![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নওগাঁর পত্নীতলায় দিবর দিঘীতে রয়েছে হাজার বছর আগের বাংলাদেশী শাসক দিব্যকের স্মৃতি স্তম্ভ।
কৈবর্ত বিদ্রোহ বা বরেন্দ্র বিদ্রোহ বলতে উত্তর বাংলার সামন্তপ্রভু কৈবর্ত সর্দার দিব্য (দিব্যক) এর (পাল কর্মচারী দিব্যের) নেতৃত্বে শুরু হওয়া কৈবর্ত সম্প্রদায়ের তৎকালীন দ্বিতীয় মহীপালের (১০৭০-১০৭৭) পাল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিপ্লবকে বোঝানো হয় যা ১০৮০ সালে হয়েছিল।এটিকে বাংলাদেশ এমনকি ভারতবর্ষের প্রথম সফল বিদ্রোহ হিসেবেও (কৃষক বিদ্রোহ) অভিহিত করা হয়। এই বিদ্রোহের মাধ্যমে কৈবর্ত নেতারা বরেন্দ্রকে নিজেদের অধীনে আনতে সক্ষম হন। তবে, বিদ্রোহের প্রথম পর্যায়কে আরও উপযুক্তভাবে সামন্ত প্রভুদের ( সামন্ত ) বিদ্রোহ হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে , যারা কৃষকদের সংগঠিত করতেন এবং বিদ্রোহের শেষ পর্যায় ছিল একটি স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থান। ১০৮২ খ্রিষ্টাব্দে পাল রাজা রামপাল সামান্তরাজাদের সহযোগিতায় পরবর্তী কৈবর্ত নেতা ভীমকে হারিয়ে পিতৃভূমি বরেন্দ্রীকে নিজেদের দখলে আনতে সক্ষম হন। এর মাধ্যমে বাঙ্গালিদের প্রথম রাষ্ট্রবিপ্লবের সমাপ্তি ঘটে।
কৈবর্তদের পরিচয়ঃ
কৈবর্তরা ছিল বাংলাদেশের প্রাচীন জনপদ বরেন্দ্র এর আদি বাসিন্দা। কৈবর্ত শব্দটি এসেছে ‘ক’ (পানি) এবং ‘বর্ত’ (জীবনযাপন) শব্দ দুটি থেকে। কৈবর্তরা জেলে সম্প্রদায় হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তাদের জীবনযাপন ছিল পানিকেন্দ্রিক। তবে অনেকে এটাও বলে থাকেন, কৈবর্তের মধ্যে কৃষকও ছিল। প্রাচীন যুগের প্রথম দিকে কৈবর্তদের নীচু মর্যাদা দেওয়া হত, তারা নৌকাচালক, জেলে, অথবা নিষাদ বা এমনকি দাসের মতো বন-বসতি স্থাপনকারী শিকারী এবং লুণ্ঠনকারীদের সাথে যুক্ত ছিল, অথবা তাদেরকে মিশ্র জাতি হিসেবে বর্ণনা করা হত—শঙ্কীর্ণ জাতি, অথবা অন্ত্যজ হিসেবে। বিষ্ণু পুরাণের বংশানুচরিত উল্লেখ করেছেন যে মগধের একজন রাজা , ঐতিহ্যগতভাবে গৃহীত ক্ষত্রিয়দের উৎখাত করে ক্ষত্রিয়দের একটি নতুন শ্রেণী তৈরি করবেন। রোমিলা থাপার উল্লেখ করেছেন যে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষত্রিয় মর্যাদায় রূপান্তরিত অন্যান্য বর্ণের তালিকায় কৈবর্ত অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ৫ম শতাব্দীর সুলতানপুর তাম্রশাসনের শিলালিপি গুপ্ত বাংলায় কুটুম্বিন (কৃষক জমিদার) সদস্য হিসেবে স্থানীয় পরিষদে (অধিকরণ) কৈবর্তশর্মনের উপস্থিতি প্রকাশ করে । স্বপ্না ভট্টাচার্য উল্লেখ করেছেন যে বরেন্দ্রে কৈবর্তদের কেবল জেলে এবং চাষী হিসেবেই নয়, ব্রাহ্মণ হিসেবেও উপস্থাপন করা হয়েছিল। আর সি মজুমদার এবং আর এস শর্মা এই উপজাতি বা বংশের আর্য বা ব্রাহ্মণ্য সমাজের সাথে একীভূত হওয়ার এবং পরবর্তীতে ক্ষত্রিয় পিতা এবং বৈশ্য মাতার বংশধর মাহিষ্যের সাথে যুক্ত হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।
দ্বিতীয় গোপালের এক অনুদানে কৈবর্তদের নাম গ্রামীণ বাসিন্দাদের মধ্যে সর্বনিম্ন শ্রেণীর একটি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল । মহীপাল প্রথম এবং বিগ্রহপাল তৃতীয়ের তাম্রশাসনে ওসিন্নকৈবর্তবৃত্তি, উদ্ধন্নকৈবর্তবৃত্তিবাহিকালের মতো কৈবর্তদের বৃত্তির উল্লেখ রয়েছে । রিয়োসুকে ফুরুইয়ের মতে, জীবিকা নির্বাহ বা কিছু পরিষেবার জন্য প্রদত্ত এই বৃত্তি বা জমিগুলি কৃষি সীমান্তে তাদের বসতি স্থাপন এবং জমিদারদের একটি শ্রেণীর কিছু অংশের বৃদ্ধিকে বোঝায়। ফুরুই আরও উল্লেখ করেছেন যে বরেন্দ্রে "কৈবর্ত" নামে একটি বৈচিত্র্যময় সামাজিক গোষ্ঠীও থাকতে পারে। কৈবর্তরা পাল রাজাদের সাথে সামরিক বা অন্যান্য পরিষেবার মাধ্যমে এবং প্রশাসনিক পদে নিয়োগের মাধ্যমে অধস্তন শাসকের পদ অর্জন করেছিলেন। অন্যদিকে, ঐতিহাসিক বিশ্বেশ্বর চক্রবর্তী এবং এইচএস কোটিয়াল মতামত দিয়েছেন যে পাল রাজা এবং বিদ্রোহী সামন্ত নেতা উভয়ই ছিলেন কৈবর্ত বা মহিষ্য।
কৈবর্ত নেতা দিব্য বা দিব্যক এর পরিচয়ঃ
এসপি লাহিড়ী যুক্তি দিয়েছিলেন যে দিব্য ছিলেন রাজ্যপালের রাজসভার প্রধানমন্ত্রী যশোদাসের পরিবারের সদস্য । কাশি কৈবর্ত বংশের এই দাস রাজবংশ , যার মধ্যে যশোদাসের পূর্বপুরুষ মালহাদাস, সুরদাস এবং সংঘদাস গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন, তাদের সম্পদ এবং বীরত্বের জন্য পরিচিত ছিল। যশোদাস যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন রাজা অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, সুহ্ম, পাণ্ড্য, কর্ণাট, গুর্জর ইত্যাদির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। যশোদাস পুকুর খনন, মন্দির, মঠ, প্রাসাদ এবং সেতু নির্মাণ ইত্যাদির মতো অনেক মানবিক ও ধর্মীয় কার্যকলাপ করেছিলেন বলে জানা যায়।
দিব্য, রুদোক এবং ভীম প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে বরেন্দ্র শাসন করেছিলেন।
দিব্যা অত্যন্ত উচ্চ রাজকীয় পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, সম্ভবত রাজকীয় সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন। বিদ্রোহীরা তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সহজেই বরেন্দ্রকে দখলে নিতে সক্ষম হন। দ্বিতীয় মহীপাল বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন এবং পাল সেনাবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। ফলস্বরূপ, দিব্য বরেন্দ্রকে একটি পৃথক রাজ্য ঘোষণা করেন এবং তিনি পাল রাজধানী গৌড়ের রাজা হন। তাঁর শাসনামলে বঙ্গে বর্মণ রাজবংশের জাতবর্মণ বৌদ্ধধর্মের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করে বরেন্দ্রকে আক্রমণ করেন। যদিও দিব্যের কোনও ক্ষতি হয়নি, জাতবর্মণের সেনাবাহিনীর আগুনে সোমপুরের বৌদ্ধ বিহারের একটি অংশ ধ্বংস হয়ে যায়। দিব্য বরেন্দ্রে তাঁর অবস্থান সুসংহত করেন। তিনি একজন শক্তিশালী শাসক ছিলেন এবং রামপালের রাজত্ব আক্রমণ করেন। তিনি তাঁর ভাই রুদোকের কাছে একটি শান্তিপূর্ণ রাজ্য রেখে যান, তবে তাঁর সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না।
বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটঃ
বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষেরা পরিচিত ছিল শান্ত ও নিরীহ মানুষ হিসেবে। তবে কেন এই লোকগুলো বিদ্রোহ করে বসল?
কৈবর্ত বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয় ধর্মীয় কারণকে। পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের। তাঁরা তাঁদের অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী এবং জীব হত্যার বিরোধী ছিলেন। কৈবর্তরা জেলে হওয়ায় মাছ ধরাই ছিল প্রধান পেশা।
তবে শুধু কৈবর্তরা নয়, বরং বরেন্দ্র অঞ্চলে বসবাসকারী বেশির ভাগ মানুষই মৎস্যভোজী ছিল। দ্বিতীয় মহীপালের সময় জীব হত্যার কথা তুলে তাদের এই পেশাকে নিরুৎসাহ এবং বাধাগ্রস্ত করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে নেমে আসে কঠোর শাস্তি। এসব কারণের পাশাপাশি মহীপাল তাঁর রাজ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। ফলে অঞ্চলের মানুষের অসন্তোষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে সময় লাগেনি।
কৈবর্ত বিদ্রোহের পিছনে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণকে প্রাধান্য দেওয়া সত্ত্বেও কিছু পণ্ডিত এর প্রকৃতিকে ধর্মীয় দিক থেকেও বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন রামশরণ শর্মা। তাঁর কাছে মনে হয়েছে যে, ধর্মীয় দ্বন্দ্বকে সমকালীন সামাজিক অবস্থা থেকে পৃথক করা যায় না। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন, এই বিদ্রোহের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গেলে উৎপীড়ক পালদের বিরুদ্ধে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পিছনে ধর্মের ভূমিকা কতখানি তা বিচার করে দেখা দরকার। খ্রিস্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতকে নির্মিত বাংলা তথা পূর্বভারতের বিভিন্ন মন্দির ও মূর্তিগুলি বিচার বিশ্লেষণ করে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, শৈব ও বৌদ্ধদের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধিতা বিরাজমান ছিল। প্রমাণস্বরূপ তিনি মূর্তিগুলির মধ্যে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিমায় বৌদ্ধদেবতার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সমসাময়িক লেখমালা পর্যালোচনা করে তিনি দেখাবার চেষ্টা করছেন যে ব্রাহ্মণ ভূমিস্বত্বভোগী ও সাধারণ কৃষকরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও বৌদ্ধ মঠগুলি সেইসময় বিশাল পরিমাণ ভূসম্পদ ভোগ করত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কৈবর্ত প্রধান ভীম শিবের উপাসক ছিলেন এবং কৈবর্ত সম্প্রদায় খুব সম্ভবত শৈবধর্মের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। সম্ভবত এই কারণেই ‘রামচরিত’ কাব্যে বলা হয়েছে, কৈবর্তদের পরাজিত করার পর রামপাল তাঁর প্রতিষ্ঠিত নতুন রাজধানী রামাবতীতে বেশ কিছু শৈব মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন। বলাবাহুল্য, এর কূটনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় কৈবর্ত জনসাধারণের আস্থা ও শ্রদ্ধা অর্জন করা। পালদের সঙ্গে কৈবর্তদের ধর্মীয় বিরোধ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল রামপালের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিতীয় মহীপালের আমলেই। এর স্পষ্ট উদাহরণ হল পাল শাসক প্রথম মহীপালের সময় কৈবর্তদের উদ্দেশ্যে দান করা ভূখণ্ড (পূর্বে উল্লেখিত) কেড়ে নিয়ে বৌদ্ধদের দান করেছিলেন।
পাল শাসনকে সাধারণত “স্বর্ণযুগ” বলে অভিহিত করা হয়। দেবপাল, ধর্মপালের শাসনের স্বর্ণযুগ পেরিয়ে যখন পাল শেষ দিকে আসতে থাকে তারা তাদের পুরনো গৌরব হারিয়ে ফেলে। ধীরে তাদের শাসন দুর্বল হতে থাকে ও অরাজকতা সৃষ্টি হতে থাকে। তাদের এই অরাজকতা থেকে রক্ষা পাওয়াই ছিল কৈবর্ত বিদ্রোহের প্রধান উদ্দেশ্য।
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মতে , কৈবর্ত বিদ্রোহ সিদ্ধ আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত । বৌদ্ধ মহাসিদ্ধদের গল্প তাদেরকে বিদ্রোহে অনুপ্রাণিত করেছিল।
রোমিলা থাপার উল্লেখ করেছেন যে বিদ্রোহীরা বৌদ্ধ ও তান্ত্রিক সম্প্রদায় - বজ্রযানের সাথে যুক্ত ছিল যা তখন এই অঞ্চলে জনপ্রিয় ছিল। বিদ্রোহীরা, যারা ব্রাহ্মণদের দেওয়া (অগ্রহরার) জমি বাজেয়াপ্ত করেছিল, তারা সম্ভবত ব্রাহ্মণদের রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং অধস্তন শাসকদের উপর এবং গ্রামীণ সমাজে ব্রাহ্মণ্য প্রতিষ্ঠানগুলির ক্রমবর্ধমান প্রভাবে অসন্তুষ্ট ছিল।
সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’ থেকে জানা যায় যে, পাল শাসক তৃতীয় বিগ্রহপালের (১০৪৪-১০৭০ খ্রিঃ) মৃত্যুর পর একদিকে সাম্রাজ্যের প্রায় সর্বত্র চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল এবং অপরদিকে রাজপরিবারের অভ্যন্তরে খুব সম্ভবত সিংহাসনে আরোহণের বিষয়কে কেন্দ্র করে তাঁর তিন পুত্র যথা দ্বিতীয় মহীপাল, দ্বিতীয় শূরপাল ও রামপালের মধ্যে ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব প্রকট হয়েছিল। এই দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত মহীপাল জয়ী হয়ে সিংহাসনে বসেন এবং শূরপাল ও রামপালকে কারারুদ্ধ করেন। স্বাভাবিকভাবেই রাজপরিবারের এই অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন পাল রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ সামন্তগণ, প্রাদেশিক শাসকগণ ও জনগণ। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় মহীপাল শাসন করার সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র এক বছর (আনুঃ ১০৭০–১০৭১ খ্রিঃ)। ‘রামচরিত’-এর বর্ণনা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে দ্বিতীয় মহীপাল ছিলেন একজন দুর্বল ও অজনপ্রিয় শাসক। এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে দিব্য নামে এক ব্যক্তি পালদের আদি বাসভূমি (রামচরিত অনুযায়ী জনক-ভূ) বরেন্দ্রী (উত্তরবঙ্গ)-তে একটি বড়ো ধরনের অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন, যা ‘কৈবর্ত বিদ্রোহ’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিদ্রোহের ডাক দেন দিব্য। কৈবর্তরা এতে সাড়া দেয় এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রাজ্যের বরেন্দ্র অংশ অধীনে আনতে সক্ষম হয়। কৈবর্তরা নৌকা চালাতে পারদর্শী ছিল বলে তারা নৌযুদ্ধকেই প্রাধান্য দেয়। রাজা দ্বিতীয় মহীপাল যুদ্ধে নিহত হন এবং এর ফলে কিছুদিনের জন্য হলেও পাল সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এর মধ্যেই দিব্যর নেতৃত্বে বরেন্দ্রকে রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা হয়। দিব্যর মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন তাঁর ছোট ভাই রুদোক এবং এর পরে রুদোকপুত্র ভীম।
বরেন্দ্রকে পুনরুদ্ধারঃ
রামপাল সিংহাসন লাভের পর ভীমের জনপ্রিয়তা, দক্ষতা, উদারতা দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হোন। আরও ভূমি হারানোর ভয়ে প্রতিবেশী ও সামান্তরাজাদেরকে অপরিমিত অর্থ ও ভূমি দান করেন এবং যুদ্ধের জন্য তারা সহযোগিতা করতে রাজি হয়। সম্মিলিত সৈন্যের সাথে ভীমের নবগঠিত রাষ্ট্রের পেরে ওঠা অনেকটা অসম্ভব ছিল। গঙ্গার উত্তর তীরে যুদ্ধ করতে গিয়ে জীবিত অবস্থায় ভীম বন্দিত্ব বরণ করেন। ভীমের অগণিত রাজকোষ পাল সেনারা লুণ্ঠন করে। কৈবর্ত বিদ্রোহ দমনে রামপাল অন্যান্য সামন্ত রাজাদের সাহায্য পেয়েছিলেন একথা সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতে উল্লেখ আছে।
ভীম বন্দী হওয়ার পর ভীমের অন্যতম সুহৃদ, বিশ্বস্ত হরি পরাজিত সৈনিকদের একত্রিত করেন এবং রামপালের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধে লড়ার অঙ্গীকার করেন। হরির নেতৃত্বে যখন সেনারা যুদ্ধ জয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন রামপাল তার স্বর্ণকলস উজাড় করে দেয়ার মাধ্যমে তাদের বশীভূত করতে সক্ষম হন। এর মাধ্যমেই বরেন্দ্রীর স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার স্বপ্ন চিরতরের জন্য মৃত্যু লাভ করে এবং পুনরায় পাল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
রামশরণ শর্মা বর্ণনা করেছেন যে ভীমের জনসমর্থন ছিল, কিন্তু বিদ্রোহীরা সমতাবাদী চেতনায় অনুপ্রাণিত হওয়ায় সামন্তরা তাকে সমর্থন করেননি। রামপালকে স্বাধীন প্রধানদের কাছ থেকে সমর্থন ভিক্ষা করতে হয়েছিল এবং প্রচুর পরিমাণে জমি ও নগদ অর্থ দান করতে হয়েছিল। ভীমের অপ্রস্তুত এবং অপ্রশিক্ষিত কৃষক ও সাধারণ সেনাবাহিনী পাল, রাষ্ট্রকূট এবং এক ডজনেরও বেশি সামন্তের একত্রিত সেনাবাহিনীর সাথে কোনও তুলনা করতে পারেনি। বরেন্দ্র পুনরুদ্ধারের পর রামপাল কৈবর্তদের শান্ত করার জন্য ভবানী এবং শিবের মন্দির নির্মাণ করেছিলেন ; কৃষকদের শান্ত করার জন্য তাকে হালকা করও গ্রহণ করতে হয়েছিল।
ভীমের বিচারঃ
রুদোকের স্থলাভিষিক্ত হন তাঁর পুত্র ভীম, যিনি ৩০ বছর ধরে এই অঞ্চলটি সফলভাবে শাসন করেছিলেন। বরেন্দ্রীর অধিপতি হওয়ার পর, ভীম, একজন জনপ্রিয় রাজা যাকে এখনও স্মরণ করা হয়, ইতিমধ্যেই সুপ্রতিষ্ঠিত কৈবর্ত শক্তিকে শক্তিশালী করেছিলেন। ভীম যুদ্ধবিধ্বস্ত বরেন্দ্রকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। ভীম ব্রাহ্মণ্যবাদী এবং অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিনিধিদের তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করেছিলেন, যা পাল রাজাদের দ্বারা প্রদত্ত ছিল। তিনি তার আত্মীয়স্বজন কৃষকদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের নওগাঁ জেলায় রাজবংশের নিদর্শন হিসেবে দিব্য জয়স্তম্ভ বা কৈবর্ত স্তম্ভ এখনও বিদ্যমান । বরেন্দ্রে ভীমের রঞ্জনবিদ্যা , ভীমের জঙ্গল , ভীমের সাগর , ভীমের পান্টি ইত্যাদি এখনও তার স্মৃতি বহন করে।
কৈবর্তেরা যেন আর কখনো রুখে দাঁড়াতে না পাড়ে সে জন্য তারা কৈবর্তে নেতাদের কঠোর শাস্তি দেয়া হয়। ভীমের পরিবারকে তার সামনে হত্যা করা হয় এবং ভীমকেও পরবর্তীকালে হত্যা করা হয়। পাল রাজারা এই বিদ্রোহ দমনে চরম নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
সূত্রঃ উইকিপিডিয়া, বিভিন্ন অনলাইন নিবন্ধ ও ডাঃ জাকির তালুকদার এর আলোচনা
©somewhere in net ltd.