নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নিশাদ কমল

নিশাদ কমল। বতর্মানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একজন কর্মচারি হিসেবে কর্মরত। ব্যক্তিগতভাবে বাক-স্বাধীনতায় এবং মুক্ত চিন্তায় বিশ্বাসী। মানব ধর্মকেই একমাত্র প্রকৃত ধর্ম হিসেবে জ্ঞান করতে আগ্রহী।

নিশাদ কমল › বিস্তারিত পোস্টঃ

নীরব চিৎকার

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৪:৩২

আজ তিন দিন হলো গোলেনুর বেগম কবরে শুয়ে আছে। এ তিন দিনে ছেলে-মেয়ে ছাড়াও পরিচিত দু’এক জন যে কবরের পাশে আসেনি তা নয়, তবে তা হাতে গোনা। ছেলে-মেয়ে এবং অতি নিকটাত্মীয়রাই কবরের পাশে এসে হাত তুলে বিড়বিড় করে দোয়া কালাম পড়ে। আর বাকীরা আসে কবর খানা এক নজর দেখতে। প্রতিবেশী এবং পুরুষ-আত্মীয়রা আসে শুধু কবর নিয়ে মন্তব্য করতে। এই যেমন- সামনে বর্ষাকাল, পলিথিন দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দিতে হবে। কেউ বলে- কবরের উপর গরু-ছাগল না উঠতে পারে সে জন্য সুপারি চেড়ার বেড়া দিতে হবে। চারপাশে পাতাবাহার লাগাতে হবে। প্রতিবেশী বৃদ্ধরা বোধ হয় শুধু কবরের সৌন্দর্য দেখতেই আসে। তাদের আলাপচারিতার সারমর্ম হলো- যে কবরের চেহারা সুন্দর হয়, ঝকঝক করে, সে কবরের বাসিন্দা জান্নাতবাসী হয়। দাফনের পর থেকে আজ পর্যন্ত গোলেনুর যাকিছু দেখলো, তাতে সে রীতিমত বিস্মিত! কিন্তু আসল বিস্ময় সে দেখতে পেল আজ সকালের পর থেকে।

খুব ভোর থেকেই সারাবাড়ি জুড়ে একটা হইহই ব্যাপার শুরু হলো। বাড়ির বউরা ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, আদা- এসবের বড় বড় ঝুড়ি নিয়ে বসে পড়ল। কেউ পেঁয়াজ রসুনের খোসা ছাড়ায়, কেউ বসে গেলো তা পিঁষে মসলা বানাতে। চাল-ডাল, তরিতরকারি ও মাংশের বিপুল সমাহার চলে আসলো। পুরুষরা ঘরের বাইরে বিশালাকৃতির কয়েকটি চুলা খনন করলো। সে চুলায় বড় বড় পাত্র বসানো হলো। শুরু হলো রান্না-জজ্ঞ। বিপুল পরিমাণ থালাবাসন, জগ-গ্লাস ও অন্যান্য তৈজষপত্র জড়ো করা হলো। ধীরে ধীরে বাড়িতে লোকসমাগম বাড়তে থাকলো। গোলেনুর অবাক দৃষ্টিতে দেখে আর ভাবে- কী হচ্ছে আজ এ বাড়িতে! কীসের এত আয়োজন? বিয়ে-টিয়ে নাতো? কার বিয়ে? পরক্ষণেই আবার ভাবল- বিয়ের আয়োজন হলে তো সুতায় সুতায় রঙিন কাগজ উড়ত, গাছের গোড়ায় চুন লাগানো হতো, মাইকে গানের রেকর্ড বাজত অবিরাম। সেসব তো হচ্ছে না। তাছাড়া এবাড়িতে এমন কার বিয়ে হতে পারে যে এত লোকের দাওয়াত পড়বে! প্রায় শতবর্ষের জীবদ্দশায় এ বাড়িতে একসাথে এত লোক তো গোলেনুর কোনোদিন দেখেনি। তবে দেশের জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে তাতে এটা অসম্ভব নয়। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী হয়।

বেলা বাড়ার সাথে সাথে লোকও বাড়তে থাকে।আঙিনার এক প্রান্তে সামিয়ানার নিচে কিছু বৃদ্ধ লোক এবং গুটিকয়েক নিকটাত্মীয় যুবক মাথায় টুপি পড়ে ঢালা বিছানায় জড়ো হয়ে ছোট ছোট নুড়ি পাথর ভাগাভগি করে গোল হয়ে নতজানু আসনে বসলো। তারপর সেগুলো একটি একটি করে হস্তান্তর করে এবং অস্ফুট স্বরে ঠোঁট নাড়ে। একি! এটাতো করা হয় মৃত ব্যক্তির রূহের মাগফেরাতের জন্য। এটাকে নাকি তছবিহ পড়া বলে। তবে কি আজ তারই রূহের মাগফেরাত কামনার জন্য এ আয়োজন? কিন্তু ওদিকে যে বিশাল বিশাল পাত্রে সুস্বাদু খাবার রান্না চলছে! তবে কি একসাথে দু’টো অনুষ্ঠান! তা হয় কী করে?

এমন ভুরি ভোজের আয়োজন তো হতে পারে একমাত্র আনন্দ অনুষ্ঠানে- মেয়ের বিয়েতে, ছেলের খাতনা অনুষ্ঠানে অথবা ইলেকশনে জয়লাভ করার পর। এসব তো আনন্দের ব্যাপার।
নাহ, বিয়েবাড়ির সেসব কোন সাজগোজ দেখা যাচ্ছে না; গেট বানানো হয়নি। কোন গান বাজনাও তো হচ্ছে না! তবে কি গোলেনুরের মৃত্যুতে এ বাড়িসহ তার গোষ্ঠি-জ্ঞাতি সবাই আনন্দ পেয়েছে! খুশি হয়েছে সবাই! দ্বিধায় পড়ে যায় গোলেনুর। দ্বিধায় পড়ারই তো কথা। কেননা, গোলেনুর মৃত্যুর আগে এমন কী জ্বালাতন করেছিলো তাদের যে, তার মৃত্যুতে এলাকাসুদ্ধ সবাই খুশি। নাকি সে সবার বোঝা হয়ে গিয়েছিলো! সেই বোঝা অপসারিত হওয়ায় তারা খুশি হয়েছে? নাহ! গোলেনুর আর কিছু ভাবতে পারছে না। দু’চোখে ঘুমও আসছে না।

‘গোলেনুর’! হঠাৎ উচ্চ স্বরে তার নাম ধরে ডাক শুনে গোলেনুর ফিরে তাকায়। চার-পাঁচ জন ফেরেস্তার একটা দল তাকে ঘিরে দাঁড়ায়।
-কী ভাবা হচ্ছে এসব?
-কই, নাতো! কিচ্ছু না।
-এটা মর্ত্য নয়, কবরদেশ। এখানে কিছু অস্বীকার করার উপায় নাই।
গোলেনুর অবাক হয়! ‘মনের কথা তো দেখছি ফেরেস্তারা সব জেনে ফেলেছে! তাহলে কি মোল্লা মুন্সিরা দুনিয়ায় যা বলেছে তা-ই ঠিক? হবে হয় তো। ঐ তো তখন আমার কবরের পাশে দাঁড়ানো লোকগুলোকে কত জোরে চিৎকার করে ডাকলাম, কেউ কোন সাড়া দিলনা।’ গোলেনুরের সব মনে পড়ে গেল। একবার হুজুর ওয়াজের মধ্যে বলেছিলেন, “মৃত্যুর সাথে সাথে মানুষের আমলনামা বন্ধ হয়ে যাবে। পঞ্চ ইন্দ্রিয় অচল হয়ে যাবে। তবে মৃত ব্যক্তি শুনতে পাবে, দেখতে পাবে, অনুভব করতে পারবে। চিৎকার করবে কিন্তু জগতের মানুষ সে চিৎকার শুনতে পাবে না।” হুজুরের কথাই তো আজ সত্য মনে হচ্ছে। হুজুর আরও বলেছিলেন, “মৃত ব্যক্তি এমন জোরে চিৎকার করতে থাকবে, সে চিৎকার যদি জগতবাসীর কানে যেত তাহলে তাদের ব্রেইন-স্ট্রোক হয়ে যেত!”

দলনেতা ফেরেস্তা এবার নিজেই প্রশ্ন করতে থাকে।
-জীবনে এমন কী করেছো যে তোমার মৃত্যুতে তোমার আওলাদকুল এত খুশি হয়েছে?
-তেমন কিছু করেছি বলে মনে পড়ছে না।
-তাহলে কি সবার অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলে?
-মৃত্যুর আগে তেমন তো মনে হয়নি।
-তাহলে কেন তোমার আওলাদবর্গ এত লোক ডেকে এমন ভুরি ভোজের আয়োজন করলো? কেন এত আনন্দ উল্লাস?
প্রাথমিক সওয়াল জওয়াবের সম্মুখীন হয়েই গোলেনুর বুঝতে পারে- ওপারে কী হচ্ছে তার সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ চলছে এপারে।

ফেরেস্তা চলে যেতেই গোলেনুর দেখে যে পুরো আঙিনা জুড়ে হোগলাপাটি বিছানো হয়েছে। উপরে বিশাল সামিয়ানা। পুরো আঙিনা ভরে পুরুষ আত্মীয় ও এলাকার গন্যমান্যরা সারি সারি করে বসলো। শুরু হলো ভোজ পর্ব। প্লেট ভর্তি মাংশ, সবজি ও ডাল দিয়ে ভুরি ভোজ। গরু না-খাওয়াদের জন্য আছে মুরগির ব্যবস্থাও! শুধু কি তাই, আছে সুস্বাদু ফিন্নি। দ্বিতীয় কাফেলায় আত্মীয়-অনাত্মীয় মহিলারা। তৃতীয় ও শেষ কাফেলায় প্রতিবেশী ছোকরা-মোকরা ও অখ্যাত পুরুষ আত্মীয়রা। পুরো আঙিনা জুড়ে রৈরৈ ব্যাপার। কেউ বলে- আর একটু মাংশ দাও তো, বেশ স্বাদ হয়েছে। একজন বলছে- মাংশের গামলা তো এদিকে আসেই না, ব্যাপার কী? কেউ বলে- ম্যানেজমেন্ট ভালো না, সবকিছু চাইতে হয়। দেইখ্যা দিতে পারে না। তৃতীয় সারির মাঝের এক লোকের পাতে ফিন্নি একটু কম পড়ছে, অমনি সে গোস্যা করে বসল- প্লেট ভইরা না দিলে আইজ খামুই না!

গোলেনুর আর স্থির থাকতে পারে না, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে- “ঐ হারামজাদারা! মুই মরলে তোরা এত খুশি অবি তা যদি আগে জানতাম, তাইলে অনেক আগেই তোদের খুশি করতাম! এতো দেরি করতাম না।”
গোলেনুরের চিৎকার ওদিকে পৌঁছায় না। সে শুনতে পায়, ওদিকে একজন বলছে- “এই জাকির ভাই, কবির ভাইয়ের প্লেটটা ভইরা দেন।”

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.