নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ওরিয়েন্টালিজম (Orientalism) হচ্ছে এডওয়ার্ড ডব্লিউ. সাঈদ এর লেখা একটি বিখ্যাত বই। এই বইটি প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৭৮ সালে। এই বই কে মোটমাট তিনটি অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। যাইহোক, এই অনুচ্ছেদে আমি চেষ্টা করবো এই বইয়ের তিনটি অংশ নিয়ে কথা বলবার ও এই বইয়ের সারসংক্ষেপ আলোচনা করবার। প্রথমে যে প্রশ্ন আমাদের মাথায় আসতে পারে সেটা হলো, এই ওরিয়েন্টালিজম (Orientalism) মূলত কী?
কোরিয়ান শব্দ “Orient” থেকে Orientalism শব্দ এসেছে। আর “Orient” ঐ সব মানুষদের বলা হয় যারা পূর্ব-দেশীয় বা পূর্ব দিকের। সংক্ষিপ্তভাবে, “Orient = Who belongs to Eastern World.”। এখন ইস্টার্ণ ওয়ার্ল্ডে এশিয়া পড়ছে। তাই এশিয়ানদের “Orient” বলা হয়ে থাকে। আর যারা ওয়েস্টার্ণ ওয়ার্ল্ডে থাকেন তাদেরকে “Occident” বলা হয়।
ওরিয়েন্টদের নিয়ে যে আলোচনা হয় সেটাই Orientalism –এর মধ্যে পড়ে। ওরিয়েন্টালিজমে ওরিয়েন্টদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ব্যবহার, অনুষ্ঠান, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে বিশদ আলোকপাত করা হয়। এই চর্চা মূলত ওয়েস্টার্ণ লেখক, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকের দ্বারা প্রভাবিত বা আলোচিত হয়ে থাকে। আশা করছি এই পর্যন্ত আমি আমার বক্তব্য পরিষ্কার করতে পেরেছি।
Introduction to Orientalism
শুরুতেই এডওয়ার্ড ডব্লিউ. সাঈদ তিনি তাঁর বইতে বলছেন, ওরিয়েন্টালিজমের যে ধারণা সেটা মূলত ওয়েস্টার্ণদের দ্বারা গঠন করা হয়েছে। কেন ওয়েস্টার্ণরা এমন দর্শন টেনে আনলেন? কেন এশিয়ানদের ভাগ করতে হলো? এর সহজ উত্তর লেখক দিচ্ছেন, যাতে তারা নিজেদের সুপিরিয়র এবং ওরিয়েন্টদের মানে আমাদের ইনফেরিয়র করে তোলা যায়। আরো সহজ ভাবে দেখলে দেখবেন, কেউ যখন নিজেকে সুপিরিয়র ধরেই নিচ্ছে ঠিক তখন তাৎক্ষণিক ভাবে বাকিরা ইনফেরিয়র হয়ে যায়।
প্রশ্ন আসতে পারে, কোন কোন দেশ এই কনসেপ্ট কে দাঁড় করালেন?
এই কনসেপ্ট মূলত ফ্রান্স, ব্রিটিশ এবং অ্যামেরিকানদের দ্বারা গঠন করা হয়েছে। তারা ওরিয়েন্টদের ক্যালচার, ট্রাডিশন এবং সাহিত্য বেশ সূক্ষ্মভাবে পড়েছেন, ওরিয়েন্টদের চিন্তা-ভাবনাসমূহ কে ভালোভাবে বুঝেছেন যাতে করে এদের উপর কর্তৃত্ব ফলানো সহজ হয়ে যায়।
এডওয়ার্ড ডব্লিউ. সাঈদ তিনি তাঁর বইয়ের শুরুতে ব্যাখ্যা করছেন এভাবেই। পাশাপাশি তিনি আমাদের চিন্তা-চেতনা ও মন-মগজ সব বিশ্লেষণপূর্বক ওয়েস্টার্ণরা এমন ধারণা তৈরি করেছেন। যেটাকে কিনা “ওরিয়েন্টালিজম” নাম দেওয়া হয়েছে। এখন আমি চেষ্টা করছি এই বইয়ের তিনটি অংশ নিয়ে আলোচনা করবার। তাহলে চলুন শুরু করা যাক,
প্রথম পর্ব: Scope of Orientalism – Knowing of the Orientals
এই অংশে লেখক এডওয়ার্ড ডব্লিউ. সাঈদ বলছেন, কীভাবে ওরিয়েন্টালিজম একটি “সিস্টেম অব অর্ডার” হয়ে গেছে এই আধুনিক যুগে। ওরিয়েন্টালিজম আমাদের ইস্টার্ণ ও ওয়েস্টার্ণ পার্ট সম্পর্কে একটি বিশদ ধারণা ও ব্যাখ্যা দেয়। এর সাথে কীভাবে ওয়েস্টার্ণরা আমাদের ভাগ করে দিয়েছেন সে ব্যাপারেও তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব হয়। ওয়েস্টার্ণরা এক্ষেত্রে দুটি টার্ম ব্যবহার করছেন,
১. Ours
২. Theirs
এই টার্ম দুটোর সহজ বাংলা হচ্ছে, আমরা এবং তারা। এই “আমরা(Ours)” মানে ওয়েস্টার্ণরা নিজেদের তো সুপিরিয়র বলছেই পাশপাশি এই “তারা(Theirs)” দিয়ে আমাদের ভাগও করে দিচ্ছেন। এখন নতুন করে যে বিষয়টি যুক্ত হচ্ছে সেটা হলো, আমরা সভ্য, তোমরা অসভ্য। তোমরা(ওরিয়েন্ট) অলস, তোমাদের লোভ বেশি, তোমাদের যৌনক্ষুধা বেশি, তোমাদের মধ্যে হিংসা বেশি তাছাড়াও তোমরা বেশ রহস্যময়।
মুশকিল হচ্ছে “Occidents” –দের ধারণা বা কনসেপ্ট বা দর্শন তা তারা নিজেরাই নিজেদের বলছেন মানে স্ব-ঘোষিত (Self-Proclaimed) । আরো গভীরে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, Occident সুপিরিয়র নয়, না কোথাও এই কথা লেখা আছে। তারা নিজেরাই নিজেদের সুপিরিয়র বলছেন, এমন কোন প্রমাণ নেই তাদের সুপিরিয়র হবার বা বলবার কারণ আছে।
কিন্তু তারা কেন এমন ন্যারেটিভ তৈরি করলেন?
প্রথমত, আমাদের কমজোর বা দূর্বল দেখানোর জন্য। দ্বিতীয়ত, আমাদের যে নৈতিকতা ও সংস্কৃতি আছে তার ভিত দূর্বল আছে এটা বুঝানোর জন্য। আর এই দুটো বিষয় কব্জায় আনা গেলে আমাদের খুব সহজেই অসভ্য বলে দেওয়া যায়। আর ঠিক তখনই সভ্যতার নাম দিয়ে আমাদের শাসন করা তাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে, যাচ্ছে।
Orients বনাম Occidents
এখন অক্সিডেন্টরা মনে করছেন যে, ওরিয়েন্টদের দিয়ে কিছুই ম্যানেজ করা যায় না বা ভরসা করা যায় না। কারণ তারা অসভ্য আর আমাদেরকেই তাদের সভ্য বানাতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, উপনেশবাদ দ্বারা আমরা যে আমাদের আইডেন্টিটি হারিয়ে ফেলেছিলাম বা এখনো খুঁজে পাচ্ছি কিনা সেটা কিন্তু এই কনসেপ্টের কারণে। শহরের রাস্তায় ওভার ব্রিজে একটু সময় কাটালে দেখতে পাবেন, আমাদের পোষাক, আমাদের চালচলন বা ব্যবহার, আমাদের দর্শন, আমাদের মতবাদ প্রায় একে অন্যের সাথে সাংঘর্ষিক। এই অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। এসব তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু অক্সিডেন্টদের মধ্যে এমন বৃহৎ পার্থক্য খুঁজে পাওয়া কষ্টকর ও দুষ্কর।
আর যেহেতু এই কনসেপ্ট বেশ শক্তভাবেই আমাদের মনে গাঁথা গেছে তাই আমরাও মনে করি, বড় কোন বিষয়ে আমাদের ম্যানেজমেন্ট করার দক্ষতা কম। আর এজন্যই চিকিৎসার ক্ষেত্রেও দেখবেন অ্যামেরিকা ফেরত কিন্তু তবুও রোগীকে বাঁচানো গেল না। এখানে মৃত্যু অনিবার্য না দেখিয়ে ওয়েস্টার্ণদের কৃতি বেশি ফুটে ওঠে। হতে পারতো আমাদের সাধারণ একজন চিকিৎসকও ঐ চিকিৎসা করতে পারেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটা সত্য বলে প্রমাণিতও হয়েছে।
“Divide and Rule” –পলিসি অক্সিডেন্টদের হাত ধরেই আসে। আর আমাদের বহু বছর তারা শাসন করেছেন। এটা সূর্যের মত সত্য। সে যাইহোক, বইটির দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে আরো আকর্ষণীয় ও দুর্দান্ত কিছু কথা।
দ্বিতীয় পর্ব: Orientalist Structure and Re-Structure
এই অংশে লেখক এডওয়ার্ড ডব্লিউ. সাঈদ ওয়েস্টার্ণদের চোখ দিয়ে দেখে বলছেন, ওরিয়েন্টরা যদিও আমাদের(ওয়েস্টার্ণদের) মত সভ্য হয়তো নয় কিন্তু এরা বেশ সহজ-সরল। এছাড়াও ওরিয়েন্টদের “খাঁটি/নির্ভেজাল” শব্দে আখ্যায়িত করছেন অক্সিডেন্টরা।
তাহলে একটি জাতি সহজ-সরল ও খাঁটি হওয়া সত্ত্বেও সভ্য নয়, সুপিরিয়র তো দূরের কথা। মানে হলো, অক্সিডেন্টরা বলছেন তো সহী, ভাই তুমি সহজ-সরল ও ঈমানদার হলেও আমি তোমার চেয়ে সভ্য ও সুপিরিয়র। উল্লেখ্য, এখানে কারো হাসি পেলে লেখক তার জন্য দায়ী নয়। এই বিখ্যাত ইহুদি লেখক তো ওয়েস্টার্ণদের প্যান্ট এমনভাবে খুলেছেন যে আমার লিখতে লিখতেও হাসি পাচ্ছে।
উনিশ শতকের দিকে এখন নতুন কিচ্চা কি? অক্সিডেন্টরা বলছেন, ভাই তুমি একটু বেশি-ই ভোলাভালা। যে কেউ তোমাকে শোষণ করতে পারে। তাই ভাই আমাদের বিশ্বাস করো, আমরা তোমাকে (ওরিয়েন্ট) কে রক্ষা করবো। কিন্তু এই কথার মধ্যে তাদের একটি লুকায়িত উদ্দেশ্য ছিলো। স্বার্থ ছাড়া কেউ কেন কাউকে রক্ষা করতে চাইবে? আমরা কি তাদের কাছে অতটুকুও স্পেশ্যাল? তারা এসব বলতো নিজেদের জাস্টিফাই করার জন্য।
কিন্তু এর মধ্যেও এই দুই ভাগের মধ্যে (Orients বনাম Occidents) যে কনসেপ্ট ওয়েস্টার্ণরা গেঁথেছেন এবং সেসব যে সত্য নয় এ বিষয়ে দুইজন লেখক সোচ্চার হোন।
১. Ernest Renan
২. Silvestre De Sacy
তাঁরা বলছেন এই কনসেপ্ট একটি মিথ বৈ কিছু নয়। এই কনসেপ্ট তৈরি করা হয়েছে ওয়েস্টার্ণদের ক্যালচার ইস্টার্ণদের মধ্যে গ্রথিত করার জন্য। আর তাদের কাজ থেকেই এডওয়ার্ড ডব্লিউ. সাঈদ অণুপ্রাণিত হোন। তো চলুন বইটির শেষ পার্ট চুকিয়ে ফেলি। তাছাড়াও অনুচ্ছেদটি দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে।
তৃতীয় পর্ব: Orientalism Now
এই অংশে লেখক এডওয়ার্ড ডব্লিউ. সাঈদ বলছেন, যদিও উপনেশবাদ খতম হয়ে গেছে তবুও এই কনসেপ্ট রদ করা বা বাতিল করা সম্ভব হয়নি। প্যারাসাইটের মত করে আমাদের মধ্যে থেকেই গেছে। যেমন ধরুন, ভাইভা বোর্ডে তীব্র গরমে কোর্ট-টাই পড়েন তো না কি! না হলে ডিস্কো খাবেন। মানে নম্বর কম পাবেন। কিন্তু এটা কোথায় লেখা আছে যে, ভাইভা বোর্ডে বা ইন্টারভিউ তে আমাদের কোর্ট-টাই পড়তেই হবে!
উপনিবেশিক ক্ষমতা আমাদের উপর কর্তৃত্ব এজন্যই ফলিয়েছিলেন যাতে করে আমরা আমাদের আইডেন্টিটি ভুলে যাই। পাশাপাশি ইউনিফর্মিটি প্রতিস্থাপনপূর্বক তাদের ক্যালচারও যথাযথভাবে প্রতিস্থাপন করেছেন। এখন বাঙালী হওয়ায়, লুঙী আর শার্ট পড়ে কে কে ইন্টারভিউ দেবার সাহস রাখেন? মন্তব্যে জানাবেন। মানে এখান থেকেই শুরু করতে হবে, যদি আমরা চাই তো। ছোট ছোট বিষয় পরিবর্তন করতে হবে আস্তে ধীরে।
Orientalism in 20th Century
কিন্তু তারও আগে এডওয়ার্ড ডব্লিউ. সাঈদ বলছেন, এখন একটি মিক্সড ক্যালচার তৈরি হয়ে গেছে। মানে ধরুন, একটা Hegemony এর উপর আরেকটা Hegemony! কীভাবে? এখন ইস্টার্ণ পার্ট ও ওয়েস্টার্ণ পার্ট একসাথে বসবাস করা শুরু করেছেন। এর মানে আবার এই নয় যে, ওয়েস্টার্ণরা আমাদের পছন্দ করতে শুরু করেছে। না তারা আমাদের মত হতে চায়, না তারা আমাদের মত করে জীবন যাপন করতে চায়। তাদের তো আলাদা-ই মাসলা। তারা এখনো নিজেদের সুপিরিয়র ভাবে। শুধু তাই নয় পাশপাশি ওরা চেষ্টা করে আমাদের সম্পর্কে আরো বেশি জানার। মেলবন্ধন নয়, দিকভ্রান্তির জন্যই এই চর্চা।
পরিশেষ
এডওয়ার্ড ডব্লিউ. সাঈদ এর লেখা “ওরিয়েন্টালিজম” আমার পক্ষে এই এক অনুচ্ছেদে প্রকাশ করা বা পুরোপুরি ধারনা দেওয়া সম্ভব নয়। আমি আমার দিক থেকে চেষ্টা করেছি মাত্র। লেখকের যুক্তির পাশাপাশি সমান্তরাল ভাবে ব্যক্তিগত টিপ্পনীও আমি দিয়েছি। আপনার যদি ঐ সব টিপ্পনী পছন্দ না হয় তবে পূর্বেই আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ধন্যবাদ।
- মেহেদি হাসান(Mehedi Hasan)
২| ২৬ শে অক্টোবর, ২০২১ রাত ২:৩৯
অন্তর্জাল পরিব্রাজক বলেছেন: দারুণ একটি লেখা। ওরিয়েন্টালিজম আর এডওয়ার্ড সাইদ আসলে স্টাডি করা হয়নি কখনো, যদিও নাম শুনেছি অনেক। যাক, এরকম লেখা আরও লিখলে ভালো লাগবে।
২৮ শে অক্টোবর, ২০২১ ভোর ৫:১৮
মি. বিকেল বলেছেন: ধন্যবাদ
৩| ২৬ শে অক্টোবর, ২০২১ রাত ৩:০৬
নুরুলইসলা০৬০৪ বলেছেন: মধ্যপ্রাচ্য ও ভারত উপমহাদেশ দুই ভাগে বিবক্ত হয়ে ছিল ইংরেজরা আসার অনেক আগে ইসলাম ধর্ম প্রচারের পরে।মুসলমানরা ছিল খিলাফতি শাসনে বিশ্বাসী,বাকিরা ছিল রাজতন্ত্রে।দুইশত বৎসর ব্যাপী ধর্ম যুদ্ধের ফলে ইউরোপের সাথে মুসলমানদের দুরত্ব অনেক বেড়ে যায়।
রেনেসা ও শিল্পবিপ্লব ,সেই সাথে যোগ হয় ফরাসি বিপ্লব এবং আমেরিকার দাস মুক্তি।এই সব ঘটনাপ্রবাহ বাকী বিশ্ব থেকে পশ্চিমা বিশ্ব জ্ঞান বিজ্ঞানে অনেক এগিয়ে যায়।
তারা যে আমাদের থেকে সবদিক দিয়ে এগিয়ে ,এটা আমরা মানলেও সত্য না মানলেও সত্য।
২৮ শে অক্টোবর, ২০২১ ভোর ৫:২০
মি. বিকেল বলেছেন: দুঃখিত! আপনার মন্তব্য পোস্টের সাথে যাচ্ছে না। অনুগ্রহ করে বইটি পড়বেন, অনুরোধ রইলো। আপনি যে বিষয়ে বলেছেন, আমি একজন ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র সেসব কিছুটা হলেও জানি।
ধন্যবাদ
৪| ২৬ শে অক্টোবর, ২০২১ দুপুর ১২:৫৮
*কালজয়ী* বলেছেন: জ্যা ফ্রাসোয়া লিওটার্ড এখানে প্রাসঙ্গিক। কারণ প্রাচ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বইগুলো এখন পড়ানো হয়। মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে প্রকাশিত La Condition postmoderne: Rapport sur le savoir (The Postmodern Condition: A Report on Knowledge) (১৯৭৯) বইয়ে লিওটার্ড উত্তর-আধুনিকতাবাদ নিয়ে কথা বলেছেন যেখানে প্রাচ্যের কিছু ন্যারেটিভ সম্পর্কে আলোচনা এসেছে। তিনি বলছেন, পোস্টমডার্ন হচ্ছে মেটা-ন্যারেটিভ। উত্তর-আধুনিকতাবাদ হল একটি অস্পষ্ট, জটিল এবং কখনও কখনও পরস্পরবিরোধী শব্দ যা সংস্কৃতি ও দর্শনের কিছু উন্নয়নকে সংজ্ঞায়িত করতে ব্যবহৃত হয়। উত্তর-আধুনিকতার অনেক সংজ্ঞা প্রযুক্তির বিকাশের সময় আধুনিক শিল্প যুগের পরিণতি হিসাবে এর প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে। এই বইটি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং শিল্পকলার অবস্থা, টেকনোক্রেসির তাৎপর্য এবং পশ্চিমা বিশ্বে তথ্যের প্রবাহ যেভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় তা দেখে সেই বিশ্লেষণকে উত্তর-আধুনিকতার দিকে প্রসারিত করে।
তিনি লিখেছেন, প্রভাবশালী আইডিওলজি (পশ্চিমাদের ভাষায় সুপিরিয়র মতাদর্শ) অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক সমাজকে সংগঠিত করে। প্রাচ্যের মেটা ন্যারেটিভ যা একটি বিশাল বা প্রভাবশালী গল্প যা অন্যান্য গল্পকে গঠন ও বৈধতা দেয়। তাহলে এই মেটা-ন্যারেটিভ আসলে কি? উদাহরণস্বরূপ মেটা ন্যারেটিভ টেরোরিজম বা সন্ত্রাসবাদ, যা অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক বর্ণনাকে বৈধতা দেয়। মিডিয়া উপস্থাপনাগুলি নির্দিষ্ট মূল্যবোধ বা মতাদর্শকে যোগাযোগ বা প্রকাশ করার জন্য পাঠ্যগুলিতে মেটা বর্ণনা ব্যবহার করে। যখন এই কাঠামোগত মেটা বর্ণনা এবং প্রভাবশালী মতাদর্শগুলিকে অসংগঠিত বা বিনির্মাণিত, বহুমাত্রিক পোস্টমডার্ন মিডিয়াস্কেপের ক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া হয় তখন কী ঘটে? সার্বজনীন মূল্যবোধ এবং সত্য আপেক্ষিক; অনিশ্চয়তা; সন্দেহজনক বর্ণনা; এবং একটি প্রতিষ্ঠিত বা কাঠামোগত ধারণার প্রতিক্রিয়ায় সমালোচনা এবং দ্বন্দ্বের ক্রমাগত ব্যাপক উপস্থিতি। উত্তর-আধুনিক কাজগুলি রেফারেন্স, প্যাস্টিচ এবং সাধারণ প্রত্যাশার ভাঙ্গনের উপর নির্মিত। অর্থাৎ প্রাচ্যের ধর্মের কোন সার্বজনীনতা নেই এবং এটি সন্দেহজনক। কেননা এটি সহিংসতা, জিহাদের (তালেবান, আইএস, বোকোহারাম) নামে সন্ত্রাসবাদকে উস্কে দেয়। এক্ষেত্রে তিনি যে ইংরেজি টার্ম ব্যবহার করেছেন তা হল, "postmodern" as an 'incredulity towards meta-narratives'। এই মেটা-ন্যারেটিভ হল প্রাচ্যের ধর্ম ও ধর্মের চর্চাকারিদের সন্ত্রাসবাদী কিংবা কাল্পনিক উসকানিমূলক গল্প যা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
তিনি এদিক থেকে জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের মতই। মার্ক্স তার ইহুদী প্রশ্নে’ বইয়ে লিখেছেন, ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থে কি আছে সেটা নয়, আমি ইহুদী ধর্মের মূল্যায়ন করব ইহুদীদের কর্মকাণ্ড দিয়ে। যদিও আলজেরিয়ায় থাকাকালীন লিওটার্ডের প্রাথমিক রাজনৈতিক মতাদর্শ ও প্রতিশ্রুতি ছিল বিপ্লবী সমাজতন্ত্র এবং তুলনামূলকভাবে গোঁড়া মার্ক্সবাদের প্রতি।
প্রাচ্যের বিশ্বাস, মূল্যবোধ যে বর্বর ও অসভ্য তা প্রমাণের জন্য তিনি ধর্মের গভীরতা সম্পর্কে অজ্ঞ-মুর্খ সুইসাইড বোম্বার ধর্মচর্চাকারিদের ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তিনি ধর্মগ্রন্থের গভীর অধ্যয়নের দিকে এগুচ্ছেন না। এখানেই তার ধূর্তামি ও চালাকি ধরা পড়ে। এই ভদ্রলোক সেয়ানা।
টিম আমেরিকা হল একটি পোস্ট মডার্ন মেটা ন্যারেটিভ যা আমেরিকান কালচার এবং মিডিয়া সম্পর্কে কোন চ্যালেঞ্জ সহ্য করেনা। দাড়ি-টুপি-পাঞ্জাবী পরিহিত মুসলিম ব্যক্তি ও সংস্কৃতির প্রতি পোস্টমডার্ন মেটা ন্যারেটিভের উদ্দেশ্য হল মিডিয়া স্কেপের সমস্ত উপাদানের বৈধতা সম্পর্কে একটি সমালোচনামূলক পদ্ধতিতে প্রকাশ করা, রাজি করানো, বিশ্লেষণ করা, জিজ্ঞাসাবাদ করা, চ্যালেঞ্জ করা এবং মন্তব্য করা। যা চূড়ান্তভাবে মুসলিমদেরকে সার্বজনীন হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করে। তিনি বলতে চাচ্ছেন উত্তর-আধুনিক এই যুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে মেটা-ন্যারেটিভ ভেঙ্গে পড়েছে।
লিওটার্ড সমস্ত প্রভাবশালী রাজনৈতিক মতাদর্শকে (মার্ক্সবাদ, উদারতাবাদ, ধর্মতত্ত্ব) মাস্টার-ন্যারেটিভ হিসাবে প্রত্যাখ্যান করেন যা সংখ্যালঘুদের বাদ দেয় এবং সামাজিক বাস্তবতার ভিন্ন প্রকৃতির সহিংসতা করে। এই প্রত্যাখ্যানটি পৌত্তলিকতার দর্শনে উদ্ভাসিত হয় যা লিওটার্ডের উত্তর-আধুনিকতার আগে ছিল। এখানে, পৌত্তলিকদের সাথে যুক্ত "অপরাধ" ধারণাটি "ধার্মিক" রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রত্যাখ্যান। এই অর্থে তিনি আবার সোশ্যাল ডারউইনবাদের ‘সারভাইভাল অব ফিটেস্ট’ মতাদর্শের বিরোধিতা করেন।
অর্থাৎ লিওটার্ড মতাদর্শিকভাবে স্থির ছিলেন না। নিয়ত পরিবর্তনশীল ছিলেন।
ফরাসি দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী এবং সাহিত্য তত্ত্ববিদ জাঁ-ফ্রাঁসোয়া লিওটার্ড ১৯৫০ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত আলজেরিয়ার ‘লিচে ওব কন্সটান্টাইনে’ পড়াতেন। এরপর ১৯৫০ সালে মূল ভূখণ্ড ফ্রান্সে ফিরে এসে ‘প্রাইটানি মিলিটারি একডেমিতে’ পড়ানো শুরু করেন। এই সমাজবিজ্ঞানী ভিজিটিং স্কলার হিসেবে পড়িয়েছেন জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে, ইয়েল ইউনিভার্সিটি, স্টনি ব্রুক ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান দিয়েগো, কুইবেকের ইউনিভার্সিটি ডি মন্ট্রিল (কানাডা) এবং ব্রাজিলের সাও পাওলো ইউনিভার্সিটির মত নামকরা ইউনিভার্সিটিতে।
কমেন্ট অনেক দীর্ঘ হয়ে যাওয়ায় আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
মিঃ বিকেল ধন্যবাদ। নিরন্তর শুভকামনা পাঠ-পরিক্রমায়।
২৮ শে অক্টোবর, ২০২১ ভোর ৫:২১
মি. বিকেল বলেছেন: আপনার অনুমতি পেলে ঠিক এই লেখা আমি আমার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে চাই। দুর্দান্ত।
৫| ৩০ শে অক্টোবর, ২০২১ সকাল ১০:৩৫
*কালজয়ী* বলেছেন: @@মিঃ বিকেল,
প্রকাশ করতে পারেন।
তবে ওয়েবসাইটের লিংকটা দিয়েন।
©somewhere in net ltd.
১| ২৬ শে অক্টোবর, ২০২১ রাত ১২:৫৪
রাজীব নুর বলেছেন: পড়লাম।