![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গল্পকার, ঔপন্যাসিক, স্ক্রিপ্ট রাইটার। শিক্ষানবিশ গবেষক ও চলচ্চিত্রকার।
সুনীল বাবুর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় নীলক্ষেতের ফুটপাথে এক পুরনো বইয়ের দোকানে।
তাঁর বয়স তখন পঞ্চাশ।
আমার সতের। সময়টা ২০০৭ সাল, আদমজী ক্যান্টনমেন্টে কলেজে পড়ছি। সেই বয়সে আমি খুব লাজুক ছিলাম।
"লাল জামা পরলে মেয়েদের খুব সেক্সি দেখায়।" এই বাক্যটি শোনার পর, লাল জামা পরা কোন মেয়েকে দেখলেই রাস্তা ছেড়ে ফুটপাথে নেমে যেতাম!
মাথা নুইয়ে অকারণ খুচরো পয়সা কুড়ানোর অভিনয় করতাম।
জীবনান্দকে ততদিনে ভালোবেসে ফেলেছি।
হুমায়ুন আহমেদ স্যারের সঙ্গে তখনো পরিচয় হয় নি।
"আজ হিমুর বিয়ে" নামে একটা মাত্র বই পড়েছি... তাও তেমন একটা দাগ কাটে নি মনে।
সেই হিসেবে সুনীল বাবুর "পঞ্চাশ বছর" ছিল রীতিমতো অগ্নি-দাগা!
সেই বইয়ের ভূমিকাতেই তিনি বলেছেন, প্রতিবেশী এক কিশোরী মেয়েকে নিয়ে কাব্যচর্চা করতে গিয়েই তাঁর সাহিত্য জীবনের সূচনা।
ভূমিকা শুনেই আনন্দে আটকানা হয়ে গিয়েছিলাম আমি! কেননা, আমি তখন সদ্য ঢাকায় আসা এক কলেজ পড়ুয়া তরুণ। গোপনে আমিও তখন একটা মেয়েকে ভালোবাসার চেষ্টা করছি এবং তাকে নিয়ে নিশিরাত্রে একান্তে কাব্য চর্চা করছি!
সেই সময়ে লেখা আমার একটা কাব্যের কিঞ্চিত নমুনা দেই:
"আক্ষেপে সুশীল চিত্ত
উঠিল গর্জিয়া,
পশ্চাতে ব্যর্থ হইয়া!
দুমুষ্ঠি বদ্ধ করি সমুখে আগাইয়া
কহিলাম:
শুনিয়াছি টুকিটাকি
are you মেঘ কন্যা অনিয়া?"
সোনিয়া নামের এক সহপাঠিনী ছিল আমার। তাকে নিয়ে লেখা এই কবিতা।
[ এই কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে এক যুগান্তকারী সংযোজন!
একই কবিতায় সাধু-চলিত, ইংরেজি এবং বাংরেজির এমন সুললিত সংমিশ্রণ বোধহয় এর আগে কেউ দেখাতে পারে নি!?..হাহ!]
সুনীলের সঙ্গে পরিচয়ের প্রাথমিক দিনগুলি ছিল খুবই বিভ্রান্তিকর। এই লোক খুব নিরীহ ভাব নিয়ে চলাফেরা করেন, অথচ সিঁড়িগোড়ায় দেখা হলেই প্রিয়তম মেয়েটার কপালে "চঠাস, চঠাস!" চুমো খায়!
আবার একটু পরেই আপন মনে প্রতিজ্ঞা করে,"এই হাত ছুঁয়েছে নীরার চিবুক, আমি আর এই হাতে করব না কোন পাপ!"
ছেলেবেলায় হারিয়ে যাওয়া এক নদীর কথা স্মরণ করে চোখের জল ফেলে আর কান্না মাখা গলায় বলে,"রাত্রির আড়িয়ালঁখার গর্জনে ছিঁড়ে যায় ঘুম..!"
আহা, সে কী কষ্ট এই মানুষটার বুকে। নদীকে যে নারীর মতো ভালোবাসা যায়, তার লেখা পড়েই প্রথম জেনেছি!
মধ্যরাতে শ্মশানে গিয়ে মদ খায়, মেয়ে মানুষের দেহ নিয়ে আদিরসের কাব্য করে বেড়ায়...
আবার এই একই মানুষ, অভুক্ত ভিখারী দেখে পকেট উজাড় করে টাকা বিলিয়ে দেয়। মাসের শেষকটা দিন পায়ে হেঁটে টিউশনে যায়। বলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালুন পরা চে গুয়েভারার কাঁধে হাত রেখে দরদী গলায় বলেন,"ভয় কী কমরেড, আমরা আছি তো!"
সুনীলের আগেই পাঠ্যপুস্তকের কল্যাণে নজরুল এসেছেন, শরৎচন্দ্র এসেছেন, আল মাহমুদ এসেছেন, শামসুর রাহমান এসেছেন... কিন্তু উনারা ছিলেন গুরুজন। রবীন্দ্রনাথের সভাসদ। সুনীল এসেছেন বন্ধু হয়ে।
প্রিয়তম বন্ধুর মতো তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে চোখ টিপে কতবার জানতে চেয়েছেন,"কি রে, করবি নাকি জীবন বদল?"
প্রথম প্রথম খুব ভয় হতো আমার। ওর সঙ্গে জীবন বদল করার মানেই হচ্ছে,
মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকা...
একটি গোলাপকে গালাপের মতো ফুটে থাকতে দেখে বেহুদা উচ্ছ্বাসে হই-হল্লা করা..
কোথাকার কোন আমসিডাঙা থেকে কলকাতার বেড়াতে আসা এক গোবর কুড়ানো মেয়েকে দেখে 'মার্গারিট ম্যাতিউ'র সুবাস ভুলে যাওয়া!
নাহ, সুনীল বাবুর সঙ্গে জীবন বদল করার দুঃসাহস আমার ছিল না।
তাই ক্রমে ক্রমে তিনি বন্ধু হতে ভ্রাতা হয়েছেন। ভ্রাতা হতে ত্রাতা হয়েছেন। ত্রাতা হতে গুরুজন হয়েছেন।
আর এখন তো তিনি এই আমার ভেতরেই এক ঋষি মানবের প্রজ্ঞা, সততা, শুদ্ধতা, গৌরব ও সৌরভ ছড়িয়ে অবিরাম প্রণোদণা দিয়ে যাচ্ছেন!
একজন সুনীল গাঙ্গ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে আমার এতবেশি আবেগ, স্মৃতি, শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতা জড়ায়ে আছে যে শুধু তাকে নিয়ে লিখতে গেলেই আধখানা জীবন লেখালেখি করে কাটিয়ে দেওয়া যাবে!
একজন সুনীল বাবু এক জীবনে এতবেশি লিখেছেন, এত কিছু আমাদের দিয়ে গিয়েছেন যে শুধু তাকে নিয়ে পরে থাকলেই একটা মানুষ ঘরে বসে পুরো পৃথিবীটা ঘুরে আসতে পারবে!
"আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি, তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ। এই কী মানুষ জন্ম, নাকি শেষ পুরোহিত কঙ্কালের পাশা খেলা?"
"আমারও আকাঙ্ক্ষা ছিল সূর্যের দোসর হব তিমির শিকারে, সপ্তাশ্ব রথের রশি টেনে নিয়ে দীপ্ত অঙ্গীকারে!"
"শুধু কবিতার জন্য তুমি নারী, শুধু কবিতার জন্য এত রক্তপাত!"
এই হল তাঁর কবিতার নমুনা!
"প্রথম আলো। সেই সময়। পূর্বপশ্চিম। ছবির দেশে, কবিতার দেশে। অর্ধেক জীবন। পঞ্চাশ বছর।" এইগুলা হল বাংলা গদ্য সাহিত্যের একেকটা মাস্টারপিস লেখা। তিনি না আসলে এই লেখাগুলি আর কারও পক্ষে লেখা সম্ভব ছিল না- এই ভাবনা ভেবে কষ্ট পাই।
তিনি বন্ধুর মতো পরম মমতাময় অন্তকরণ নিয়ে আমার কাঁধে হাত রেখেছিলেন, আর এখনো ঋষি মানবের মতো পথপ্রদর্শক হয়ে আমাকে পথে পথে প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছেন- এই সংবাদ জানিয়ে তৃপ্তি পাই।
#সুনীল_সমাচার
লেখক: মুহম্মদ নিজাম
©somewhere in net ltd.