নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মোহাম্মদ নাসের

মোহাম্মদ নাসের › বিস্তারিত পোস্টঃ

সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা

২২ শে মার্চ, ২০১৩ দুপুর ১২:৪৬

( উৎসর্গঃ অত্যাচারিত সংখ্যালঘু মানুষেরা এবং অগ্নিদগ্ধ গার্মেন্টস শ্রমিকরা)









নব্বই দশকের শুরুতে সোভিয়েত ভাঙনের পর, এদেশের বুদ্ধিজীবীদের (যারা নিজদেরকে প্রগতিশীল মনে করে) অধিকাংশের লেখা থেকে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ শব্দটি উবে গিয়েছিল। তাদের আচরণ থেকে আমরা বুঝেছিলাম, তারা মনে করেন, এক মেরুবিশিষ্ট পৃথিবীতে যুদ্ধের সম্ভাবনা কমে গেছে, আগামীতে তৃতীয় বিশ্বে উন্নয়ন অব্যাহত গতিতে এগিয়ে যাবে, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের সাম্প্রদায়িকতা অপসৃয়মান হবে প্রতিটি দেশে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা আরও বাড়বে, বৈশ্বিক পর্যায়ে গণতন্ত্র আরও বিকশিত হবে। অন্যদিকে প্রায় একই সময় ইতালীয় ঐতিহাসিক Domenico Lusordo (১৯৯৬) লিখছেন বিপরীত কথা, তিনি ভবিষ্যত বাণী করলেন, অক্টোবর বিপ্লবের ফসল হিসেবে পাওয়া সারা পৃথিবীর সাধারণ নারী-পুরুষের অনেক সুযোগ-সুবিধা অচিরে কেড়ে নেওয়া হবে, ধন-বর্ণ-ধর্মগত বৈষম্য আরও বাড়বে- এক কথায় অক্টোবর বিপ্লবপূর্ব পৃথিবী আরও ভয়ঙ্কর হবে আবির্ভূত হবে। গত পাঁচ বছরের ঘটনা কাদেরকে সমর্থন করছে? নিশ্চয় আমাদের বুদ্ধিজীবীদেরকে নয়। ধনবৈষম্য তো জাতীয়-আন্তর্জাতিক পরিসরে বেড়েছে, এমনকি সাম্প্রদায়িকতায় দীর্ণ পৃথিবীর এমন হতাশাজনক অবস্থা কোন কালে হয়েছিল কিনা সেটা ইতিহাসবিদদের গবেষণার বিষয়বস্তু হয়ে দাড়িয়েছে। ইতিমধ্যে এক ডজনের মত যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে , প্রতিটি ক্ষেত্রে মার্র্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তার বক্তব্যটা এমন- তার পক্ষে থাকলে কোন রাষ্ট্র বা গোষ্ঠী যতই অগণতান্ত্রিক হোক কেন সে সভ্য, গনতান্ত্রিক ; অন্যথায় সে অসভ্য, সন্ত্রাসী। এমন অবস্থায় হৃদয়বান মানুষই বসে থাকতে পারে না। তাকে পরিস্থিতি বদলাবার পথ খুঁজতে হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের বুদ্ধিজীবী শিবিরে প্রধানত দুটো ধারা দেখছি। বলাবাহুল্য, যারা প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িকতার পক্ষে অবস্থান নেয়, রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে ইসলামকে সমর্থন করে তাদেরকে হিসেবের বাইরে রাখছি। বৃহত্তর অংশটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন পরিচয়ে ৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তন দাবী করলেও প্রকাশ্যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বক্তব্য তুলে ধরে না, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রমে অংশগ্রহণ করে না। এমনকি তাদের কেউ কেউ সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভর করে দেশের সাম্প্রদায়িকতা এবং সাম্প্রদায়িকতায় পুষ্টি সরবরাহকারী ধর্মান্ধতা দূর করতে চায়। সাম্রজ্যবাদের বিপুল যুদ্ধের প্রস্তুতির প্রতিপক্ষ হিসেবে সাম্রাজ্যবাদের কথামত ইসলামী মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোকে (যারা সাম্রাজ্যবাদের অস্ত্র ছাড়া চলতে পারে না ) মনে করে। বিভিন্ন লেখায় সেগুলো তারা তুলেও ধরে। অধিকতর দুর্বল অংশটি মার্কসবাদের জনপ্রিয় ধারণাগুলো ব্যবহার করে তীব্র সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার খোলসে গন্ধপচা সাম্প্রদায়িক-ধর্মান্ধ-গোষ্ঠীর পক্ষে নেয় বা প্রকৃত শ্রেনী আন্দোলন গড়ার নামে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে হালকা করে দেখে।

এই ধারাদ্বয়ের বিপরীতে আমরা মনে করি ;

(ক) সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা-উভয়ই বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর মানুষের বিকাশের অন্তরায়, তার অস্তিত্বের হুমকি স্বরুপ। ধনবৈষম্য, পরিবেশ বিপর্যয়, যুদ্ধাস্ত্রের ক্রম দূরীকরণ, যুদ্ধের অবসান ইত্যাদি কোনটি আর্স্তজাতিক সম্পর্কের গণতান্ত্রিকরণ ছাড়া সম্ভব নয়। আবার এই বৈশ্বিক গণতন্ত্র সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার অবসান ছাড়া সম্ভব নয়।

(খ) সাম্রাজ্যবাদ তার নিজস্ব বিকাশের নিয়মে দেশে ধনবৈষম্য বাড়িয়ে চলছে, তৃতীয় বিশ্বে পরনির্ভর লুটেরা শ্রেণী গড়ে তুলছে। বিপুল সম্পদের অপচয় ঘটাচ্ছে, যুদ্ধাস্ত্রের সংখ্যা বাড়িয়ে বিক্রির জন্য হন্যে হয়ে বাজার খুঁজে চলেছে। এর ফলে ক্ষুব্ধ মানুষ যাতে সিয়াটল-জেনোয়া দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বিকল্প সমাজ গড়ার সংগ্রমে অবতীর্ণ না হয় তার জন্য সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোকে পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে বা করছে ; ইহুদী-ইসলাম-খ্রীষ্টান-হিন্দু ইত্যাদি ধর্মের সাম্প্রদায়িক অংশগুলোকে নানানভাবে মদদ দিচ্ছে। ধর্মগুলোর ঐতিহাসিক বিরোধগুলো উসকাচেছ, কখনও প্রতিবাদ করার ভান করছে ( রাজা হরিশশ্বামী ২০০১)। সন্ত্রাস-সেক্স সর্বস্ব সংস্কৃতি দিয়ে মানুষের সৃজনশীলতা-মানবিকতা নষ্ট করার চেষ্টা করছে। সকল ধরনের মানবিক সংস্কৃতির বিকাশ ও প্রচার রুদ্ধ করার প্রয়াস পাচ্ছে। তার প্রতিক্রিয়া হিসেবেও পুষ্টি পাচ্ছে দেশে দেশে ধর্মান্ধতা, সম্প্রদায়িকতা। একই সাথে উৎপাদনশীলতার বাড়ার লক্ষ্যে কতিপয় বিজ্ঞানীদের অঢেল সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। এই বিরোধ বেশী দিন চলতে পারে না। লেনিন বর্ণিত সাম্রাজ্যবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহের কোনটি লোপ পায়নি, বরং প্রতিটি আরও তীব্র হয়েছে-সেকথা বলেছেন মার্কিন সামাজ বিজ্ঞানী ডেভিড আইজেন আওয়ারসহ (২০০০) বহু বামপন্থী গবেষক (যেমন Ian Jasper, ১৯৯৩)। সেকারণে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে তৃতীয় কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল প্রদত্ত শ্লোগান, ‘‘সকল দেশের শ্রমিক এবং নিপীড়িত জাতিসমূহ এক হও ॥’’ আজও খুব প্রাসঙ্গিক। সাম্রজ্যবাদী দেশের গণমানুষেরা সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ববোধ, জাতীয়তাবাদ ও বর্ণ-ধর্মগত সংকীর্ণতা পরিহার করে শ্রেণীচেতনার উপর ভর করে বিশ্বচেতনা অর্জন করার চেষ্টা করবে, অন্যদিকে বাংলদেশসহ তৃতীয়বিশ্বের সাধারণ মানুষেরা সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ববোধ ও বর্ণ-ধর্মগত অন্ধত্ব বর্জন করে জাতীয় চেতনা ও শ্রেণীচেতনা ব্যবহার করে বিশ্বচেতনা আয়ত্ত করার প্রয়াস পাবে - এটাই লেনিন নির্দেশিত পথ। তাই তৃতীয় বিশ্বে বসে মার্ক্সবাদের নামে শ্রেণী চেতনা গড়ার লক্ষ্যে যারা জাতীয় চেতনাকে এড়িয়ে বা প্রগতিশীল জাতীয় চেতনাকে এড়িয়ে যায় বা সত্যিকার প্রগতিশীল জাতীয় চেতনাকে নানান কারণে চিনতে বারবার ভুল করে তারা যাই হোক জনগণের বন্ধু নয়- এটা সহজে বলা যায়। ফরহাদ মজহার এ ব্যাপারে ক্ষমার অযোগ্য ভ্রান্তি প্রদর্শন করছেন। এ জন্য বিস্তারিত দেখুন যতীন সরকার (২০০১)।

(গ) তৃতীয় বিশ্বসহ উন্নত বিশ্বের মানুষ তার চরম আপেক্ষিক দারিদ্র, বেকারত্ব ও সাংস্কৃতিক ভাবে অনগ্রসরতার এসব সাম্প্রদায়িক ভেল্কিবাজিতে বিভ্রান্ত হচ্ছে। ইসলাম অধ্যুষিত দেশগুলোতে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পশ্চাদপদতা এবং খ্রীষ্টান ও ইসলাম ধর্মের ঐতিহাসিক বিরোধ ঐসব ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। গণমাধ্যমগুলো চেপে যাচ্ছে, এমনকি মজহার-সলিমুল্লাহ খানরা উল্লেখ করছে না, আফগান যুদ্ধের বিরুদ্ধে সবচাইতে বেশী প্রতিবাদ বিচিত্রভাবে সংগঠিত হয়েছে এক খ্রীষ্টান অধ্যুষিত দেশে, গ্রীসে। ইতালীও কম যায়নি। গ্যালাপ ইন্টারন্যাশনাল-এর মতো পরিসংখ্যান বিশেষজ্ঞ সংস্থা ৩৭টি দেশে এ-সম্পর্কে যে নমুনা পরীক্ষা চালিয়েছিল তা থেকে জানা যাচ্ছে মাত্র ৩টি দেশের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ইসরাইল) সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই আক্রমণে সমর্থন জানাচ্ছে। এমনকি খোদ ব্রিটেনের ৫% আক্রমণের পক্ষে নয়। (আবুল হাসান রুবেল ও ফিরোজ আহমেদ, ২০০২)।৭

(ঘ) ধর্মবিশ্বাসী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী কেবলমাত্র তখনি সাম্রাজ্যবাদের কার্যকর প্রভাবের বাইরে আসতে পারে, সমাজ বিকাশে প্রগতির পক্ষে ভূমিকা রাখতে পারে যদি সে চারটি বৈশিষ্ট্য ধারণ করে;

১) সাম্রাজ্যবাদের অর্থনীতির বিকল্প অর্থনীতি হিসাবে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কোন রূপকে সমর্থন করে। কারণ এই দুই অর্থনীতির বাইরে কোন অর্থনীতি বর্তমানে সম্ভব নয়।

(২) মার্কসবাদীদের সাথে সহাবস্থানে সম্মত আছে।

(৩) অন্য ধর্ম বিশ্বাসের উপর শ্রেষ্ঠত্বের দাবী পরিহার করে মোটামুটি সমানাধিকার দিতে রাজী থাকে এবং

(৪) নারীর সমানাধিকারের অনেকটা স্বীকৃতি দেয়। মওলানা ভাসানী, ল্যাটিন আমেরিকার লিবারেশনেথিওলজি এর প্রবক্তাদের (বদরুল আলম খান,১৯৮৮) ও স্বামী বিবেকনন্দের বক্তৃতায় বা জীবনাচরণে এ ধরনের বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেলেও তালেবান বা লাদেনপন্থীর মাঝে এর কোনটির হাদিস পাওয়া যায় না অথচ আমাদের দেশের কতিপয় পরিচিত বুদ্ধিজীবী (যেমন ফরহাদ মজহার, ২০০১ এবং সলিমুল্লাহ খান, মার্কসীয় ধারণা অপব্যবহার করে তালেবানদের মাঝে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা খুঁজে পাচ্ছেন, আমাদের সবাই তালেবানদের পক্ষে থেকে লড়াই করার জন্য উদাত্ত আহবান জানাচ্ছেন। আফগান যুদ্ধকে শ্রেণী সংগ্রাম বলে প্রকৃত শ্রেণী সংগ্রামকে কালিমালিপ্ত করেছেন,প্রগতিমুখী শ্রেণী সংগ্রামের সাথে প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণী সংগ্রামকে গুলিয়ে ফেলেছেন কেউ কেউ আরো এগিয়ে লাদেনের সাথে চে এর সাথে তুলনা করতে পিছপা হচ্ছেন না। এই সব বাল্যখিল্যতার প্রকৃত জবাব লিখেছেন আবুল হাসান রুবেল ও ফিরোজ আহমেদ (২০০২) এবং আনু মুহাম্মদ (২০০২)।

তাদেরকে অশেষ ধন্যবাদ। পাঠকবৃন্দকে লেখাদ্বয় পড়তে অনুরোধ করছি।

(ঙ) কমিউনিস্ট ইশতেহার বা মার্কস-এঙ্গেলসের অন্যান্য লেখা থেকে আমরা জানি, যে কোন বড় ধরনের সামাজিক সংঘাত হতে পারে:

( ১) শ্রেণীর আভ্যন্তরীন সংঘাত

(২) প্রগতিমুখী শ্রেণী সংগ্রাম বা

(৩) প্রতিক্রিয়শীল শ্রেণী সংগ্রাম বা

(৪) বর্ণগত-জাতিগত ও ধর্মগত সংঘাত বা

(৫) একধিক বৈশিষ্টমন্ডিত যেখানে কোনটিকেই প্রধানতম হিসেবে চিহৃত করা যাচ্ছে না। আমরা অতি সহজে বলতে পারি, আফগান যুদ্ধ কোন মতে প্রগতিমুখী শ্রেণীসংগ্রাম ছিল না। যুদ্ধের এক দিকে সাম্রাজ্যবাদ থাকলেও লাদেন বাহিনীরা তালেবানরা ইতিহাসের চাকাকে পেছাতে চেয়েছে -এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এমনকি কেউ যদি বলেন, লাদেনকে সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্টি করেছে মধ্যপ্রাচ্যের স্বর্ণ-তেল-গ্যাস সম্পদ লুষ্ঠন করার জন্য, সারা পৃথিবীতে যুদ্ধোন্মদনা সৃষ্টি করে পাশ্চাত্যে NATO জোটের অপরিহার্যতা তুলে ধরা এবং চীনসহ অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রাষ্ট্র ও শক্তিকে অবরুদ্ধ করার তাগিদে সেটা কি সহজে খণ্ডান যাবে ? The Wall Street Journal এর বিভিন্ন লেখা থেকে (যেমন ১৯-এ সেপ্টেম্বরের সম্পাদকীয়) আমরা দেখছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেন ১১ই সেপ্টেম্বরের মত ঘটনার জন্য বসে ছিল। গত তিন চার বছরব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন পুঁজিবাদী দেশে বিরাজমান মন্দা, সিয়াটল থেকে উদ্ভূত ক্রমবর্ধমান সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন, ডারবান সম্মেলনে সাম্রাজ্যবাদ ও তার বিশ্বস্ত সঙ্গী জায়নবাদের পরাজয় ইত্যাদি ঘটনা থেকে বেরিয়ে এসে সমগ্র বিশ্বকে আরও শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সাম্রাজ্যবাদের হাতে টুইন টাওয়ারের মর্মন্তিক ঘটনা মোক্ষম অস্ত্র তুলে দিয়েছে। পাশ্চাত্য জগতে সাম্রাজ্যাবাদ কর্তৃক আরোপিত বিশ্ব-কাঠামোবিরোধী লড়াই কি আপাত ‘ক্রুসেড’ ও ‘জেহাদ’ দ্বারা বিভ্রান্ত হয় নি ? তাই আমাদের মস্তিস্কে কোন ভাবে আসে না -একজন বুদ্ধিজীবী যিনি নিজকে বামপন্থী মনে করেন ,সাম্রজ্যবাদ- বিরোধী সংগ্রামকে প্রধানতম কর্তব্য বলে মানেন, তিনি কি করে একটি ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা-নির্ভর আন্দোলনকে সমর্থন করে সাম্রাজ্যবাদের পাতা জালে ধরা পড়েন ?

তাদের লেখা থেকেও এটা স্পষ্ট এই যুদ্ধ কোন বর্ণগত-জাতিগত-ধর্মগত লড়াই ছিল না, কেননা যুদ্ধের মূল নায়ক সাম্রাজ্যবাদ। সাম্রাজ্যবাদ জাতি-র্ধম-বর্ণগত সংঘর্ষ উসকাতে পারে কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ যেখানে মুল পক্ষ, সেটি কোনভাবে প্রকৃত জেহাদ বা ক্রুসেড হতে পারে না। সে কখনই পুঁজিবাদের প্রাথমিক মানবিক দর্শন, ধর্মাদ্ধতা বিরোধিতা ধারন করতে পারে নি। ম্যাক্স ওয়েভারের মতে, Protestant ethics: the spirit of capitalism উনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে লোপ পেয়েছে তার স্থালে স্থান পেয়েছে পণ্যের বন্যোৎসব। সেই বন্যোৎসব এখন ভযঙ্কর রূপ নিয়ে মানুষসহ প্রকৃতি গিলে খেতে উদ্যত হয়েছে। এটা ঠিক, ব্যাপক কৃষকবিদ্রোহ কোন না কোন ভাবে ধর্মীয় উপাদান ব্যবহার করে, ধর্মীয় মূল্যাবোধ অস্বীকার করতে পারে না। তবে সেই উপাদান নিশ্চয় তালেবান বা আল-কায়দা মার্কা দর্শন নয়। এর মধ্যে সকল ধর্মের মানুষের, বিশেষ করে গরীব মানুষের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ পাবে। প্যারী ও অক্টোবর বিপ্লবের পর কোন কৃষক আন্দোলন কমিউনিষ্ট বিরোধী হয়ে কৃষক স্বার্থ দেখতে পারে না, ভবিষ্যতেও পারবে না। কমিউনিস্ট তথা শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তার প্রগতিশীলতা মাপা যেতে পরে। বর্তমান যুগের কোন ধর্মনির্ভর আন্দোলন কমিউনিস্ট ভীতিতে ভুগলে সে সাম্রাজ্যবাদের দালাল হবে বা অবশ্যম্ভাবীভাবে সাম্রাজ্যাবাদকে শক্তিশালী বরবে, স্থানীয় প্রতিক্রিয়ার ঘাটিতে রসদ যোগাবে। ইহুদী-খ্রীষ্টান ও হিন্দু মৌলবাদীদের মত ইসলামী মৌলবাদীরা (যতই তারা আস্ফালন দেখাক না কেন) আবশ্যিকভাবে সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষা করবে।

এবার দেশীয় পরিসরে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। বিশ্ব পরিসরে সাম্রাজ্যবাদ মানবতার প্রধানতম শক্র হলেও বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতাকে খাটো করার কোন সুযোগ নেই। মূলত সাম্প্রদায়িকতার কারণে এই অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদ অতি সহজে তার নকশা বাস্তবায়িত করতে পারছে। ‘সাম্প্রদায়িকতা’ শব্দটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ও সংস্কৃতিতে বহুল উচ্চারিত হলেও এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়- এই বিষয়ে আমাদের দেশে কোন সিরিয়াস আলোচনা বা গবেষণা হয়নি। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম সৈয়দ আমিরুল ইসলাম ও কাজল বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘‘বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিঃ ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতার সস্কট’’ শীর্ষক প্রবন্ধসংকলনটি। এই গ্রন্থটিতে এদেশের সংস্কৃতিতে-আদর্শিক পরিমণ্ডলে বিশেষ করে মুসলিম মানসিকতার সাম্প্রদায়িকতার শেকড় ধরার চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুল্লেখিত রয়েছে যেমন-

(ক) সাম্রাজ্যবাদ তার অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভূমিকার মাধ্যমে কিভাবে এদেশে সাম্প্রদায়িকতা লালন ও পুষ্ট করেছে বা করছে । এটা আজ তর্কাতীতভাবে প্রমাণিত-বাংলাদেশসহ ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, ইরান, মিসর প্রভৃতি দেশের প্রকৃত অসম্প্রদায়িক শক্তি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হওয়ায় সাম্রাজ্যবাদ অতীতে কট্টর ধর্মান্ধ শক্তি বা সাম্প্রদায়িক শক্তির পক্ষ নিতে দ্বিধা করেনি। এখন অবশ্য নতুন পরিকল্পনা ফাঁদছে সাম্রাজ্যবাদ। তার সৃষ্ট ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তালিবানিজম ঠেকানোর নামে আমাদের মত দেশ পুরো কব্জায় নিতে চাইছে। জনগণের দু’দিক থেকেই বিপদ-ডাঙ্গায় সাম্রাজ্যবাদ; জলে ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা।



(খ) ভারতীয় রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র এরা বৃহৎ পুঁজি বিশেষ করে মাড়ওয়ারী পুঁজি কিভাবে এখানে সাম্প্রদায়িকতাকে ইদ্ধন দিচ্ছে ? সুনীতিকুমার ঘোষের ‘‘বাংলা কেন দ্বিখন্ডিত হলো এবং কাদের স্বার্থে’’ (১৯৯৮-১৯৯৯) নামক প্রবন্ধ থেকে জানতে পারি-কিভাবে মাড়ওয়ারী পুঁজির শিরোমণি, বিড়লা কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাভাগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। সেই ষড়যন্ত্রকারী ভূমিকা সেখানেই শেষ হওয়ার কথা নয়। আমরা সহজে অনুমান করতে পারি, বাংলাদেশ যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে তার শিক্ষা-চিকিৎসার ব্যবস্থা ও অর্থনীতির উন্নতি করতে পারত, তার সুপ্রভাব পড়ত পশ্চিম বাংলাসহ বাংলাদেশের আসে পাশের ভারতীয় প্রদেশ সমূহে। সে প্রভাব কোনভাবেই ভারতীয় রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র, বৃহৎ পুঁজিপতি শ্রেণী এবং সাম্প্রদায়িক শক্তি (হিন্দু ও মুসলিম উভয়ের) পক্ষে যাবে না। বাংলাদেশ জন্মগতভাবে উপমহাদেশের হাজার হাজার বছর ধরে শোষিত মানুষের পক্ষে অন্য দিকে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির ইতিহাসের কারণে শোষক শ্রেণীর প্রতিনিধি (ফরহাদ মজহার এ ব্যাপারে আপত্তি করতে পারেন। এ জন্য বিস্তারিত দেখুন যতীন সরকার, ২০০১) তাই এই অঞ্চলের তাবৎ সাম্প্রদায়িক শক্তি বাংলাদেশের জন্মগত সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করতে চায়। আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় না, বাংলাদেশ মুসলিম বাংলা হলে (সেটা সে পঁচাত্তরের পনের আগষ্টের পরে হয়েছে) পাকিস্তান রাষ্ট্র, ভারতীয় রাষ্ট্র ও সকল সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের স্বার্থে পক্ষে যায়। তাদের দ্বন্দ্বটা বাংলাদেশকে ব্যবহার করা নিয়ে-কে কার স্বার্থে কতটুকু ব্যবহার করবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর বাংলাদেশ তাদের সকলের বিরুদ্ধে যায়, কেবল উপমহাদেশের সাধারণ মানুষের নয়, প্যালেষ্টাইন থেকে ফিলিপাইন পর্যন্ত, সকল নিপীড়িত মানুষের স্বার্থের প্রতিভূ হয়ে উঠে। এই কারনেই মনে হয় মাড়ওয়ারী পুজি স্বাধীন বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক শক্তির আশ্রয়দানকারী এবং ভারতবিরোধী শ্লোগানের কারিগর জাসদকে আর্থিক ভাবে সাহায্য করেছিল। বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি ব্যতিরেক ভারতীয় গুপ্তচর বাহিনীর তত্ত্বাবধানে মুজিব বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। ‘বাংলাদেশ’ নামটা কেবল মুসলিম সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর নয় অনেক ভারতীয় বুদ্ধিজীবীর অপছন্দের ছিল, এখনও রয়েছে। শঙ্কর জাতি হিসাবে এদেশের মানুষের পক্ষে সকল সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান আত্মস্থ করে সত্যিকারের আধুনিক জাতি হিসেবে গড়ে উঠার সম্ভাবনা অন্য জাতির তুলনায় একটু বেশী নয় কি ? আমরা এটা না বুঝলেও সাম্রজ্যবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি ভালভাবে জানে।

(গ) ভারতীয়ত্বের সাথে বাঙালীত্বের সম্পর্ক কি হবে? কি হওয় উচিত ? শিখা অনির্বাণ এর গত সংখ্যায় প্রকাশিত অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘একুশে ফেব্র“য়ারীর তাৎপর্য’ প্রবন্ধে এ ব্যপারে তার মত পাচ্ছি, সে প্রবন্ধে তিনি পশ্চিম বাঙলার বাঙালী হিসাবে বলেছেন, “বাঙালীত্ব আমাদের যতই প্রিয় হোক না কেন ভারতীয়ত্ব আমাদের অস্থিমজ্জায়।” আর বাংলাদেশের বাঙালী সম্বন্ধে লিখছেন, “যারা ত্রিশ লাখ প্রাণ বিসর্জন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছেন তারা কোন দুঃখে ভারতীয় ঈউনিয়নের একটি অঙ্গরাজ্যের অধিবাসী হতে যাবেন। ‘‘অর্থাৎ আমরা কেবল বাঙালীর সাধনা করে যাব। কিন্তু এইটুকু বলা যথেষ্ট নয়, ভারতীয় রাষ্ট্র আমাদের স্রেফ বাঙালীত্বের বিকাশ কিভাবে নেবে- এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের পেতে হবে।

(ঘ) বাঙালী হিন্দু মানুষের মুসলিম বিদ্বেষ বিশ্নেষিত হয় নি। জয়া চট্রোপাধ্যায়ের ``Bengal Divided’’ (১৯৯৫) গ্রন্থে বাংলা ভাগে হিন্দু মধ্যবিত্তের সেই মানসিকতার স্বরূপ ও ভূমিকাকে আমরা পেতে পারি। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে আনার সংগ্রামের রূপরেখা তুলে ধরা হয় নি। বিশ্লেষণ করে দেখা হয় নি-ষাটের দশকের মত মধ্যবিত্তের উপর ভর করে ঐ চেতনা ফিরিয়ে আনা সম্ভব কিনা। আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি, সেটা সম্ভব নয়। নতুন শ্রেণীর উপর ভর করে চেতনা আরও সমৃদ্ধ করে পুনরুদ্ধার হবে। ইবনে আজাদ তার সুলিখিত প্রবন্ধ,‘বাঙলার রাজনীতি ও বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ (১৯৯২)- এ সেকথাটি নানান যুক্তি ও ঐতিহাসিক তথ্য দিয়ে উপস্থাপন করেছেন এবং সঠিক ভাবে আওয়ামী লীগের পরবর্তীকালের জামাত তোষণ নীতির পূর্বাভাস দিতে সক্ষম হয়েছেন। শিখা অনির্বাণ এর ষষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত আমার একাটি প্রবন্ধ থেকে দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিচ্ছি। আশা করি পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে না;



‘‘সাম্প্রদায়িকতা একটা জনগোষ্ঠীর উন্নয়নকে দু‘দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত করে- সংখ্যালঘু জনগণ অধিকার হারা হয়ে নিজদেশে পরবাসী হয়ে পড়ে। তাদের ভেতরকার সৃজনশীলতা আত্মবিশ্বাস রুদ্ধ হয়ে পড়ে। অন্যদিকে সংখ্যাগুরু জনগণ নানা অগণতান্ত্রিক-অবৈজ্ঞানিক চেতনা যেমন ধর্মাদ্ধতা,বর্ণবাদ,আঞ্চলিকতা ইত্যাদি দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে- সৃজনশীলতা হয় পথহারা, সন্ত্রাস-নির্যাতন-ঘুষ-দুর্নীতি ধরনের অমানবিক উপসর্গে সেও হয় জর্জরিত। নানান দুযোগ-বাধা (সামাজিক-প্রকৃতিক) কোনটাই সে মোকাবেলা করতে পারে না যথার্থভাবে। এভাবে সমস্ত জনগোষ্ঠী (মুষ্ঠিমেয় ধনী-লুটেরা ছাড়া) অনুন্নয়নের জালে আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। তবে এটা ঠিক, এতে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সংখ্যালঘু জনগণ এবং সংখ্যাগুরুর নীচের তলার অংশ। এদেশের সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস কি সেই সত্য তুলে ধরে না ? সমাজের উপরিকাঠামোতে প্রাধান্য বিস্তারকারী যে কোন প্রপঞ্চের মত সাম্প্রদায়িকতার দুটো ভিত্তি রয়েছে- একটি বস্তুগত ও অন্যটি ভাবগত। একই ভাবে অসাম্প্রদায়িকতার ও দু‘টি ভিত্তি রয়েছে। ভিত্তি দু’টো একই সাথে দুর্বল / শক্তিশালী না হলে সাম্প্রদায়িকতা / অসাম্প্রদায়িকতা দুর্বল / শক্তিশালী হবে না। একটিকে অবহেলা করে আকাঙ্খিত ফলে পাওয়া যাবে না। প্রেট্রাস যেভাবে বলেছেন সে ভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে বিশ্ব-দেশীয় পরিসরে শ্রেণী কাঠামোতে ফেলে বুঝতে হবে এবং পথ খুঁজে নিতে হবে। এক্ষত্রে উত্তর মার্কসবাদীরা (কমিউনিস্ট কেন্দ্রের অবস্থা দেখুন) দু-দিক থেকে ভুলটা করেছেন;

১।

সাম্প্রদায়িকতার/ অসম্প্রদায়িকতার বস্তুগত ভিত্তিকে একেবারে অবহেলা করছেন। তারা বুঝছেন না, সমাজের সবচাইতে অসাম্প্রদায়িক (বস্তুগতভাবে) জনগোষ্ঠীকে (শ্রম বেচা ছাড়া যাদের বাঁচার কোন পথ নেই) রাজনৈতিক অর্থনৈতিক-আদর্শগতভাবে শক্তিশালী না করে সাম্প্রদায়িকতাকে হঠান যাবে না।

২।

বিশ্ব অর্থনীতি-সংস্কৃতি এবং শ্রেণীকাঠামোর বাইরে সাম্প্রদায়িকতাকে দেখছেন। তাই তারা অনুধাবন করছেন না;

(ক) সত্তর দশকের শেষার্ধ থেকে পৃথিবীর সামনে যতই সমাজতন্ত্র আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছিল-পুঁজিবাদী বিশ্ব ততই সমস্ত ক্রটিসহ (বেকারত্ব, বৈষম্য, আগ্রাসী ভোগবাদ) শক্তিশালী হচ্ছিল ততই দেশে দেশে নানান ধরেনর সাম্প্রদায়িকতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল। এই প্রক্রিয়া ক্রমশঃ অগ্রসরমান হয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দিয়েছে। এটা যেমন দারিদ্র-অশিক্ষ পীড়িত জনগণের । আত্মরক্ষামূলক (জৈবিক ও আত্মিক-উভয়ার্থে) পথানুসন্ধান তেমনি দেশে দেশে নব্য-উদার নৈতিকতাবাদীদের চরম সুবিধাবাদী-আত্মসমর্পণবাদী-নির্যাতনমূলক নীতির ফল।

(খ) যে দেশে রাজনৈতিক সচেতন মেহনতি মানুষ যত অসংগঠিত সে দেশে নানান ধরণের সাম্প্রদায়িকতা তত বেশী প্রকট।

(গ) রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার, সবদেশে বাড়লেও সবদেশে সমান ভাবে সেটা সাম্প্রদায়িকতার রূপ নেয়নি। সাম্প্রদায়িকতা সমানুপতিকহারে নির্ভর করছে সেই দেশের (ক) অর্থনীতিতে প্রাক পুজিবাদী উৎপাদনসম্পর্কের প্রভাব।

(খ) রাজনীতিতে-সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠানিক ধর্মে অবিশ্বাসীদের দুর্বলতা।



তাই উত্তর-মার্কসবাদীরা নব্য-উদার নৈতিকতাবাদীদের (আওয়ামী লীগ) কাছে দেনদরবার করে সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে চায়। তাদের বুঝা উচিত-সংখ্যাগুরুর বিরাট অংশের আন্তরিক সক্রিয়তা ছাড়া সাম্প্রদায়িকতাকে কবর দেওয়া যাবে না। সেই বিরাট অংশ হতে পারে- মেহনতি মানুষ এবং শিক্ষিত মধ্যবিত্তের খুবই প্রতিভাবান সৃজনশীল (নজরুল, জামাল নজরুল ইসলাম, শামসুর রহমান, তাজউদ্দিন প্রমুখ সৃজনশীল ব্যক্তিরা) অংশ অথচ গত পার্লামেন্টারী নির্বাচন দেখিয়েছে এখনও মেহনতি মানুষরা সাম্প্রদায়িক শক্তির ভোট ব্যাংক হিসাবে কাজ করছে। সাম্প্রদায়িকতার অবসানে সমগ্র জনগণের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধ হলে সবার স্বার্থ সমানভাবে রক্ষিত হয় না- এমনকি জনগোষ্ঠীর একাংশের (যারা সাম্প্রদায়িকতায় লাভবান হয়েছে / হচ্ছে) বর্তমানে স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে । এদেশের সংখ্যাগুরু মেহনতি অংশ গত সত্তর বছরের সাম্প্রদায়িকতায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়া লাভবান হয়নি। বরং ১৯২০-৩০ চাইতে বেশী পরিমাণে দারিদ্র-অনাহারে রোগে ইত্যাদিতে জর্জরিত হচ্ছে। তাই সে শ্রম বিক্রী করতে দিল্লী বা বোম্বে বা কলকাতায় যেতে পারে। এদেশের মুসলিম মধ্যবিত্ত কি ভুলতে পারে ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের নগদ প্রাপ্তিকে ? নিশ্চয় না। এর সাথে যোগ হয়েছে বর্তমান পুঁজিবাদী ভয়ঙ্কর অমানবিক মনোবৃত্তি, (সংখ্যালঘুর হৃদয়ের ব্যথা অনুভব করার তার সময় কোথায় ?) মুসলিম মানসে প্রোথিত ভারতীয়ত্বের প্রতি অবজ্ঞা এবং হিন্দু মানসে বাঙালীত্বের তুলনায় ভারতীত্বের প্রতি অধিকতর দুর্বলতা । সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে আমাদের দেশের মার্কসবাদীরা দু’ দিক থেকে ভুল করেছে, করছে;

(১) বস্তুগত ভিত্তিকে অনুধাবন করলেও বস্তুগত ভিত্তিকে সঠিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাঝে নাড়া দিতে পারেনি। প্রথমে শ্রেণী আন্দোলন পরে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন- এমন চিন্তায় তাদের নেতাকর্মীরা ঘুরপাক খাচ্ছে। তারা বুঝতে পারেছে না- দুটো আন্দেলনকে সমান গুরুত্ব দিয়ে এগুতে হবে। এটাই সময়কার দাবী। এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে-পাকিস্তানী আমলের মত বর্তমানে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত শ্রেণী ফলপ্রসূ সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনের মূল ভিত্তি হবে না, হতে পারে না- শ্রেণী সচেতন শ্রমিক-দিনমজুর-প্রান্তিক কৃষক ও অন্যান্য মেহনতি মানুষকে ঐ দায়িত্ব পালন করতে হবে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের উল্লেখযোগ্য একাংশ সেখানে সহায়কের ভূমিকা নিতে পারে। সেক্ষেত্রে কিছু প্রতিভাবান সৃজনশীল ব্যক্তির ভূমিকা আলাদাভাবে বিবেচনায় নিতে হবে। শ্রেণী আন্দোলন ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনের মাঝে বিভেদ টানা (বাম ও ডান উভয় দিক থেকে) আত্মঘাতী হবে- তাতে সাম্প্রদায়িক শক্তি লাভবান হবে, মেহনতি মানুষেরা পিছিয়ে যাবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে মেহনতি মানুষ ভাবাদর্শগতভাবে সজ্জিত হবে ?

(১) প্রতিষ্ঠানিক ধর্মসমূহ শ্রেণীচেতনা গড়তে মূলত চারভাবে বাধা দিচ্ছে;

(ক) বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরোধ ( বিশেষ করে হিন্দু-মুসলমান )

(খ) একই ধর্মাবলম্বীদের ভেতরকার বিরোধ (যেমন- হিন্দুদের বর্ণবাদ, শিয়া-সুন্নী-

আহমেদিয়া বিরোধ)

(গ) প্রগাঢ় ভাগ্যবাদিতা (যেমন তবলীগ-জামাত) ও

(ঙ) নারী বিদ্বেষ প্রচার।

এসব বাধাসমূহ (স্থূল শ্রেণীচেতনা নয়, যেমনটা আগে চেষ্টা করা হয়েছে) জাতীয় চেতনাকে আত্মস্থ করে গড়ে-ওঠা শ্রেণী চেতনা কেবলমাত্র হঠাতে পারে। আগামী অনেক কালব্যাপী সত্যিকার শ্রেণী চেতনা গণতান্ত্রিক জাতীয় চেতনার হাত ধরাধরি করে চলবে। তাই বঙ্গবন্ধু, সুভাষ বসু, বেগম রোকেয়া, সূর্যসেন, সিধু, ইলিয়াস শাহ্ প্রমুখ জাতীয় চরিত্রকে অস্বীকার করে নয়; তাদের যথার্থ মূল্য দিয়ে মার্কসবাদীদের এগোতে হবে।



(২) সাম্প্রদায়িকতার ভাবগত ভিত্তি তারা ঠিকমত আক্রমণ করতে পারছে না। ধর্মবিশ্বাসহীন মানবতাবাদ ও ধর্মবিশ্বাসযুক্ত মানবতাবাদ (যেমন রবীন্দ্রনাথ, লালন, আবু জর গিফারী) দুটোই সমান গুরুত্ব সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী লড়াই- এ (বিশেষ করে আমাদের জন্য),আরজ আলী মাতব্বরদের মত মানবিক দার্শনিকদের চিন্তাকে মার্কসবাদী দলগুলোর উচিত গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে। আরজ আলী মাতব্বরদের মত মানবিক দার্শনিকদের চিন্তাকে মার্কসবাদী দলগুলোর উচিত গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে। তাদের বুঝা উচিত ইসলাম ধর্ম আচারে বেশ গণতান্ত্রিক হয়েও দর্শনগতভাবে সেটা এখনও পর্যন্ত ভালভাবে ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। তাই যারা কেবল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার কথা বলে কিন্ত সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বলে সংখ্যালঘু মনঃকষ্ট অনুভ করে না- তাদেরকে সত্যিকার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তি মনে করি না। অপরপক্ষে যারা কেবল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বলে অথচ খেলাপী ঋণ , গ্যাস রপ্তানির বিরুদ্ধে সোচচার হয় না তাদেরকে প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক শক্তি বলতে রাজী নই অচিরে সাম্রাজ্যবাদ-সাপ্রদায়িকতার চরা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-তিস্তার বিপুল জলরাশিতে গুড়িয়ে যাবে, মধ্যযুগের জগদ্বিখ্যাত মানবিক বাংলাদেশ জেগে ওঠে সমগ্র পৃথিবীর অমানিশা কাটাতে সাহায্য করবে- আসুন, এই আশায় আমরা বুক বাঁধি, স্বপ্ন দেখি ও কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়ি।

ভেনিজুয়েলা, লাল সালাম।

শিখা অনির্বাণ, দশম সংখ্যা, এপ্রিল, ২০০২।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.