![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আবারও ঘটলো লঞ্চ দুর্ঘটনা। লঞ্চ দুর্ঘটনা কেন হয়, দুর্ঘটনা এড়িয়ে কিভাবেই বা বাঁচানো যায় মানুষের জীবন- মূলত এ দুটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছি এই লেখাটিতে। ছাপা হয়েছে আজকের বণিক বার্তায়।
নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত হলো না
স্বজনহারার আর্তি, চরাচরজুড়ে মানুষের আহাজারি আর সংবাদমাধ্যমে বড় হেডলাইন ও স্ক্রল। বছর বছর হূদয়বিদারী দুর্ঘটনা ঘটে আর সারা দেশ মুখর হয় নদীমাতৃক এ দেশের নৌপথের নিরাপত্তা নিয়ে। তারপর বৈশাখ গত হয়, বর্ষা পার হয়, শেষ হয় কালবৈশাখী আর মৌসুমি ঝড়ের দিন। আমরা বেমালুম ভুলে যাই বিষয়টি।
৪ মে নৌনিরাপত্তা সপ্তাহ উদ্বোধনের দিনই এল আরেকটি নৌ দুর্ঘটনার খবর। ৩ মে পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার কলাগাছিয়া নদীতে ঘটে এ দুর্ঘটনা। কালবৈশাখীর কবলে পড়ে এমভি শাথিল-১ নামের লঞ্চ ডুবে অন্তত ১২ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। দুই বছর আগে ২০১২ সালেও এমন একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছিল নৌ নিরাপত্তা সপ্তাহ চলাকালীন।
দেশের পরিবহন খাতে সব সময়ই নৌপথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী দেশের মোট যাত্রী সংখ্যার ৩৫ শতাংশ নৌপথে চলাচল করে। মোট পণ্যের ৭০ ও তেলজাত দ্রব্যের ৯০ শতাংশ নৌপথে পরিবহন করা হয়। অন্য একটি হিসাব থেকে জানা যায়, প্রতি বছর প্রায় ৯ কোটি মানুষ দেশের নৌপথে যাতায়াত করে। নানা যৌক্তিক কারণেই নৌপথ জনপ্রিয়, সহজলভ্য এবং আরামদায়ক ভ্রমণমাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত। অথচ এ নৌপথ কারণ হচ্ছে নিয়মিত প্রাণহানিরও। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর মে, জুন ও অক্টোবরে নৌ দুর্ঘটনার হার সবচেয়ে বেশি।
দেশে এখন পর্যন্ত কতটি নৌদুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে, এতে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সে বিষয়ে বিভিন্ন উত্স থেকে একাধিক রকমের তথ্য পাওয়া যায়। এক হিসাবে জানা যায়, ২০০১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১১-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত ১১ বছরে ৪৪০টি যাত্রীবাহী লঞ্চ দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে। এতে মারা গেছে প্রায় ২ হাজার ৭০০ জন, আর নিখোঁজ হয়েছে প্রায় ৭০০ জন। অন্যদিকে বাংলাদেশ সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের একটি পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৭৭ থেকে ২০১০-এর জুন পর্যন্ত ৩৯৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছে ৪ হাজার ৪৭ জন এবং নিখোঁজ ৩৪১ জন। হাওর এলাকায় ২০০৮ সাল থেকে ২০১২-এর ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে ৯টি। ২০১২ সালের মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া ও কিশোরগঞ্জের মিঠামইনের লঞ্চডুবির ঘটনা ছাড়াও ২০১১ সালের ১১ মে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে নৌকাডুবি, একই বছর একই উপজেলায় বিপাশা নামের লঞ্চডুবি, ২০১০ সালের ৮ জুন সুনামগঞ্জে যাত্রীবাহী ট্রলারডুবি, একই বছর ১২ মে কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাঝামাঝি একটি স্থানে ট্রলারডুবি, ২০০৯ সালের ৪ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে ট্রলারডুবি, ২০০৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নৌকাডুবি এবং ২০০৮ সালের ১২ মে কিশোরগঞ্জে ট্রলারডুবি উল্লেখযোগ্য। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৪০০ লোক।
নৌ দুর্ঘটনার সুনির্দিষ্ট অনেক কারণ রয়েছে। বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, একই ধরনের কিছু কারণে বারবার নৌ দুর্ঘটনা ঘটছে। মালিকপক্ষের অনিয়ম, অবহেলা, অতি মুনাফালোভী মনমানসিকতা যেমন দুর্ঘটনাকে ত্বরান্বিত করে, তেমনি সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সীমাবদ্ধতা, অদক্ষতা ও নিষ্ক্রিয়তাও এক্ষেত্রে কম দায়ী নয়। আবার সাধারণ যাত্রীদের অসচেতনতা, জীবনের চেয়েও সময়ের মূল্যকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়ার প্রবণতা দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়ার ঝুঁকিকে উসকে দেয়। সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের এক হিসাবে দেখা যায়, ৫৪ দশমিক ২ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণ মুখোমুখি সংঘর্ষ, অতিরিক্ত বোঝাইয়ের কারণে ঘটছে ২৪ দশমিক ৯, ঝড়ের কবলে পড়ে হচ্ছে ১০ দশমিক ৪ শতাংশ। এর সঙ্গে রয়েছে আরো কিছু কারণ।
কেন এ নৌ দুর্ঘটনাগুলো ঘটে, তার কয়েকটি কারণ খুঁজে পাওয়া যায় সাম্প্রতিক একটি লঞ্চ দুর্ঘটনার কিছু বিষয় বিশ্লেষণ করলে। ৩ মে পটুয়াখালীতে এমভি শাথিল-১ নামের যে লঞ্চটি ডুবে যায়, তাতে কারিগরি ও কাঠামোগত ত্রুটি ছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানা যায়। এর আগেও একই লঞ্চ একবার দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল। জানা যায়, যে নকশায় লঞ্চটি তৈরি করা হয়েছিল, সে রকম নকশার লঞ্চ ২০০৬ সালের পর থেকে চলাচলের উপযুক্ত মনে করা হচ্ছে না।
নৌ দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রথম এবং প্রধান কারণই হলো অনিয়ম তথা নিয়মের প্রতি মারাত্মকভাবে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন। হাওর অঞ্চলের নদী ও অন্যান্য জলপথে প্রতিদিন শতাধিক মোটর লঞ্চ, দুই শতাধিক কার্গো ও তিন সহস্রাধিক শ্যালো ইঞ্চিনচালিত নৌকা যাত্রী ও মালপত্র পরিবহন করে। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী এসব মোটর লঞ্চ, কার্গো ও ইঞ্জিনচালিত নৌকার দিকনির্দেশক যন্ত্র, মানসম্মত অবকাঠামো, ধারণক্ষমতা ও সময়ানুপাত জ্ঞান, ছাদে টিন ব্যবহার, লাইফবয়া, ব্রেক, প্রশিক্ষিত সারেং ইত্যাদি থাকার কথা থাকলেও এসব নৌযানের মালিক তা মানছেন না। ফলাফল দুর্ঘটনা, প্রাণ ও সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি।
নিরাপদ নৌপথ বাস্তবায়ন জোট ২০০৬ সালের এক গবেষণায় দেখতে পায়, ১৯৭৬ সাল থেকে ২০০৫ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য যত নৌ দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় ৭০ ভাগই ঘটেছে ত্রুটিপূর্ণ নকশার কারণে। লঞ্চের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, ড্রাফট (ড্রাফট হলো নৌযানের পাটাতন হতে নিচের দিকের গভীরতা, যা নৌযানের ভারসাম্য বজায় রাখে) ও উচ্চতা চারটি বিষয় একে অন্যের সঙ্গে আনুপাতিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে সম্পৃক্ত। যখন কোনো লঞ্চের যাত্রী ধারণক্ষমতা বাড়ানোর জন্য খেয়ালখুশিমতো দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা বাড়ানো হয়, তখনই লঞ্চটি ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যায়। কারণ তখন দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা বাড়ানো হলেও ড্রাফট বাড়ানো সম্ভব হয় না। দেশের নদীপথগুলোর নাব্যতা কমে যাওয়ায় অনেক সময় আবার ইচ্ছে করে ড্রাফট বা লঞ্চের গভীরতা কমিয়ে রাখা হয়। যখন কোনো নৌযানের ড্রাফট তার উচ্চতার তুলনায় আনুপাতিক হারে কমে যায়, তখন সামান্য ঝড়ো বাতাসে এটি কাত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া লঞ্চের ভেতরে যে হুড বা খোল থাকে, তার অপব্যবহারের ফলেও চলন্ত পথে লঞ্চগুলো ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। লঞ্চের খোলের ভেতরটি থাকে ফাঁপা, এখানে মালপত্র রেখে ঢাকনা ভালো করে বন্ধ করে দিলে ভেতরে বাতাস আটকে থাকে এবং এটি লঞ্চটিকে পানির ওপর ভেসে থাকতে সহায়তা করে। কিন্তু দেখা যায়, অতিরিক্ত মালবোঝাই করার জন্য প্রায়ই এ খোলের ঢাকনা খুলে রাখা হয় এবং লঞ্চের পাটাতনে বা ডেকের ওপরও অবাধে মালপত্র রাখা হয়। এমভি শাথিলের হুডটিও খোলা ছিল বলে জানা যায়। এসব কারণে নষ্ট হয় লঞ্চের ভারসাম্য। ভারসাম্যহীন নৌযান যে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াবে, সেটাই স্বাভাবিক।
দেশের নৌপথের নিরাপত্তা বিধানে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকবলের তীব্র সংকট রয়েছে। পর্যাপ্ত ও যথাযথ তদারকির অভাব আর কিছু ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের অস্বাভাবিক ও অনৈতিক দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণেও নৌপথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। চলাচলকারী জাহাজ বা লঞ্চের সংখ্যানুযায়ী প্রয়োজনীয় লোকবল সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর ও বিআইডব্লিউটিএর নেই। সাম্প্রতিক এক হিসাবে দেখা যায় যে, প্রায় ১২ হাজার নিবন্ধিত নৌযানের তদারকির জন্য সার্ভেয়ার মাত্র পাঁচজন। সার্ভে ছাড়াও নৌযান নিবন্ধন, দুর্ঘটনা তদন্ত, নকশা অনুযায়ী জাহাজ পরীক্ষা, মাস্টার ও চালকের যোগ্যতা যাচাই, নৌযান সরঞ্জামাদি পরীক্ষা ইত্যাদি সার্ভেয়ারকেই করতে হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বেশির ভাগ সময় না দেখেই, যথাযথ নিয়মে পরীক্ষা না করেই একজন সার্ভেয়ারকে রিপোর্ট প্রদান করতে হয়।
দেশের নদীপথ ও নৌযানগুলো তদারকির জন্য তথা নৌপথ ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তিনটি পৃথক সংস্থা রয়েছে। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিদ্যমান তিনটি সংস্থা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) ও সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর নৌ চলাচল ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত। প্রতিটি সংস্থা মোটামুটি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে বারবার একই ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা কমে যেত। তিনটি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয়। যদিও সংস্থা তিনটির দায়িত্ব সুনির্দিষ্টভাবে আলাদা করে দেয়া আছে, তবু জাহাজের নকশা প্রণয়ন ও নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা লক্ষ করা যায়। যেহেতু নৌযানের ফিটনেস সার্টিফিকেট ও নৌ নিরাপত্তার প্রচলিত নিয়মনীতি অনুযায়ী নৌযান চলাচল নিশ্চিত করার দায়িত্ব সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের, সেহেতু নৌযানের নকশা অনুমোদন করার দায়িত্বও সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের ওপর ন্যস্ত থাকাই যুক্তিসঙ্গত, কিন্তু নকশা অনুমোদনের ক্ষমতা অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের।
লঞ্চ দুর্ঘটনার আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে চালকের গাফিলতি, অদক্ষতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। অধিকাংশ লঞ্চে কোনো দক্ষ চালক নেই। ঢাকা-চাঁদপুর-বরিশাল নৌ রুটে চলাচলকারী প্রায় ১০০টি লঞ্চের বিপরীতে কতজন সার্টিফিকেটধারী দক্ষ চালক আছেন, সে তথ্য অনেক অনুসন্ধান করেও জানা যায়নি। লঞ্চ মাস্টারদের অদক্ষতার কারণেও অনেক ক্ষেত্রে লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। পাশাপাশি তারা কর্তব্যেও অবহেলা করেন এবং নৌ ট্রাফিক ব্যবস্থা মানেন না। যেসব মাস্টার বিভিন্ন ধরনের নৌযান পরিচালনা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তাদের আবহাওয়া সম্পর্কে ভালো জ্ঞান নেই, কখন কোন পথে গেলে ভালো হবে তা তারা জানেন না, নৌযান চলাচলের সংকেত সম্পর্কে তাদের স্পষ্ট ও সঠিক ধারণা নেই এবং নদী ও মোহনার বিভিন্ন পয়েন্টে স্রোত ও ঘূর্ণির তীব্রতা, গতি-প্রকৃতি সম্পর্কেও তাদের পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব রয়েছে। তাছাড়া দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া কীভাবে মোকাবেলা ও কী ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়, তা তাদের অনেকের জানা নেই; যারা জানেন, তারাও আবার নানা কারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেন না। এছাড়া নৌ নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয়ে মাস্টার ড্রাইভারদের জন্য বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের বিষয়টি কেউ মানছেন না। এক্ষেত্রে মাস্টারদের যারা পরীক্ষা নেন, পরীক্ষক বোর্ডের ওপরও এ দায়িত্ব বর্তায়। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় এসব অত্যাবশ্যকীয় জ্ঞান যাচাই করা হয় না বলেই লঞ্চ দুর্ঘটনা কমছে না।
দেশের আবহাওয়া পূর্বাভাস ব্যবস্থা এখনো আধুনিক ও যথার্থ নয়। আবহাওয়া পূর্বাভাস নিয়ে দেশে অনেক রসিকতাও প্রচলিত। সঠিক পূর্বাভাসের অভাবেও অনেক সময় লঞ্চগুলো দুর্ঘটনায় পতিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে আবহাওয়া অধিদফতর দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াকালীন ঝড়ের পূর্বাভাস সঠিকভাবে দিতে পারছে না। তারা নিম্নচাপের পূর্বাভাস দিতে পারলেও কালবৈশাখীর ঝড়ো হাওয়া সম্পর্কে সুস্পষ্ট কিছু বলতে পারছেন না। আবার সমুদ্রবন্দর ও নৌবন্দরের জন্য যেসব সতর্ক সংকেত ব্যবহার করা হয়, সেগুলোও বেশ পুরনো, জটিল এবং অনেকের কাছে বোধগম্য নয়। বর্তমান আবহাওয়ার সঙ্গে ব্রিটিশ আমলের এসব সতর্ক সংকেত যুগোপযোগী নয়। দেশের বর্তমান ভৌগোলিক অবস্থার নিরিখে নৌবন্দরের আবহাওয়ার সতর্ক সংকেতগুলো যুগোপযোগী করা প্রয়োজন এবং নৌচালকদের এসব বিষয় বুঝতে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন।
নৌ দুর্ঘটনার জন্য নদীর নাব্যতা হ্রাসও পরোক্ষভাবে দায়ী। আমাদের নৌপথে ও নৌবন্দরগুলোয় নাব্যতা কমে গেছে। দেশের নৌরুটগুলোয় নিয়মিত ড্রেজিং করা হচ্ছে না, ফলে শীত মৌসুমে লঞ্চ চলাচল বিঘ্নিত হয়। অনেক সময় দেখা যায়, বাঁশের লাঠির সাহায্যে গভীরতা মেপে মেপে লঞ্চ চালানো হয়। নাব্যতা সংকটের কারণে বড় বড় লঞ্চের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে নিচের দিকে বড় করা যাচ্ছে না (ড্রাফট বাড়ানো যাচ্ছে না)। নিচের দিকে বড় করলে সদরঘাটসহ অধিকাংশ ঘাটেই তা নিচের মাটিতে লেগে যাবে। ফলে অল্প পানিতে চলাচলের সুবিধার্থে লঞ্চের তলদেশ গোলাকার এবং বড় না করে সমতল করা হয় এবং এটি পরবর্তী সময়ে দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
নৌ দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ হলো ডুবোচর। নদীতে ডুবোচর লঞ্চ, স্টিমার ও অন্যান্য নৌযান চলাচলে মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করে। প্রতি বছর মধুমতি নদীর মানিকদা থেকে চর গোবরা, চাপইল ও শুক্তাইল থেকে বড়দিয়া ও ভাটিয়াপাড়া পর্যন্ত বড় বড় ডুবোচর জেগে ওঠে। ফলে যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী অনেক ট্রলার ও লঞ্চ তিন-চারদিন পর্যন্ত আটকা পড়ে থাকে। এতে অনেক নৌযানের তলদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এসব সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ আর সদিচ্ছা জরুরি। রাজনীতির সঙ্গে ব্যবসা আর মুনাফার যে শক্তিশালী আঁতাত তৈরি হয়েছে, তাকেই সদিচ্ছার অন্তরায় মনে করছেন অনেকে। দেশের রেল বা নৌপথ সংস্কার হলে সড়কপথের গুরুত্ব কমে যেতে পারে। বাস আমদানি কমে যাবে। আর এসব কারণে কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থেরও হানি হতে পারে। সুতরাং একটি নিরাপদ নৌপথ বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারের প্রয়োজন কার্যকর, সত্ ও সাহসী রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এবার এ সদিচ্ছা যদি সত্যিকার অর্থেই তৈরি হয়, তখন কী করতে হবে?
সংশ্লিষ্ট মহল মনে করে, নৌ দুর্ঘটনা রোধ করতে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি যেমন— কোনো লঞ্চকে বিপজ্জনক মনে হলে সেই লঞ্চ আটক করার ক্ষমতা সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর ও বিআইডব্লিউটিএকে দেয়া, নৌযানের নকশা অনুমোদন ও এর নির্মাণকাজ পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর অথবা বিআইডব্লিউটিএকে এককভাবে দেয়া, সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর ও বিআইডব্লিউটিএতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক সার্ভেয়ার ও পরিদর্শক নিয়োগ দেয়া। ইনল্যান্ড সার্ভেয়ার হিসেবে মাস্টার মেরিনার, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ও নেভাল আর্কিটেক্ট— এ তিন ডিসিপ্লিন থেকে নিয়োগ দেয়া, চাঁদপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী ও খুলনার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিয়ন্ত্রণে ভ্রাম্যমাণ নৌ আদালত প্রতিষ্ঠা, মেরিন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে পুলিশ ফোর্স মঞ্জুর করা, অভ্যন্তরীণ নৌ অধ্যাদেশ ১৯৭৬-এর সংশোধন করে নৌ দুর্ঘটনার কারণে নিহত ও আহতদের পরিবারকে মাথাপিছু ক্ষতিপূরণ দানের বিধান করা এবং এ অধ্যাদেশের অধীনে সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে মালিককেও দায়ী করার বিধান চালু, নৌপথে পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন, অভ্যন্তরীণ নৌ নিরাপত্তা নিশ্চিত ও বর্তমান ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাস করা, পরিদর্শকদের আরো সক্রিয় ও শক্তিশালী করা। এগুলো ছাড়াও অনেকে মনে করেন যে, সরকারকে নৌ দুর্ঘটনাকে দুর্যোগ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে নৌ মন্ত্রণালয় ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়কে রিলিফ ও পুনর্বাসন কাজে এগিয়ে আসতে হবে। নৌ চলাচলের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ নৌ রুটগুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন এবং এর তীরবর্তী লোকালয়গুলোয় উদ্ধারকর্মীদের টাস্কফোর্স গঠন করে এদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যাত্রীদের বীমার ব্যবস্থা করাটাও জরুরি। তাছাড়া লঞ্চ ছাড়ার আগেই যাত্রীর নামের তালিকা প্রণয়ন বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন।
©somewhere in net ltd.