![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি একটা সুপার শপে চেক-আউট অপারেটরের কাজ করি। সোজা বাংলায় দোকানদার। অনেক দিন ধরে একই দোকানে কাজ করায় দোকানের নিয়মিত কাস্টমারদের সাথে আমার ভালো জানা-শুনা হয়ে গিয়েছে। এমনই আমার নিয়মিত এক কাস্টমারের গল্প বলছি। ভদ্রলোক অন্ধ, চোখে দেখেন না। অনেক বয়স। সব সময় উনার স্ত্রী’র সাথে শপিং এ আসেন। উনি এবং উনার স্ত্রী দুইজনই আমাকে খুব স্নেহ করেন। পরিবার-পরিজন ছেড়ে দূরে থাকায় আমি এমনিতেই স্নেহের কাঙ্গাল। তাই উনাদের প্রতি আমার একটা অন্যরকম মায়া হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া আমার দাদা-দীদা’র সাথে উনাদের কোথায় যেন একটা মিল আছে। তাই গেলো বছরের ক্রীস্টমাসের সময় উনারা যখন শপিং করতে এলেন আমি তখন উনাদেরকে এক বাক্স চকলেট উপহার দিলাম। বাক্সটা হাতে ধরেই উনি বুঝে ফেললেন যে এটা চকলেটের বাক্স। উপহার পেয়ে বৃদ্ধ একেবারে বাচ্চাদের মত খুশি হয়ে উঠলেন। আমাকে বললেন যে শেষ কবে উনি ক্রিস্টমাসের উপহার পেয়েছেন মনেই করতে পারছেন না। আহারে বেচারা!
কারো কারো জন্য আসলে ঈদ-ক্রিস্টমাসের দিনগুলো খুশির কোন দিন তো নয়ই, বরং দিনগুলোতে উল্টো তাদের মন খারাপ হয়ে যায়। যেমন আমি দেশ ছেড়ে আসার পর থেকে প্রতি ঈদের দিন ফোনে আমার মা’কে কাঁদতে শুনেছি। এই দূরদেশে ঈদের দিনেও যখন নামাজ বাদ দিয়ে ভার্সিটিতে পরীক্ষা দিতে যেতে হয়, তখন মনে হয় যে ক্যালেন্ডারে ঈদের দিনটা থাকার থেকে না থাকাই ভালো ছিলো। যাই হোক, আমার দোকান ভয়াবহ ব্যাস্ত। ক্রিস্টমাস এর বাজার। একেবারে ঈদের আগে আগে বাংলাদেশের নিউমার্কেটের মতন অবস্থা। তাই উনাদেরকে খুব বেশি একটা সময় দিতে পারলাম না। পরের কাস্টমারকে সার্ভ্ করা শুরু করলাম।
পরের কাস্টমার দেখি আবার ট্রলি ভর্তি করে উপহার কিনেছেন। তাঁর ট্রলি’র ভেতর অন্য অনেক উপহারের মধ্যে দেখি ‘মেরি-ক্রিস্টমাস’ লেখা দুই-তিনটা কুকুরের খেলনাও আছে। মেজাজ ভীষণ রকম খারাপ হল। কত মানুষের ঘরে খাবারই নেই, আর কত মানুষের আবার কুকুরের জন্য উপহার কেনার ক্ষমতাও আছে। পৃথিবী টা অন্যায় রকমের অসমান বলে মনে হল। নিজেকে এই বলে বোঝালাম যে, যার ক্ষমতা আছে, সে তো নিজের মত করে উদযাপন করবেই। অন্যদের কথা ভেবে তাঁর উদযাপন থেমে থাকবে কেন! আমি নিজেও তো দেশে থাকতে ঈদ উদযাপন করার সময় পথশিশুদের কথা ভাবতে পারতাম, একজন রিক্সা-শ্রমিককে নতুন একটা জামা কিনে দিতে পারতাম অথবা অনাহারী দুটো মানুষের মুখে ঈদের পোলাও-কোর্মা তুলে দিতে পারতাম। এসবের কিছুই যখন করিনি, তখন আমার এই ছেলে-ভুলানো মেজাজ খারাপ করার কোন অধিকার নেই। এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই ভদ্রলোকের জিনিসগুলো স্ক্যান করছিলাম। যে পরিমান জিনিস উনি কিনেছেন, সবগুলো স্ক্যান করা শেষ করতে আমার যে কতক্ষণ লাগবে আল্লাহ্ জানেন। এর মধ্যে ভদ্রলোক আবার আরও জিনিস আনতে গিয়ে দোকানের ভেতর উধাও হয়ে গেলেন। হায়রে উৎসবের বাজার! দোকানদারের জন্য উৎসবের বাজারের চেয়ে ভয়াবহ আর কিছুই হতে পারে না। যাইহোক, আমি আমার কাস্টমারকে অন্য জিনিস নিয়ে ফিরে আসার পর্যাপ্ত সময় দেবার জন্য ইচ্ছা করেই তাঁর জিনিস গুলো ধীরে-সুস্থে স্ক্যান করছি আর সাত-পাঁচ ভাবছি। হঠাৎ করে ডানদিকে তাকিয়ে দেখি যে আমার সেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এখনও দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তখন উনাদের দিকে ফিরে জিগ্যেস করলাম, ‘সব কিছু ঠিক আছে তো!’
একগাল হাসি মুখে নিয়ে বৃদ্ধের স্ত্রী উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ বাবা, সব ঠিক আছে।’
-“তাহলে এখনও দাঁড়িয়ে আছেন যে...”
বৃদ্ধা আমাকে বললেন যে আমি এখন যে কাস্টমারের জিনিস স্ক্যান করছি এই ভদ্রলোক নাকি উনার ছেলে। শুধুমাত্র শপিং সেন্টারে আসলেই উনাদের দেখা হয়। তাই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা অপেক্ষা করছেন ছেলের জন্য। ছেলের শপিং শেষ হলে ছেলের সাথে কথা বলবেন।
আমি একেবারে আকাশ থেকে পড়লাম। বৃদ্ধার কথা শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। নিজের অজান্তেই আমার গলায় বিস্ময় ফুটে উঠলো।
“আপনার ছেলে তো ট্রলি ভর্তি করে উপহার কিনেছে...”
-“হ্যাঁ, তাতে কি হয়েছে?” বৃদ্ধার গলায়ও বিস্ময়।
বৃদ্ধার বিস্ময় দেখে আমার বিস্ময় আরো বেড়ে গেলো। আমি হা-হা করে জিগ্যেস করলাম,
-“এই মাত্র যে আপনার স্বামী বললেন যে উনি শেষ কবে ক্রিস্টমাসের উপহার পেয়েছেন, সেটা উনি ভুলেই গিয়েছেন।”
বৃদ্ধা হেসে বললেন,
-“হ্যাঁ, আমি এখন আর চাকরি করিনা তো, তাই ওকে উপহারও কিনে দিতে পারি না।”
নাও ঠেলা, আমি কী বলি, আর উনি কী বোঝেন। আমি তাই এবার সরাসরিই জিগ্যেস করে ফেললাম,
-“কেনো, তোমাদের ছেলে তোমাদের উপহার কিনে দেয় না!”
বৃদ্ধ বললেন যে, -“শুধু আমাকে দেয়, ওর বাবাকে দেয় না।”
-“কেন?”
-“বাবার উপর রাগ। কারণ ওর ধারণা ওর বাবা ওকে আজীবনে কোনদিন কোন উপহার কিনে দেননি।”
বুঝলাম না এটা কি করে সম্ভব। তাই আবারো জানতে চাইলাম,
-“এটা কি শুধুই একটা ধারণা, নাকি আসলেই তোমার স্বামী নিজের ছেলে কে কোনদিন কোন উপহার দেননি!”
তখন বৃদ্ধা যা বললেন তা শোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না মোটেই,-
-“আমাদের ছেলে অন্ধ ছিলো। ওর দ্বিতীয় জন্মদিনের সময় ওর বাবা ওকে নিজের চোখ উপহার হিসেবে দিয়েছেন। এই বিষয়টা জানলে ছেলে কষ্ট পাবে দেখে উনি সারাজীবন ছেলের কাছ থেকে ব্যাপারটা গোপন রেখেছেন। নিজে অন্ধ হয়ে যাওয়ায় এরপর থেকে তাঁর আর কোন চাকরি ছিলো না। আমার একার সীমিত উপার্জনে টানাটানি করে কোন রকমে সংসার চলতো। উপহার কেনার সামর্থ্য আমাদের ছিলো না। আর ছেলের পড়াশুনার খরচ দিতো সরকার। এটা নিয়েও ওর খুব ক্ষোভ ছিলো। ছোটবেলা থেকে এরকম অভাব-অনটনে থেকে হঠাত বড় ধনী মানুষ হয়ে যাওয়ার চাপ ও সামলাতে পারেনি। বাসার সমস্ত পুরনো ফার্নিচার পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদেরকে ওল্ড-হোম্ এ রেখে এসেছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো...
বৃদ্ধা সবচেয়ে মজার ব্যাপারটা আর বলার সময় পেলেন না। তাঁর আগেই উনার সুপুত্র শপিং শেষ করে চেক-আউট এ ফিরে এসেছে। তাই উনাকে চুপ মেরে যেতে হলো। মনে মনে ভাবলাম, মজার ব্যাপারটা না শুনতে পেরে মনে হয় ভালোই হলো।
©somewhere in net ltd.