![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বিশাল এক ধাক্কা খেয়ে তিন হাত দূরে ছিটকে পড়ল সুলতান। ততক্ষণে জটলা মিরনকে জাপটে ধরে ঘাসবনের দিকে এগিয়ে গেছে। নদীর পাড়ের কাশবন আর লম্বা লম্বা ঘাস। মাথা উঁচিয়ে বাতাসের ঢেউয়ে নাচছে। সুলতান চিৎকার করে বাঁচাতে পারল না ছেলেকে। ছোট ছেলে। বয়স কত আন্দাজ করতে পারে না সে। হয়তো বারো-তেরো হবে। তিন-চার মাস হয় লেদ মেশিনে কাজ শুরু করেছে। ছেলেকে কাজে লাগিয়ে হালকা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে এবার। তার শরীর চলে না। একসময় ধুম ধাম করে রিকশা চালিয়েছে। এখন আর শক্তি পায় না। তাই আজ ভোর ভোর সকালে তার গলা দিয়ে আওয়াজ জোর পেল না।
সকালের আলো ফোটেনি, খন্দকার আবু মেম্বার তার দরজায়। সুলতানের কোথায় আঙিনা, কোথায় বারান্দা; দুটি আধভাঙা ঘর। বসতে বলার সাহস পায়নি। খন্দকার বসার জন্যও আসেনি। রাগি রাগি গম্ভীর চেহারা। মিরন যে কি করেছে কে জানে। সুলতানের বুকে আতঙ্ক একদলা থুতুর মতো আছড়ে পড়ে।
‘মিরন কই?’
‘শুইয়া আছে স্যার।’
‘বেডা রে ডাক।’
গরিব মানুষকে অনেককিছু শুনতে হয়। কোনো কারণ জিজ্ঞেস করা যায় না। সুলতান চুপচাপ দ্বিতীয় ঘরের দরজার দিকে মুখ করে চিৎকার দেয়।
‘মিরন ও মিরন, মানুষ ডাকে ওঠ।’
বাধ্য ছেলে। বাপের একডাকে বেরিয়ে আসে। তখনো দুচোখে ঘুম জড়ানো। ঠোঁটে সমীহ আর হাসি নিয়ে সামনের আগন্তুকের দিকে তাকায়।
‘যাই স্যার...মুখ ধুইয়া আইতাসি।’
‘ওই বেডা, জিনিসটা দে।’
‘কোন জিনিস স্যার?’
‘ক্যান কাল তুই সরাইছিস। মোবাইল দে বান্দির পুত। মাদারচোদ।’
‘আমি জানি না। লই নাই স্যার।’
খন্দকারের চেঁচামেচিতে ভেতর থেকে জামিলা বের হয়ে আসে। মাথার এলোমেলো চুল ঠিক করে নিতে নিতে বলে উঠে, -
‘কী হইছে...আমার পুলা চুর?’
সুলতান এবার সাহস পায় বুকে। দুর্বল পুরুষের স্ত্রী বরাবর সাহসী হয়। জামিলার গলা বেশ ঝাঁজালো। তার ভালো লাগে। এবার সেও জোরের সঙ্গে প্রতিবাদ করে।
‘আমার ঘরে কারেন নাই। পুলায় মোবাইল কী করব স্যার? খুঁইজ্যা দেহেন কোথাও পইড়া রইছে।’
‘সব জায়গা খুঁজছি মিয়া। ওরে এক ঘণ্টা টাইম দিতাছি...বুজায়া-সুঝায়া বাইর কইরা দে, নাইলে খবর আছে।’
খন্দকার পেছনে সজোরে পানের পিক ফেলে ঘুরে দাঁড়ায়। এবার সুলতান আর জামিলা মিরনকে ধরে। প্রশ্নবান উপদেশ পরামর্শ বোঝানো চলে। অবশেষে সিদ্ধান্ত আসে, মিরন নেয় নাই। মালিক যখন গত সন্ধ্যেয় ওই জিনিস সকলকে দেখায়, সেও ওতে ভিডিও দেখেছে। সিনেমার মতো ঝকঝকা ছবি। সুন্দর গান বাজে। এমন ছোট সিনেমা হয় সে কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেনি। সে ওই জিনিস নেয়নি। কে নিয়েছে জানে না। সে তারপর কাজে লেগে যায়। সে কিছুই জানে না। সুলতান মাথায় হাত দিয়ে পড়ে। কী হবে এখন!
সকাল নয়টার দিকে খন্দকার আরও দু-তিনজন মানুষ নিয়ে আসে। কিছু কথা হয়। দুর্বলের কথা জোর পায় না। জামিলা আর সুলতানের শক্ত করে চেপে রাখা বাঁধন আলগা হয়ে পড়ে। তারপর হট্টগোলের মধ্যে কে কাকে মারধর করে, কার আর্তস্বরে বাতাস অস্থির হয়ে ওঠে আর কেউ না জানুক, সুলতান জানে। সে ওই ভিড়ের মধ্যে ছুটে যায়। জামিলা সেই দৌড়ে তাল সামলাতে পারে না। রাস্তার কোথাও পড়ে গেছে। সুলতান আর সেদিকে তাকাতে পারেনি। তার বুকের ধনকে সকলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মারধর করছে। ছেলের চিৎকারে সে দিশেহারা। পাগলের মতো ছুটে এসে দাঁড়ায়। তারপর কে যে তাকে খুব জোরে ধাক্কা দেয়। সে রাস্তার প্রান্তে ড্রেনের কাছে হাঁপাতে থাকে।
আজকাল মানুষ বিনোদনের পিয়াসি। সহজে আন্দোলিত হয়। কোথাও কোনো চোর ধরা পড়লে তার হাত নিশপিশ করে। এরচেয়ে বড় সুখ আর নেই। বিচার করতে আর শাস্তি দিতে কে না চায়! তখন সেই আমোদের উত্তেজনায় চোর আসলে চোর কি না ভেবে দেখার ফুরসত পাওয়া যায় না। ছোট দলের সংখ্যা বাড়ে। সুলতান ভেজা ভেজা দৃষ্টিতে সেই ভিড়ের মধ্যে ছেলেকে খুঁজে পায় না। বাতাসে শুধু উল্লাস। কোনো কান্নার চিৎকার নেই। তারপর সমস্ত ঘটনার সাক্ষি হতে সে ধীরে ধীরে তার শ্লথ ক্লান্ত দেহটিকে সেখানে নিয়ে যেতে পারে। তার বুকের উপর কতগুলো পদাঘাত এসে লাগে। দুচোখ অন্ধকারে নেমে যেতে চায়। তখন কেউ হয়তো বলে উঠে।
‘বেডার চোখ তুইল্যা ফেল। অমন দামি জিনিস! কত ট্যাকা দাম নিছে ভাইয়া?’
‘হ হ ঠিক...বেডার চোখ দুইটা তুইল্যা ফেললে বাপে-মায়ে সুড়সুড় কইরা বাইর কইরা দিব।’
‘স্যারেরা আমার মিরন চুর না। হেয় চুরি করে নাই। ওর চোখ তুইল্যেন না স্যারেরা। আমারে ওর কাছে লন...বুঝায়া দেহি। বুঝায়া দেহি।’
সুলতানের চিৎকার ভিড় কোরাসে ঠাঁই পায় না। আতঙ্কে তার দম বন্ধ হয়ে আসে। দুর্বল শরীরে নেমে আসে অন্ধকার। সে কী করবে? কার কাছে যাবে? কোথায় খোদা? হায় আল্লাহ!
‘কী দিয়া তুলবেন? এ্যই তুলবেন কী দিয়া? বেডারে লাগান আরও কডা। শালা চুর। ওর বাপ চুর...মা চুর। বান্দির পুত। চোদ্দ গুষ্টি চুর। মার আরও মার।’
‘ভাই এই লন খেজুরকাঁটা। এই বেডারে মাডিত ফেলা...মাডিত ফেলা...।’
‘আ রে হালায় এই কাঁডা দিয়া কিচ্ছু হইব না। শালার দুডা চোখই তুলতে হইব। যে চোখ দিয়া ভিডিও দেখছে তার শাস্তি।’
‘ওই বে হাবিব সামনে থেইক্যা কাঁডাচামচ লইয়া আয়...দুইডা আনবি, বুঝসোছ?’
‘ভাই ওর বাপেরে দিয়া দুচোখ তুইল্যা ফেলান যায় না? বেশ শাস্তি হইব কী বলেন?’
‘হ হ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। ওই বে ওর বাপেরে ডাক...বুড়ারে লই আয়।’
তখন কেউ হয়তো ছুটে সামনে বেরিয়ে যায়। মানুষ তামাশা করে। তামাশা দেখতে বড়ই মজা। মনোহর। বিনোদন আর বিনোদন। সুলতানের দুচোখ অন্ধকার। সে কোনোমতো ভিড়ের মধ্যে নিজেকে গড়িয়ে ছেলের কাছে এগিয়ে যেতে প্রাণপণ শক্তি ছুড়তে থাকে। তখন কেউ একজন তাকে ধাক্কা দিয়ে আবার ফেলে দেয়। সামনের কোনো গাছে একসঙ্গে কয়েকটি কাক চিৎকার করে উঠে।
তারপর যখন দিনের আলো প্রচণ্ড প্রখরতায় নামতে শুরু করে, ভিড় সরে যায় আর এক বৃদ্ধ বাবা খুঁজে পায় তার আদরের সন্তান। তার দু-গাল রক্তাক্ত। চোখ আছে চোখ নেই। চোখের দুটো মনি কোন্ কুকুরে কোন্ ফাঁকে নিয়ে সরে পড়েছে কেউ জানে না। সে অর্ধচেতন ছেলেকে বুকে জড়িয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করে। অনেক ভারী। পারে না। অবিচারের ওজন পরিমাপ করা যায় না...প্রচণ্ড ভারী। কারও পক্ষে তুলে ধরা কিংবা বহন করা সম্ভব নয়।
সন্ধ্যেয় আকাশ অন্ধকার করে কালো মেঘ জমেছে। খন্দকার আবু মেম্বারের অন্য মোবাইলে পরিচিত নম্বর থেকে কল আসে। মন মেজাজ খারাপ। কত শখের মোবাইল! এখন এই পুচকে মোবাইলে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মোবাইল টিঁ...টিঁ করে বাজতে থাকে। সে রিসিভ করবে কি না ভাবতে ভাবতে কানে তুলে ধরে। আজ যা ঘটনা ঘটল, অথচ মোবাইল পাওয়া গেল না; কত দামী জিনিস!
‘দুলাভাই আপনাকে বলা হয়নি, কাল আপার কাছে থেকে আপনার মোবাইলটা দেখতে দেখতে নিয়ে এসেছি; এটা কিন্তু দেব না।’
নৈর্ঋত কোণার মেঘে বৃষ্টি হবে কি না তেমন জানা নেই। তবে বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে ছুটে যাচ্ছে। অনেক দূরে সুলতানের কোলে শুয়ে আছে এক অন্ধ-বালক। আঙিনায় লুটিয়ে আছে আলুথালু এক মহিলা। এখন রাত। কাল সকালে মিরনকে হাসপাতালে নেয়া হবে। বৃদ্ধ বাবার দুচোখে সেই তখন থেকে বৃষ্টি ঝরছে। আঠালো অস্বচ্ছ দৃষ্টিতে তবু সে অলীক কোনো ঈশ্বরকে খুঁজে চলে।
১৬ ই নভেম্বর, ২০১৭ সকাল ৭:২২
মাহবুব আলী বলেছেন: ঠিক...একমত।
২| ১৫ ই নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৮:১৬
বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: অর্ধচেতন ছেলেকে বুকে জড়িয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করে। অনেক ভারী। পারে না। অবিচারের ওজন পরিমাপ করা যায় না...প্রচণ্ড ভারী। কারও পক্ষে তুলে ধরা কিংবা বহন করা সম্ভব নয়।
--
নৈর্ঋত কোণার মেঘে বৃষ্টি হবে কি না তেমন জানা নেই। তবে বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে ছুটে যাচ্ছে। অনেক দূরে সুলতানের কোলে শুয়ে আছে এক অন্ধ-বালক। আঙিনায় লুটিয়ে আছে আলুথালু এক মহিলা। এখন রাত। কাল সকালে মিরনকে হাসপাতালে নেয়া হবে। বৃদ্ধ বাবার দুচোখে সেই তখন থেকে বৃষ্টি ঝরছে। আঠালো অস্বচ্ছ দৃষ্টিতে তবু সে অলীক কোনো ঈশ্বরকে খুঁজে চলে।
অসাধারন!
হৃদয়কে এফোর ওফোর করে দিল !
মুগ্ধ ভাললাগা
+++++++++++++++++
১৬ ই নভেম্বর, ২০১৭ সকাল ৭:২৪
মাহবুব আলী বলেছেন: একটু কষ্টের গল্প। আপনার চমৎকার বিশ্লেষণ অনুপ্রেরণা ছড়াল। শুভেচ্ছা।
৩| ১৯ শে নভেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:০৪
শামছুল ইসলাম বলেছেন: আগেও পড়েছিলাম । তখনও হৃদয়কে ছুঁয়ে গিয়েছিল - আজও ।
১৯ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৮:৫৮
মাহবুব আলী বলেছেন: অনেক শুভকামনা।
৪| ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:০০
রিএ্যাক্ট বিডি বলেছেন: ভাই আপনার এই গল্পটা আমার খুব ভালো লাগসে... আমি ইটা দিয়া Short Film একটা করতে চাই | তার জন্য আপনার অনুমতি লাগবে |
২৭ শে নভেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:০৬
মাহবুব আলী বলেছেন: আপনার কথা জেনে ভালো লাগল। শর্ট ফিলম করবেন ভালো কথা। তার আগে কথা বলতে হবে। আমাকে কী করতে হবে? অথবা আমার কোন সুবিধে জানা দরকার। লিখুন। আমার মেইল ঠিকানা: [email protected]
৫| ২৯ শে নভেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১:৪৪
রিএ্যাক্ট বিডি বলেছেন: আপনার কিছুই করতে হবে না শুধু আপনার পারমিশন লাগবে | আমাদের চ্যানেল Team Rohitpur
২৯ শে নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৪৯
মাহবুব আলী বলেছেন: আমার তো কথা থাকতে পারে। কোন মাধ্যমে বলা যায়। ফেসবুক বা মোবাইল। বিষয়টা আমার জানা দরকার।
৬| ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:৪৫
রিএ্যাক্ট বিডি বলেছেন: My fb profile https://www.facebook.com/TalhaYousufKhan
৭| ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৩০
মাহবুব আলী বলেছেন: তৈরি করুন। গল্প লেখক হিসেবে আমার উল্লেখ রাখবেন। চিত্রনাট্য তৈরি আপনার। লোকেশন আপনার। আমাকে ভিডিও দিয়েন। শুভকামনা।
৮| ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৩:০৯
মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন: হৃদয় ছোয়া ও বেদনার হাহাকারে ভরা গল্প।
শুভ কামনা।
০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৮ সকাল ৮:৩৫
মাহবুব আলী বলেছেন: কষ্টের কাহিনি।
৯| ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:২৫
রিএ্যাক্ট বিডি বলেছেন: MOBILE CHOR (মোবাইল চোর) BANGLA NEW SHORT FILM 2018[Emotional] | Team Rohitpur
Watch Now:- https://youtu.be/kcJnjzeg-mA :O
৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:০০
মাহবুব আলী বলেছেন: 'মোবাইল চোর' গল্পটি নিয়ে আপনার টিম যে কাজ করেছে, তার জন্য সাধুবাদ। তবে গল্প অনুযায়ী স্ক্রিপ্ট শক্তিশালী হয় নাই, মেকআপ অর্থাৎ পোশাক-আশাক ঠিক করা দরকার ছিল। তারা দরিদ্র। পিতার ভূমিকায় দেখানো হয়েছে রিকশাঅলা, অথচ দামি সার্ট। নারী চরিত্র অভিনয়ে নারী নেই। বৃদ্ধ বাবার নাম তমিজউদ্দিন নয়, সুলতান। ছেলের নাম মিরণ। মিরণের মায়ের নাম জামিলা। একজন শ্যালিকা ছিল, ব্যাকগ্রাউন্ডে কথা থাকলেই হতো। যা হোক, তারপরও যে উদ্যোগ, পরিশ্রম আর আন্তরিক ভালবাসায় 'মোবাইল চোর' চিত্রায়িত করেছেন, সে-জন্য অফুরান শুভকামনা। এবং কৃতজ্ঞতা। এগিয়ে চলুন একদিন ভালো কাজ করতে পারবেন। শুভেচ্ছা রইল।
©somewhere in net ltd.
১|
১৫ ই নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৮:০৭
রাজীব নুর বলেছেন: লেখাটি মন ছুঁয়ে গেল।
আমাদের দেশে চোরদের খুব নির্মম ভাবে মারা হয়। এটা মোটেও ঠিক নয়।