![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গল্পকার, ঔপন্যাসিক, স্ক্রিপ্ট রাইটার। শিক্ষানবিশ গবেষক ও চলচ্চিত্রকার।
এইমাত্র খবর পেলাম, আমার ফুপাত ভাই বদরুল ক্রসফায়ারে মারা গেছে।
খবর শুনে খানিকটা ব্যথিত হয়েছি বটে, কিন্তু তারচেয়েও বেশি উদ্বিগ্ন হয়েছি এইটা ভেবে যে, বদরুলকে আমাদের দেখতে যাওয়া উচিত হবে কি না? কিংবা ওরা নিজ থেকে লাশ ফেরত দেওয়ার জন্য আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে কি?
দোতলায় মেজ কাকার ঘরে গোপন সভা বসেছে। আমাকে নিচে পাঠানো হয়েছে চা-চিনি এবং সিগারেট নেওয়ার জন্য। রাত্রি সাড়ে বারোটা। আমাদের পাড়ার সবকটা দোকানের সাটার নেমে গেছে। আমি যাচ্ছি বড়-বাজারের দিকে। এত তাড়াহুড়ার কিছু নেই। আজ সারা রাতই মিটিং চলবে। বাড়ির একটা ছেলে মারা গেছে—এই খবর কারো বিছানায় যাওয়া উচিত নয়। হয়তো সম্ভবও নয়। তাই বাকি রাতটুকু সবাই জেগে বসেই কাটাবে।
বদরুল মারা গেছে।
কানা বদরুল।
এইটা একটা ভালো খবর। আগামীকাল সব কটা পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হবে নিশ্চয়ই খবরটা। ভোরের আলোয় সদেয় কেনা পত্রিকার পাতা মেলতে মেলতে শান্তিপ্রিয় নগরবাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলবে,”ভালো রে! খুব ভালো।“
দুনিয়া থেকে যত বেশি মন্দ মানুষ কমবে ততই তাদের ভালো।
বদরুল যে আপাদমস্তক একটা মন্দ মানুষ এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি প্রায়ই যেটা ভাবি তা হচ্ছে,”কেন সে মন্দ মানুষ?”
বদরুল আমার ফুপাত ভাই। একদা সে-ই ছিল আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু এবং সবচেয়ে বিশ্বস্ত খেলার সাথি। ওর জীবন বিকৃ্তির গল্পটা বোধ হয় আমিই সবচেয়ে ভালো জানি।
সুনসান চারিধার।
মাঝেমধ্যে ঝনঝনিয়ে একটা-দুইটা রিকশা আসছে। চোখের পলক না পড়তেই তারা আবার আমাকে অতিক্রম করে দূরে সরে যাচ্ছে।
আমি হাঁটছি ধীরে।
খুব ধীরে।
রাস্তার দুইপাশে সার বাঁধা দেবদারু গাছের উপর লাইটপোস্টের হলুদ আলো পড়ে মাটিতে জ্যোৎস্নার মতো নরম ছায়া ফেলেছে। মনটা আমার ক্রমেই বিষণ্ন হয়ে উঠছে। বদরুলটা মারা গেল, এই শহরের সবচেয়ে কুখ্যাত টেরর কানা বদরুল। শহরতলীর দক্ষিণ দিকে চন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাঙা মন্দির চত্বরে ওর লাশ পড়ে আছে। কিংবা কে জানে, এতক্ষণে হয়ত সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ওখান থেকে।
বদরুলের বাবা এখনো জীবিত। তাকেও নিশ্চয়ই খবর দেওয়া হয়েছে। শুনেছি তিনি এখন টিকাটুলির সবচেয়ে বিত্তবান পেয়াজ-রসুনের আড়তদার। বড় ফুপির মৃত্যুর পর বছরখানেক বদরুল তার বাবার সঙ্গেই ছিল। এরপর তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সৎমায়ের সংসারে উৎপীড়িত হচ্ছে শুনে একদিন আমার বাবা এবং দাদিজান গিয়ে বদরুলকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসে।
ওর বয়স তখন সাড়ে পাঁচ।
আমার ছয়।
সেই ছেলেবেলা থেকেই আমি ছিলাম একটু দস্যি টাইপ। সেই তুলনায় বদরুল ছিল অনেক বেশি শান্ত সুবোধ এবং খানিকটা হেবলা। আমিই ওকে দীক্ষা দিয়েছিলাম, কীভাবে বাঁদরামি করতে হয় এবং কীভাবে অহেতুক ছুতা বের করে ছেলেমেয়েদের প্যাদাতে হয়। বেশি দিন লাগে নি, বছর ঘুরতেই মারামারিতে সে আমার সমান পারদর্শী হয়ে উঠল।
কিন্তু তাঁর কিছুদিন পরেই ঘটল সেই ঘটনাটা।
ঘটনা ভয়াবহ।
স্কুলের পুকুরে নেমে জলে ডুব দিয়েছি আমরা দুজন। এক ডুবে কে কতদূর যেতে পারে, এই নিয়ে প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগী আমি আর বদরুল। বিচারক ছিলেন বড় কাকার মেয়ে দোলা আপা। দোলা আপা পাড়ে দাঁড়িয়ে। আমি-বদরুল জলের অনেক নিচ দিয়ে মাটি ঘেঁষে ছুটছি। অনেক দূরে গিয়ে বদরুলকে হারাতে পেরেছি— এই রকম একটা উচ্ছ্বাস মনে নিয়ে ভেসে উঠতেই দেখি, বদরুল পাড়ের কাছেই ঝিম ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
ওর একটা চোখের নিচ থেকে টকটকে লাল রক্তের ধারা নেমে এসেছে। দোলা আপা পাড়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে,”এই কী হয়েছে? এই বদরুল, এই—!”
বদরুল শক্ত ছেলে।
সে ভয় পায় নি।
ব্যথা কিংবা অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের কারণেই হয়ত ডাঙায় উঠার পর সে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। জ্ঞান ফিরল হাসপাতালে নেওয়ার পর। আমি তখন ওর পাশেই বসা। সে এক চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল,”আমার এই চোখে কঈ হয়েছে দাদা? চোখ বাঁধা কেন?”
দাদিজান আমার দিকে তাকিয়ে না-সূচক একটা ইঙ্গিত করলেন। অর্থাৎ চুপ। বলিস না কিছু। কিন্তু সেদিন, সেই দুঃসময়ে আমি দাদিজানের চাহনির মানেটা ধরতে পারি নি। কেমন হাবার মতো বলে বসলাম,”তোর একটা চোখ গলে গেছে। তুই কানা হয়ে গেছিস!”
বদরুল প্রথমে বুঝতেই পারে নি, কী ভয়ংকর ক্ষতির মুখে সে পড়েছে। শুধু বদরুল কেন, আমিও বুঝতে পারি নি। কিন্তু সেই থেকে ওর জীবনে নতুন একটা অধ্যায়ের শুরু। কী তুচ্ছ ঘটনা, কী সামান্য কারণেই না বদরুলকে একটা চোখ হারাতে হল। আর তারই ফলশ্রুতিতে ওর ভবিষ্যৎ জীবনের ছকটা বড় বিচ্ছিরিভাবে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল!
আমরা সেবার ক্লাশ থ্রীতে উঠেছি। বদরুল কালো চশমাতে চোখ ঢেকে স্কুলে ফিরে এলো। আগের চেয়েও বেশি শান্ত সুবোধ এবং দুঃখী এবং কানা। সারাদিন ভাঙা মনে ক্লাশরুমে বসে থাকত। প্রায়ই আড়াল থেকে দেখতাম, নির্জন কোন স্থানে দাঁড়িয়ে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। দেখে যা কষ্ট হতো আমার ! মনে মনে সারাক্ষণ ভাবতাম কীভাবে ওকে দুঃখ ভুলিয়ে হাসিখুশি রাখা যায়। চোখ নষ্ট হবার পর প্রথম কয়েকটা দিন অবশ্যি ঘরে বাইরে সবার মধ্যেই এইটুকু সহানুভূতি ছিল। স্যারেরা বুঝিয়ে বলায় ক্লাশের অন্যান্য সহপাঠীরাও ওকে দয়ার চোখে দেখত। কিন্তু সে খুবই অল্প দিনের জন্য। কিছুদিন যেতেই দেখা গেল স্কুলের বন্ধুরা, পথে পথে ছেলেমেয়েরা, এমনকি ঘরেও কেউ কেউ ওকে ‘কানা’ ডাকতে শুরু করল।
কানা বদরুল।
সবচেয়ে বেশি বলত আমাদের বড়লোক প্রতিবেশীরা। বিশেষ করে সানু ডাক্তারের মেয়ে রিটা। বদরুলকে দেখলেই সে তিনতলার ঝুল বারান্দা থেকে চিৎকার করে বলতে শুরু করতো,”এই বদরুল। কানা বদরুল! এক চোখ কানা, দেখতে কি তোর মানা—!”
আমরা তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। এইটুকু একটা মেয়েকে ক্ষমা করা যায় তা বুঝি। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ লাগত যখন ওই শানু ডাক্তারের ষাণ্ডামার্কা বউটা এসে মেয়েকে বাড়ন না করে বরং ওর পাশে দাঁড়িয়ে দাঁত খেলিয়ে হাসত। আমার তখন কী যে রাগ লাগত বলে বুঝাতে পারব না! বদরুলকে কখনো রাগ করতে দেখি নি। কিন্তু প্রতিশোধটা সে-ই নিয়েছিল। খুব ঠান্ডা মাথায়। সাতাশ বছরের জীবনে সে কম হলেও এক ডজন মানুষকে খুন করেছে। আমার ধারণা, শানু ডাক্তারের মেয়ে রিটা-ই হচ্ছে ওর প্রথম শিকার।
ঘটনাটা বলি-
ডাক্তার কাকুর ছোট বোনের বিয়ে। বাড়িভর্তি মেহমান। ছাদের উপর তিরপল টানিয়ে উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। তখন সন্ধ্যা। আকাশে মেঘ আছে, অল্প অল্প বৃষ্টিও হচ্ছে। বড়রা মঞ্চ তৈরিতে ব্যস্ত, ছোট ছোট ছেলেমেয়েতে কিলবিল করছে চারপাশ। আমি মঞ্চের একপাশে বসে কয়েকটা কাগজের ফুল হাতিয়ে নেবার ফন্দি আটছিলাম। বদরুলকে একবার দেখলাম রিটার হাত ধরে ঘুরছে। আরেকবার দেখলাম সে একা পানির ট্যাংকির আড়াল থেকে বের হয়ে আসছে। এর মিনিট তিনেক পরেই নিচ থেকে একটা তুমুল হইচই আর কান্নার ধ্বনি ভেসে এল। সবার দেখাদেখি হুড়মুড়িয়ে নিচে নামলাম। নিচে এসে দেখি রিটা মরে গেছে।
ছাদ থেকে পিছলে পড়ে।
আহা!
বদরুলের প্রথম খুন। একমাত্র সাক্ষী বোধহয় আমি-ই। রাতে আমরা দুজন এক খাটে ঘুমাতাম। সারারাত উত্কর্ণ হয়েছিলাম যদি কিছু বলে। কিন্তু না, রিটার মৃত্যু প্রসঙ্গে নিজ থেকে সে টুঁ শব্দটি উচ্চারণ করে নি। আমিও ভয়ে বেশি কিছু বলার সাহস পাই নি। ভয় ছিল, যদি সত্যি সত্যিই সে বলে বসে,"আমিই ওকে ছাদ থেকে ঠেলে দিয়েছি।"
এই ঘটনাটা আমার কাছে আজও আবছা হয়ে রইল। দ্বিতীয় খুনটা অবশ্যি আমার চোখের সামনেই করল এবং এর পেছনে যেভাবেই হোক আমারও হয়তো একটু হাত ছিল। আমাদের বয়স তখন চৌদ্দ-পনেরোর ঘরে। শীতের ছুটি পড়েছে। স্কুল বন্ধ। আমি আর বদরুল রোজ রেলস্টেশনে যাই লুকিয়ে বিড়ি সিগারেট টানার জন্য। আরও অনেকে আসে। খুব আড্ডাবাজি, রঙবাজি হয়।
এক সন্ধ্যায় ঘটল অন্য ঘটনা। সারাদিন রোদ নেই, খুব কুয়াশা সেদিন। ঘোলাটে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে একেকটা ট্রেন স্টেশনে ঢুকছে। মুহূর্তেই আবার তীব্র হুইসেল বাজাতে বাজাতে বেরিয়ে যাচ্ছে। কল-কোলাহল থেকে একটু দূরে একটা পিলারে হেলান দিয়ে সিগারেট টানছি আমি। এই সময় কোথা থেকে এক টোকাই এসে হাত বাড়াল,
"গুরু আগুন দাও।"
আমি একশ' ষাট টাকা দিয়ে কেনা শখের লাইটার স্বগর্বে বাড়িয়ে দিলাম। টোকাই হারামজাদার বিড়ি না জ্বালিয়ে দেশলাই নিয়ে হাঁটা শুরু করল। আমি 'হেই' বলে, উঠে দাঁড়ালাম।
ছেলেটা দৌড় দিল। আমিও দৌড়ালাম। বদরুল যে আমাদের সামনেই বিপরীত দিক থেকে হেঁটে আসছে, আমি খেয়াল করি নি। হঠাৎ দেখলাম সে একটা পা আলগোছে বাড়িয়ে দিয়েছে ছুটন্ত ছেলেটার পায়ের নিচে। একটা নিখুঁত ল্যাঙ মারা হল। পরিণতিতে টোকাই ছেলেটা দুই ফুট উঁচু প্লাটফর্ম থেকে নিচে পড়তে পড়তে পর-পর আড়াইটা ডিগবাজি খেল। নাক মুখ থেকে ভুড়ভুড়িয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। কিন্তু এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর দায় ছিল না আমাদের। কাছে গিয়ে দেশলাইটা হাতে নিয়ে আমরা দু'ভাই অন্যদিকে খাড়া দৌড়াতে লাগলাম।
এরপর টানা এক বছর আমরা আর স্টেশনের দিকে যাই নি। তবে এইটুকু জানতে পেরেছিলাম যে, ছেলেটা মারা গেছে। খবর শুনে আনি বদরুলকে বললাম,
"এ তুই কী করলি বদরুল?"
বদরুল অনুশোচনা করে নি। লাজুক হেসে মাথা চুলকে বলেছে,"ও শালার ভাগ্য খারাপ!"
"তুই যদি ল্যাংটা না মারতি-।"
"আমি তো মেরে ফেলার জন্য লাগাই নি!"
"যদি এখন কিছু হয়?"
"কি হবে?"
কিছু যে হবে না তা আমিও জানতাম। তবু মনে মনে দারুণ ভয়ে ছিলাম আমি। এই ঘটনার পর থেকেই কীভাবে জানি একটু ভদ্র হয়ে গেলাম আমি।
অন্যদিকে বদরুল পড়াশোনা ছেড়ে পাড়ার গুণ্ডাপাণ্ডাদের সাথে চলতে শুরু করল। আঠারো বছর পূর্ণ হবার আগেই সে সৌভাগ্য গুণে একটা পিস্তলও জোগাড় করে ফেলল। সতের থেকে সাতাশ- মাত্র দশ বছরে সে এই কোটি মানুষে ঠাসা শহরের একটা বিরাট অঞ্চলে গ্যাং লিডার হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে উঠল। আর দশ-বারো বছর আয়ু পেলে হয়তো আরো অনেকটা এগিয়ে যেত সে। সন্ত্রাসী তখমা মুছে ফেলে দেশপ্রেমী রাজনৈতিক আতেলা হয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু না, বদরুল মারা গেছে...।
চা-চিনি এবং সিগারেট কেনা হয়ে গেছে।
আমি বাসায় ফিরছি।
রাত্রি পৌনে একটা।
খুব সুনসান চারিদিক।
শহরতলীতে বসবাসের মজাটাই এখানে। একই সঙ্গে গ্রাম এবং শহর দুরকমের আমজে পাওয়া যায়। বড় বাজার থেকে দ্রুত বাড়ি ফেরার জন্য আমি একটা পায়েহাঁটা পথ ধরলাম। এদিকটায় অন্ধকার একটু বেশি। পথ চলতে হয় পা টিপে টিপে। আমি মাথা নিচু করে ধীর পায়ে হেঁটে চলেছি। খুব ধীরে। বদরুলটা মারা গেছে। কানা বদরুল। ওর কথা আমি সব সময়ই ভাবতাম।
এখনো ভাবছি।
বদরুল আমার চেয়েও শান্ত-সৌম্য ছিল। তবু সে নষ্ট হয়ে গেল। কেন এভাবে নষ্ট হয়ে গেল সে?
বদরুলকে আমি প্রায়ই জিজ্ঞেস করতাম,"এইসব তুই কেন করিস?"
"কী সব?"
"চাঁদাবাজি। খুন-খারাপি!"
"জানি না!"
"এসব ছেড়ে দে। ভালো হয়ে যা।"
"আমি তো ভালোই ছিলাম। কিন্তু সবার জীবনে ভালো থাকা হয়ে উঠে না দাদা।"
হ্যা, সে মিথ্যে বল নি। যদি জন্মের পরপরই বদরুলের মা মারা না যেত, যদি বাল্যকালেই সে অন্ধ না হয়ে যেত, যদি ভদ্রলোকের বাচ্চারা ওকে কানা বলে তাচ্ছিল্য না করত, বদরুল হয়ত আমার মতোই একটা সুস্থ সুন্দর জীবন পেত। কিন্তু নিয়তি বৈরী। নষ্ট হবার প্ররোচনাকে আমি উপেক্ষা করতে পেরেছি কারণ আমার চোখের সামনে সুন্দরতম জীবনের আওহান ছিল। বদরুল পারে নি। সে একদিন কথায় কথায় আমাকে বলেছিল,"কোন গবেষনা বা চাকরিতে গেলে তোমাদের যেমন সার্টিফিকেট দেখাতে হয়, আমাদের লাইনেও একই ব্যবস্থা!"
"কেমন ব্যবস্থা?"
"এই যেমন ধরো আমার এক চোখ কানা, দেখতে বদখদ, কোন পিছুটান নেই, মায়াদয়া নেই, যৌবনে পা দেবার আগেই দুই দুইটা খুনের অভিজ্ঞতা- এইসব যোগ্যতা আছে বলেই তো ওরা আমাকে পজিশন ছেড়ে দিল।"
"ওরা কারা?"
"আন্ডারওয়ার্ল্ড এর গড। দিনমানে অবশ্যি তোমাদের চোখের সামনেই ভদ্রলোকের মতো ঘুরে বেড়া। কিন্তু ভেতরে ভেতরে একেকটা দেউ-দানব!"
"ওরা থাকে কোথায়?"
আমি খুব আগ্রহ নিয়েই প্রশ্ন করেছিলাম। কিন্তু বদরুল আমার অজ্ঞতায় প্রশ্রয়ের হাসি হেসেছিল। নরম গলায় বলেছিল,"বাদ দাও দাদা। এইসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি শিক্ষক মানুষ। এসব কাদা ঘেটে মন খারাপ করো না।"
বদরুল সন্ত্রাসীর খাতায় নাম উঠিয়েছিল। কিন্তু ওর অন্তর থেকে মায়া মমতা মুছে ফেলতে পারে নি। আমাদের পরিবার থেকে বিতাড়িত হলেও আমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছে। যখনই দেখা হয়েছে, মাথা গুণে পরিবারের সবার কুশল জানতে চেয়েছে।
নিজের ভাবনাতে খুব বেশি মগ্ন হয়ে ডুবে ছিলাম বলেই হয়তো লোকটাকে দেখে আমার মনে কোন সন্দেহ জাগে নি। সে আমাদের বাহির বাড়ির গেইটে লাগানো মাধবীলতার ঝোপের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিল। গেইটের কাছে যেতেই এগিয়ে এসে ডাক দিল,
"এই যে শুনুন!"
"জি।"
"আপনার নাম নিজাম?"
"জি।"
"আপনাকে একটু আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে।"
"কেন?"
মধ্যবয়সী লোকটা তৎক্ষণাৎ আমার কথার জবাব দিল না। কাছে তলপেটের কাছে একটা রিভলবারের নল ঠেকিয়ে দুর্বোধ্য একটা ইঙ্গিত করে হালকা গলায় বলল,"চলেন, গেলেই বুঝতে পারবেন!"
পরিশিষ্ট:
তিন বছর পরের কথা। জেল থেকে বলছি। কি বলব ভেবে পাচ্ছি না।
যে সমাজ বদরুলদের মৃত্যুর খবরে উচ্ছ্বসিত হয়, বদরুলদের জীবনের বিপর্যয়ের গল্প গুলি পাঠ করে কখনো গ্লানিবোধ করে না, আমি তাহাদেরই লোক।
আমার ফাঁসি চাই!
গল্পঃ মন্দ মানুষ
প্রকাশঃ পাক্ষিক অন্যদিন, অক্টোবর ২০১৩
© মুহম্মদ নিজাম।
©somewhere in net ltd.