নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাহিত্য ভালোবাসি, সাহিত্য নিয়েই আছি, সাহিত্য নিয়েই থাকতে চাই।

মৌরি হক দোলা

আগুনপাখি

মৌরি হক দোলা › বিস্তারিত পোস্টঃ

একটি সাঁকোর ব্যবধান

২১ শে জুন, ২০২৪ রাত ১১:৫২



ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বিজ্ঞানের ব্যাপক বিপ্লবসমূহ, যার অন্যতম দুইটি নির্দেশক হতে পারে ডারউইনবাদ এবং ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বের প্রকাশ, মানবজীবনকে একটা ভঙ্গুর পথের দ্বারের কাছে এনে দাঁড় করায়। বহু বছরের উদযাপিত শান্তির উৎস ধর্ম ও ধর্মকে উপস্থাপন করা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে শুরু করে, আর সেই সাথে শুরু হয় সংশয়বাদের উত্থান। মানুষের জীবন হয়ে পড়তে শুরু করে বস্তুবাদ কেন্দ্রিক। তখন যেন বহুদিনের পুরোনো একটা নিরাপদ আশ্রয় টলতে শুরু করে এবং মানুষের চিন্তাসমূহ ও জীবনযাত্রা একটা ধাক্কা খায়। সেই ভঙ্গুর অবস্থা স্বাভাবিকভাবেই প্রতিফলিত হয় সেই সময়কার কবি-সাহিত্যক-দার্শনিকদের দর্শনে। ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে এটি 'ভিক্টোরিয়ান কনফ্লিক্টস' হিসেবে বেশ পরিচিত। এই দ্বান্দিক সময়ের প্রভাব সেই ভিক্টোরিয়ান যুগের ইংরেজ সাহিত্যিক থেকে শুরু করে বিশ শতকের ফ্রেঞ্চ, জর্মান কিংবা আমেরিকান লেখকদের লেখায়ও সুস্পষ্ট। ঊনিশ শতকের ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার যেমন তাঁর 'এনিহোয়্যার আউট অব দ্য ওয়ার্ল্ড' কবিতায় সে সময়ের পৃথিবী ছেড়ে 'অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে' চলে যাওয়ার মনোবাসনা প্রকাশ করেন, তেমনি নর্থ আমেরিকান কবি অ্যালেন গিনসবার্গ তাঁর 'আ সুপার মার্কেট ইন ক্যালিফোর্নিয়া' কিংবা 'সানফ্লাওয়ার সূত্রা'য় বলেন মানবজীবন কীভাবে তৎকালীন আধুনিকতাবাদ, পুঁজিবাদ দ্বারা কর্দমাক্ত হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে জর্মান লেখক ফ্রান্স কাফকা তো তাঁর বিখ্যাত বই 'মেটামোরফোসিস'-এর মূল চরিত্র গ্রেগরকে এ হীন অবস্থার প্রতিবাদ স্বরূপ এক কর্মে অনিচ্ছুক 'ভারমিন' বা পোকাতেই রূপান্তরিত করে ফেলেন!

আলোচ্য লেখাগুলো যখন সৃষ্টি হয় কিংবা প্রকাশিত হয়, তখন আধুনিকতাবাদ বা পুঁজিবাদের শুরুর দিককার সময়। এরপর আরও বহুবছর পেরিয়ে গিয়ে আরও একটি নতুন শতক এসে তার এক চতুর্থাংশ পর্যায়ও শেষ হয়ে যাচ্ছে। আর এ সময়টা যেন সেই বোদলেয়ারের সময়ে মাত্র শুরু হওয়া আধুনিকতাবাদ বা বস্তুবাদ বা পুঁজিবাদের একটা শীর্ষ সময়। কারণ বর্তমানের জীবনগুলো হয়ে উঠছে একেকটি পণ্য। প্রত্যেকের জীবনে আধুনিকতা এতোটাই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়েছে যে মানুষ একে অপরের থেকে চূড়ান্তভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, যে বিচ্ছিন্নতা উল্লেখ্য বিভিন্ন '-বাদ' এরই এক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। এ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার উপস্থিতি দৈনন্দিন জীবনের সাথে এতোটাই মিশে গিয়েছে যে একে আর এখন পৃথক করে তেমন কেউ উপলব্ধি করতে পারে না, বরং সকলে একেই স্বাভাবিক হিসেবে বিশ্বাস করে। স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিয়ে তারা বসবাস করতে শুরু করে এক অদৃশ্য যোজন যোজন দূরত্বে। তখন বিচ্ছিন্নতাবাদের সূত্র ধরে জীবনে একে একে এসে হাজির হয় ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, বিষণ্ণতা ও এমনই আরও কিছু নেতিবাচক উপকরণ। তখন মনে প্রশ্ন জাগে, জীবন কি কেবল এমনই স্বার্থপরতায় জর্জরিত? সব সম্পর্কের মায়াজালই কি তবে মিথ্যে? মানুষ কি দিনশেষে সত্যিই একা?

একবিংশ শতকের একজন মানুষ হিসেবে উক্ত প্রশ্নগুলো আমার মনেও ঘুরপাক খায়। কখনো কখনো বিষণ্ণতার স্রোতে তলিয়ে নিয়ে যায়। মনে হয়, সব মিথ্যে। সব কৃত্রিম। আসলে এ জগতে কেউ কারো কিছু না, তবু ভান ধরে ভালোবাসার অভিনয় করে যায় কেবল। সে পরিবার থেকে বন্ধুবান্ধব কিংবা সাধারণ পরিচিত কেউ- অর্থাৎ যে কোনো মানুষের ক্ষেত্রেই সত্য। সত্যিকারের সৌহার্দ্য বলে বোধ হয় কিছু হয় না। আর যদি কখনো বা হয়েও থাকে, অন্তত এ যুগে আর তা বেঁচে নেই। কিন্তু আমার এ বিশ্বাস যেন এক হোঁচট খেল গতকালের এক অভিজ্ঞতায়।

গতকাল আমাদের এলাকার এক প্রান্তিক অচেনা গ্রামে দলবেঁধে আমরা স্কুলের বন্ধুরা পিকনিকে যাই। পদ্মার পাড়ের এক স্থান। সামনে নদীর বিশাল অবস্থান, আমরা সব দাঁড়িয়ে আছি এক খোলা প্রান্তরে- মাথার উপরে খোলা আকাশ। নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার বদৌলতে সে স্থানে পৌঁছতে আমাদের অনেকটা দেরি হয়ে যায়। গিয়েই রান্নার যোগাড়-যন্তর শেষ করে বড় বড় পাথরের ফাঁকে চুলোর মুখ তৈরি করে রোস্টের মাংস ভাজতে শুরু করতে না করতেই অন্যদিকে শুরু হয়ে যায় অঝোর ধারাস্রোত। একে তো আষাঢ়ে বৃষ্টি, তার উপরে নদীর নিকটস্থ এলাকা। আড়াই ঘন্টার আগে এ বৃষ্টির অবসান নেই। আমরা ঊনিশ-কুড়িজন মানুষ যে যেভাবে পারলাম নৌকার গলুইতে, দোকানের ছাউনিতে আশ্রয় নিলাম। সব আমরা ছাত্র মানুষ, এতো শখ করে এতোদিন পরে পুরোনো বন্ধুরা হাজির হয়েছি এ আনন্দ আয়োজনের জন্য- তার মাঝে এই বিপদ! আয়োজন পন্ড হলে এতো টাকার ক্ষতি, দুপুরের খাবার বাদ, আনন্দও বিনষ্ট। এসব ভাবনা নিয়ে দূরের এক দোকানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। হঠাৎ শুনতে পেলাম কাছাকাছি বাড়ির এক ভদ্রমহিলা এসে নৌকায় রান্নার জিনিসপত্র নিয়ে আমাদের যে বন্ধুরা বসে ছিল, তাদের জোর করে ডেকে তার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছেন। এই ভদ্রমহিলার সাথে এই স্থানে আসার পরপরই আমাদের আলাপ হয়েছিল। কৌতুহল নিয়ে বাকি আরও মানুষের মতো তিনিও আমাদের উদ্দেশ্য কী জানতে এসে বেশ আন্তরিকতা নিয়েই বলেছিলেন, আমরা যেন সবকিছু তার বাড়িতে দিয়ে আসি। তিনি আমাদের জন্য রেঁধে দিবেন, আর আমরা ঘুরে আনন্দ করে সময় কাটাবো। কারণ তার মনে হয়েছিল খোলা জায়গায় বাতাসের মধ্যে রাঁধতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হতে পারে। কিন্তু তখন আমরা তার এ প্রস্তাবে সম্মত না হয়ে আন্তরিকতা নিয়ে জানাই যে, যদি প্রয়োজন হয় অবশ্যই তাকে জানাবো। দুঃখজনক হলেও সত্যি, তখন আমাদের মনে এ অযাচিত আন্তরিক প্রস্তাবে কৃতজ্ঞতার চেয়ে বিরক্তির উদ্রেকটাই বেশি হয়েছিল। আমরা হাঁসফাঁস করছিলাম কী করে এ আপদ থেকে নিস্তার পাওয়া যায় তার জন্য।

এরপরে সেই ভদ্রমহিলা বৃষ্টির তোড় দেখেই ভিজতে ভিজতে ছুটে আসেন আমাদেরকে তার বাড়ি নিয়ে যেতে এবং এক প্রকার জোরপূর্বক নিয়েও গেলেন। তবে শুধু তাই না, গিয়ে নিজেদের রান্নাঘরে রাঁধার ব্যবস্থা করে দিলেন, কখনো অনুপস্থিত কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে নিজেদের থেকে দিচ্ছিলেন, বারবার রান্নার কাছে গিয়ে তদারকিও করছিলেন যথাসম্ভব। এছাড়া বাকিদের নিজ ঘরে আশ্রয় দিলেন (অন্তত মেয়েগুলোকে; তবে আমার বিশ্বাস আমাদের ছেলে বন্ধুগুলোও দল বেঁধে এসে ঘরে উঠতে চাইলে মানা করতেন না)। এমনকি সবশেষে আমরা খাবারটাও খেলাম তাদের বড় ঘরে বসে। অবশ্যই শুধুমাত্র এই ভদ্রমহিলা নন, তার পরিবারের বাকি সদস্যবৃন্দসহ পাড়াপ্রতিবেশিরাও একই রকম আন্তরিকতা নিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করলেন। বহুদিন পরে এমন আন্তরিক ব্যবহার পেয়ে আমরা এতোটাই মুগ্ধ হলাম যে মনে হলো, পৃথিবী থেকে এখনও মানবিকতা হারিয়ে যায়নি। হয়ে যায়নি সকলেই বিচ্ছিন্ন কিংবা আত্মকেন্দ্রিক। এখনও পৃথিবীতে এমনও মানুষ আছে, যারা হয়তো শহরীয় আধুনিক প্রাচুর্যের মধ্যে বাস করে না- বরং সকল উন্নয়নের ধারণার থেকে সাধারণ একটি নড়বড়ে বাঁশের সাঁকোর মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন- তবে এদের মধ্যেই এখনো প্রকৃত মানবীয় মিথস্ক্রিয়তা বেঁচে আছে। এরাই মানবকূলের সেইসব প্রতিনিধি, যারা এই পৃথিবীকে ইতিবাচকভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পারে আরও বহুদিন।

ছবি: শুভ্র শোভন

মন্তব্য ১৬ টি রেটিং +৬/-০

মন্তব্য (১৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে জুন, ২০২৪ রাত ১২:২৩

বিষাদ সময় বলেছেন: চমৎকার লেখা। আমিও এরকম অনেক ঘটনা দেখেছি। তবে মানুষের চরিত্র খুব বিচিত্র। মাটির গভীরে যেতে থাকলে স্তরে ম্তরে যেমন মাটির প্রকৃতি পাল্টায়। মানুষের চরিত্র অনেকটা সে রকম। ধন্যবাদ।

২২ শে জুন, ২০২৪ রাত ১০:৩৬

মৌরি হক দোলা বলেছেন: তবে মানুষের চরিত্র খুব বিচিত্র। মাটির গভীরে যেতে থাকলে স্তরে ম্তরে যেমন মাটির প্রকৃতি পাল্টায়। মানুষের চরিত্র অনেকটা সে রকম।

যথার্থই বলেছেন। ধন্যবাদ।

২| ২২ শে জুন, ২০২৪ রাত ১২:৫০

মাহমুদুর রহমান সুজন বলেছেন: সুন্দর লিখনী।এখনো এই মানুষগুলি রয়েছে বলেই পৃথিবী এতো সুন্দর!

২২ শে জুন, ২০২৪ রাত ১০:৩৭

মৌরি হক দোলা বলেছেন: ধন্যবাদ, সুজন ভাই।

৩| ২২ শে জুন, ২০২৪ রাত ১:১৭

কামাল১৮ বলেছেন: ঐ ভদ্রমহিলার ব্যবহারের নামই মানবতাবাদ।মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ।যা আমাদের আবার ঐক্যবদ্ধ করবে।ধর্মীয় বিভেদ ভুলে মানবতাবাদের পতাকা তলে সবাই ঐক্যবদ্ধ হলে আবার ফিরে পাবো সুন্দর প্রথিবী।
প্রথমে বিশ্লষণটা খুব ভালো লাগলো।আমি ভাবছিলাম ওখানেই থাকবেন।

২২ শে জুন, ২০২৪ রাত ১০:৩৮

মৌরি হক দোলা বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

৪| ২২ শে জুন, ২০২৪ রাত ১:২০

ঢাকার লোক বলেছেন: চমৎকার লেখা।

২২ শে জুন, ২০২৪ রাত ১০:৩৮

মৌরি হক দোলা বলেছেন: ধন্যবাদ।

৫| ২২ শে জুন, ২০২৪ রাত ১:৩৬

খায়রুল আহসান বলেছেন: প্রথম তিনটে অনুচ্ছেদ পড়ার পর আমার মনে যেসব ভাবনার উদয় হয়েছে, মন্তব্যরূপে তার প্রকাশঃ
আপনার বক্তব্যের সাথে প্রতীকী ছবিটার খুব সুন্দর সমন্বয় ঘটেছে। কথা ও ছবি এভাবেই একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে।
সূচনা বক্তব্যটা, বিশেষ করে প্রথম দুটো অনুচ্ছেদ অত্যন্ত চমৎকার হয়েছে। সাহিত্যের ছাত্রী (এবং লেখকও) হিসেবে আপনার স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ ঘটুক, সাহিত্যের উন্মুক্ত আকাশে আপনি মুক্তবিহঙ্গের মত ওড়াউড়ি করে নতুন নতুন সীমানায় পৌঁছে যান, এ শুভাশিষ রইলো। মাঝে মাঝে শুধূ আপনার নতুন নতুন অভিজ্ঞতা ও ভাবনার কথাগুলো ব্লগে এসে আপনার পাঠকদের সাথে শেয়ার করে যাবেন, এ কামনাও করি।
'ভিক্টোরিয়ান কনফ্লিক্টস' নিয়ে আলোচনাটুকু সামান্য, কিন্তু এ নিয়ে ভবিষ্যতে আপনার কলম দিয়ে আরও অনেক কিছু বেরিয়ে আসতে পারে, ঐ সামান্য লেখাটুকু সে ইঙ্গিতও দিচ্ছে।

পোস্টের বাকি অংশের উপর আমার মন্তব্যঃ
প্রকৃতি উদার; সচরাচর এ উদারতার কোন ব্যত্যয় ঘটে না, যদি না অকৃতজ্ঞ মানুষ তার প্রতি চরম বৈরী হয়। মানুষও জন্মগত ভাবে উদার, কিন্তু জন্মের পর পারিপার্শ্বিকতার কারণে বহুলাংশের স্বভাবে সংকীর্ণতা ও স্বার্থান্ধতার অনুপ্রবেশ ঘটে। মানবিকতা সকল মানব হৃদয়ে নিহিত; কিন্তু তথাকথিত আধুনিকতা ও বস্তুবাদের প্রকোপে গত দেড় শতাব্দী ধরে মানুষ ক্রমেই স্বার্থান্বেষী, সংকীর্ণ, একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন, বিষণ্ণ ও হিংস্র হয়ে নিজেরাও কেবলই "একটি পণ্যে" পরিণত হয়ে পড়ছে। কালের পরিক্রমায় এ "দ্বান্দিক সময়" এর অবসান হয়তো হবে কোনদিন, তবে তা দেখে যেতে পারবো বলে মনে হয় না।
সেই ভদ্রমহিলা মাতৃস্নেহে আপনাদেরকে কাছে টেনে নিয়েছেন, প্রবল বৃষ্টির সময় আপনাদেরকে নৌকোয় করে নিয়ে গিয়ে নিজ ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন, এমনকি আপনাদের রান্নাবান্নার বাকি আয়োজনটুকুও নিজ তত্ত্বাবধানে সুসম্পন্ন করেছেন। মানুষ তো আগে এরকমই ছিল। এ উদারতা ও মানবিকতা মানুষের সহজাত, যতক্ষণ না সে স্বার্থান্বেষী প্রতিযোগিতার পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত হয়।

শেষ কয়েকটি বাক্যের মাধ্যমে অনুপমভাবে বক্তব্যের উপসংহার টানা হয়েছে।


২২ শে জুন, ২০২৪ রাত ১০:৪৮

মৌরি হক দোলা বলেছেন: আপনার চমৎকার বিস্তারিত মন্তব্যের জন্য কৃতজ্ঞতা। সেদিনের অভিজ্ঞতা সত্যিই আমার দৃষ্টভঙ্গিকে একটু ভিন্নদিকে আলোড়িত করেছে। মানুষের মধ্যে থাকতে পারলে সবকিছুই একটা ভিন্ন মানে নিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায়। কিন্তু শহরের এ আত্মকেন্দ্রিক জীবনে সে সুযোগ নেই। এখানে বাইরে হঠাৎ কোথাও পানি খেতে গেলেও সাধারণত পয়সার প্রয়োজন হয়। এমন হিসেবী পরিবেশ থেকে বের হয়ে মাটির কাছাকাছি গেলে মানসিক টানাপোড়েন অনেকটাই কমে যায় অনুভব করেছি। কিন্তু যে হারে নগরায়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে উন্নতির ছোবলে গ্রামীণ এই আবহটুকুও আর কতদিন অবশিষ্ট থাকে কে জানে। তবে আশার কথা এটাই, কালের পরিক্রমায় সত্যিই হয়তো আমরা আবারো হয়তো অতীতের মতো সোনালী দিনে ফিরে যেতে পারবো।

৬| ২২ শে জুন, ২০২৪ সকাল ১০:০৩

আহমেদ জী এস বলেছেন: মৌরি হক দোলা,




চমৎকার লেখা হয়েছে ।
তবে ঐ যে বললেন - "ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বিজ্ঞানের ব্যাপক বিপ্লবসমূহ, যার অন্যতম দুইটি নির্দেশক হতে পারে ডারউইনবাদ এবং ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বের প্রকাশ, মানবজীবনকে একটা ভঙ্গুর পথের দ্বারের কাছে এনে দাঁড় করায়। বহু বছরের উদযাপিত শান্তির উৎস ধর্ম ও ধর্মকে উপস্থাপন করা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে শুরু করে..." সেখানটাতে একটু সংশয় রয়ে গেলো! শুধু কি এগুলোই মানুষকে বস্তুবাদী করে তুলেছে নাকি আরো অনেক অনুঘটক আছে এর পেছনে? আমার তো মনে হয়, আদিকাল থেকে বিরূপ প্রকৃতির মাঝে বেঁচে থাকার প্রতিযোগিতাই মানুষকে বেশী স্বার্থপর-বস্তুবাদী- অমানবিক করে তুলেছে।
সহ-ব্লগার খায়রুল আহসান এর মতো আমিও বলতে চাই, যে সব কনফ্লিক্টস' নিয়ে খানিকটা আলোচনা করেছেন, তা নিয়ে ভবিষ্যতে আপনার কলম থেকে আরও অনেক কিছু বেরিয়ে আসুক।

নড়বড়ে বাঁশের সাঁকোর রূপকে মানবিকতা - অমানবিকতার বসতির সন্ধান যে ভাবে দিয়েছেন তা অতুলনীয়। নদী পারের সেই ভদ্রমহিলা যেন বাঁশের সাঁকোর ওপারের এক স্নেহ বৎসল-মানবিক বসতিবাসী।

শেষে বলি - "দিন শেষে মানুষ একা" কথাটি বাস্তব সত্য। আমিও বলি আসলেই দিন শেষে মানুষ একা!

আর আগের অসমাপ্ত মন্তব্যটি মুছে দেবেন।
শুভেচ্ছান্তে......

২২ শে জুন, ২০২৪ রাত ১১:০১

মৌরি হক দোলা বলেছেন: শ্রদ্ধেয়, আপনার সংশয় সম্ভবত অমূলক নয়। তবে এই বিপ্লবসমূহই কিন্তু বহুদিনের তৈরি হওয়া ক্ষোভকে একটা নতুন পরিণতির দিকে ধাবিত করতে বড়সড় ভূমিকা রেখেছে। আপনাদের কামনায় আমারও ইচ্ছে রইল, ওই সময়টা আর ভিক্টোরিয়ান কনফ্লিক্টস নিয়ে ভবিষ্যতে আরও কিছু লেখার।

ওখান থেকে আসার সময় আমার সত্যিই মনে হয়েছিল, এই সাঁকোটাই এদেরকে শহরীয় প্রভাব থেকে আলাদা করে রেখেছে। যদিও গ্রামের মানুষগুলোকে বেশ ভুগতে হয়, তারা অধিকাংশই খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া সাঁকোর এ পাড়ে আসেন না বলে শুনলাম। যে বাড়িতে উঠেছিলাম, সেখানকার পুত্রবধূ জানালেন গত দুই বছরে তিনি সাঁকো পার হননি। তবে এদের সমস্যা সমাধানের জন্য সাঁকোর স্থলে কনক্রিটের ব্রিজ করলেই হয়তো এরা এদের মৌলিকত্ব হারিয়ে আমাদেরই মতো যন্ত্র হতে শুরু করবে। সম্ভবত তাদের কাছে এই উন্নয়ন অনেক কাঙ্খিত। তবে উন্নয়নের মধ্যে বসবাস করে আমরা অনুভব করতে পারি, প্রকৃতির কোলে এরা কতই না শান্তিতে আছে। হয়তো তাদের মনেও জটিলতা কুটিলতা আছে- সেটার মাত্রা তুলনামূলক বেশিও হতে পারে- তবু তারা অনেক বেশি পরস্পর মানবীয় সংস্পর্শে আছে। এটাই দুটো জীবনের পার্থক্য।

অনেক ধন্যবাদ। শুভকামনা রইল।

৭| ২২ শে জুন, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩৩

সাড়ে চুয়াত্তর বলেছেন: ভালো লাগলো লেখাটা। প্রথম অংশে বর্ণিত হয়েছে কিভাবে মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। আর দ্বিতীয় অংশেই আশার আলো দেখা গেল। পৃথিবীর সব মানুষ এখনও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যায়নি বোঝা গেল।

আমাদের পরিবারের একজনের প্রয়োজনে রংপুর জেলাতে একটা বাসা খোঁজার দরকার ছিল। আমরা উত্তর বঙ্গে খুব কম গিয়েছি। আত্মীয় স্বজন বা পরিচিত কেউও নাই বললেই চলে যাদের সাহায্য নেয়া যায়। আমি এবং আমার স্ত্রী রংপুর যাওয়ার পরে ওষুধ কিনতে গিয়ে এক তরুণ দম্পতির সাথে ৫ মিনিটের জন্য কথা হয় আমার স্ত্রীর সাথে। তারপরে আমরা ঢাকা চলে আসি বাসা ঠিক না করেই। কারণ আমরা বুঝতে পারি যে বাসাটা ঠিক করতে হবে আরও কিছুদিন পরে। দ্বিতীয় বার রংপুর যাওয়ার আগেই আমাদের একটা বাসা ঠিক করা খুব দরকার হয়ে পড়ে। তখন আমার স্ত্রী ফোনে ঐ মেয়েটাকে অনুরোধ করে একটা বাসা খুঁজে দেয়ার জন্য। অথচ ওদের সাথে রাস্তায় ৫ মিনিটের পরিচয় হয়েছে আমার স্ত্রীর। আমার স্ত্রীর অনুরোধে মেয়েটি সত্যিই ৩/৪ দিন ঘুরে আমাদের জন্য একটা বাসা ঠিক করে দেয়। পরে খরচের টাকা সাধার পরেও নিলো না। এই ধরণের আন্তরিকতা এখনও আছে দেখে ভালো লাগলো। ঘটনাটা ১ মাস আগের। পরে ঐ মেয়েটাকে একটা জামা উপহার দিয়েছে আমার স্ত্রী। আমার স্ত্রী আবার যে কোন অপরিচিত মানুষের সাথে এমনভাবে কথা বলে যে মনে হয় আগে থেকে চেনে।

১৯৮৯ সালের একটা ঘটনা বলি। আমি, আমার ছোট ভাই আর আমার এক বন্ধু যাচ্ছিলাম মেহেরপুরের মুজিবনগরের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে বাসে আমাদের চেয়ে ৪/৫ বছরের বড় একজনকে জিজ্ঞেস করলাম যে চুয়াডাঙ্গা/ দর্শনা (ভালো করে খেয়াল নেই) থেকে কিভাবে মেহেরপুর যাবো। কিছুক্ষণ আলাপে উনি বললেন যে তোমরা তো দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসতে পারবে না। ওখানে থাকার কোন ব্যবস্থাও নেই। আলাপের এক পর্যায়ে প্রকাশ পেল যে উনি আমার বড় ভাইকে অল্প চেনেন। মানে একবার তাদের কোন ভাবে পরিচয় হয়েছিল কিছু সময়ের জন্য। উনি বললেন যে এক কাজ কর তোমরা চুয়াদাঙ্গাতে/ দর্শনাতে আমার বাসায় আজকে দুপুরে খেয়ে তারপরে বাড়ি চলে যাও। কারণ আজকে কিছুতেই তোমরা গিয়ে ফিরে আসতে পারবে না। আমরা ভদ্রতা করে বলি যে না দুপুরে খাওয়ার দরকার নাই। আমরা বাইরে কোথাও খেয়ে যশোর ফিরে যাবো। কিন্তু উনি নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত ওনার বাসায় আমাদের ৩ জনকে খাওয়ালেন। তারপরে আমরা আবার যশোর ফিরে এলাম। এটাকেও আমার কাছে আন্তরিকতার একটা ঘটনা বলে মনে হয়েছে।

আপনার দেয়া ছবির সাকোতে ধরার জন্য একাধিক হাতল আছে। এগুলি পার হওয়া সহজ। কিন্তু কয়েক বছর আগে গ্রামে একটা সাকো পার হতে হয়েছিল যেটার কোন হাতল নেই। বহু কষ্টে ভয়ে ভয়ে পার হয়েছিলাম। কারণ পড়লে নীচে কাদা আর পানি।

পোস্টের নামটাও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। সেই সাথে দেয়া ছবিটাও।

২২ শে জুন, ২০২৪ রাত ১১:১১

মৌরি হক দোলা বলেছেন: আপনার অভিজ্ঞতাগুলো জেনে খুব ভালো লাগলো। হয়তো এগুলোই স্বাভাবিক আচরণ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন এসব ঘটনা এতোটাই অপ্রতুল হয়ে পড়েছে যে, মাঝে মাঝে এসব অভিজ্ঞতা আমাদের বিস্মিত করে।

এ নিয়ে দুইবার আমি সাঁকো পার হলাম। এর ৭-৮ বছর আগে আরেকবার এক বান্ধবীর গ্রামে ঘুরতে গিয়ে সাঁকো পার হতে হয়েছিল। মনে পড়ে, সেদিন তিন-চার জনের সহায়তায় আমাকে পার হতে হয়েছিল। কেননা, তখন আমি আরো ছোটো, আরো ভীতু ছিলাম। এবার ধীরে ধীরে সসংশয়ে হলেও ছয় বারের মতো একাই পারাপার হলাম। অবশ্যই হাতল থাকাতেই সুবিধাটা বেশি হয়েছে। তবে এ ধরনের ছোটোখাটো রিস্কি কাজ করে বেশ আত্মসন্তুষ্টি অনুভূত হয়; আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। তাই ভালোই লাগে।

৮| ২৩ শে জুন, ২০২৪ ভোর ৫:০১

শ্রাবণধারা বলেছেন: সুন্দর একটি ঘটনার মনোরম উপস্থাপন। পড়তে পড়তে মনে হলো আপনার বর্ণনার মানুষগুলোকে যেন দেখতে পাচ্ছি। এই মানুষগুলোই হয়তো আমাদের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা "বাংলাদেশ"।

লেখার প্রথমে ভূমিকাটি কিছু খাপছাড়া মনে হলো। বোদলেয়ার, অ্যালেন গিন্সবার্গ, কাফকা এই তিন খ্যাতিমান লেখক, যাদের প্রথম দুজন কবি একেবারেই ভিন্ন সময়ের, ভিন্ন জনরা বা শৈলির লেখক। তাদেরকে কোন লেখায় উল্লেখ করতে হলে তাদের লেখা অনেকটা পড়া থাকা দরকার এমন মনে করি।

বোদলেয়ার, যার জন্ম উনিশ শতকের শুরুতে, তাকে বাংলাভাষী পাঠকের কাছে বিখ্যাত করেছেন বুদ্ধদেব বসু। তিনি বোদলেয়ারের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ "Les Fleurs du mal" বা "The Flowers of Evil" এর বাংলা অনুবাদ করেছিলেন "ক্লেদজ কুসুম" এই নামে। আপনার উল্লেখিত বোদলেয়ারের কবিতাটি এই কাব্যগ্রন্থেরই একটি কবিতা যেটা পড়লে মনে হবে যখন ওয়ার্ডসওয়ার্থ কেবল সদ্য প্রয়াত হয়েছেন এবং যখন রবীন্দ্রনাথের জন্মও হয়নি তখন কি করে ফরাসি দেশের একজন এমন ভয়ানক আধুনিক মানুষের মত তীব্র হতাশার সুতোয় মুক্ত তুলে আনছেন: "Life is a hospital where every patient is obsessed by the desire of changing beds."

আর হ্যাঁ, বোদলেয়ারের প্রথম নাম "চার্লস" নয়, "শার্ল"। রোমান হরফে "Charles" এভাবেই লেখা হলেও ফরাসি উচ্চারণে এটা হয়ে যায় "শার্ল"।

পরিশেষে, কিছু কড়া সমালোচনা করার জন্য কবিতা দিয়ে ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করছি। বোদলেয়ারের কবিতা "অচেনা মানুষ", বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ। আশা করি আপনার ভালো লাগবে।

"কাকে তুমি ভালোবাসো মানুষ?
তোমার বাবা, মা, বোন, ভাইকে?
-পরিবার বলতে কিছু ছিলনা আমার।
-তোমার বন্ধুদের?
-তুমি এমন একটি শব্দ ব্যবহার করছো, যার অর্থ আমি আজ পর্যন্ত বুঝিনি
-তোমার দেশ?
-কোন দ্রাঘিমায় তার অবস্থান আমি জানিই না!
-কোন নারীকে?
-আমি আনন্দের সাথেই তাকে ভালোবাসতাম, যদি হতো সে কোন দেবী, অমর...
-অর্থ? সম্পদ ভালোবাসোনা তুমি?
-ঘৃণা করি, যেমন তুমি কর ঈশ্বরকে!
-তবে কী ভালোবাসো তুমি অদ্ভুত মানুষ?
-ভালোবাসি ওই আকাশে...সুদূরে...দূর নীলিমায় ভেসে যাওয়া আশ্চর্য মেঘদল!..."

২৩ শে জুন, ২০২৪ দুপুর ১:০০

মৌরি হক দোলা বলেছেন: প্রথমেই আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

আচ্ছা, ভূমিকাটা্ খাপছাড়া মনে হয়েছে কি ভিন্ন সময়ের ভিন্ন ধরনের তিনজন লেখককে নিয়ে লেখায়? নাকি তথ্যের ঘাটতি রয়েছে বলে মনে হয়েছে? একটু জানাবেন অনুগ্রহ করে। হয়তো পরবর্তীতে লেখাটা সম্পাদনা করলে আপনার পরামর্শ আমার উপকারে আসতে পারে। তবে আমি কিন্তু তাদের স্থান-কালের ভিন্নতা মাথায় রেখেই তাদের কথা টেনেছি- শুধুমাত্র তাদের দর্শনকে আমার কাছে অনেকটা একই মনে হয়েছে তাই। কেননা, আমি যতটুকু বুঝতে পেরেছি, মোটামুটি তারা প্রত্যেকেই কিন্তু আধুনিকতা, পুঁজিবাদ, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা নিয়ে ভেবেছেন, কাজ করেছেন। আমার ধারণায় কোনো ভুল থাকলে সেটাও জানাবেন আশা করি।

আর চার্লস/শার্ল বিভ্রাট আপনার পরামর্শ অনুযায়ী ঠিক করে নিলাম। ধন্যবাদ জানবেন। আর হ্যাঁ, আপনার দেওয়া কবিতাটাও চমৎকার।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.