নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নাসীমুল বারী-র প্রযুক্তির উঠোনে স্বাগতম

নাসীমুল বারী

ঢাকার আজিমপুরে জন্মেছি। বেড়েও উঠেছি এখানে। ঐতিহ্যবাহী ওয়েষ্ট এন্ড হাই স্কুল থেকে এসএসসি সনদপ্রাপ্ত আমার পৈত্রিক নিবাসটা কিন্তু ‘ইলশে পাড়া’- চাঁদপুরের হাজিগঞ্জ উপজেলার সাদরা গ্রামে।

নাসীমুল বারী › বিস্তারিত পোস্টঃ

পুরুষ ছেঁটে ফেলেছি, এখন লিঙ্গ রাখতে চাই না

২৫ শে এপ্রিল, ২০১৪ দুপুর ২:২৪

।। নাসীমুল বারী ।।

পুরুষ— যেখানে পুরুষ থাকবে, সেখানে নারী বা মহিলাও থাকতে হবে। কিন্তু চরম এক আশ্চর্য যে আমাদের চেতনায়, বিশেষ করে বাংলাভাষীর চেতনায় শুধু পুরুষই ছিল, পুরুষই আছে। মহিলার কোনো অস্তিত্ব নেই। নারী বাদ দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আমরা এমনই চর্চা করে আসছি। আজ আমরা সম অধিকার নিয়ে, নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কথা বলছি— কিন্তু আমাদের ভাষার চর্চায় সে নারী সম্পূর্ণ বাদ। এ ব্যপারটা কি কেউ লক্ষ্য করেছেন? কথাটা বলছিলাম বাংলা ব্যাকরণের ‘পুরুষ’ নামক পাঠ নিয়ে। ‘পুরুষ’ নামে স্বতন্ত্র একটি পাঠ আছে, ‘নারী’ নামে নেই কে? ‘পুরুষ’ নামক পাঠটি ভাষায় ‘কর্তা’র উপস্থিতি চিহ্নিত করে। ভাষার ব্যাকরণে এটি একটি আবশ্যক। সে আবশ্যকটা ‘পুরুষ’ হবে কেন? আর কি কোনো শব্দ নেই— যে শব্দ চয়নে এ অধ্যায়ের পাঠ আমরা গ্রহণ করতে পারি। বাংলা ব্যাকরণের ইতিহাস কয়েকশ বছরের। এর মধ্যে ‘পুরুষ’ শব্দ দিয়ে কর্তার উপস্থিতি নির্ধারণ করা— তা বদলানোর কি চেষ্টা হতে পারে না? এখন প্রশ্ন আসবে ‘পুরুষ’ শব্দ থাকলে সমস্যা কী? বদলাতে হবে কেন? প্রাণিসত্তার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ‘পুরুষ’। সেই ‘পুরুষ’কে নিয়ে ব্যাকরণের একটি পাঠ— একটু বেমানানই। ইংরেজিতে এ অধ্যায়টা ‘ম্যান’ দিয়ে কিন্তু নয়। বাংলা ভাষায় আমি ‘পুরুষ’ বললে মানুষ পুরুষ বুঝব (এক্ষেত্রে নারী নয়)। বাংলা ব্যাকরণের বেলায় ‘সে’, ‘তুমি’, ‘জাবির’ ইত্যাদি এমনসব অর্থ বুঝব। আবার ব্যাকরণের ‘পুরুষ’ শ্রেণিবিন্যাসে উত্তম পুরুষ আছে। উত্তম পুরুষ ছাড়া অন্য পুরুষগুলো কি অধম? এতে কি মানবসত্তাকে খাটো করা হয় না? হয়ত একারণেই ব্যাকরণবিদরা একটু ঘুরিয়ে বলেছেন— মধ্যম পুরুষ, নাম বা তৃতীয় পুরুষ। সেই একই ভাবার্থ— অধম পুরুষ। বাংলা ভাষায় শুধু ‘পুরুষ’কে নিয়ে এত টানাটানি কেন? একটু গোলমেলে লাগে না?

তেমনি ‘লিঙ্গ’ বাংলা ব্যাকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। ‘লিঙ্গ’ বললে ভাষার বেলায় ‘পুরুষের জননেন্দ্রিয়’ বুঝি আর ব্যাকরণের বেলায় বুঝি ‘নারী’ বা ‘পুরুষ’ স্বরূপ। কিন্তু ‘পুরুষের জননেন্দ্রিয়’টা বেশি প্রচলিত। বেশি প্রচলিত এ শব্দটি খুবই অমার্জিত, অপরিশীলিত, বিব্রতকর যা আজ ব্যাকরণের পাঠ।

‘পুরুষ’ আর ‘লিঙ্গ’ নিয়ে আমার আপত্তি আছে। অনেকদিন ধরে ভাবছি এ শব্দ দুটোর পরিবর্তনে গ্রহণযোগ, যুৎসই ও পরিশীলিত শব্দ ব্যবহারের প্রস্তাবনা করা যায় কিনা। প্রথমেই ‘লিঙ্গ’কে নিয়ে ভাবছি। ভাবার্থ ‘লিঙ্গ’টাই বেশি বিব্রতকর ও অপরিশীলিত। বিভিন্ন সাহিত্য আসরে এ নিয়ে আমি ১৯৯৭ থেকেই বলে আসছি। এরই মধ্যে ২০১২ সালে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড’ ৬ষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণ বই রচনার পাঠক্রমে (Syllabus) ‘পুরুষ’কে ছেঁটে ফেলেছে। নাম দিয়েছে ‘পক্ষ’ এবং পক্ষের বিভাজন— বক্তাপক্ষ, শ্রোতাপক্ষ ও অন্যপক্ষ। ব্যাস, আর কোনো বিবরণ, বর্ণনা বা সূত্র দেয় নি।

যেহেতু আমার চেতনায় এ অধ্যায়টির নাম পরিবর্তনের একটা প্রত্যাশা ছিল— তাই এ অধ্যায়ে একটি পূর্ণ পাঠ রচনা করি। সাথে ‘লিঙ্গ‘কে নিয়েও একটি পূর্ণ পাঠ রচনা করি।

এখন ব্যাকরণের ধারায় এখানে ‘পক্ষ’ ও ‘লিঙ্গ’ নিয়ে একটু আলোচনা করছি।

‘আমি পড়ছি।’, ‘তুমি পড়ছ।’, ‘সে পড়ছে।’— এ উদাহরণে ‘আমি’, ‘তুমি’, ‘সে’— এ সর্বনামগুলোর উপস্থিতিকেই আমরা ‘পুরুষ’ হিসেবে পাঠ নিয়েছি। পুরুষের শ্রেণিবিভাজনে আমি- উত্তম পুরুষ, তুমি- মধ্যম পুরুষ আর সে- নাম বা তৃতীয় পুরুষ।

পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের নতুন প্রস্তাবনায় ‘পুরুষ>পক্ষ, উত্তম পুরুষ>বক্তাপক্ষ, মধ্যম পুরুষ>শ্রোতাপক্ষ, নাম পুরুষ>অন্যপক্ষ। এ বিষয়ে আমি পূর্ণপাঠ রচনা করেছ— তবে এখানে শুধু আমার সংজ্ঞায়িত সংজ্ঞাগুলো উল্লেখ করলাম—

পক্ষ : ক্রিয়াপদ নিষ্পন্ন করে সর্বনাম পদের স্বঅবস্থান নিরূপণ করাকেই পক্ষ বলে।

ক. বক্তাপক্ষ : কর্তা নিজেকে বুঝাতে যে সর্বনাম পদ ব্যবহার করে, তাকে বক্তাপক্ষ বলে।

খ. শ্রোতাপক্ষ : কাউকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলতে যে সর্বনাম পদ ব্যবহার করা হয়, তাকে শ্রোতাপক্ষ বলে।

গ. অন্যপক্ষ : কর্তা অনুপস্থিত কারো উদ্দেশ্যে কোনো কিছু বলে, তা বুঝাতে যে সর্বনাম পদ ব্যবহার করা হয়, তাকে অন্যপক্ষ বলে।



‘আমি’ ও ‘তুমি’ ছাড়া আর সব সর্বনাম পদই অন্যপক্ষ।



‘লিঙ্গ’ ব্যাকরণের একটি অধ্যায়। একটি পাঠক্রম।



বৈয়াকরণিকভাবে ‘লিঙ্গ’ হলো বিশেষ্য পদের একটি শব্দরূপ—যা পুরুষ নারী পার্থক্য চিহ্নিত করে। ভাষায় লিঙ্গের ব্যবহার অনিবার্য। কোনো ভাব প্রকাশ করতে পুরুষ-নারীত্বের স্বরূপটাও ভাবের একটা মৌলিক অংশ। পুরুষ-নারীর স্বরূপটাকে চিনিয়ে দিতে ভাষাবিজ্ঞানীরা ব্যাকরণের একটি অধ্যায় ‘লিঙ্গ’ উপস্থাপন করেছেন। লিঙ্গ কিন্তু বাংলা ভাষার একটি প্রচলিত শব্দ। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ব্যবহারিক বাংলা অভিধানের একাদশ মুদ্রণ ২০০৯-এর ১০৫৬ নং পৃষ্ঠায় বর্ণিত ‘লিঙ্গ’ শব্দের আভিধানিক প্রধান অর্থ হলো ‘পুরুষের জননেন্দ্রিয়’। এরপর অভিধানে আরও যে অর্থ পাওয়া যায় তার একটি হলো ‘হিন্দুদের শিবলিঙ্গ মূর্তি'। এ শিবলিঙ্গ কী? তারও ব্যাখ্যা একই অভিধানের ১০৮০ নং পৃষ্ঠায় পাওয়া যায় এভাবে— ‘প্রস্তর মৃত্তিকাদি দিয়ে গঠিত শিবের লিঙ্গরূপ মূর্তি।’ বাংলা একাডেমী প্রকাশিত বাংলা-ইংরেজি অভিধানের ১৭তম মুদ্রণ ১৯৯৭-র ৭৩২ নং পৃষ্ঠায় ‘লিঙ্গ' শব্দের ইংরেজি রূপান্তর— ‘সাইন অব সেক্স’, ‘পেনিস’, ‘অর্গান অব জেনারেশন’। এ ছাড়া ‘মার্ক' ‘সাইন’ও বলা হয়েছে। তবে ‘পেনিস’, ‘সাইন অব সেক্স’ ইত্যাদি প্রাধান্য পেয়েছে। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ইংরেজি-বাংলা অভিধানের ৩২তম মুদ্রণ ২০০৯-এর ৫৬২ নং পৃষ্ঠায় পেনিস-এর বাংলা অর্থ বা বাংলা শব্দ হলো ‘পুং জননেন্দ্রিয়’, ‘লিঙ্গ’। আর কোনো অর্থ বা প্রতিশব্দ নেই। ইংরেজি ব্যাকরণে ‘লিঙ্গ' অধ্যায়টা ‘জেন্ডার’। একই ইংরেজি-বাংলা অভিধানের ৩১১ নং পৃষ্ঠায় ‘জেন্ডার’-এর আভিধানিক অর্থ ‘শব্দের ব্যাকরণগত শ্রেণিবিন্যাস।’ এরপর ব্র্যাকেটে দিয়েছে পুরুষ, স্ত্রী, ক্লীব। ‘জেন্ডার’ ভাবগত অর্থে অবশ্য অন্যভাবে ব্যবহার হয়। আরবি ব্যাকরণে ‘লিঙ্গ’ অধ্যায়টা ‘জিন্স’। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত আরবি-বাংলা অভিধানের ২য় খ- ২য় মুদ্রণ নভেম্বর ১৯৯৯-র ১১১৯ নং পৃষ্ঠায় ‘জিন্স’-এর মূল আভিধানিক অর্থ বর্ণিত হয়েছে—‘বংশ, জাতি, প্রকার, প্রণালী, স্বভাব, প্রকৃতি'। ইংরেজি অভিধানে জেন্ডারকে কিন্তু সরাসরি ‘জননেন্দ্রিয়’ অর্থে অর্থায়িত করে নি। জেন্ডার আভিধানিক কিংবা ব্যাকরণগত উভয় অবস্থানেই পুরুষ, স্ত্রী চিহ্নিত করে মাত্র। একইভাবে আরবি অভিধানেও জিন্সকে সরাসরি ‘জননেন্দ্রিয়’ অর্থে অর্থায়িত করে নি। এ ভাষাতেও জাতি, প্রকার, প্রণালী, স্বভাব, প্রকৃতি ইত্যাদি ভাবার্থে নর-নারীর রূপগত পার্থক্য নিরূপণ করেছে।

‘লিঙ্গ’ শব্দের বাংলা অর্থের মৌলিকতা এটি মানুষের বিশেষ করে পুরুষের জননেন্দ্রিয়। এ শব্দের মাধ্যমেই বাংলা ভাষায় পুরুষত্বকে চিহ্নিত করা হয়। তাই এর বিপরীত ‘স্ত্রী’। এটাও কি ঠিক? পুরুষের বিপরীতটা কি ‘স্ত্রী' নাকি ‘মাহিলা'? প্রচলিতভাবে আমরা জানি ‘স্ত্রী’র বিপরীত ‘স্বামী’ আর ‘পুরুষের’ বিপরীত ‘মহিলা’— বড়জোর ‘নারী’ও বলতে পারি। আর ব্যাকরণে এসে পুরুষের বিপরীত ‘স্ত্রী’ অর্থাৎ ‘পত্নি’ হয়ে গেল। পত্নি আর নারী বা মহিলা কিন্তু এক নয়। যেমন ‘ভাই’ এটি পুরুষ রূপ। তাহলে এর ‘স্ত্রী' রূপ ‘বোন’ না ‘ভাবী'? ‘বোন’ ও ‘ভাবী’র অর্থগত অবস্থানে বেশ পার্থক্য আছে। আবার মনে করি একটি প্রতিষ্ঠানের দুই জন সদস্য। একজন পুরুষ। অপরজন মহিলা। পুরুষজন ‘সদস্য' আর এর স্ত্রীলিঙ্গ ‘সদস্যা’। তার মানে তিনি কি পুরুষ সদস্যজনের ‘স্ত্রী’? দেখা যায় লিঙ্গ অধ্যায়ে ব্যবহৃত এই ‘স্ত্রীলিঙ্গ’ শব্দটির প্রয়োগও কিন্তু অসংগত, যথাযথ নয়।

বাংলাদেশে বাংলা ভাষার পরই আবশ্যক ভাষা ইংরেজি। আর আরবি ভাষা প্রায় আবশ্যিকই। এ দুই ভাষাতে নর-নারীর রূপগত পার্থক্য নিরূপণে ব্যাকরণগত শব্দটি সরাসরি কিন্তু ‘জননেন্দ্রিয়’ অর্থে প্রয়োগ হয় নি। শুধু আমাদের বাংলা ভাষায় এমনটি করা হয়েছে। বাংলা ভাষার ‘লিঙ্গ’ শব্দটি মূলত একটি বিব্রতকর শব্দ। শালীনতা বর্জিত শব্দ। আবার ‘স্ত্রীলিঙ্গ’— এটিও যথাযথ প্রয়োগ নয়। এমন বিব্রতকর ও শালীনতা বর্জিত একটি শব্দের উপর ভিত্তি করেই ব্যাকরণের একটি অধ্যায়, ধারা গড়ে উঠেছে। আমরা বাংলা ভাষাভাষীরা কি আমাদের আবশ্যক ভাষা শিক্ষা থেকে এমন বিব্রত ও শালীনতা বর্জিত এবং অসংগত শব্দ থেকে মুক্তি পেতে পারি না?

‘লিঙ্গ’র পরিবর্তে একটি যুৎসই শব্দ প্রয়োগে ‘লিঙ্গ’ অধ্যায়ের পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। ‘পুরুষ’এর বিপরীত ‘স্ত্রী’— এ অসামঞ্জস্যতাও নিরসন করা দরকার। আমার প্রস্তাবে ‘লিঙ্গ’র পরিবর্তে ‘বাচক’ আর রূপগত ‘স্ত্রী’ শব্দটা ‘নারী’ হবে।

‘বাচক’ শব্দের অর্থই ‘অর্থ প্রকাশক রূপ’। বাচকের আরও অর্থ ‘দ্যোতক’ও হয়, ‘বোধক’ও হয়, ‘সূচক’ও হয়। ‘দ্যোতক’ অর্থই প্রকাশক, দীপ্তিমান, সূচক; এর মানেই যা কোনো কিছুকে চিহ্নিত করে, দৃশ্যমান করে। এমন অর্থটাই বুঝতে পারি দ্যোতক থেকে। ‘বোধক’ অর্থ বুঝতে পারা বা উপলব্ধি করা। আর ‘সূচক’ মানেই ‘চিহ্ন’। অতএব, যে উপলব্ধিতে আমরা অর্থ প্রকাশক রূপ বা স্বরূপ বুঝতে পারি বা চিহ্নিত করতে পারি, সেটাই আভিধানিক অর্থে ‘বাচক’। বাচকের সকল সামর্থক শব্দের অর্থও একই ভাবার্থ বহন করে। এর অন্য কোন অমার্জিত বা বিব্রতকর অর্থ নেই। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে আর রাজশেখর বসুর চলন্তিকা বঙ্গভাষার অভিধানে বাচকের এ অর্থগুলো পাওয়া যায়। তাই বিশেষ্য পদে যখন কোনো শব্দের রূপটা অর্থ প্রকাশে পুরুষ অর্থাৎ নর কিংবা নারী ইত্যাদি রূপগত পার্থক্য চিহ্নিত করে; এমন রূপগত অর্থ প্রকাশের ধরনটাই ‘বাচক’ হতে পারে— যাকে আমরা এতদিন ‘লিঙ্গ’ বলে জানি। তাই ‘লিঙ্গ’ পরিবর্তীত হয়ে পরিশীলিত শব্দ ‘বাচক’ করা আমি মনে করি অধিকতর যুক্তিযুক্ত। পাঠক্রমের ধারায় আমরা বাচককে সংজ্ঞায়িত করতে পারি এভাবে, “বিশেষ্য পদে কোনো শব্দ অর্থ প্রকাশে নর-নারী ইত্যাদি রূপগত পার্থক্য চিহ্নিত করে, তাকে বাচক বলে।”

‘বাচক’ দ্বারা আমরা শব্দের রূপগত পার্থক্য চিহ্নিত করি। বাচকের শ্রেণিবিন্যাসে এটি পাঁচ প্রকার। নরবাচক, নারীবাচক, উভবাচক, নিত্যবাচক এবং অবাচক। নরবাচক তো শব্দের পুরুষ বা নর রূপটা। নারীরূপটা নারীবাচক। নারীবাচকও আবার দুই প্রকার। একটি জাতি নারীবাচক অন্যটি পত্নি নারীবাচক। যেমন ‘বন্ধু’ নরবাচক এ শব্দটির জাতিগত নারীবাচক রূপ ‘বান্ধবী’ আর পত্নিগত নারীবাচক রূপ ‘বন্ধুপত্নি’। ‘বান্ধবী’ আর ‘বন্ধুপত্নি' কিন্তু এক অর্থ বহন করে না। আবার ভাসুর বা দেবর শব্দটা দেখি। এরও দুইটি নারীবাচকতা আছে। জাতিগত নারীবাচক ‘ননদ’ আর পত্নিগত নারীবাচক ‘জা'। এভাবে আমাদের প্রাত্যহিক ব্যবহার্য অনেক শব্দই আছে যেগুলোর দুইটি নারীবাচকতা আছে।

কিছু কিছু শব্দ আছে যেগুলোর শুধু একই বাচক হয়, বিপরীত বাচকতা নেই। যেমন ‘বিধবা’। এটি শুধু নারীবাচক, এর নরবাচকতা নেই। ‘কা-পুরুষ’ এ শব্দটি শুধু নরবাচক, এর নারীবাচকতা নেই। এমন শব্দগুলোই নিত্যবাচক। নিত্যবাচকও দুই ভাগ; নরনিত্যবাচক আর নারীনিত্যবাচক।

কিছু শব্দরূপ আছে যেগুলোতে নর-নারী উভয় রূপই চিহ্নিত করে। যেমন ‘মানুষ'। মানুষ বলতে নর বা নারী উভয়টাই বুঝায়। ‘শিশু' বলতেও তেমনি। এমনসব শব্দরূপই উভবাচক।

আবার কিছু শব্দরূপ আছে যেগুলোতে নর-নারী কোন বাচকতাই প্রকাশ করে না। যেমন ‘বই’। এটি নরও নয়, নারীও নয়। ‘হিজড়া’ মানুষ হলেও ওরা নর নয়, নারীও নয়। এমনসব শব্দগোষ্ঠীই অবাচক।

ভাষার উৎকর্ষতা আর বিবর্তনে এখন অনেক শব্দরূপ আছে, যেগুলোর বাচকতা থাকা সত্তেও অপরিবর্তীতভাবে ব্যবহৃত হয়। সমাজ বাস্তবতায় সেসব শব্দের বাচকতা অপরিবর্তনীয় রাখাটাই যুক্তিযুক্ত। যেমন ‘চেয়ারম্যান'। এটি নরবাচক। প্রচলিত ব্যাকরণের রীতিতে এর নারীরূপ ‘মহিলা চেয়ারম্যান’। ‘সভাপতি’র নারীবাচক ‘সভানেত্রী’। কিন্তু বর্তমানে সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন বিশ্বময় এগিয়ে গেছে। আর এর প্রভাব ভাষায়ও পড়েছে। রীতি-বিধিতেও পড়েছে। তাই এখন এসব শব্দরূপগুলোর বাচকতা অপরিবর্তীত রয়ে গিয়ে ‘মহিলা চেয়ারম্যান’কে শুধু ‘চেয়ারম্যান’ই বলে। ‘সভানেত্রী’কে ‘সভাপতি’ই বলে। আবার বংশীয় উপাধির নারীবাচক ‘চৌধুরানী’ এখন আর তা নয়। এখন পুরুষ-নারী উভয়েই লিখেন ‘চৌধুরী’। মূলত পেশাগত আর বংশগত পদবীগুলোর বাচকতাই অপরিবর্তনীয় থেকে নর-নারী উভয় বাচকে একই রূপে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর তাই এগুলোকে ‘অপরিবর্তনীয়বাচক’ বলতে পারি। বাচকের এটি একটি নতুন অর্থাৎ ষষ্ঠতম শ্রেণিবিন্যাস।

অপরিবর্তনীয়বাচকের কিছু শব্দ তালিকা দেওয়া হলো : বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী, সংসদনেতা, উপাচার্য, অধ্যক্ষ, প্রধানশিক্ষক, ব্যারিস্টার, মহা-পরিচালক, পরিচালক, মহা-ব্যবস্থাপক, ব্যবস্থাপক, চেয়ারম্যান, মেম্বার, উকিল, ডাক্তার, প্রকৌশলী, কেরাণি, সভাপতি, সম্পাদক, মন্ত্রী, কবি, চৌধুরী, সৈয়দ, খান, ইত্যাদি। এ জাতীয় শব্দগুলো নর-নারী উভয় বাচকে অপরিবর্তীত থাকছে।

‘বাচক’ সাধারণ বহুল ব্যবহার্য কোনো শব্দ নয়। বলতে পারি, অনেকটাই অব্যবহৃত শব্দ। ‘লিঙ্গ’ ব্যাকরণ ছাড়াও সাধারণভাবে জননেন্দ্রিয় অর্থেও ব্যাপক ব্যবহার হয়। তখন এটি বিব্রতকর শব্দ, আর ব্যাকরণে পাঠের সময় বিব্রতভাবকে হজম করে স্বাভাবিক ভাবকে ভাবতে হয়। এটা একটা অর্থগত বিভ্রান্তিও বটে। কিন্তু ‘বাচক’-এর কোনো বিব্রতকর অর্থদ্যোকতা নেই। ফলে অর্থগত বিভ্রান্তি ছড়াবে না। সাধারণ ব্যবহার্য নয় বলে শুধু ব্যাকরণগত শব্দ হয়ে উঠলে এর বৈয়াকরণিক স্বাতন্ত্র্যও বজায় থাকবে। চমৎকার ব্যাকরণবিধিগত শব্দ হয়ে উঠবে। আবার পরিশীলিত শব্দ মার্জনে একটি অধ্যায়ও পুনর্গঠিত হবে। এভাবেই ‘লিঙ্গ’কে ‘বাচক’-এ পরিবর্তন করে একটি সম্পূর্ণ অধ্যায় পরিমার্জন ও পুনর্গঠন করা যায়।

আমি প্রস্তাব করছি এভাবে পরিমার্জন করলে বিব্রতকর আর শালীনতা বর্জিত শব্দ ‘লিঙ্গ’কে পাশ কাটিয়ে আমরা একটি পরিশীলিত শব্দযোগে মার্জিত অধ্যায় পেতে পারি। আর মার্জিত এ অধ্যায় ব্যাকরণ শিক্ষাকে আরও পরিশীলিত করবে। বাংলা ব্যাকরণ আরও স্বাতন্ত্র্য উৎকর্ষতায় এগিয়ে যাবে। প্রস্তাবনার স্বপক্ষে এমন প্রত্যাশাই করছি আমি।



#



আরও দেখুন : লিঙ্গ’-এর বৈয়াকরণিক পরিবর্তন : একটি প্রস্তাবনা

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ৯:০৯

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: ইন্টারেস্টিং প্রস্তাব। ভেবে দেখার মতো।

২৬ শে এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ৭:১৭

নাসীমুল বারী বলেছেন: ধন্যবাদ।
প্রস্তাবটিতে আপনার সমর্থন আছে জেনে ভাল লাগল।
শুভ কামনায়-

২| ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ৯:৪২

ভারসাম্য বলেছেন: পুরুষকে ছেঁটে বিভিন্ন পক্ষে ভাগ করে দেয়া হয়েছে শুনে ভাল লাগলেও, বক্তা/শ্রোতা/অন্যপক্ষ না করে প্রথম/দ্বিতীয়/তৃতীয় পক্ষ হলেই ভাল হত হয়তো।

আর ব্যাকরণ থেকে লিঙ্গোচ্ছেদ ঘটিয়ে, সেখানে বাচকতা প্রতিস্থাপন জোড়ালোভাবেই সমর্থন করি। 'বাচক' না হয়ে, 'জাতক' হতে পারে এমন কথা এলেও, আমার মতে 'বাচক' ব্যাবহারই যৌক্তিক ও সুন্দর।

ভাষা বিষয়ক লেখাগুলো ভাল লাগে অনেক। +++

২৬ শে এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ৭:৩০

নাসীমুল বারী বলেছেন: সুন্দর ও গঠনমূলক আলোচনার জন্য ধন্যবাদ।

বক্তা/শ্রোতা/অন্যপক্ষ - পক্ষের এ বিভাজনটা কিন্তু আমার প্রস্তাব নয়। এটি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েই করে ফেলেছে। আর 'লিঙ্গ' পরিবর্তন করে 'বাচক'-এর প্রস্তাবনাটা আমার। শব্দ নিয়ে লেখা ব্লগার শাবা-র প্রস্তাব ছিল 'জাতক'। সে নিয়েও আমি আমার যুক্তি তুলে ধরেছি- নিশ্চয় দেখেছেন? আপিনও 'জাতক'এর পরিবর্তে 'বাচক'কে সমর্থন করেছেন। এ জন্যও আপনাকে ধন্যবাদ।

৩| ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ৯:৪৬

দালাল০০৭০০৭ বলেছেন: ভাল

২৬ শে এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ৭:৩৩

নাসীমুল বারী বলেছেন: পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

৪| ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১১:৫৪

বেলা শেষে বলেছেন: .....if i write - it will heat...& after heat ---every Body will beand- i too....so better nothing to say!

৫| ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৪ বিকাল ৫:০৩

দেশ প্রেমিক বাঙালী বলেছেন: চমৎকার লাগলো।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.