![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সূচনা
এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশে যৌনকর্মের ইতিহাসের উপর একটি বিস্তৃত এবং গবেষণামূলক আলোচনা উপস্থাপন করে, যা প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত এই প্রথার বিবর্তন এবং এর সাথে জড়িত সামাজিক, অর্থনৈতিক, আইনি ও স্বাস্থ্য বিষয়ক দিকগুলি বিশদভাবে বিশ্লেষণ করে। এই আলোচনায় সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, দার্শনিক, সমাজ সংস্কারক এবং ধর্মীয় নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা যৌনকর্মের বহুবিধ দিক এবং এর পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরতে সহায়ক।
এছাড়াও, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে যৌনকর্মীদের অধিকার এবং স্বীকৃতির সংগ্রামের উপর আলোকপাত করা এই প্রতিবেদনের অন্যতম উদ্দেশ্য। এই পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে একটি কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরা হবে, যেখানে যৌনকর্মের ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে।
‘যৌনকর্ম’ শব্দটির সংজ্ঞা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এর অর্থ ভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। শিল্পী, পতিতা, শ্রমিক—এই পরিচয়গুলির মধ্যে কোনটি যৌনকর্মীদের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত, তা নিয়ে সমাজে দীর্ঘ বিতর্ক বিদ্যমান। ‘কলঙ্ক’ এবং সামাজিক কলঙ্কবাদ-এর ধারণা যৌনকর্মের সাথে গভীরভাবে জড়িত, যা এই পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের জীবনে নানাবিধ সমস্যা তৈরি করে।
এই প্রতিবেদনে আমরা এই বিতর্কিত পরিচয় এবং কলঙ্কের ইতিহাসও অনুসন্ধান করবো। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে আসা আজকের সমস্যাগুলো অনুধাবন করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১. ঐতিহাসিক পর্যায়ক্রমিক বিভাজন
১.১ প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে যৌনকর্মের সামাজিক-অর্থনৈতিক ভূমিকা (খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ – ২০০ খ্রিষ্টাব্দ)
বর্তমান বাংলাদেশের ভূখণ্ড ঐতিহাসিকভাবে বৃহত্তর ভারতীয় উপমহাদেশের অংশ ছিল, যেখানে প্রাচীনকাল থেকেই যৌনকর্মের প্রচলন ছিল। ঋগ্বেদেও যৌনকর্মের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে ‘বারাঙ্গনা’ ও ‘কুমারী মাতার পুত্র’ শব্দগুলি ব্যবহৃত হয়েছে। বাজসনেয়ী সংহিতায় এটিকে একটি পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল, যদিও সমাজের বিভিন্ন স্তরে এর গ্রহণযোগ্যতা ভিন্ন ছিল।
প্রাচীন ভারতে যৌনকর্ম কখনও কখনও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছিল, যেখানে বিভিন্ন ধরনের যৌনকর্মী বিদ্যমান ছিলেন, যেমন – গণিকা ও রূপজীবা। সাহিত্য অনুযায়ী, বৈদিক যুগের কয়েক শতাব্দী পর এই পেশাটি সমাজে আত্মপ্রকাশ করে।
প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে যৌনকর্মের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এবং বাত্সায়নের কামসূত্রে এই সময়ের যৌনকর্মের বিভিন্ন দিক বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। অর্থশাস্ত্র অনুসারে, রাজদরবারে সুন্দরী, যুবতী এবং গুণবতী নারীদের বেতনভুক্ত যৌনকর্মী (গণিকা) হিসেবে নিয়োগ করা হত। তাদের বার্ষিক বেতন ছিল ১,০০০ পণ, যা সেই সময়ের বিচারে যথেষ্ট সম্মানজনক ছিল।
শুধু তাই নয়, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে পতিতাবৃত্তিকে একটি শিল্প হিসেবে গণ্য করা হত এবং রাষ্ট্র কর্তৃক প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা ছিল। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত এই পতিতারা রাষ্ট্রের রাজস্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচিত হত।
প্রাচীন ভারতের অভিজাত নারীদের মধ্যে গণিকারা ছিলেন বিদুষী ও গুণী, যাঁরা সমাজে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁরা কেবল যৌনতৃপ্তি দান করতেন না, বরং বিভিন্ন শাস্ত্র, শিল্পকলা যেমন – নৃত্য, সঙ্গীত, লেখা, এবং রাজনৈতিক ও সাহিত্য সভায় অংশগ্রহণ করতেন। এমনকি, গণিকারা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজে গুপ্তচর হিসেবেও নিয়োজিত হতেন, যা তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবের পরিচায়ক।
অন্যদিকে, বাত্সায়নের কামসূত্রে কামকে জীবনের তিনটি প্রধান লক্ষ্যের (ধর্ম, অর্থ, কাম) মধ্যে অন্যতম স্থান দেওয়া হয়েছে। কামসূত্রের ষষ্ঠ অধ্যায়ে মূলত নারীদের কথা বলা হয়েছে, যেখানে একজন নারী কীভাবে লাভ, লোকসান এড়াতে পারে এবং ভালোবাসা পেতে পারে, সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। প্রাচীন ভারতে গণিকাদের উচ্চ সামাজিক মর্যাদা ছিল এবং তারা ধনী ও শিক্ষিত ছিলেন। তারা কেবল যৌনতৃপ্তি প্রদানেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং ৬৪ প্রকার শিল্পকর্মেও পারদর্শী ছিলেন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক সভায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন।
বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থেও যৌনকর্মীদের সম্পর্কে মিশ্র মতামত পাওয়া যায়। কিছু গ্রন্থে তাদের সম্মানজনক স্থান দেওয়া হয়েছে, আবার কিছু গ্রন্থে তাদের নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে। হিন্দু ধর্মগ্রন্থে যৌনকর্মকে সরাসরি নিন্দা না করলেও, এটিকে খারাপ কর্মফল হিসেবে বিবেচনা করা হয় যা ভবিষ্যতে কষ্টের কারণ হতে পারে।
দেবদাসী প্রথা, যেখানে নারীরা দেবতাদের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করতেন, তারও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। গুপ্ত যুগে গণিকাদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থানের উন্নতি ঘটেছিল। প্রাচীনকালে যৌনকর্মের ধারণা এবং এর সামাজিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট পরবর্তী সময়ের তুলনায় যথেষ্ট ভিন্ন ছিল।
প্রাচীন ভারতে যৌনকর্মীদের বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা হত। গণিকারা ছিলেন রাজদরবারে বেতনভুক্ত যৌনকর্মী, শিল্পী এবং গুপ্তচর। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র অনুসারে, তাদের বার্ষিক বেতন ছিল ১,০০০ পণ। রূপজীবারা স্বাধীনভাবে সৌন্দর্য বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন এবং তাদের বার্ষিক আয় ছিল ৫০০ পণ। প্রতিনিকারা গণিকার অনুপস্থিতিতে বিকল্প হিসেবে কাজ করতেন এবং তারা গণিকার অর্ধেক বেতন পেতেন। দেবদাসীরা মন্দিরে সেবাদাসী হিসেবে নৃত্য ও সঙ্গীত পরিবেশন করতেন এবং কিছু ক্ষেত্রে যৌনকার্যও করতেন।
১.২ মধ্যযুগে নবাবী আমলের বাইজি/তাওয়াইফ সংস্কৃতি (১৬০৮–১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দ)
মধ্যযুগে বাংলায় নবাবী শাসনের সময় (বিশেষত ঢাকা) বাইজি বা তাওয়াইফ সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। পূর্ববঙ্গে এই সংস্কৃতির বিস্তার মূলত ১৭ শতকের শুরুতে, সুবাহদার ইসলাম খানের (১৬০৮-১৬১৩) শাসনামলে শুরু হয়। সেই সময় নৃত্য ও সঙ্গীতে পারদর্শী নারীদের কাঞ্চনী বলা হত।
বাইজিরা মূলত খেয়াল, ঠুমরি, টপ্পা, গজল গাইতেন এবং কত্থক নৃত্যে বিশেষভাবে পারদর্শী ছিলেন। তাঁদের পরিবেশনা মেহফিল বা মুজরো নামে পরিচিত ছিল, যা নবাব, রাজা, জমিদার এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মনোরঞ্জনের প্রধান মাধ্যম ছিল। ইসলাম খানের দরবারে এই শিল্পীরা ‘কাঞ্চনী’ নামে পরিচিত ছিলেন। ঢাকার নবাবী আমলে নুসরাত জং, শামসুদ্দৌলা, কমরুদ্দৌলা, আব্দুল গনি এবং আহসানউল্লাহর পৃষ্ঠপোষকতায় বাইজিদের জলসা অনুষ্ঠিত হতো। আহসান মঞ্জিলের রংমহল ও নিমতলী প্রাসাদ ছিল বাইজিদের উল্লেখযোগ্য স্থান।
ঢাকায় আহসান মঞ্জিল, শাহবাগের ইশরাত মঞ্জিল এবং দিলকুশা গার্ডেন হাউসের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে বাইজিদের নিয়মিত জলসা বসত। উনিশ শতকের শুরুতে ধনাঢ্য এবং জমিদার শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতায় বাইজি পেশা আরও লাভজনক হয়ে ওঠে। বাইজিরা কেবল বিনোদনই দিতেন না, বরং সমাজে তাদের একটি বিশেষ স্থান ছিল এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ সামাজিক কল্যাণমূলক কাজেও যুক্ত ছিলেন।
নবাব আব্দুল গনি শাহবাগে বাইজিদের জলসার আয়োজন করতেন। সুপঞ্জান নবাব আব্দুল গনির পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন এবং নৃত্য ও সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। মুস্তারি বাইও নবাব আব্দুল গনির পৃষ্ঠপোষকতায় গান গেয়ে বিখ্যাত উর্দু সাহিত্যিকদের আকৃষ্ট করেছিলেন। পিয়ারি বাই এবং হীরা বাই নবাব আব্দুল গনির দরবারে নৃত্য ও সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। গৌহর জান বিভিন্ন নবাব ও জমিদারের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন এবং তিনি গান ও নৃত্য পরিবেশনার পাশাপাশি উপমহাদেশের প্রথম শিল্পী যিনি গ্রামোফোন রেকর্ডে কণ্ঠ দেন।
নবাবী আমলে বাইজি সংস্কৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চ হিসেবে বিবেচিত হত। বাইজিরা কেবল যৌনকর্মী ছিলেন না, বরং তারা সঙ্গীত, নৃত্য ও আদব-কায়দার ধারক ও বাহক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। সমাজের অভিজাত শ্রেণী তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করত, যা তাদের সামাজিক মর্যাদার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। তবে, সামাজিক স্বীকৃতি ও পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে তাঁদের নিয়মিতভাবে বাধার সম্মুখীন হতে হতো এবং তাঁদের পেশাকে নৈতিকভাবে গর্হিত কাজ হিসেবে দেখা হতো।
নবাবী আমলে বাইজিরা আর্থিকভাবে স্থিতিশীল এবং সামাজিকভাবে উচ্চ অবস্থানে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং পারিবারিক অনুষ্ঠানে ও বাগানবাড়িতে আমন্ত্রিত হতেন। বাইজিরা খেয়াল, ঠুমরি, টপ্পা, গজল গাইতেন এবং কত্থক নৃত্য পরিবেশন করতেন। তাঁরা নৃত্য ও মুখের ভাব এবং হাত, চোখ, নাক ও ঠোঁটের মাধ্যমে গানের আবেগ প্রকাশ করতেন। বাইজিরা ভারতীয় নান্দনিক ও আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির ধারক হিসেবে বিবেচিত হতেন। ঢাকা, লখনউ ও কলকাতার বাইজি সংস্কৃতির মধ্যে কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
লখনউতে তাওয়াইফরা মূলত মুঘল দরবারের সংস্কৃতির অংশ ছিলেন, যেখানে ঢাকায় বাইজিরা স্থানীয় নবাব এবং জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করতেন। কলকাতায় ব্রিটিশদের আগমনের পর বাইজি সংস্কৃতির চরিত্র কিছুটা পরিবর্তিত হয়। ১৯৪০ সালের দিকে বাইজিদের পৃষ্ঠপোষকতা ধীরে ধীরে হ্রাস পায় কারণ তাঁদের পৃষ্ঠপোষক নবাব ও জমিদারদের প্রভাব কমে গিয়েছিল এবং পুরনো প্রথা বিলুপ্ত হতে শুরু করে।
নবাবী আমলে যৌনকর্ম, বাইজি সংস্কৃতির মাধ্যমে, ঢাকার অভিজাত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের একটি অংশ ছিল, যা পরবর্তীকালে হ্রাস পায়।
১.৩ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি (১৮৫৮–১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ)
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে বাংলাদেশে যৌনকর্মের চিত্র উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল, যা ব্রিটিশদের নৈতিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত ছিল। ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৪ সালে ক্যান্টনমেন্ট অ্যাক্ট প্রণয়ন করে। এই আইনের মাধ্যমে ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটিগুলোতে পতিতাবৃত্তিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হত যাতে সৈন্যদের মধ্যে যৌনরোগের বিস্তার রোধ করা যায়। এর ফলস্বরূপ সেনানিবাস এলাকায় ‘চাকলা’ নামক পতিতালয়গুলোতে যৌনকর্মীদের নিবন্ধন, স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং পৃথকীকরণের ব্যবস্থা করা হয়।
প্রতিটি ব্রিটিশ রেজিমেন্টের সৈন্যদের জন্য ১২ থেকে ১৫ জন ভারতীয় নারীকে ব্রোথেল (চাকলা)-এ রাখা হত। এই আইন অনুযায়ী, যৌনকর্মীদের সপ্তাহে একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো বাধ্যতামূলক ছিল এবং যৌনরোগ ধরা পড়লে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও হাসপাতালে (Lock Hospital) ভর্তি করা হত। ব্রিটিশ সৈন্যরা তাদের জন্য সেনানিবাস এলাকায় বিশেষভাবে পতিতালয় স্থাপন করে, যেখানে মূলত গ্রামীণ দরিদ্র পরিবার থেকে নারীদের নিয়োগ করা হতো।
ঐ সময়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের মধ্যে যৌনরোগের প্রকোপ ছিল ব্যাপক। ১৮৬৬ সালের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ব্রিটিশ সৈন্যদের মধ্যে সংক্রমণের হার ছিল ২১৮ প্রতি ১০০০, যেখানে ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে এই হার ছিল মাত্র ৫৪। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার কর্তৃক প্রণীত বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক আইনের ধারাগুলির ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব ছিল। ব্রোথেল স্থাপনের মাধ্যমে ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক ভারতীয় নারীর আবাসন ও কাজের ব্যবস্থা করা হয়। বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফলে যৌনকর্মীদের সপ্তাহে একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো বাধ্যতামূলক করা হয়, যা তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও মর্যাদার লঙ্ঘন ছিল।
যৌনরোগে আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তির মাধ্যমে যৌনরোগ ধরা পড়লে যৌনকর্মীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও হাসপাতালে ভর্তি করা হত, যা তাদের স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ ছিল। কেবল সৈন্যদের সাথে মেলামেশার অনুমতি প্রদানের ফলে ভারতীয় যৌনকর্মীদের শুধুমাত্র ব্রিটিশ সৈন্যদের সাথে মেলামেশার অনুমতি দেওয়া হত, যা তাদের পেশাগত স্বাধীনতাকে সীমিত করত। উনিশ শতকের শেষদিকে এবং বিশ শতকের শুরুতে, পূর্ব ইউরোপ ও জাপান থেকে নারীদের ট্র্যাফিকিং করে আনা হত এবং তারা ব্রিটিশ উপনিবেশিক ও সৈন্যদের যৌন চাহিদা পূরণ করত। ব্রিটিশ সরকার পতিতাবৃত্তিকে ‘প্রয়োজনীয় মন্দ’ হিসেবে দেখত এবং এর নিয়ন্ত্রণকে সৈন্যদের নৈতিক অবক্ষয় রোধের একটি উপায় হিসেবে মনে করত।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে যৌনকর্মের চরিত্র আমূল পরিবর্তিত হয়। নিয়ন্ত্রণমূলক আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্র সরাসরি যৌনকর্মীদের জীবন ও জীবিকার উপর হস্তক্ষেপ করে। এই সময়ের নীতিগুলি মূলত ঔপনিবেশিক স্বার্থ এবং সৈন্যদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার উপর জোর দিত, যার ফলে যৌনকর্মীরা আরও প্রান্তিক ও অরক্ষিত হয়ে পড়েন। ক্যান্টনমেন্ট অ্যাক্ট এবং Contagious Diseases Acts-এর মতো আইনগুলি নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্যমূলক ছিল, যেখানে কেবল নারীদেরকেই স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য বাধ্য করা হত এবং রোগের জন্য দায়ী করা হত।
ঔপনিবেশিক নীতি একটি দ্বৈত ব্যবস্থা তৈরি করেছিল যেখানে ব্রিটিশদের জন্য যৌনকর্ম সহ্য করা হত এবং নিয়ন্ত্রিত হত, কিন্তু একই সাথে বৃহত্তর ভারতীয় সমাজে এটিকে একটি সামাজিক ব্যাধি ও রোগের উৎস হিসেবে দেখা হত। এই নীতি স্বাধীন বাংলাদেশে ভবিষ্যতের আইনি ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে বাংলা প্রেসিডেন্সিতে ব্রিটিশ সৈন্যদের সংখ্যা এবং তাদের মধ্যে যৌনরোগে আক্রান্তের হার বিভিন্ন দশকে ভিন্ন ছিল। ১৮২০ থেকে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৬,০০০ ব্রিটিশ সৈন্য ছিল, তবে এই সময়ের যৌনরোগের তথ্য পাওয়া যায় না। ১৮৪৮ সালে ১৫,৫৫৮ জন সৈন্যের মধ্যে ৮৪৭ জন মারা যান, যদিও সুনির্দিষ্ট হার অনুপস্থিত। ১৮৬৬ সালে সৈন্যদের মধ্যে সংক্রমণের হার ছিল ২১৮ প্রতি ১০০০ জন। ১৮৯৫ সালে এই হার ৫০০-এর বেশি ছিল।
১.৪ স্বাধীনতা-পরবর্তী আইনি সংঘাত ও মানবাধিকার মামলা (১৯৭১–২০০০ খ্রিষ্টাব্দ)
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যৌনকর্মের আইনি ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিবর্তন দেখা যায়। বাংলাদেশে পেশাদার যৌনকর্ম আইন অনুযায়ী বৈধ, যদি ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সের নারী স্বেচ্ছায় আদালতে ঘোষণা দিয়ে এই পেশা বেছে নেন। তবে, বাংলাদেশের সংবিধানে পতিতাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। পেশাদার যৌনকর্ম আইন অনুযায়ী বৈধ হলেও, জনসাধারণের কাছে আবেদন, ব্রোথেল পরিচালনা এবং দালালী-এর মতো কার্যকলাপ অবৈধ হিসেবে গণ্য হয়।
সরকার কর্তৃক যৌনকর্মীদের ‘সামাজিকভাবে অক্ষম নারী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা সমাজে তাদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটায়। দেশে দৌলতদিয়ার মতো বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম নিবন্ধিত পতিতালয় রয়েছে। অতীতে টানবাজার ও নিমতলীর মতো পতিতালয় উচ্ছেদের চেষ্টা হলেও ২০০০ সালে হাইকোর্ট পেশাদার যৌনকর্মকে বৈধ বলে ঘোষণা করেন।
তবে, ২০০০ সালের হাইকোর্ট রায় বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই রায়ে যৌনকর্মীদের মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং তাদের প্রতি মানবিক আচরণের কথা বলা হয়। শুধু তাই নয়, এই রায়ে সরকার ও রাষ্ট্রকে যৌনকর্মীদের পুনর্বাসন এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে যৌনকর্মের আইনি অবস্থান একদিকে পতিতাবৃত্তিকে বৈধতা দেয়, অন্যদিকে এর সাথে জড়িত অন্যান্য কার্যকলাপের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ২০০০ সালের হাইকোর্ট রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও, বাস্তবে এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এখনও অনেক দূরে।
১.৫ আধুনিক যুগে শ্রমিক অধিকার ও সামাজিক স্বীকৃতির লড়াই (২০০০–বর্তমান)
আধুনিক যুগে বাংলাদেশে যৌনকর্মীরা কেবল আইনি বাধাই নয়, সামাজিক কলঙ্ক এবং শ্রমিক অধিকারের অভাবের মতো বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন। নারী অধিকার আন্দোলন এবং নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন যৌনকর্মীদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হয়েছে এবং তাঁদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। যদিও এই বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে এবং ধর্মীয় গোষ্ঠী এর বিরোধিতা করছে।
যৌনকর্মীরা আজও সমাজে কলঙ্ক ও বৈষম্যের শিকার হন এবং তাঁদের জানাজা ও সামাজিক স্বীকৃতি নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। গ্রামীণ ও শহুরে যৌনকর্মীদের মধ্যে বৈষম্য এবং বৃহত্তর লিঙ্গ বৈষম্যের প্রেক্ষাপটও বিদ্যমান। মানবাধিকার আদালতের রায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যৌনস্বাস্থ্য শিক্ষা এবং এইচআইভি ও অন্যান্য যৌনরোগের বিস্তার রোধে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। যৌনকর্মীরা প্রায়শই দারিদ্র্য, প্রতারণা, এবং অসহায়তার কারণে এই পেশায় আসতে বাধ্য হন।
কোভিড-১৯ এর মতো সংকটকালে তাঁদের ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। ২০১০-এর দশকে বাংলাদেশে বেশ কিছু ব্রোথেল উচ্ছেদ করা হয়, যার ফলে যৌনকর্মীরা বাস্তুহারা হন এবং তাদের জীবিকা হুমকির মুখে পড়ে। এর ফলস্বরূপ যৌনকর্মীদের মধ্যে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বর্তমানে যৌনকর্মীরা তাদের অধিকার এবং সামাজিক স্বীকৃতির জন্য জোরালো আন্দোলন করছেন। তারা যৌনকর্মকে শ্রম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছেন, যাতে তারা অন্যান্য শ্রমিকদের মতো আইনি সুরক্ষা ও অধিকার লাভ করতে পারেন। সম্প্রতি বাংলাদেশে এই প্রথার বাইরে যৌনকর্মীর জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘটনা দেখা যায়, যা কিছু ক্ষেত্রে মনোভাব পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পেশ করেছে। কমিশনের প্রধান, বিশিষ্ট নারী অধিকার কর্মী এবং নারীপক্ষ সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন পারভীন হকের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি কমিশন এই সুপারিশমালা প্রণয়নের কাজটি সম্পন্ন করে।
২০২৫ সালের ১৯ এপ্রিল, শনিবার কমিশন তাদের সুপারিশমালা সম্বলিত ৪৩৩টি বিস্তারিত প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করে। প্রতিবেদন পেশের সময় কমিশনের অন্যান্য সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন এবং তারা প্রধান উপদেষ্টার সামনে প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন।
এই প্রতিবেদনেই যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতির গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনাটি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে, এই প্রস্তাবনার বাস্তবায়ন এবং সমাজের সর্বস্তরে এর গ্রহণযোগ্যতা এখনও একটি কঠিন এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া হিসেবে বিদ্যমান।
২. বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণ
২.১ আইন ও নীতি
বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের জন্য যৌনকর্ম বৈধ, যদি তারা স্বেচ্ছায় আদালতে এই পেশায় আসার ঘোষণা দেয়। কিন্তু এই আইনি প্রক্রিয়াটি জটিল এবং অনেক যৌনকর্মী আইনি সুরক্ষা ও জ্ঞানের অভাবে এর সুযোগ নিতে পারেন না। তবে, ব্রোথেল পরিচালনা এবং জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা এখনও আইনত দণ্ডনীয়।
বিভিন্ন সময়ে (যেমন: ২০০২, ২০১৩, ২০১৪, ২০১৯) ব্রোথেল উচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে, যার ফলে যৌনকর্মীরা তাদের কর্মস্থল হারিয়েছেন এবং আরও প্রান্তিক জীবনে চলে গেছেন। বাংলাদেশে যৌনকর্মের আইনি কাঠামো পরস্পরবিরোধী। একদিকে পতিতাবৃত্তি বৈধ, অন্যদিকে এর স্বাভাবিক চর্চার জন্য প্রয়োজনীয় স্থান ও পদ্ধতির উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এর ফলে যৌনকর্মীরা আইনি সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হন এবং পুলিশের হয়রানির শিকার হন।
এই অস্পষ্টতা তাঁদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা হয়রানি ও শোষণের ঝুঁকিতে ফেলে। এই আইনি দুর্বলতা প্রায়শই দালাল এবং অসাধু ব্যক্তিদের সুযোগ করে দেয়, যারা যৌনকর্মীদের শোষণ করে থাকে।
২.২ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি
সমাজে যৌনকর্মীদের ‘পতিতা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং তাদের কলঙ্কের দৃষ্টিতে দেখা হয়। সমাজবিজ্ঞানীরা বাংলাদেশে যৌনকর্মকে সামাজিক কাঠামো, প্রথা ও মিথস্ক্রিয়ার প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করেন। দারিদ্র্য, কর্মসংস্থানের অভাব, লিঙ্গ বৈষম্য, নিরক্ষরতা এবং গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন নারীদের যৌনকর্মে আসতে বাধ্য করে। অনেক নারী ‘জীবনধারণের জন্য যৌনতা’কে একমাত্র উপায় হিসেবে দেখেন। এই নারীরা প্রায়শই সমাজের সবচেয়ে দুর্বল এবং প্রান্তিক অংশ থেকে আসেন, যাদের অন্য কোনো বিকল্প থাকে না।
যৌনকর্মীরা এবং তাঁদের সন্তানরা সমাজে তীব্র stigma ও marginalization-এর শিকার হন, যার ফলে তাঁরা মৌলিক অধিকার যেমন – বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হন। প্রাচীনকালে গণিকাদের শিল্পী এবং জ্ঞানী হিসেবে সম্মান করা হত। নবাবী আমলে বাইজিরা সঙ্গীত ও নৃত্যের শিল্পী হিসেবে সমাজে মর্যাদা পেতেন। কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে তাদের পরিচয় কলঙ্কিত করা হয়। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় সমাজ সংস্কারকরা বাইজি সংস্কৃতিকে পতিতাবৃত্তির সমতুল্য হিসেবে দেখতে শুরু করেন এবং এর প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করেন, যার ফলে বাইজি সংস্কৃতির পতন ঘটে।
আধুনিক যুগে যৌনকর্মীরা ‘শ্রমিক’ হিসেবে নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে চান, যাতে সমাজে তাদের মর্যাদা বাড়ে এবং তারা শ্রমিক অধিকার লাভ করতে পারেন। ঢাকা শহরে হোটেল ও আবাসিক এলাকায় কর্মরত যৌনকর্মীরা সমাজ ও আইনের চোখে নিজেদের আড়াল করতে ‘অদৃশ্য গতিশীলতা’র কৌশল অবলম্বন করেন। বাংলাদেশে যৌনকর্ম গভীরভাবে কাঠামোগত বৈষম্যের মধ্যে প্রোথিত, যেখানে দারিদ্র্য ও লিঙ্গ বৈষম্য নারীদের এই পেশায় আসতে বাধ্য করে। পতিতালয় এবং এর ভেতরের স্তরবিন্যাস যৌনকর্মীদের অভিজ্ঞতা ও দুর্বলতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
যৌনকর্মীদের পরিচয় সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগে শিল্পী হিসেবে সম্মানিত হলেও, ঔপনিবেশিক যুগে এবং পরবর্তীতে তারা মূলত ‘পতিতা’ হিসেবে কলঙ্কিত হয়েছেন। বর্তমানে তারা শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করছেন, যা তাদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের একটি প্রয়াস।
সমাজ সংস্কারকরা যৌনকর্মীদের প্রতি সমাজের কলঙ্ক, বৈষম্য ও প্রান্তিকতা দূর করার জন্য প্রচারণা চালান এবং তাঁদের মৌলিক অধিকার যেমন – স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও পুনর্বাসনের সুযোগ সৃষ্টির জন্য কাজ করেন। গণমাধ্যম ও জনসচেতনতামূলক প্রচারণার মাধ্যমে তাঁরা যৌনকর্মীদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের চেষ্টা চালান। তবে সমাজের বৃহত্তর অংশে এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন এখনও সুদূর পরাহত এবং যৌনকর্মীরা প্রায়শই ঘৃণা, অবজ্ঞা এবং অপমানের শিকার হন।
২.৩ স্বাস্থ্য সংকট
বাংলাদেশে যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি ও সিফিলিসের প্রাদুর্ভাব একটি উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্য সংকট। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, যৌনকর্মীরা তুলনামূলকভাবে বেশি অর্থ উপার্জন করলেও, তাঁদের আয়ের একটি বড় অংশ প্রায়শই দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা ও পুলিশের হাতে চলে যায়।
যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি সহ অন্যান্য যৌনরোগের হার বেশি কারণ তাঁরা বিভিন্ন ঝুঁকির সম্মুখীন হন এবং স্বাস্থ্যসেবা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ কম পান। কোভিড-১৯ মহামারীর সময় যৌনকর্মীরা বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিলেন, কারণ তাদের উপার্জন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার অভাব ছিল। স্বাস্থ্য সংকট বাংলাদেশের যৌনকর্মীদের জন্য একটি বড় সমস্যা। এইচআইভি, সিফিলিসের মতো যৌনরোগের বিস্তার তাদের জীবন ও স্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলে।
কোভিড-১৯ মহামারী তাদের অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়। সমাজ সংস্কারকরা যৌনকর্মীদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা (যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং এইচআইভি প্রতিরোধ সহ), তাঁদের সন্তানদের শিক্ষা এবং পুনর্বাসন ও বিকল্প জীবিকা তৈরির লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তবে, এই উদ্যোগগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল এবং অনেক যৌনকর্মী নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবার আওতার বাইরে থেকে যান। অনিরাপদ যৌন অভ্যাস এবং সচেতনতার অভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
২.৪ নারী অধিকার আন্দোলন
বাংলাদেশে নারী অধিকার আন্দোলনের সাথে যুক্ত বিভিন্ন গোষ্ঠী যৌনকর্মীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে। কিছু গোষ্ঠী যৌনকর্মকে নারীর উপর সহিংসতা হিসেবে দেখে এর বিলোপ চায়, আবার কিছু গোষ্ঠী যৌনকর্মকে নারীর স্বাধীন পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে। যৌনকর্মীদের নিজস্ব সংগঠনও রয়েছে যারা তাদের অধিকার এবং সুরক্ষার জন্য কাজ করে। নারী অধিকার আন্দোলনের মধ্যে যৌনকর্মের বিষয়ে বিভিন্ন মেরুকরণ দেখা যায়। এই ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি যৌনকর্মীদের অধিকার আদায়ের পথে জটিলতা সৃষ্টি করে। যৌনকর্মীদের নিজস্ব সংগঠন এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন, যার প্রধান হলেন শিরীন পারভীন হক, যৌনকর্মীদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হয়েছে এবং ২০২৫ সালের ১৯ এপ্রিল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাঁদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব পেশ করেছে। এই ১০ সদস্যের কমিশন যৌনকর্মীদের অধিকার ও মর্যাদা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশমালা তৈরি করেছে। কিন্তু নারী অধিকার আন্দোলনের অভ্যন্তরে এই বিভাজন যৌনকর্মীদের অধিকার আদায়ের পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
একদিকে বিলোপের আকাঙ্ক্ষা এবং অন্যদিকে স্বীকৃতির দাবি – এই দুইয়ের মাঝে যৌনকর্মীদের আইনি ও সামাজিক সুরক্ষা দুর্বল হয়ে পড়ে।
২.৫ মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব
মনোবিজ্ঞানীরা বাংলাদেশে যৌনকর্মে জড়িত ব্যক্তিদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর আলোকপাত করেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে যে যৌনকর্মীদের মধ্যে বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, মানসিক চাপ এবং হতাশার মতো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলির ব্যাপকতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। শৈশবের আঘাত, জোরপূর্বক যৌনতা, সহিংসতা ও নির্যাতনের অভিজ্ঞতা যৌনকর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলে।
সামাজিক কলঙ্ক ও বৈষম্য মানসিক স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জগুলিকে আরও বাড়িয়ে তোলে, যার ফলে যৌনকর্মীরা লজ্জা, একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতার অনুভূতিতে ভোগেন। কিছু যৌনকর্মী মানসিক কষ্টের উপশম হিসেবে মাদকদ্রব্য ব্যবহার করেন। যৌনকর্মে প্রবেশের বয়স এবং এই পেশায় থাকার সময়কাল মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ক্রমবর্ধমান প্রভাব ফেলে। অনেক যৌনকর্মী এই পেশা ছেড়ে যেতে চান, যা তাঁদের মধ্যে অন্তর্নিহিত মানসিক কষ্টের পরিচায়ক।
বাংলাদেশে যৌনকর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ব্যাপক গবেষণা এবং তাঁদের জন্য উপযুক্ত মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও সহায়তার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু সামাজিক কলঙ্ক এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক যৌনকর্মী এই প্রয়োজনীয় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হন এবং দীর্ঘস্থায়ী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার শিকার হন।
২.৬ দার্শনিক ও নৈতিক বিতর্ক
দার্শনিকরা যৌনকর্মের নৈতিক ও দার্শনিক দিকগুলি নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করেছেন। উদারপন্থী দৃষ্টিকোণ থেকে, যৌনকর্মকে প্রাপ্তবয়স্কদের সম্মতির ভিত্তিতে একটি বৈধ পেশা হিসেবে দেখা হয়, যেখানে ব্যক্তি তার নিজের শরীর ও শ্রমের উপর কর্তৃত্ব রাখে। এই দৃষ্টিকোণ প্রায়শই যৌনকর্মকে অপরাধমুক্ত করার এবং শ্রমিকদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার পক্ষে যুক্তি দেয়।
অন্যদিকে, নারীবাদী ও বিলোপবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে, পতিতাবৃত্তিকে নারীর প্রতি সহিংসতা, শোষণ এবং পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গণ্য করা হয় এবং এটিকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত দেওয়া হয়। এই মতানুসারে, দারিদ্র্য ও অন্যান্য চাপের মুখে দেওয়া সম্মতিকে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন ও নৈতিক সম্মতি বলা যায় না।
কান্টের নীতিশাস্ত্র অনুসারে, যৌনকর্ম মানুষকে কেবল একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে, যা মানব মর্যাদা ও যুক্তিবুদ্ধির লঙ্ঘন। যৌনকর্মের সাথে মানব মর্যাদা ও সম্মানের ধারণাটি গভীরভাবে জড়িত, যেখানে কেউ কেউ যুক্তি দেন যে যৌনতার বাণিজ্যিকীকরণ মানব মর্যাদার পরিপন্থী, আবার কেউ কেউ ব্যক্তিগত স্বায়ত্তশাসন ও পছন্দের মর্যাদার উপর জোর দেন। যৌন স্বায়ত্তশাসন, অর্থাৎ নিজের যৌন জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার, যৌনকর্মের বৈধতা নিয়ে দার্শনিক বিতর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
দারিদ্র্য ও সুযোগের অভাবের প্রেক্ষাপটে যৌনকর্মে সম্মতি এবং স্বায়ত্তশাসনের ধারণাটি বিশেষভাবে জটিল। এই নৈতিক বিতর্ক সমাজের নীতি নির্ধারণ এবং যৌনকর্মীদের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে একটি বড় প্রভাব ফেলে। নৈতিক দ্বিধা এবং সামাজিক মূল্যবোধের সংঘাতের কারণে যৌনকর্মীদের পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি এবং অধিকার প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে পড়ে।
২.৭ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ
বাংলাদেশে যৌনকর্মের বিষয়ে প্রধান ধর্মীয় নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন। ইসলামে বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক (যিনা) এবং পতিতাবৃত্তি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ এবং এটিকে অনৈতিক ও গুনাহের কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে, সম্প্রতি বাংলাদেশে এই প্রথার বাইরে যৌনকর্মীর জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘটনা দেখা যায়, যা কিছু ক্ষেত্রে মনোভাব পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। কিছু ধর্মীয় নেতা যৌনকর্মীদের শ্রমিক অধিকার দেওয়ার প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেছেন।
হিন্দু ধর্মে যৌনকর্মের বিষয়ে প্রাচীনকালে কিছু নমনীয়তা দেখা গেলেও (যেমন দেবদাসী প্রথা, দুর্গাপূজায় পতিতালয়ের মাটি ব্যবহার), বর্তমানে এটিকে সাধারণত খারাপ কর্মফল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। খ্রিস্ট ধর্ম পতিতাবৃত্তিকে পাপপূর্ণ কাজ হিসেবে দেখে তবে এর সাথে জড়িত ব্যক্তিদের প্রতি সহানুভূতি ও সাহায্যের কথা বলে। কিছু খ্রিস্টান সংগঠন যৌনকর্মীদের এই পেশা ছেড়ে আসতে সাহায্য করার জন্য কাজ করে।
বৌদ্ধ ধর্মে যৌনকর্মকে অকুশল কাজ হিসেবে গণ্য করা হলেও, এর সাথে জড়িত ব্যক্তিদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করা হয় না এবং তাঁদের নির্বাণ লাভের পথ খোলা থাকে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যৌনকর্মের বিরোধিতা বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী সামাজিক ও নৈতিক ভিত্তি তৈরি করে, যা এই বিষয়ে আইনি ও সামাজিক নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ধর্মীয় অনুশাসন এবং সামাজিক রীতিনীতির কারণে যৌনকর্মীদের প্রতি সমাজের একটি বড় অংশের মানুষ বিরূপ মনোভাব পোষণ করে, যা তাদের জীবনে আরও কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করে।
৩. তথ্য উৎস ও পদ্ধতি
এই প্রতিবেদনটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের তথ্য উৎস ব্যবহার করা হয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষাপট বোঝার জন্য কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, বাত্সায়নের কামসূত্র এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক সাহিত্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যযুগের নবাবী আমলের বাইজি সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার জন্য বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ পর্যালোচনা করা হয়েছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগের নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি এবং সৈন্যদের মধ্যে যৌনরোগের বিস্তার নিয়ে আলোচনার জন্য ঔপনিবেশিক নথি ও সরকারি প্রতিবেদন ব্যবহার করা হয়েছে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী আইনি সংঘাত ও মানবাধিকার মামলার প্রেক্ষাপট বিশদভাবে তুলে ধরতে আদালতের রায় ও আইনি দলিল বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আধুনিক যুগের শ্রমিক অধিকার ও সামাজিক স্বীকৃতির লড়াই এবং স্বাস্থ্য সংকট নিয়ে আলোচনার জন্য UNAIDS ও অন্যান্য এনজিওর প্রতিবেদন এবং বিভিন্ন গবেষণা পত্র ব্যবহার করা হবে।
প্রতিবেদনে বিভিন্ন সময়ের যৌনরোগের প্রাদুর্ভাবের পরিসংখ্যান উপস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও, যৌনকর্মীদের সাক্ষাৎকার বা তাদের লেখা আত্মকথা থেকেও তথ্য ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, দার্শনিক, সমাজ সংস্কারক এবং ধর্মীয় নেতাদের বিশ্লেষণ বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধ, জার্নাল এবং ঐতিহাসিক দলিল থেকে নেওয়া হয়েছে।
৪. সমালোচনামূলক প্রশ্নাবলি
৪.১ যৌনকর্মকে ‘শ্রম’ হিসেবে স্বীকৃতি: সামাজিক কলঙ্ক দূরীকরণে ভূমিকা ও সীমাবদ্ধতা
যৌনকর্মকে ‘শ্রম’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া একটি জটিল প্রশ্ন। এই স্বীকৃতি একদিকে যেমন যৌনকর্মীদের অধিকার এবং মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করতে পারে, তেমনি সমাজে বিদ্যমান নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে এর সংঘাত সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। যদি যৌনকর্মকে শ্রম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তবে যৌনকর্মীরা সম্ভবত অন্যান্য শ্রমিকদের মতো কিছু আইনি সুরক্ষা ও অধিকার লাভ করবেন। তবে, যৌনকর্মের সাথে জড়িত দীর্ঘদিনের সামাজিক কলঙ্ক রাতারাতি দূর হবে কিনা, তা বলা কঠিন।
সামাজিক কলঙ্ক বহুলাংশে নৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের উপর নির্ভরশীল, যা রাতারাতি পরিবর্তন করা কঠিন। আইনি স্বীকৃতি হয়তো বৈষম্য কমাতে সাহায্য করবে, কিন্তু সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া।
৪.২ ব্রোথেল উচ্ছেদ: নৈতিক ন্যায্যতা ও অর্থনৈতিক প্রভাব (সহিংসতা?)
ব্রোথেল উচ্ছেদ একটি অত্যন্ত বিতর্কিত পদক্ষেপ। নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, মানব পাচার ও শোষণ বন্ধের ক্ষেত্রে এটি হয়তো সমর্থনযোগ্য হতে পারে। তবে, অন্যদিকে এটি বহু যৌনকর্মীর জীবিকা কেড়ে নেয় এবং তাদের আরও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়। উচ্ছেদের ফলে যৌনকর্মীরা কোথায় যান এবং তাদের জীবনের উপর এর কেমন প্রভাব পড়ে, তা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ব্রোথেল উচ্ছেদের ফলে পতিতাবৃত্তি আসলে কমে না, বরং আরও গোপন ও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। ব্রোথেলগুলি অনেক যৌনকর্মীর জন্য তুলনামূলকভাবে নিরাপদ স্থান হতে পারে, যেখানে তারা দলবদ্ধভাবে থাকতে পারে এবং কিছু সুরক্ষা পেতে পারে। উচ্ছেদের ফলে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং দালাল ও পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ার ঝুঁকি বাড়ে।
৪.৩ আইনি সংস্কার বনাম বাস্তবতা: মানবাধিকার রায়ের বাস্তবায়নের পথে বাধা ও ব্যর্থতার কারণ ২০০০ সালের হাইকোর্ট রায় বাংলাদেশে যৌনকর্মীদের অধিকারের স্বীকৃতি দিলেও, বাস্তবে এর প্রয়োগ এখনও সীমিত। এই রায় বাস্তবায়নের পথে বেশ কিছু বাধা রয়েছে। সামাজিক কলঙ্ক যৌনকর্মীদের সমাজের মূল স্রোতে মিশতে বাধা দেয়। পুলিশের অসহযোগিতা এবং দুর্নীতি আইনি সুরক্ষা প্রদানকে কঠিন করে তোলে।
এছাড়া, বিকল্প জীবিকার অভাব অনেককে এই পেশায় থাকতে বাধ্য করে। আইনি সংস্কার একা যৌনকর্মীদের জীবনের মান উন্নত করতে যথেষ্ট নয়, এর সাথে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনও জরুরি। সামাজিক কলঙ্ক এবং বাস্তব প্রয়োগের অভাবের কারণে অনেক মানবাধিকার রায় বাস্তবে ফলপ্রসূ হয় না।
৫. বাংলাদেশের পতিতাবৃত্তি: সমাজের মুখে কালিমা ও ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি
বাংলাদেশে পতিতাবৃত্তি সমাজের এক গভীর ক্ষত, যেখানে সমাজের দ্বিচারিতা প্রকটভাবে বিদ্যমান। একদিকে তথাকথিত আইনি বৈধতা থাকলেও, পতিতালয়ে গমন কেবল ঘৃণ্যই নয়, বরং পতিতাদের প্রতি চরম অবমাননাকর এক পশুসুলভ আচরণ। এই সমাজে লালসার চাহিদা যেমন আকাশছোঁয়া, তেমনই নীতিবাক্যের ফুলঝুরিও কম নয়। নির্লজ্জভাবে পতিতাদের ব্যবহার করা হয়, যাদের সংখ্যা ২০১৬ সালে প্রায় দেড় লক্ষ ছিল (UNAIDS), এবং দৌলতদিয়ার মতো বৃহত্তম পতিতালয়ে ১৬০০ জন ঘৃণ্য জীবন যাপন করে। আনিসা বেগম যেমন বলেছিলেন, সমাজ তাদের মানবিক চাহিদা পূরণের জন্য ব্যবহার করে, কিন্তু তাদের দেখে যেন তারা মানুষ নয়, জন্তু জানোয়ার (DESIblitz, 2025)।
এই ভণ্ডামি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে, যেখানে পুরুষরা অল্পবয়সী মেয়েদের প্রতি কামুক দৃষ্টি দেয়, কিন্তু তাদের মৃত্যুর পর সাধারণ কবরের জায়গাও জোটে না (Wikipedia, 2025)। হামিদা বেগমের ব্যতিক্রমী জানাজা ২০২০ সালে সমাজের আসল চিত্র চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় (DW, 2020)।
পতিতালয়ে যাওয়ার পেছনে লম্পটদের অসুস্থ মানসিকতা যেমন দায়ী, তেমনই চরম দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব আর সমাজের নির্মম শোষণ মহিলাদের এই অন্ধকার পথে ঠেলে দেয়। উঠতি বয়সের ছেলেরা প্রায়শই ‘পুরুষত্ব’ প্রমাণ করতে অথবা সামাজিক চাপে পড়ে এই নোংরামিতে লিপ্ত হয় (Taylor & Francis, 2009), যেখানে অল্পবয়সী মেয়েদের শরীর ১০ থেকে ৪০ বছর বয়সের ভিত্তিতে বিভিন্ন দামে নিলামে ওঠে (DESIblitz, 2025)।
অন্যদিকে, অনেক পরিবার অভাবের তাড়নায় তাদের মেয়েদের এই নরকে বিক্রি করে দেয়, যেখানে গড় আয় মাত্র ১,৪৪০ ডলার এবং প্রায় ১৩ শতাংশ মানুষ দিনে দুই ডলারের কম রোজগার করে (SCIRP, 2017)। মেয়েরা ২-৩ বছর ধরে কেবল ঋণ শোধ করে। বাল্যবিবাহও একটি বড় কারণ, যেখানে প্রায় ১৮ শতাংশ মেয়ের বিয়ে ১৫ বছর হওয়ার আগেই হয়ে যায় (SCIRP, 2017)।
এছাড়াও, মানব পাচার এবং চাকরির মিথ্যে প্রলোভনের শিকার হয়েও বহু নারী এই অভিশপ্ত জীবনে প্রবেশ করে, এমনকি ২০২১ সালের তথ্য অনুসারে প্রায় ২০ হাজার শিশুও বাদ যায় না (US Department of State, 2021)। পুলিশ ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা ঘুষ নিয়ে এই ঘৃণ্য ব্যবসাকে বাঁচিয়ে রাখে, যা পতিতালয়ের আয়ের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি (SCIRP, 2017)।
পতিতাদের পুনর্বাসন এক কঠিন চ্যালেঞ্জ, কারণ সমাজের জঘন্য দ্বিচারিতার কারণে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব। উদ্ধার হওয়া শিশুরা প্রায়ই খাবার আর আশ্রয়ের অভাবে ফের সেই অন্ধকারেই ডুবে যায়।
যদিও গবেষণায় ভারতে বছরে ৮০ ডলারের মতো নাগরিক আয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে (SCIRP, 2017), বাংলাদেশে এই ধরনের নীতি বাস্তবায়নের সম্ভাবনা এখনও সুদূর। এই ঘৃণ্য সমস্যার সমাধানে দরকার কঠোর নীতিগত পদক্ষেপ, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং পতিতাদের জন্য সমন্বিত ও কার্যকরী পুনর্বাসন ব্যবস্থা।
৬. সুপারিশ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
৬.১ শ্রম অধিকার আইনের প্রস্তাবনা ও তার বাস্তবায়ন
যৌনকর্মকে শ্রম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে যৌনকর্মীদের জন্য একটি স্বতন্ত্র শ্রম অধিকার আইন প্রণয়ন করা যায় কিনা, তা বিবেচনা করা প্রয়োজন। এই আইনের মাধ্যমে তাদের কাজের পরিবেশ, বেতন, স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক নিরাপত্তা কিভাবে নিশ্চিত করা যায়, সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা ও পরিকল্পনা করা দরকার।
তবে, এই আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আসতে পারে, যার মধ্যে প্রধান হলো সমাজের নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রবল বিরোধিতা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব। এমনকি আইন প্রণীত হলেও, সামাজিক কলঙ্কের কারণে যৌনকর্মীরা তাদের অধিকার পুরোপুরি ভোগ করতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
৬.২ যৌনস্বাস্থ্য শিক্ষার সম্প্রসারণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি
যৌনকর্মীদের এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে যৌনস্বাস্থ্য শিক্ষা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। এইচআইভি/সিফিলিস এবং অন্যান্য যৌনরোগের সংক্রমণ রোধে ব্যাপক সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গণমাধ্যম ও অন্যান্য প্ল্যাটফর্মকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
তবে, কুসংস্কার এবং ভুল তথ্যের বিস্তার এই সচেতনতামূলক কার্যক্রমের কার্যকারিতাকে সীমিত করতে পারে।
৬.৩ সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরির কৌশল ও চ্যালেঞ্জ
যৌনকর্মীদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদী কৌশল অবলম্বন করতে হবে। এই ক্ষেত্রে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরির পথে বেশ কিছু বাধা আসতে পারে, যার মধ্যে ধর্মীয় রক্ষণশীলতা এবং সমাজের বিদ্যমান কুসংস্কার সবচেয়ে শক্তিশালী। রাতারাতি এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আশা করা কঠিন।
৬.৪ গ্রামীণ বনাম শহুরে যৌনকর্মীদের মধ্যে বৈষম্য হ্রাস করার উপায়
গ্রামীণ ও শহুরে যৌনকর্মীদের মধ্যে সুযোগ এবং সুরক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বৈষম্য দেখা যায়। গ্রামীণ এলাকার যৌনকর্মীরা স্বাস্থ্যসেবা এবং আইনি সুরক্ষার দিক থেকে আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। এই বৈষম্য কমানোর জন্য গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবার প্রসার এবং বিকল্প জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই পরিষেবাগুলির বিস্তার এবং নজরদারি করা একটি কঠিন কাজ।
৬.৫ যৌনকর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান
যৌনকর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য বিশেষায়িত এবং সংবেদনশীল মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা জরুরি। এই পরিষেবাগুলির নকশা এবং বাস্তবায়নে যৌনকর্মীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা উচিত। তবে, সামাজিক কলঙ্ক এবং গোপনীয়তার অভাবের কারণে অনেক যৌনকর্মী এই পরিষেবা গ্রহণে দ্বিধা বোধ করতে পারেন।
৬.৬ মানব পাচার ও জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি রোধে কঠোর পদক্ষেপ
মানব পাচার ও জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি একটি গুরুতর অপরাধ এবং এর বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এই অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষা ও পুনর্বাসনের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রাপ্তবয়স্কদের স্বেচ্ছায় যৌনকর্মে জড়িত হওয়া এবং মানব পাচার, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি ও শিশু যৌন শোষণের মতো অপরাধকে আলাদাভাবে দেখা উচিত এবং শেষোক্ত অপরাধগুলির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
কিন্তু এই অপরাধগুলি প্রায়শই সংঘবদ্ধভাবে এবং গোপনে সংগঠিত হয়, যা আইনের প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
৬.৭ গবেষণা ও তথ্যের প্রসার
বাংলাদেশে যৌনকর্মের বিভিন্ন দিক নিয়ে আরও বেশি গবেষণার প্রয়োজন। এই গবেষণালব্ধ তথ্য নীতি নির্ধারণ এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়ক হবে। তবে, এই বিষয়ে গবেষণা করা কঠিন হতে পারে কারণ যৌনকর্মীরা প্রায়শই সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে তথ্য প্রদান করতে দ্বিধা বোধ করেন।
উপসংহার
বাংলাদেশে যৌনকর্মের ইতিহাস জটিল এবং বহুস্তরময়। সময়ের সাথে সাথে এর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আইনি প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব এই পেশার উপর গভীর রেখাপাত করেছে। বর্তমানে যৌনকর্মীরা অধিকার ও স্বীকৃতির জন্য সংগ্রাম করছেন। তবে বাস্তবতা হলো, আইনি বৈধতা থাকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশের যৌনকর্মীরা আজও সমাজের প্রান্তিক এবং অরক্ষিত অংশ হিসেবে জীবনযাপন করেন।
ভবিষ্যৎ গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যৌনকর্মের স্থানীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে আরও গবেষণা করা প্রয়োজন। যৌনকর্মীদের জীবনের উপর ব্রোথেল উচ্ছেদ এবং অন্যান্য আইনি পদক্ষেপের প্রভাব নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করা দরকার। যৌনকর্মীদের অধিকার এবং সামাজিক স্বীকৃতি আদায়ের ক্ষেত্রে সফল মডেল ও কৌশল খুঁজে বের করার জন্য তুলনামূলক গবেষণা করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে যৌনকর্ম আইনিভাবে বৈধ হলেও, সমাজ সংস্কারকদের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও গভীর সামাজিক কলঙ্ক এবং জটিল আইনি কাঠামো একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। দারিদ্র্য, সামাজিক বৈষম্য, এবং নৈতিক ও ধর্মীয় বাধা যৌনকর্মীদের জন্য একটি কঠিন বাস্তবতার সৃষ্টি করে, যেখানে শোষণ, সহিংসতা এবং বঞ্চনা তাদের নিত্যসঙ্গী।
এই পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আনা একটি সুদূরপ্রসারী এবং বহুস্তর বিশিষ্ট পদক্ষেপের মাধ্যমেই সম্ভব, যেখানে আইনি সংস্কারের পাশাপাশি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও অপরিহার্য।
ছবি: vankayalapati Chiranjeevi
©somewhere in net ltd.