নতুন অভিযাত্রীরা রূপার খনির গুজব দ্বারা পরিচালিত হন। ভুমিপথে অভিযান পরিচালিত হয় লিমা থেকে, কিন্তু সেসময় দামী ধাতব পদার্থের অনুপস্থিতি এবং স্থানীয়ভাবে মেক্সিকোর অ্যাজটেক বা পেরুর ইনকার মতো সভ্যতার অনুপস্থিত থাকা ঐ অঞ্চলে স্পেনীয় জনসংখ্যার বিকাশ ঘটতে দেয়নি।

আর্জেন্টিনায় পদার্পণকারী প্রথম ইউরোপীয় হলেন হুয়ান দিয়াজ দে সোলিস, যিনি রিও দে লা প্লাতা আবিস্কার করেন। সোলিস এবং তার কিছু অনুচর চারুয়াদের হাতে মারা পড়েন এবং তার নৌবহর স্পেনে ফিরে যায়। সোলিসের সাথে যাওয়া অভিযাত্রী ফ্রান্সিসকো দেল পুয়ের্তো অল্পবয়সী হওয়ার কারণে চারুয়ারা তাকে মারেনি। তিনি কয়েক বছর দক্ষিণ আমেরিকাতে কাটান। ভেনেশীয় অভিযাত্রী সেবাস্তিয়ান কাবোত পরে তাকে উদ্ধার করেন। ফ্রান্সিসকো তাঁর কাছে রূপার খনির “গপ্পো” ঝাড়েন। এর কারণে ঐসব জায়গায় পরে আরও অভিযান চলে। সেখানে কোনও রূপা বা দামী কোনও ধাতব পদার্থ পাওয়া যায়নি। কিন্তু ঐসব গপ্পো বা কাল্পনিক কাহিনী পরবর্তীতে “আর্জেন্টিনা” নামের জন্ম দেয়। উল্লেখ্য যে, ইতালীয় ভাষায় আর্জেন্টিনা শব্দটির অর্থ “রূপার তৈরি” বা “রূপালী রঙ”। ইতালীয় শব্দ “আর্জেন্টিনা” বলতে বুঝায় “আরজেন্তিনা তেররা” অর্থাৎ “রূপার দেশ”। অনুমান করা হয় ভেনেশীয় অভিযাত্রী জিওভান্নি কাবোতোর দেয়া নাম থেকে “আর্জেন্টিনা” নামকরণটি এসেছে।
গোন্সালো কোয়েলো এবং আমেরিগো ভেসপুচির অভিযাত্রার মধ্য দিয়ে আর্জেন্টিনায় প্রথম ইউরোপীয় উপনিবাশবাদীদের পা পড়ে ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে। জোয়াও দে লিসবোয়া এবং এস্তাভাও দে ফ্রয়াস বর্তমান আর্জেন্টিনার রিও দে লা প্লাতা আবিস্কার করেন ১৫১২ খ্রিস্টাব্দের দিকে। তারা চারুয়াদের সাথে সংযোগ স্থাপন করেন, অভিযান চালান এবং স্থানীয়দের কাছ থেকে ইনকা সাম্রাজ্যের প্রথম খবর আনেন। তারা আরও দক্ষিণে যান গালফ অব মাতিয়াস বা পাতাগনিয়ার সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত। ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে হুয়ান দিয়াজ দে সোলিস এর নেতৃত্বে স্পেনীয়রা আর্জেন্টিনা অভিযান করে। ১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দে পেদ্রো দে মেন্দোজা , বুয়েনোস আইরেস অঞ্চলে প্রথম ছোট আকারে ইউরোপীয় বসতি স্থাপন করেন, যেটা পরে ১৫৪১ খ্রিস্টাব্দে পরিত্যাক্ত হয়।
প্যারাগুয়ে থেকেও উপনিবেশ স্থাপনের চেষ্টা চলে। রিও দে লা প্লাতা অঞ্চলে স্পেনের প্রশাসনিক বিভাজন স্থাপিত হয় ১৫৪৯ খ্রিস্টাব্দে। স্পেন এবং পর্তুগীজ সাম্রাজ্যের মধ্যে দক্ষিণ আমেরিকা ভাগাভাগি করা নিয়ে সম্পাদিত তোর্দেসিলাস চুক্তি অনুযায়ী এ অঞ্চলের ঔপনিবেশিক শাসন স্পেনীয় গভর্ণারোটের অধীনে চলে যায়। স্থাপিত হয় রিও দে লা প্লাতার প্রশাসনিক বিভাজন। ফ্রান্সিসকো দে আগুয়ের ১৫৫৩ খ্রিস্টাব্দে উত্তর আর্জেন্টিনায় সান্তিয়াগো দেল এস্তেরো শহর স্থাপন করেন। একইভাবে লোন্দ্রেস স্থাপিত হয় ১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে, মেন্দোজা ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে, সান হুয়ান ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে, সান মিগুয়েল দে তুকুমান ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হয়। অভিযাত্রী হুয়ান দে গেরে ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে সান্তা ফে স্থাপন করেন এবং ঐ একই বছর জেরোনিমো লুই দে কাব্রেরা করদোবা শহর স্থাপন করেন। গেরে আরও দক্ষিণে যান এবং বুয়েনোস আইরেস ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। সান লুইস ১৫৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।

বেরেসফোর্ডের আত্মসমর্পণ


স্পেনীয় সাম্রাজ্য আর্জেন্টিনা অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বলিভিয়া এবং পেরুর স্বর্ণ এবং রৌপ্য খনির সম্পদের এক করে দেয়। এটা পেরুর ভাইসরয়্যালটির অংশ হয়ে যায় এবং ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে রিও দে লা প্লাতার ভাইসরয়্যালটি সৃষ্টির সময় পর্যন্ত এইরকম থাকে। বুয়েনোস আইরেস হয় এর রাজধানী। ব্রিটিশরা এখানে দখলদারিত্ব নেওয়ার জন্য হামলা চালালে বুয়েনোস আইরেস থেকে সেগুলো ব্যর্থ করে দেয়া হয় ১৮০৬ এবং ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে। স্পেনীয় সম্রাট সপ্তম ফার্দিনান্দ সিংহাসনচ্যুত হলে এগুলো নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তা দেখা দেয়।
আর্জেন্টিনার কথা ছিল ভাইসরয়্যালটির উত্তরাধিকারী হওয়ার। কিন্তু ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে ‘মে বিপ্লব’ হয় এবং ভাইসরয় বালতাজার হিদালগো দে সিসনেরোস প্রথম জান্তা বা আর্জেন্টিনার প্রথম স্বাধীন সরকার কর্তৃক পদচ্যুত হন। বুয়েনোস আইরেসে স্থানীয়দের দ্বারা প্রথম সরকার গঠিত হয়। স্বাধীনতার যুদ্ধে এই জান্তা করদোবায় রাজতান্ত্রিক প্রতিবিপ্লব প্রতিহত করে কিন্তু আবার এরা বান্দা ওরিয়েন্টাল, আপার পেরু ও প্যারাগুয়েতে ব্যর্থ হয় যেগুলো পরে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

মে বিপ্লবের সময় বুয়েনোস আইরেস কাবিলদোর সামনে জনসমাগম

বিপ্লবীরা সেন্ট্রালিস্ট এবং ফেডারালিস্ট এই দুটো গ্রুপ বা দলে ভাগ হয়ে যায়। ত্রয়োদশতম বছরের এসেম্বলি কর্তৃক আর্জেন্টিনার প্রথম সুপ্রিম ডিরেক্টর হিসেবে নির্বাচিত হন গেরভাসিও আন্তনিও দে পোসাদাস। ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে তুকুমানের কংগ্রেস স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গঠন করে। এক বছর পর জেনারেল মার্তিন মিগুয়েল দে গুয়েমেস দেশের উত্তরদিকে রাজতান্ত্রিকদের পরাভূত করে থামিয়ে দেন। জেনারেল হোসে দে সান মার্তিন আন্দিজ অঞ্চলে সৈন্যবাহিনী নিয়ে স্বাধীন চিলিকে রক্ষা করেন এবং পেরুতে স্পেনীয়দের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। তিনি পেরুর স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
হোসে দে সান মার্তিন



১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে সেন্ট্রালিস্ট এবং ফেডারালিস্টরা একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন, যেটা ‘সেপেদার যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এ যুদ্ধের ফলে সুপ্রিম ডিরেক্টরের শাসনের অবসান ঘটে। ১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দে বুয়েনোস আইরেস একটি সেন্ট্রালিস্ট কন্সটিটিউশন পাশ করে যার আওতায় বার্ণার্দিনো রিভাদাভিয়া দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ হন। কিন্তু দ্রুতই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজ্যগুলো তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এবং তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করে। তারা সংবিধান বাতিল করে দেয়। এদিকে সেন্ট্রালিস্ট এবং ফেডারালিস্টরা একে অপরের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। ফেডারালিস্টরাই টীকে যান এতে এবং তারা হুয়ান মানুয়েল দে রোসাসের নেতৃত্বে ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে ‘আর্জেন্টাইন কনফেডারেশন’ গঠন করেন। হুয়ান মানুয়েল দে রোসাস তাঁর আমলে ফরাসীদের অবরোধ (১৮৩৮-৪০), কনফেডারেশনের যুদ্ধ (১৮৩৬-৩৯) এবং ইঙ্গ-ফরাসীদের যৌথ অবরোধের (১৮৪৫-৫০) মুখে পড়েন কিন্তু তাঁকে পরাস্ত করা কারো পক্ষেই সম্ভব হয়নি। তবে তার বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার নীতিমালা অভ্যন্তরীণ রাজ্যগুলোকে চটিয়ে দেয়। ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে জুস্তো জোসে দে উরকুইজা তাঁকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেন। উরকুইজা হন নতুন প্রেসিডেন্ট। তিনি ১৮৫৩ সালে একটি উদার ও ফেডারেল সংবিধান পাশ করেন। বুয়েনোস আইরেস আলাদা রাজ্য হিসেবেই ছিল কিন্তু সেটাকে ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে সেপেদার যুদ্ধে পরাভূত করে কনফেডারেশনে ফিরিয়ে আনা হয়। আর্জেন্টিনা মূলত ১৮১৪ থেকে ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত গৃহযুদ্ধের মধ্যেই ছিল।


উরকুইজা ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে পাভনের যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে উৎখাত হন। বার্তোলোমে মিত্রে হন নবগঠিত দেশের প্রেসিডেন্ট। তাঁর পরে যথাক্রমে দোমিঙ্গো ফুয়াস্তিনো সারমিয়েনতো এবং নিকোলাস আভেলানিদা প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন।
এই তিনজন প্রেসিডেন্ট আধুনিক আর্জেন্টিনার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
এখানে জেনারেশন ’৮০ বা ‘৮০র প্রজন্মের কথা না বললেই নয়। জেনারেশন ’৮০ ছিল ১৮৮০ থেকে ১৯১৬ পর্যন্ত বিরাজমান আর্জেন্টিনার সম্ভ্রান্ত শাসকবর্গ। এতি গঠিত ছিল মূলত প্রধান রাজ্য এবং অন্যান্য রাজ্যসমূহের ধনী ও ক্ষমতাশালী ব্যাক্তিবর্গের দ্বারা। এদের অবস্থান দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক বাহিনীতে ছড়িয়ে ছিল।
১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে আর্জেন্টিনার ৮ম প্রেসিডেন্ট হয়ে আসেন প্রেসিডেন্ট জুলিয়ো আর্জেনতিনো রোকা। সেসময় থেকে পরপর দশটি ফেডারেল সরকার আর্জেন্টিনার জন্য উদার অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন করে। তারা ইউরোপ থেকে ব্যাপক হারে অভিবাসনকে উৎসাহ প্রদান করেন। তখন এই অভিবাসন ছিল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম। এই ব্যাপক অভিবাসন আর্জেন্টিনার সমাজ এবং অর্থনীতিকে প্রায় নতুনভাবে এবং ব্যাপকভাবে বদলে দেয়। এতোটাই যে ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে আর্জেন্টিনা হয়ে দাঁড়ায় বিশ্বের ৭ম ধনীতম উন্নত দেশ। ব্যাপক অভিবাসন এবং কম মৃত্যুহারের ফলে সেসময় আর্জেন্টিনার জনসংখ্যা প্রায় পাঁচগুন এবং অর্থনীতি প্রায় পনেরোগুন বৃদ্ধি পায়। ১৮৭০ থেকে ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ বিশ্বে আর্জেন্টিনার গম রপ্তানি বেড়ে দাঁড়ায় ১,০০,০০০ টন থেকে ২৫,০০,০০০ টনে এবং হিমায়িত গরুর মাংস রপ্তানি বেড়ে দাঁড়ায় ২৫,০০০ থেকে ৩,৬৫,০০০ টনে, যার ফলে আর্জেন্টিনা সেসময় বিশ্বের ৫ম বৃহত্তম রপ্তানিকারী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। মোট রেলপথের পরিমাণ ৫০৩কিলোমিটার থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৩১,১০৪ কিলোমিটারে। বাধ্যতামূলক, সেকুলার এবং বিনামূল্যের শিক্ষাব্যবস্থায় আর্জেন্টিনার শিক্ষার হার বেড়ে দাঁড়ায় ২২% থেকে ৬৫%, যেটা অন্যান্য লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর তুলনায় বেশ উন্নত ছিল। তদুপরি, প্রকৃত জি ডি পি এতো দ্রুত বৃদ্ধি পায় যে ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ব্যাপক অভিবাসন সত্বেও পার ক্যাপিটা ইনকাম উন্নত দেশগুলোর স্তরের তুলনায় ৬৭% থেকে ১০০% এ উন্নীত হয়। ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে আর্জেন্টিনা পার ক্যাপিটা আয়ের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ২৫টি দেশের অন্যতম ছিল। কিন্তু ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সেটা ডেনমার্ক, কানাডা এবং নেদারল্যান্ডকে অতিক্রম করে সেটা ৭ম স্থানে পৌঁছায়। তখন আর্জেন্টিনার সামনে ছিল কেবল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড এবং বেলজিয়াম। আর্জেন্টিনার পার ক্যাপিটা আয় তখন ছিল ইতালির তুলনায় ৭০% বেশী, স্পেনের তুলনায় ৯০% বেশী, জাপানের তুলনায় ১৮০% বেশী এবং প্রতিবেশী ব্রাজিলের তুলনায় ৪০০% বেশী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আর্জেন্টিনা নিরপেক্ষ শক্তি ছিল।
হিপোলিতো ইরিগোয়েন ১৯১৬ সালে নির্বাচনে জিতে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হন। প্রেসিডেন্ট ইরিগোয়েন দুবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।সামাল দিয়েছিলেন ১৯১৯ সালে শুরু হওয়া বিশ্বব্যাপি তীব্র অর্থনৈতিক সংকট, যেটা ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ নামে পরিচিত। তবে ১৯৩০ সালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জোসে ফেলিক্স উরিবুরুর নেতৃত্বে পরিচালিত এক সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি উৎখাত হন।
এখান থেকেই শুরু হয় আর্জেন্টিনার পতনের পালা।
যদিও আর্জেন্টিনা বিশ্বের সবচেয়ে ধনী পনেরোটি দেশের অন্যতম ছিল, এই সামরিক অভ্যুত্থান আর্জেন্টিনাকে উন্নত দেশের কাতার থেকে অনুন্নত দেশের দিকে ঠেলে দেয়ার সূচনা করে। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী উরিবুরু ছিলেন আর্জেন্টিনার প্রথম ডি ফ্যাক্টও প্রেসিডেন্ট। দুবছর দেশ শাসনের পর তিনি ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর অগাস্টিন পেড্র জুস্তো এক প্রতারণাপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট হন। আর্জেন্টিনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রথম দিকে নিরপেক্ষ শক্তি ছিল। এ সিদ্ধান্ত ব্রিটেনের সমর্থন পেলেও পার্ল হারবারে জাপানি আক্রমনের পর তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পায়নি। আবারো সামরিক অভ্যুত্থান হয় দেশটিতে এবং সরকার উৎখাত হয়। এরপর আর্জেন্টিনা অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে (অর্থাৎ জার্মানি, ইতালি, জাপান জোট) যুদ্ধ ঘোষণা করে, তবে সেটি ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র এক মাস আগে।

প্রেসিডেন্ট পেরোন



তখনকার সমাজকল্যাণমন্ত্রী হুয়ান দোমিঙ্গ পেরোন জেলে নিক্ষিপ্ত হলেও তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে তাঁর মুক্তি ঘটে। এরপর ১৯৪৬ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন।
প্রেসিডেন্ট পেরোন একটি রাজনৈতিক মতবাদের জন্ম দেন যেটা “পেরোনবাদ” নামে পরিচিত। তিনি শিল্পকারখানা এবং সেবাখাতকে জাতীয়করণ করেন, মজুরিবৃদ্ধি করেন ও কর্মক্ষেত্রের পরিবেশের উন্নতি ঘটান, বৈদেশিক ঋণ পুরোপুরি পরিশোধ করেন এবং প্রায় পুরোপুরি বেকারত্ব বিমোচন করেন। কিন্তু তা স্বত্বেও অতিরিক্ত ব্যায়ের কারণে অর্থনীতির অবস্থা খারাপ হতে থাকে। তাঁর স্ত্রী এভা পেরোন, যিনি তৎকালীন দেশের ফার্স্ট লেডি, খুব জনপ্রিয় ছিলেন। এভা পেরোন খুব গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ভুমিকা পালন করতেন। ১৯৪৭ সালে সংসদীয় কংগ্রেসকে রীতিমতো আইন করে তিনি নারী ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে বাধ্য করান। এছাড়াও তিনি সমাজের অসহায় ও দুর্বলদের উন্নতির জন্য নজিরবিহীন সহায়তাদান করেন। তবে খুব দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার যে এই মহীয়সী নারী বেশীদিন দেশসেবা করতে পারেননি। ১৯৫১ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে তিনি ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর আগে আর্জেন্টাইন কংগ্রেস তাঁকে “জাতির ঐশ্বরিক নেত্রী” খেতাবে ভূষিত করেছিলো। আবার তাঁর স্বামী হুয়ান পেরোন পুনরায় দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সেবছরই।

এভা পেরোন


প্রেসিডেন্ট পেরোন ও তাঁর স্ত্রী এভা পেরোন


১৯৫৫ সালে ঘটে যায় আর্জেন্টিনার ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক ঘটনা। ১৯৫৫ সালের ১৬ই জুন রাজধানী বুয়েনোস আইরেসের প্লাজা দে মেয়ো স্কোয়ারে আর্জেন্টিনারই নৌ ও বিমানবাহিনীর ৩০টি বিমান একযোগে হামলা চালায়। এই ঘটনা প্লাজা দে মেয়োর বোমাবর্ষণ নামে পরিচিত। এটা ছিল মূলত একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান। এর উদ্দেশ্য ছিল প্রেসিডেন্ট হুয়ান পেরোনকে হত্যা করা। এতে ৩০৮ জন মানুষের মৃত্যু হয় এবং আহত হয় অসংখ্য মানুষ। ঘটনার সময় সরকারের কার্যালয় কাসা রোসাদায় অসংখ্য মানুষ সমবেত হয়েছিলো প্রেসিডেন্ট হুয়ান পেরোনকে সমর্থন জানানোর জন্য। কারণ কিছুদিন আগে হুয়ান পেরোনের বিরোধীরা তাঁর মানহানির জন্য দেশের পতাকা পুড়িয়েছিল। বিদ্রোহী সেনাদের এই ক্যুদেতা কঠোরভাবে দমন করা হয়। তারপর সে রাতেই ক্ষুব্ধ পেরোনবাদীরা আটটি চার্চ, দুটি বাসিলিকা ও একটি ক্যাথিড্রালে আগুন ধরিয়ে দেয় কারণ ক্যাথোলিক চার্চ এই ক্যুদেতা সমর্থন করেছিলো। উল্লেখযোগ্য যে পুলিশ বা দমকলকর্মীরা কেউই তাদের বাধা দেয়নি।

কাসা রোসাদা

তবে সেবছরই সেপ্টেম্বর মাসে আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট হুয়ান পেরোন উৎখাত হন। এরপর পেরোন স্পেনে চলে যান। মিলিটারি ডিক্টেটরের হাতে চলে যায় দেশ। দেশের তৎকালীন নতুন কর্তা পেদ্রো ইউজিনিও আরাম্বুরু এসেই পেরোনবাদকে নিষিদ্ধ করেন। তবে পেরোনবাদীরা গোপনে তাদের তৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকে। মিলিটারি ডিক্টেটরশিপ শেষ হয় ১৯৫৮ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের মধ্য দিয়ে, যে নির্বাচনে আর্তুরো ফ্রন্দিজি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি বিনিয়োগে উৎসাহিত করেন, বাণিজ্য ঘাটতি কমান এবং পেরোনবাদের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। পেরোনবাদীদের সাথে এবং সামরিক বাহিনীর সাথে তিনি সুসম্পর্ক রাখার চেষ্টা করেন, তবে প্রত্যখ্যাত হয়েছিলেন দুতরফ থেকেই এবং আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থানে তিনিও উৎখাত হন। আবার নিষিদ্ধ হয় পেরোনবাদ। এরপর ১৯৬৩ সালের নির্বাচনে আর্তুরো ইলিয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং তিনি দেশকে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে থাকেন। তবে পেরোনবাদকে বৈধ করার প্রচেষ্টার ফলে আবারো দেশে সামরিক অভ্যুত্থান দেখা দেয় এবং তিনি ১৯৬৬ সালে হুয়ান কার্লোস অঙ্গানিয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত এক সামরিক অভ্যুত্থানে উৎখাত হন। সামরিক শাসনে চলে যায় দেশ।
এরপর আসে “ডার্টি ওয়ার” বা নোংরা যুদ্ধের যুগ। এটা ছিল “অপারেশন কোনডোর” এর অংশ যা মূলগতভাবে ছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সি. আই. এ এর পরিকল্পনা। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক প্রেসিডেন্ট যেমন জনসন, নিক্সন, ফোর্ড,কার্টার, রিগান প্রমুখের সংশ্লিষ্টতা ছিল এবং এসময় যুক্তরাষ্ট্র আর্জেন্টাইন সরকারকে অনেক সামরিক সাহায্য এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করেছিলো। এ যুদ্ধটা ছিল আদতে রাষ্ট্রীয় সান্ত্রাসবাদ যা পরিচালিত হয়েছিলো মূলত রাজনৈতিক ভিন্নমতোবলাম্বি এবং বামপন্থি গেরিলাদের বিরুদ্ধে, এবং তাদের বিরুদ্ধেও যাদের মনে করা হতো সোশিয়ালিজমের সাথে সংশ্লিষ্ট অথবা রাষ্ট্রের নয়া উদারতাবাদ পলিসির বিরোধী। এর শিকার যারা হয়েছিলো তাদের সংখ্যা আনুমানিক ১৫,০০০ থেকে ৩০,০০০ এর মধ্যে। আরও যারা এর শিকার হয়েছিলো তারা ছিল মূলত বামপন্থী, ট্রেড ইউনিয়নিস্ট, ছাত্র, সাংবাদিক, মার্ক্সবাদী, পেরোনবাদী গেরিলারা এবং তারাও যারা ছিল এদের প্রতি সহমর্মি। গেরিলারা, যাদের শিকারের সংখ্যা ছিল ৫০০-৫৪০ এর মতো, তারা ছিল মূলত মিলিটারি এবং পুলিশ এবং ২৩০ জন নাগরিক। কিন্তু এই গেরিলারা মূলত ১৯৭৬ এর পর থেকে নিস্ক্রিয় ছিল । সুতরাং আদতে যুদ্ধের বদলে এটা ছিল মূলত সাধারণ নাগরিকদের উপর সামরিক জান্তার পরিচালিত একটি গণহত্যা।
চিলির গুপ্ত পুলিশের তরফ থেকে পাওয়া কিছু ডিক্লাসিফাই হওয়া ডকুমেন্ট থেকে জানা যায় যে ২২,০০০ মানুষকে ১৯৭৫ থে ৭৮ সালের মধ্যে হত্যা অথবা গুম করা হয়েছিলো। পরবর্তীতে প্রকাশিত হয় যে, ৮৬২৫ জন মানুষ স্রেফ উধাও হয়েছিলেন এবং এদেরকে বন্দী করে রাখা হয়েছিলো গোটা আর্জেন্টিনা জুড়ে থাকা অসংখ্য গুপ্ত বন্দীশিবিরে এবং এরা মুক্ত হয়েছিলেন মূলত কূটনৈতিক চাপে। বিভিন্ন সূত্রে এটা মনে করা হয় যে, ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যে ৯০৮৯ জন থেকে ৩০,০০০ জনকে হয় হত্যা নয়ত গুম করা হয়েছিলো। ফকল্যান্ড যুদ্ধে পরাজয়ের পর এই সামরিক বাহিনী দেশশাসন থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দেশের কংগ্রেস এই হত্যা এবং গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য আইন পাশ করে। এই সামরিক স্বৈরশাসনের সময় যারা হত্যা নয়ত গুমের শিকার হয়েছিলো তাদের পরিবারের অথবা কাছের মানুষদের মধ্যে প্রায় ১১০০০ আর্জেন্টাইন সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছে ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করে এবং প্রত্যেকে ২০০,০০০ মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ পায়।
এই দমনপীড়নের ঘটনাগুলো কবে থেকে শুরু হল সেটার ক্রনোলজি এখনো পর্যন্ত বিতর্কিত। কারো কারো মতে এই দীর্ঘ রাজনৈতিক যুদ্ধের সূচনা ১৯৬৯ সাল থেকে। পেরোনবাদী এবং মার্ক্সবাদী প্যারামিলিটারিদের হত্যার নিশানায় পড়েছিল ট্রেড ইউনিয়নিস্টরা ১৯৬৯ সাল থেকে। আর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পেরোনবাদী ও মার্ক্সবাদীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ শুরু হয়েছিলো মূলত সেই ১৯৫৫ সাল থেকেই, প্লাজা দে মেয়োতে বোমা হামলার সময় থেকেই। ১৯৭৩ সালের ত্রেলেও হত্যাকাণ্ড, ১৯৭৩ সাল থেকে আর্জেন্টিনার কমিউনিস্টবিরোধী জোটের তৎপরতা এবং ১৯৭৫ সালের ইসাবেল মার্তিনেজ দে পেরোনের বামপন্থী গেরিলাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত নির্মূল অভিযান বা “অপারেতিভো ইন্দিপেন্দেন্সিয়া” কেও এই নোংরা যুদ্ধের সূচনাকাল হিসেবে গণ্য করা হয়।
ডিক্টেটর অঙ্গানিয়া কংগ্রেস বন্ধ করে দিলেন, সমস্ত রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করলেন এবং ছাত্র ইউনিয়ন ও শ্রমিক ইউনিয়ন ধংস করে দিলেন। ১৯৬৯ সালে দুটো ব্যাপক জনবিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় আর্জেন্টিনায় – একটি হল কর্দবাজো ও আরেকটি হল রোজারিয়াজো। সন্ত্রাসী গেরিলা সংগঠন মন্তনেরোস দেশের সাবেক কর্তা পেদ্রো ইউজিনিও আরাম্বুরুকে অপহরণ করে হত্যা করে। নতুন সরকারপ্রধান আলেহান্দ্র অগাস্তিন লানুস রাজনৈতিক চাপের মুখে হেক্তর জোসে কাম্পরাকে পেরোনের বদলে পেরোনবাদী প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াতে সুযোগ দেন। ১৯৭৩ সালের মার্চে নির্বাচনে কাম্পরা বিজয়ী হন। এরপর তিনি গেরিলাদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করেন ও স্পেনে নির্বাসিত প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হুয়ান পেরোনের নিরাপদ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করেন।
কিন্তু পেরোনের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনই বেধে যায় সংঘর্ষ। সেসময় পেরোনবাদীদের নিজেদের মধ্যকার ডানপন্থী ইউনিয়ন নেতাদের সাথে বামপন্থী মন্তনেরোসদের সংঘর্ষ জন্ম দেয় এজেইজা হত্যাকাণ্ডের। প্রেসিডেন্ট কাম্পরা পদত্যাগ করেন। তারপর বহু রাজনৈতিক সহিংসতার পরে হুয়ান পেরোন সেবছরের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে আবার বিজয় লাভ করেন। তাঁর তৃতীয় স্ত্রী ইসাবেল হন ভাইস প্রেসিডেন্ট। পেরোন মন্তনেরোসদের পার্টি থেকে থেকে বহিষ্কার করেন এবং মন্তনেরোসরা আবারো একটা গুপ্ত সংগঠনে পরিণত হয়। তাদের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য এবং পিপল’স লিবারেশন আর্মির ( ই আর পি) বিরুদ্ধে লড়ার জন্য জোসে লোপেজ রেগা আর্জেন্টিনার কমিউনিস্টবিরোধী জোটকে সংগঠিত করেন।
১৯৭৪ সালে প্রেসিডেন্ট পেরোন মৃত্যুবরণ করেন। তখন তাঁর স্ত্রী ইসাবেল হন তাঁর উত্তরসূরি। তিনি বামপন্থিদের নির্মূল করার জন্য মিলিটারি ও পুলিশকে নিয়ে একটি গোপন ডিক্রি জারি করেন এবং তুকুমান প্রদেশে ই আর পির বিদ্রোহ দমন করেন। এক বছর পর জেনারেল জোর্গে রাফায়েল ভিদেলার নেতৃত্বে পরিচালিত এক সামরিক অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট ইসাবেল পেরোন ক্ষমতা থেকে উৎখাত হন। এরা পরে ‘জাতীয় পুনর্গঠন প্রক্রিয়া’ শুরু করে, যার নাম ছিল “প্রসেসো”।
“প্রসেসো” কংগ্রেস বন্ধ করে দেয়, সুপ্রিম কোর্ট থেকে বিচারকদের অপসারণ করে এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করে। ১৯৭৬ সালের শেষের মধ্যে মন্তনেরোসরা ২০০০ সদস্য হারায় এবং ১৯৭৭ সালের মধ্যে ই আর পি পুরোপুরি পরাস্ত হয়। ব্যাপকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ার পর ই আর পি ১৯৭৯ সালে শেষবারের মতো পাল্টা আক্রমণ করে বসে যেটি দ্রুতই নির্মূল করা হয়। ক্ষমতায় থেকে যায় সামরিক জান্তা।
১৯৮২ সালে তখনকার রাষ্ট্রপ্রধান লিওপোলদো গালতিয়েরি দক্ষিণ জর্জিয়ায় অবস্থিত ব্রিটিশ ভূখণ্ড দখল করার প্রচেষ্টা চালান ও ২রা এপ্রিল ফকল্যান্ড দ্বীপ দখল করার চেষ্টা করেন। এর থেকেই ব্রিটেনের সাথে শুরু হয় আর্জেন্টিনার ফকল্যান্ড যুদ্ধ। যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে ১৪ই জুন আর্জেন্টিনা আত্মসমর্পণ করে। এরপর বুয়েনোস আইরেসের রাস্তায় রাস্তায় শুরু হয় দাঙ্গা এবং দায়ী সামরিক নেতৃত্ব সরে দাঁড়ায়। রেনালদো বিনোনে পরে গালতিয়েরির স্থলাভিষিক্ত হন এবং দেশে গনতান্ত্রিক শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হন

রাউল আলফোনসিন

১৯৮৩ সালের নির্বাচনে রাউল আলফোনসিন বিজয়ী হন। তিনি প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন করছিলেন যারা সামরিক সরকারের আমলে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিলেন। পরবর্তীতে এটা সামরিক জান্তাদের বিচারের সম্মুখীন করে এবং তাতে ক্যু এর শীর্ষস্থানীয় নেতাদের শাস্তি হয়। যদিও পরে সামরিক বাহিনীর চাপের মুখে আইন করে তিনি মামলার তদন্তের কাজ বন্ধ করে দেন। তবে অর্থনৈতিক সংকট ও মূল্যস্ফীতি তাঁর জনপ্রিয়তা হ্রাস করে এবং ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে পেরোনবাদী প্রার্থী কার্লোস মেনেম বিজয়ী হন। অন্যদিকে দাঙ্গার মুখে আলফোনসিন আগেই পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

কার্লোস মেনেম
কার্লোস মেনেম নয়া-উদারনৈতিক পলিসি গ্রহণ করেন। তিনি ক্ষমতায় এসে আলফোনসিনের আমলে শাস্তি পাওয়া অফিসারদের ক্ষমা করে দেন। ১৯৯৪ সালের সংবিধান সংশোধন মেনেমকে দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ করে দেয়। ১৯৯৫ সাল থেকে আবারো অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি শুরু হয় এবং ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের কারণে চাপের মুখে পড়ে দেশ।
ফার্ণান্দো দে লা রুয়া ১৯৯৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হন।
দে লা রুয়া অর্থনৈতিক সংকট চলা স্বত্বেও মেনেমের অর্থনৈতিক কর্মসূচী বজায় রাখেন যেটা সামাজিক অসন্তুষ্টি তৈরি করে। প্রচুর পরিমাণে অর্থ-সম্পদ দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছিলো। এটা রুখতে ব্যাপকভাবে ব্যাঙ্ক একাউন্ট ফ্রিজ করে দেয়া শুরু হয়, যেটা আরও বেশী বিক্ষোভ ও অশান্তি তৈরি করে। এর ফলে ২০০১ এর ডিসেম্বরে শুরু হয় দাঙ্গা যার ফলে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। কংগ্রেস এসময় এদুয়ারদো দুহালদেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়। তিনি আবার মেনেমের প্রতিষ্ঠা করে যাওয়া ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট বাতিল করে দেন। এর ফলে অনেক আর্জেন্টাইন তাদের সেভিংসের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হারায়। যাই হোক, ২০০২ এর শেষদিকে অর্থনৈতিক সংকট কমে আসতে থাকে। তবে পুলিশের হাতে দুজন পিকেতেরোর হত্যাকাণ্ড জন্ম দেয় রাজনৈতিক অস্থিরতার, যেকারনে দুহালদে নির্বাচন এগিয়ে নিয়ে আসতে বাধ্য হন।
নির্বাচনে নেস্তর কির্চনার বিজয়ী হন।

নেস্তর কির্চনার
দুহালদের রেখে যাওয়া নয়া-কেনেসিয় অর্থনীতির প্রসার ঘটিয়ে কির্চনার সরকারি রাজস্ব , বানিজ্য উদ্বৃত্ত ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির বেশ উন্নতি ঘটান এবং আর্জেন্টিনার অর্থনৈতিক সংকটের ইতি টানেন। তাঁর শাসনাধীনে আর্জেন্টিনা তার অনাদায়ী ঋণের পুনর্গঠন করে নজিরবিহীনভাবে বেশিরভাগ বন্ডের ৭০% মূল্যহ্রাস ঘটিয়ে এবং আই এম এফ এর ঋণ পরিশোধ করে দিয়ে। এছাড়া এসময় সামরিক অফিসার যাদের ব্যাপারে মানবাধিকার বজায় রাখার রেকর্ড সুবিধার ছিল না তাদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চালানো হয়, ডিউ অবেডিয়েন্স আইনকে বাতিল ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয় এবং সামরিক জান্তার অপরাধের ব্যাপারে আইনি প্রতিবিধান অব্যাহত রাখা হয়। কির্চনার কিন্তু নিজে পুনঃনির্বাচনের দিকে যাননি, পরিবর্তে তাঁর স্ত্রী সিনেটর ক্রিস্তিনা ফার্ণান্দেজ দে কির্চনারকে নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়া করান। ক্রিস্তিনা ২০০৭ এর নির্বাচনে বিজয়ী হন এবং আবার ২০১১ এর নির্বাচনে পুনঃনির্বাচিত হন। ক্রিস্তিনার প্রশাসন ইতিবাচক বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করে ও অন্যান্য দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়, যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সাথে অবনতিশীল সম্পর্ক অব্যাহত থাকে।
এদিকে জোর্গে রাফায়েল ভিদেলা যিনি আর্জেন্টিনার ডার্টি ওয়ার এর সময় দমন-পীড়ন চালিয়েছিলেন তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয় ২০১০ এ। তিনি ২০১৩তে কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন।
মওরিসিয় মাকরি ২০১৫ সালে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। ইনি ১৯১৬ সালের পর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি র‍্যাডিকেল নন বা পেরোনবাদী নন। বর্তমানে মাকরি প্রশাসন দেশের মুদ্রাস্ফীতি রোধ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
অফিসিয়ালি আর্জেন্টিনা মুলত একটি ফেডারেল সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র এবং প্রতিনিধিত্বমূলক গনতন্ত্র। সংবিধান মোতাবেক আর্জেন্টিনার সরকার নিয়ন্ত্রিত হয় চেক এন্ড ব্যাল্যান্স ব্যবস্থার মাধ্যমে। এর ফেডারেল সরকার তিনটি প্রধান বিভাগে গঠিত। এর আইন-প্রণয়নকারী বিভাগ দাঁড়িয়ে আছে দুই কক্ষবিশিষ্ট কংগ্রেস এর উপর, যেটা সিনেট এবং ডেপুটি চেম্বারের সমন্বয়ে গঠিত। এর মাধ্যমে আর্জেন্টিনা তার ফেডারেল আইন তৈরি, যুদ্ধ ঘোষণা ও চুক্তি অনুমোদন করে। এর রয়েছে ইম্পিচমেণ্ট এর ক্ষমতা, যার মাধ্যমে এ সরকারের যেকোনো পার্লামেন্ট সদস্যকে অপসারণ করতে পারে। ডেপুটি চেম্বার গণমানুষের প্রতিনিধিত্ব করে ও এর ২৫৭টি সদস্যপদ রয়েছে যা ৪ বছর মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হয়। প্রদেশগুলোতে আসনসংখ্যা বন্টিত হয় জনসংখ্যা মোতাবেক প্রতি দশ বছরে। ২০১৪ তে ১০টি প্রদেশে মাত্র ৫ জন ডেপুটি ছিলেন, যেখানে বুয়েনোস আইরেস প্রদেশে যেটি সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ, সেখানে ছিলেন ৭০ জন ডেপুটি। আরেকটি শাখা, সিনেটরদের চেম্বার প্রদেশগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে। এর ৭২ জন সদস্য রয়েছে যারা ৬ বছর মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হন। প্রতিটি প্রদেশে ৩টি করে আসন রয়েছে। সিনেটের আসনের এক তৃতীয়াংশ প্রতি বছরের জন্য নির্বাচিত হয়। পার্টির প্রতিনিধিত্ব করা সদস্যদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশকে অবশ্যই নারী হতে হবে। নির্বাহী বিভাগে প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন সামরিক বাহিনীর কমান্ডার ইন চীফ। কোনও বিল আইনে পরিণত হওয়ার আগে তাতে তিনি ভেটো দিতে পারেন, যদিও কংগ্রেসের ক্ষমতা আছে সেটিকে অভাররাইড করার। তিনি ক্যাবিনেট সদস্য এবং অন্যান্য অফিসারদের নিয়োগ দেন , যারা ফেডারেল আইন ও অন্যান্য পলিসি প্রয়োগ ঘটান।
প্রেসিডেন্ট সরাসরি গণমানুষের ভোটে নির্বাচিত হন ৪ বছর মেয়াদের জন্য। প্রেসিডেন্ট একটানা দুবারের বেশী নির্বাচিত হতে পারবেন না। বিচার বিভাগ গঠিত সুপ্রিম কোর্ট এবং অধস্তন ফেডারেল কোর্টগুলোর সমন্বয়ে যাদের কাজ আইন ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ করা এবং যেগুলো অসাংবিধানিক সেগুলোকে বাতিল করা। বিচার বিভাগ এখানে অন্যান্য বিভাগ থেকে স্বতন্ত্র। সুপ্রিম কোর্টের সদস্য রয়েছেন ৭ জন, যাদের নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট। এদের অবশ্য সিনেটের অনুমোদনও প্রয়োজন হয়। এরা জীবনভর সার্ভিস দিয়ে যেতে পারেন। নিম্ন আদালতের বিচারকরা প্রস্তাবিত হন ম্যাজিস্ট্রেটদের কাউন্সিল দ্বারা - সিনেট অনুমোদনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট এঁদের নিয়োগ দেন।
আর্জেন্টিনা প্রাকৃতিক সম্পদে খুবই সমৃদ্ধ একটি দেশ। এর রয়েছে উচ্চশিক্ষিত জনসংখ্যা, বৈচিত্র্যপূর্ণ শিল্পখাত এবং রপ্তানিমুখী কৃষিখাত। আর্জেন্টিনার অর্থনীতি গোটা লাতিন আমেরিকায় তৃতীয় বৃহত্তম এবং দক্ষিণ আমেরিকায় দ্বিতীয় বৃহত্তম। এর মানবসম্পদ উন্নয়নের হার খুবই উচ্চ। এর জিডিপি পার ক্যাপিটাও উচ্চ। তাছাড়া এদেশের অভ্যন্তরীণ বাজার বেশ বড় এবং এখানে হাই-টেক সেক্টরও উন্নত হচ্ছে। এটি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় উন্নয়নশীল দেশ এবং এর রয়েছে মিডল ইমার্জিং ইকোনমি। আর্জেন্টিনা জি-২০ মেজর ইকোনমির এর অন্যতম সদস্য।
২০১৯ অর্থবছরের হিসেব অনুযায়ী আর্জেন্টিনার জি.ডি.পি (পিপিপি) এর পরিমাণ হয়েছে ৯২০.২০৯ বিলিয়ন ডলার যেটা বিশ্বের ২৫তম এবং জি.ডি.পি পার ক্যাপিটা ২০,৪২৫ ডলার (পিপিপি), যেটা বিশ্বের ৫৬তম।
ঐতিহাসিকভাবেই আর্জেন্টিনা তার অর্থনীতির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি। এর উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বারে বারেই তীব্র মন্দা, আয় বৈষম্য এবং ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্যের কবলে পড়েছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আর্জেন্টিনা খুব উন্নতি অর্জন করেছিলো এবং অর্ধ শতাব্দীব্যাপী বিশ্বের ১৫টি শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতির অন্যতম দেশ ছিল। যদিও একটা দীর্ঘ সময় ধরে এর অর্থনীতি ক্রমশ নিম্নগামী হয়েছে তবুও এখনো পর্যন্ত আর্জেন্টিনা উচ্চ আয়ের দেশ।
দশকের পর দশক ধরে আর্জেন্টিনা উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির দুর্ভোগে পড়েছে। এটা আবারো আক্রান্ত করেছে একে, ২০১৭তে এই মুদ্রাস্ফীতির বার্ষিক হার ছিল ২৪.৮%। আয়বণ্টন ২০০২ থেকে শুরু করে যদিও উন্নত হয়েছে তবুও এখনো অনেকটাই আয় বৈষম্য রয়ে গেছে।
২০১৭ সালে আর্জেন্টিনা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের করা দুর্নীতির সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ৮৫তম হয়েছে যেটা ২০১৪ সালের পর রীতিমতো ২২ ধাপ উন্নতি। মাকরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এদেশ ২০১৬ সালে তার দীর্ঘদিনের ঋণ-সংকটের ইতি টেনেছে; ভালচার ফাণ্ডের সহায়তায়।



২০১২ অর্থবছরের হিসেব অনুযায়ী আর্জেন্টিনার প্রধান উৎপাদন খাতগুলি হল – খাদ্য ও পানীয় প্রক্রিয়াজাতকরণ, তামাক উৎপাদন, যানবাহন ও যানবাহনের যন্ত্রাংশ উৎপাদন, বস্ত্র ও চামড়াশিল্প, বায়োডিজেল ও রিফাইনারি দ্রব্য, লৌহ ও ইস্পাতসামগ্রী, এলুমিনিয়াম, শিল্পজাত ও কৃষিজাত যন্ত্র, সিমেন্ট, গ্লাস, আসবাবপত্র ও গৃহস্থালি পণ্য, টায়ার ও প্লাস্টিকসামগ্রী ইত্যাদি। এছাড়া তেল পরিশোধনশিল্প এবং পর্যটন শিল্প এদেশের অন্যতম প্রধান শিল্প।
আর্জেন্টিনা দীর্ঘদিন থেকেই বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ৫টি ওয়াইন (মদ) উৎপাদনকারী দেশের অন্যতম। এছাড়া এদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বেশী গরুর মাংস উৎপাদন ও ভক্ষণকারী দেশের অন্যতম।
আর্জেন্টিনা বিশ্বের ৭৪টি দেশের অন্যতম যেখানে শিশুশ্রম ও জোর-জবরদস্তিমূলক শ্রম হয়ে থাকে। ২০১৪ সালের ব্যুরো অফ ইন্টারন্যাশনাল লেবার অ্যাফেয়ার্স এর এক রিপোর্টে দেখা যায় কৃষিখাত থেকে উৎপাদিত দ্রব্যের অনেকগুলোই শিশুশ্রম ও জোর-জবরদস্তিমূলক শ্রমে উৎপাদিত।
আর্জেন্টিনার প্রধান উৎপাদনকেন্দ্র করদোবায় অবস্থিত; এখানে যানবাহন ও যানবাহনের যন্ত্রাংশ এবং ধাতবসামগ্রীর উৎপাদন হয়ে থাকে। পরবর্তী প্রধান উৎপাদনকেন্দ্র অবস্থিত বুয়েনোস আইরেস, রোজারিয়, সান মিগুয়েল দে তুকুমান, সান লরেনজো, সান নিকোলাস দে লস আররোয়স এবং উশুয়াউইয়া ও বাহিয়া অঞ্চলে। এছাড়া অন্যান্য উৎপাদনকেন্দ্রগুলো অবস্থিত সান্তা ফে, মেন্দোজা ও নিওকোয়েন, চাকো ও সান্তা ক্রুজ এবং সালতা ও চুবুত প্রদেশে।
২০১৯ এর জুলাই মাসের আদমশুমারি অনুযায়ী আর্জেন্টিনার জনসংখ্যা ৪ কোটি ৫০ লক্ষ ৯৯ হাজার ৮৯০ জন। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে মাত্র ১৫জন।
আর্জেন্টিনার মানুষ মূলত স্প্যানিশভাষী। এছাড়াও এখানে ইতালীয় ভাষাসহ অন্যান্য ভাষা চালু আছে।
আর্জেন্টিনায় শিক্ষিতের হার ৯৮%। এর সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা সকল স্তরেই অবৈতনিক এবং সেকুলার।
খ্রিস্টধর্ম আর্জেন্টিনার নাগরিকদের প্রধান ধর্ম। তবে এদেশে দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম ইহুদী এবং বৃহত্তম মুসলিম সম্প্রদায় রয়েছে। সংবিধান মোতাবেক এদেশের নাগরিকরা স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের অধিকারী। এদেশের কোনও রাষ্ট্রধর্ম নেই। ২০১৭ এর হিসেব অনুযায়ী আর্জেন্টিনার জনসংখ্যার ৬৬% রোমান ক্যাথোলিক।
উল্লেখ্য যে ভ্যাটিকানের পোপ ফ্রান্সিস আর্জেন্টিনার মানুষ এবং বর্তমান যুগে তিনিই প্রথম পোপ যিনি ইউরোপীয় নন।
সুত্রঃ উইকিপিডিয়া।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১১:২৪

নেওয়াজ আলি বলেছেন: জানলাম

২| ১৭ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১১:২৯

রাজীব নুর বলেছেন: অনেক আগেই আমি আর্জেন্টীনিয়া কে নিয়ে পোষ্ট দিয়েছি।

১৭ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১১:৩৯

অন্তর্জাল পরিব্রাজক বলেছেন: জী, আইচ্ছা.....

৩| ১৮ ই এপ্রিল, ২০২০ সকাল ১১:১৯

ক্ষুদ্র খাদেম বলেছেন: তথ্যবহুল এবং দারুণ লেখা :D

যদিও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আমার খুব পছন্দের কিছু না, কিন্তু তবুও অনেক কিছুই জানলাম :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.