নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কখনো গল্প লেখার চেষ্টা করি।

মাহবুব আলী

মাহবুব আলী

মাহবুব আলী › বিস্তারিত পোস্টঃ

কাঠ কয়লা ছাই

০২ রা জুলাই, ২০২০ ভোর ৫:৩৩


রাত-দুপুরে নয়, সন্ধের পর পর তুলে নেওয়া হয় তাকে। বিকেল থেকে আকস্মিক মেঘলা আকাশ। শেষ ফাল্গুনের এই বেলায় কখনো ঝড়-বৃষ্টি হয়। গাছের পাতা ঝরে যাওয়া শাখাপ্রশাখায় নেমে আসে জীবনের নবায়ন। আকলিমার বুক জুড়ে শূন্য হাহাকার। অনেক জোরপায়ে ছুটে আসা। তার মুখছবিতে অজানা কোনো আশঙ্কায় মৃত অন্ধকার হাত-পা ছড়িয়ে নেমে আসে। শেষ সন্ধের বিমর্ষ আঁধারও নিজেকে বিছিয়ে নেয় চারপাশ। তখন রাস্তার পশ্চিমে গলির মাথায় ধূসর-নীল পুলিশ-ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকে দু-তিনজন হেঁটে হেঁটে ঘরের দোরগোড়ায়। মানুষের হালকা জটলা। দেড় মিটার প্রশস্ত গলি। পশ্চিমে চলে গেছে চল্লিশ মিটার। তখন ছায়া-আবছায়ায় সবকিছু সংকীর্ণ লাগে। উত্তর-দক্ষিণে বাড়িঘর-বারান্দা-সীমানা প্রাচীর। কোনো ঘরের জানালা ঝটপট বন্ধ হয়ে যায়। কারও উৎসুক জিগীষু দৃষ্টি জানালা থেকে লাফিয়ে গলিতে নেমে আসে। কৌতূহল বড় সাংঘাতিক জিনিস। কী ব্যাপার? ঘটনা কী? মামুনকে ভ্যানের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আকলিমা পেছনে পেছনে হেঁটে-দৌড়ে আর পারে না। কী করার আছে তার? কখন দপ করে নিচে বসে পড়ে মনে নেই। গলির সবটুকু বিস্তৃতি বালু...বালু আর বালু। উত্তরে বিশাল জায়গা গভীর করে খনন হয়েছে মাস দুয়েক আগে। পুরোনো ভবন ভেঙে দশ-বারোতলা ফ্ল্যাট উঠছে। সারাদিন বালুর ট্রলি আর শ্রমিকের চেঁচামেচি হট্টগোল। মানুষ কাজ করে। আকলিমাও দিনভর অনেক কাজে ব্যস্ত। রাত আট-নয়ে ফেরার অবসর পায়। হোটেলের কাজ, শুরু আছে; শেষ নেই। সে মাছ-মাংস-সবজি কাটে। শিলনোড়ায় মশলা বাটে। উনুনে কতরকম রান্না। আগুনের হলকা পোড়া বুকের কাঠ-কয়লা-ছাই। সেই সকল কাহিনি মনে করতে চায় না। কখনো তবু হামলে পড়ে। একে একে মনে আসে। এইসব নিয়ে বেঁচে থাকা। শত কষ্টের মধ্যেও একটু আশা প্রদীপের মতো জ্বলজ্বল জেগে থাকে। ছেলেমেয়ে। চোখের আলো। সেই আলো শত কষ্টে বুকে আগলে রাখা। কতটুকু পারে অথবা পারল সেই ভাবনা মনকে দোলায়। কখনো বিশুষ্ক দৃষ্টিতে ভাবতে হয়। অবসর নেই। আজকাল দু-হাতের সন্ধি আর কবজিতে টান ধরে। কোমর আর হাঁটুতে আচমকা চিনচিন ব্যথা। কখনো অসাড়। কাজ থেমে থাকে না। তখনো কাজ বাকি। তবু সবকিছু এড়িয়ে ছুটে আসতে হয়। ঘরের দরজার কাছাকাছি থেমে অসি'র দমবন্ধ হাঁসফাঁস ক্লান্তি। মামুন মোবাইল কিনে দিয়েছে। সেটাই গমগম করে বেজে উঠেছিল। মুনার অস্থির কণ্ঠ।
‘মা তাড়াতাড়ি আসো...পুলিশ আসছে।’
‘পুলিশ!’
মামুনও হতভম্ভ। পুলিশ? সে তখন ঘরের বাইরে দেয়াল ঘেঁষে রাখা সাইকেল নিতে যায়, শেষ টিউশন; কিছু বুঝতে পারে না। এমন কোন্ অপরাধ করেছে সে? তার হাতে হাতকড়া পড়ে কিছু বুঝতে না বুঝতেই। কেন? কী অপরাধ? আকলিমা ছুটে-দৌড়ে এসে হাঁপাতে থাকে। তারও জিজ্ঞাসা।
‘মামুন করছেডা কী?’
সেই প্রশ্নের উত্তর কিংবা কৈফিয়ত শোনে না কেউ। অথবা কারও মনোযোগ নেই। অথচ গলির প্রান্ত ঘেঁষে গুরুতর অভিযোগ দমকা বাতাসের ঢেউয়ে উদোম নেচে নেচে ছড়িয়ে যায়। যা জানার কথা নয়, ভাবনা কিংবা কল্পনার শক্তি নেই; সেই কথা সুর-লয়-তাল ধরে মানুষের ঠোঁটে ঠোঁটে কানে কানে ধাক্কা মারে। মামুন ড্রাগ কারবারি। অথচ সকলেই জানে ছেলেটি যেমন ভদ্র-বিনয়ী-সৎ, তেমন পরিশ্রমী। পুলিশ ঘরের মধ্য থেকে চার বোতল ফেনসিডিল বের করে। প্যান্টের পকেটে আট পিস ইয়াবা। মুনা নিশ্চুপ বিস্ময়-বিমুঢ়। কী করবে ভেবে পায় না। সে কখনো পুলিশ আর প্রতিবেশী মানুষজন আবার কখনো বাইরের অন্ধকারে কিছু খোঁজে। বড় অসহায়।
পুলিশ হেঁটে চলে। তাদের মধ্যখানে মামুন। তারা অনেক দূর চলে গেছে। অবশেষে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে-দৌড়ে গলির মাথায় এসে দাঁড়ায় মুনা। রাস্তার বাঁ-পাশে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে পিকআপ ভ্যান। উত্তরে কোতয়ালি থানা। সেদিকে মুখ। ইঞ্জিন ধীরস্থির প্রায় নিশ্চুপ শব্দ তুলে যায়। ভ্যানের পেছন উন্মুক্ত, পুব-পশ্চিমে দুটো বেঞ্চ; কয়েকজন বসে আছে অভিব্যক্তিশূন্য কাঁচপাথর। তাদের হাতে রাইফেল আকাশমুখী। বেঞ্চ দুটোর মধ্যখানে নিচে এক মানুষ, এলোমেলো বিস্রস্ত দুশ্চিন্তার ছবি আঁকা অবয়ব। ড্রাইভারের পাশে কেউ একজন, তার সামনে উইন্ডশিল্ডের কাছে রাখা ওয়ারলেসে বিচিত্র শব্দের গুঞ্জন বাজে। সেই কথামালা ভারি অদ্ভুত লাগে। মামুন এতক্ষণে পশ্চিম বেঞ্চের মধ্যখানে সেই মানুষের কাছে বসে পড়ে। মাথার টুপি খুলে সামনে ছুড়ে দেয়। চোখে-মুখে ভয়ার্ত জলছাপ। অদেখা দুশ্চিন্তা রেখা। আকলিমা ছুড়ে দেওয়া সেই বস্ত্রখণ্ড ধরতে পারে না। ছেলে তার কয়েক মাস হয় নামাজ ধরেছে। নিয়মমতো মসজিদে যায়। উপরঅলার দরবারে হাত তোলে। কষ্ট যে আর সহ্য করা যায় না। মাগরিব শেষে ঘরে ফিরে ঘটনার মুখোমুখি। দোকানের পার্টটাইম চাকরি অকারণ একদিন চলে গেল। কাজ পাওয়া সহজ নয় যত অবলীলায় চলে যায়। কয়েক সপ্তাহ এখানে-ওখানে ঘোরাঘুরি করে। অবশেষে কয়েকটি টিউশন। শেষ-দুপুর থেকে একটির পর আরেকটি। এমন একজন ছেলে কি না ড্রাগ ব্যবসায়ী! মানুষের ফিসফিস গুঞ্জনধ্বনি। উচ্চকণ্ঠ মন্তব্য। মুনা অসহায় নির্বাক দৃষ্টি তুলে দেখে থাকে। কী করবে কিছু বুঝে উঠতে পারে না। পিকআপ ভ্যানে বসে থাকা পুলিশেরা যেন পাথরের মানুষ। কোনো দয়মায়া নেই। কোনো ভাবান্তর নেই। তারপর মিহি ধোঁয়া উড়িয়ে চলে যেতে থাকে ভ্যান। মুনা মায়ের গা-ঘেঁষে দঁড়িয়ে বিষাদ সন্ধের সবটুকু বেদনা বুকে গেঁথে নেয়। মামুনের দৃষ্টি থেকে ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়তে থাকে। আকলিমার দু-চোখে অসহায় তেপান্তর কাহিনি। মুনা ঘুরে দাঁড়ায়। অত সহজে ঘাবড়ে যায় না সে। মায়ের হাত টেনে পশ্চিমে ফিরে চলে। এখনো সামলে উঠতে পারে নাই আকলিমা। বুকের গহিনে চাপাকান্নার নিশ্চুপ গুঞ্জন থেকে থেকে ধাক্কা দেয়। কী করবে এখন? কীভাবে সামলাবে বিপদ? তখন আকাশের দিগন্ত থেকে দু-এক ফোঁটায় নেমে আসে মেঘজল। সেখানে কি জেগে ওঠে অতীতদিনের ক্ষোভ-বিক্ষোভ? আগুন ঝলসানো দৃষ্টিবান? কে জানে।
‘দেখলি? হেরা ছাইয়ের দড়ি পাকাইতে পারে। ওদের লগে কাইজ্যা করতে নাই রে মা। এ্যাহন কী যে হইব কে জানে।’
‘ভাই তো কিছু করে নাই। একখান থাপ্পর দিয়া সাবধান কইরা দিছে মাত্র।’
‘কী দরকার আছিল? হাজার হাজার মাইয়া রাস্তাঘাটে কত্তো কথা শোনে, কত্তো মন্দ জিনিস হয়, মানুষজন ফাতরা, তাগো লগে কিয়ের কাইজ্যা? কোনো বেডি তো কিছু কয় না। মাথা নিচু কইরা ঘরে ফিইরা আহে। এ্যাইডা পুরুষ মানুষের সমাজ। মাইয়া গো সব বুইজা চলন লাগে। কী দরকার ঝামেলার?’
‘আমি তো কিছু কই নাই। মাথা নামাইয়া স্কুল যাই। সেদিন কী হইছে ভাই রে তো কই নাই। কেডায় কইছে? কোথাও শুনছে মনে হয়। সহ্য করবার পারে নাই। কথা কাটাকাটি হইছে। সজল রে একখান হালকা চাটি দিছে। ঠিক করছে। বান্দরের বাচ্চা বান্দর।’
‘মা রে...মাছ না চিলকাইলে বক ঠোকর মারে? আমি বুঝি না?’
‘তুমি আমারে খারাপ কইলা মা? আমি এমুন মাইয়া?’
‘নে থো! আর কথা বাড়াস না। চল থানাত্ যাই। হাত-পা ধইরা যদি কাম হয়।’
‘তুমি যাও...আমি যামু না।’
‘তা যাবি ক্যান্ হারামজাদি।’
মুনার অভিমান জেগে ওঠে। মন বড় দিশাহীন অস্থির। মামুনকে বেশি ভালবাসে মা। তার চেয়েও। সে যে মেয়ে। তার মূল্য কম। মা সারাদিন কথায় কথায় কাজে-অকাজে ছেলে আর ছেলে। মুনা কি ভাইকে ভালবাসে না? তার বুকে কোত্থেকে এত কষ্ট আসে? সন্ধে অন্ধকার হয়ে নেমে যায়। সেই ছায়া ছায়া-আবছায়া বুকের বিষাদ লুকোতে পারে না বুঝি। সে মায়ের হাত ছেড়ে দেয়। ঘরে সাঁঝবাতি দেওয়া হয়নি। দ্রুত ঘরে ঢুকে সুইচ খুঁজে নিতে থাকে। তারপর হলদে-ফ্যাকাশে আলোয় দু-জন মানুষ পরস্পরের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে একমুহূর্ত। এখন কী করার আছে? (চলমান)

মন্তব্য ১৫ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (১৫) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা জুলাই, ২০২০ সকাল ১০:৩০

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: বাস্তব সমাজচিত্র যেন।
বর্ণনা ডিটইলসে যেয়ে একটু ভারী হলেও সবশেষে পূর্নচিত্র মিলে...
হালকা কাইজ্যা করে এভাবেই ফেসে যায় মামুনরা!
মুনারা বুকে যাতনা চেপে বড় হয়

চলুক তবে . . . .

+++

০২ রা জুলাই, ২০২০ বিকাল ৪:৫৬

মাহবুব আলী বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। একটু শ্লথ সন্দেহ নেই। নভেলা।

২| ০২ রা জুলাই, ২০২০ দুপুর ১২:১৭

রাজীব নুর বলেছেন: প্রফেসর মাহবুব আলী খুব সুন্দর লিখেছেন।

০২ রা জুলাই, ২০২০ বিকাল ৪:৫৮

মাহবুব আলী বলেছেন: প্রথমত: আমি প্রফেসর নই। সামান্য প্রভাষক। দ্বিতীয়ত: লেখার চেষ্টা করি। অনেক ধন্যবাদ।

৩| ০২ রা জুলাই, ২০২০ বিকাল ৩:২২

নেওয়াজ আলি বলেছেন: চমৎকার! ভীষণ ভালো লাগলো l

০২ রা জুলাই, ২০২০ বিকাল ৪:৫৮

মাহবুব আলী বলেছেন: ধন্যবাদ।

৪| ০৩ রা জুলাই, ২০২০ রাত ৮:৪১

আহমেদ জী এস বলেছেন: মাহবুব আলী,




মামুনকে নিয়ে এ ঘুনে ধরা সমাজের একটি চলন্ত বাস্তবতা।
পাশাপাশি মেয়ে বলে মুনার অভিমানটাও বাস্তবের আবারে নয়।

সুন্দর। চলুক................

৫| ০৩ রা জুলাই, ২০২০ রাত ৮:৪২

আহমেদ জী এস বলেছেন: মাহবুব আলী,



কারেকশান - আবারে < বাইরে

০৬ ই জুলাই, ২০২০ বিকাল ৪:১৯

মাহবুব আলী বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য।

৬| ১৩ ই জুলাই, ২০২০ দুপুর ১:৫২

হাসান মাহবুব বলেছেন: রুক্ষ খটখটে সৌন্দর্য আপনার বর্ণনায়।

চলুক।

২০ শে জুলাই, ২০২০ ভোর ৫:৩৫

মাহবুব আলী বলেছেন: ধন্যবাদ রাইটার।

৭| ৩০ শে জুলাই, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:২৮

নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন:

দ্বিতীয় পর্ব থেকে শুরু করে
প্রথম পর্ব শেষ করলাম।
চমৎকার পটভুমিতে বাস্তব চিত্র!
শুভকামনা রইলো পরবর্তী পর্বের জন্য।

৩১ শে জুলাই, ২০২০ সকাল ৭:৪০

মাহবুব আলী বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

৮| ০৭ ই আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৫:২০

শামছুল ইসলাম বলেছেন: আপনার জীবনধর্মী গল্প পড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুকের গভীর থেকে।
মামুনরা এই সমাজে আজ এতোটাই বিপদগ্রস্থ !

০৮ ই আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৫৩

মাহবুব আলী বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। শুভকামনা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.