![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ঢাকার আজিমপুরে জন্মেছি। বেড়েও উঠেছি এখানে। ঐতিহ্যবাহী ওয়েষ্ট এন্ড হাই স্কুল থেকে এসএসসি সনদপ্রাপ্ত আমার পৈত্রিক নিবাসটা কিন্তু ‘ইলশে পাড়া’- চাঁদপুরের হাজিগঞ্জ উপজেলার সাদরা গ্রামে।
।। নাসীমুল বারী ।।
রাত গভীর।
পাশে শোয়া মিলিকে বিছানায় রেখেই রাসেল বারান্দায় আসে। চৈত্রের ঝির ঝির বাতাস বইছে। পূর্ণ যৌবনা চাঁদও তার দ্যুতি বিছিয়ে দিয়েছে ধরণীতে। ক'টি কালো বাদুর এলোমেলো উড়ে চলে গেল। চাঁদের রূপোলি সৈকতে কালো বাদুড়ের ওড়োওড়ি অপূর্ব এক আলপনা তৈরি করেছে। রাসেল তন্ময় হয়ে দেখছে প্রকৃতির এ অপরূপতা।
মনটা ভালো নেই কাল দুপুর থেকেই। ঘুম আসছিল না বলেই একাকী বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। রাত আর চাঁদের নৈসর্গিক মিতালিতে কিছুটা স্বস্তি খুঁজতে চেষ্টা করে রাসেল। কিন্তু স্বস্তি আসছে না। সমস্যা আর নৈসর্গিক রোমাঞ্চের অনুভূতির ফারাকটা একটু বেশিই, তাই স্বস্তি পাচ্ছে না। নতুবা পাশে শোয়া চিরতরুণী, গভীর ভালোবাসার ধন মিলিকে নিয়েই রাতের এমন অনুভবটা উপভোগ করতো রাসেল।
এখন পারেছে না।
মিলি টের পায়। মাথাটা উঠিয়ে দেখতে চেষ্টা করে রাসেলকে। আনমনে সে চাঁদ দেখছে। ‘ওমা একি!'—মনে মনে বলে মিলি। ‘পড়ন্ত যৌবনের এ বয়সে আজ এভাবে চাঁদ দেখছে কেন? আমাকে না জানিয়েই বা ওভাবে একা একা বারান্দায় কী রোমান্টিকতা খুঁজছে?'
ভাবতে ভাবতেই বিছানায় উঠে বসে মিলি।
রাসেল আর মিলির সুন্দর সংসার।
সুখেরও বটে।
সামাজিক মর্যাদায়, শিক্ষায়, পারিবারিক ঐতিহ্যে দুজনেই সমান। পেশাগতভাবে মিলি অধ্যাপনা করে। রাসেল শিল্পপতি। সমাজের উঠতি শিল্পপতি। শিক্ষার সাথে সমন¦য় করেই কাপড় বুননের শিল্প গড়ে তুলেছে। ছেলে-মেয়ে দুজনেই আজ শিক্ষায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে। আর ভালোবাসায় দুজনের মনের যোগটাও বেশ গভীর। কিন্তু এখন কী হলো - - !
ভাবছে মিলি।
কী হতে পারে? শরীরটা কি ভালো নেই? গালে হাত দিয়ে ভাবছে।
প্রায় বিশ মিনিট পেরিয়ে গেল। রাসেলের কোনো ভাবান্তর নেই। ডাকবে নাকি কাছে যাবে—তা-ই ভাবছে মিলি।
ক্ষণিক পরেই পা টিপে টিপে ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। রাসেলের কোনো চেতনা নেই। আনমনে তাকিয়ে আছে বারান্দার গ্রিল গলিয়ে চাঁদটার দিকে।
মিলি আলতো করে ওর পিঠে হাত রাখে।
চমকে ওঠে রাসেল। তারপর ঘুরে ওর দিকে তাকিয়ে একটু ভরা গলায় বলে, তুমি! তুমি এখানে কেন? তুমি না ঘুমিয়ে ছিলে?
—হুঁ।
—তাহলে এলে কেন?
—কেন, এখানে আসা কি নিষেধ?
থেমে যায় রাসেল। ক্ষণিক চুপ থেকে শান্ত কণ্ঠে বলে, না, মানে কী দরকার ঘুম নষ্ট করে এখানে দাঁড়িয়ে থাকার?
—তোমার ঘুম নষ্ট হচ্ছে না?
—হচ্ছে। মানে ঘুমই তো আসছে না। তাই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি।
—কেন ঘুম আসছে না?
—এমনিতেই।
—তোমার ঘুম না এলে আমি কি ঘুমাতে পারি?
একটু মুচকি হেসে বলে মিলি। নিরালা একাকীতে মিলির এমন হাসিতে রাসেল কী অনুভবই না প্রকাশ করত; আজ করে নি। এমনকি কোনো জবাবও দেয় নি। মুখটা ঘুরিয়ে আবার চাঁদের দিকে তাকায়। ফিসফিসিয়ে বলে, চাঁদের মতো এ সমাজ-জীবনটাও যদি সুন্দর হতো . . .! তারপরই নরোম কণ্ঠে মিলিকে বলে, যাও ঘুমিয়ে পড়ো। আমার একটু দেরি হবে।
—কেন?
—যাও না, তুমি শুয়ে পড়ো। আমার ভালো লাগে না, একটু পরে আসছি। তুমি যাও।
—তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?
—না।
—কোনো সমস্যা হয়েছে? ইন্ডাস্ট্রিজে সমস্যা? শ্রমিক সমস্যা?
—না, ওসব কিছু না। প্লিজ মিলি যাও। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।
মিলি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে বিছানায় চলে আসে। চিন্তা ঝেড়ে শুয়ে পড়ে। ক্ষণিকেই ঘুম এসে যায় ওর।
প্রতিদিনের মতোই সকালে ওঠে দুজনে।
নামায পড়ে।
নাস্তা আর সংসারের কাজে লেগে যায় মিলি। রাসেল গিয়ে আবার শুয়ে পড়ে বিছানায়।
চমকে যায় মিলি।
রাসেল ঘুমোচ্ছে! এটা তো ওর স্বভাব অনুমতি দেয় না। সকালে ও ঘুমোবে না, বাসায় কাউকে ঘুমোতেও দেবে না। ঘুমোলে ভীষণ রাগ করে। অসুস্থ শরীর হলে অবশ্য ভিন্ন কথা। এ ব্যাপারটাই মিলির কাছে কষ্টের। খারাপ। দীর্ঘ সংসার জীবনে শুধু এ ব্যাপারটা নিয়েই মন খারাপের ঘটনা ঘটে। মান অভিমান হয়।
আজ যে ভিন্নতা! রাসেলই ঘুমিয়ে পড়েছে সকালে।
ভাবছে মিলি। আর মনে মনে ভাবছে, শরীরটা নিশ্চয় খারাপ। বলছে না হয়ত। মায়া জাগে ভীষণ রাসেলের প্রতি। রাত থেকে কী অভাবনাই না ভেবেছে ওর এমন আনমনা অভিব্যক্তিতে। রান্নাঘর থেকে রাসেলের পাশে এসে বসে। মাথায় আলতো হাত রাখে। রাসেল জেগে যায়। ঘুরে ওর দিকে তাকায়। মিলি নরোম কণ্ঠে বলে, শরীরটা খারাপ বুঝি? আমাকে বলছ না কেন? ডাক্তারের কাছে যাবে?
—না।
—তবে যে আবার বিছানায়?
—মনটা ভালো নেই।
—কেন? কী হয়েছে মনের? রাত থেকেই বলছ ও কথা?
—আছে অনেক ব্যাপার। তুমি বুঝবে না ওসব। আচ্ছা নাস্তা হয়েছে?
—হচ্ছে, আর কিছুক্ষণ।
—রুটি আর সবজি?
—হুঁ।
—নাস্তা রেডি করে ডাক দিও। জুঁই, সৈকত ওরা কি ক্লাসে চলে গেছে? তুমি যাবে কখন?
—রেডি হচ্ছে ওরা। নাস্তা হলে ডাকবো মানে? গোসল করবে না?
সাথে সাথে উঠে বসে রাসেল। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলে, লুঙিটা দাও।
মিলি লুঙি আনতে ওয়ারড্রোব খোলে।
রাসেলের মনটা কেন ভালো নেই, কী ঘটেছে? কিছুই তো জানাচ্ছে না। আর জানার জন্যে পীড়াপীড়ি করবে? না, এটাও এখন দরকার নেই। ও একটু স্বাভাবিক হোক, তখন নিজেই বলবে সব কথা। এটাই রাসেলের স্বভাব।
শরীর খারাপ না হলে ফ্যাক্টরিতে নিশ্চয় কোনো সমস্যা হয়েছে।
টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ— বন্ধু মারুফ আর রাসেল গড়ে তোলার মূল কারিগর। এরপরও আছে পরিচিতজন অনেকে। মিলিও এর একজন অংশীদার। বাংলাদেশের ব্যবসার ধরন অনুযায়ী পারিবারিক বা একান্ত নিজস্ব গ-ি থেকেই প্রথমে শুরু হয়। তারপর বৃহত্তর গ-িতে পাবলিক প্রতিষ্ঠানও হয়ে যায়। সে পথেই এগুবে রাসেলরা। কিন্তু শুরুতেই একটা হোঁচট খেয়েছে—এটা জানে মিলি। গত পাঁচ বছর দফায় দফায় বিদ্যুতের মূল্য বেড়েছে। গ্যাসের জোগান পায় নি। উৎপাদনের গোড়াতেই বাধা। দেশের অর্থনীতির মন্দার প্রভাবে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে। সুতা আমদানিতে ব্যয় হচ্ছে প্রচুর। শ্রমিকরাও মাঝে মাঝেই কর্মবিরতিতে যায়। রাজনৈতিক অস্থিরতায় হরতালে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে অনেক। সরকারের আমদানি নীতির কারণে আমদানিকৃত একই মানের কাপড়ের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। বাজারকে অস্থিতিশীল আর একপেশে করে ফেলেছে।
দফায় দফায় ওরা বোর্ড মিটিং করছে। ব্যবসাকে গতিশীল করতে কোনো সুযোগই আসছে না। সরকারি উদ্যোগ শুধু নীতিকথায়, বাস্তবে নয়। বাজার পরিস্থিতির এমন জটিল পর্যায়ের যোগ-বিয়োগে ব্যবসা মন্দাধারায় প্রবাহিত। ব্যাংকঋণের দায়-ব্যারোমিটারটা বেড়েই চলছে।
এ ঘটনাগুলো কিন্তু চার-পাঁচ বছরের ধারাবাহিক। এ জন্যে আজই মন খারাপ হওয়ার কিছু নয়। মন খারাপ হতে পারে না।
রাসেলের কখনো মন খারাপ হলে মিলি চুপ থাকে। একটু সময় পর ও স্বাভাবিক হয়। তারপর মন খারাপের সব বিষয় খুলে বলে। এখনও তাই হবে। রাতে বাসায় আসুক, হয়ত ততক্ষণে ও স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তখনই সব শোনা যাবে।
মিলি আর কোনো ভাবনা না ভেবে লুঙিটা এনে দেয়। ঠিক তখনই ওর মোবাইলটা বেজে ওঠে। ফোনটা রিসিভ করে রাসেল বলে, এখন কথা বলতে পারব না। অফিসে এসে নেই, তারপর। অফিসে এসে আমিই ফোন দেব।
মোবাইলটা রেখে গোছলে ঢোকে রাসেল।
মিলি আনমনে মোবাইলটা তুলে রিসিভলিস্টটা দেখে। ‘তানিয়া ম্যাডাম' নামে একজন ফোন করেছে।
‘তানিয়া'! চমকে যায় মিলি। তার সাথে এখন কথা বলবে না, অফিসে গিয়ে কথা বলবে। মানেটা কী?
রাসেলের শরীর খারাপ নেই। ব্যবসায় সমস্যা নেই। শুধু শুধু মন খারাপ হবে কেন তাহলে? তবে তানিয়ার জন্যেই কি আজ মন খারাপ? রাজ্যির ভাবনা এসে জমে মনে। কে এই তানিয়া? বয়স কত? বসে বসে ভাবছে।
মিলির মনটাও খারাপ হয়ে যায়। সাথে ঔৎসুক্যও জন্ম নেয় তানিয়াকে নিয়ে। কে ও? কী করতে চায়? না, এখন কোনো কথা বলবে না এ বিষয়ে। চুপি চুপি পর্যক্ষেণ করবে রাসেলের গতিবিধি। আচরণ।
রাতে বাসায় আসে রাসেল।
বর্ষার মেঘলা আকাশের মতোই ভার। খুব একটা কথা বলছে না। কী যেন ভাবছে শুধু। খাওয়া দাওয়ায়ও একটু অন্যমনস্ক।
খাওয়া শেষে টিভি দেখতে আসে রাসেল।
পাশে এসে বসে মিলি।
রাসেল তো এমন না। বাইশ বছরের সংসার জীবনে কোনো দিন তো রাসেলকে অসংলগ্ন কিছু দেখে নি। আজ কেন?
টিভি স্ক্রলে ব্রেকিং নিউজ— ‘আগামীকাল থেকে ৩৬ ঘণ্টার হরতাল।'
—ধ্যাৎ!
বিরক্তিতে উঠে দাঁড়ায় রাসেল। কোনো কথা নেই। আবার ফোন বেজে ওঠে। রাসেল রিসিভ করে বলে, মারুফ?
ফোনে কথা বলতে বলতে বারান্দায় চলে আসে রাসেল। ‘কেন সামনে কথা বলছে না' ভাবে মিলি। তাই সতর্ক হয়ে শুনতে চেষ্টা করে রাসেলের কথা। রাসেল মারুফকে বলছে, বারবার ভাবছি। আমি সত্যি রাজি নই। তোরা রাজি হলেও আমি রাজি নই। আমি এ বিষয়টা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। প্রয়োজনে তানিয়ার সাথে আলাদা একাকী কথা বলব।
কথা শেষ হতে হতে চলে আসে বেডরুমে। ফোনটা বিছানায় রেখে একটু বসে। তারপর ওয়াশরুমে ঢোকে।
এতোক্ষণের কথাগুলো শুনছে মিলি।
হিসাব মেলাতে পারছে না।
তানিয়ার সাথে ওর একাকী কী কথা! ও কী সিদ্ধান্ত নিতে পারেছে না? নাকি মারুফই তানিয়াকে ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে? কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। যদি মেনেই নেয় তানিয়াকে, তবে বয়স আর সন্তানাদি নিয়ে যে সামাজিক অবস্থান— ও মুখ দেখাবে কীভাবে সমাজের কাছে? কলেজ করবে কীভাবে?
এমন ভাবনায় মনটা ভালো থাকে কারও?
কেটে গেল এভাবে এক সপ্তাহ।
রাসেল আগের মতোই।
নীরবতা ওকে ভর করেছে। কথা কম বলে। হাসিখুশি ভাব নেই। কেমন যেন আনমনা।
রাসেল তো এমন না।
দারুণ ফূর্তিবাজ ছেলে। সবসময় হাসিখুশি। রাগ করে খুবই কম। কখনো মন খারাপ হলেও একটা সময় পর সব ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু এবার সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে, এখনো একই রকম। তা হলে কী হতে পারে? মিলি চুপি চুপি মোবাইলের ডায়াল আর কললিস্ট দেখে। উভয়টাতেই তানিয়ার নাম্বারটা আছে। সময়ও লম্বা। এতো সময় ধরে কী কথা বলে?
প্রতিদিনের মতোই অফিসে ঢোকে মারুফকে ডাকে রাসেল। রাসেল কোম্পানির চেয়ারম্যান, মারুফ এমডি। মারুফ ঢোকে। সামনের চেয়ারটায় বসে। তারপর কথা তোলে, তানিয়া ম্যাডামের সাথে কথা বলতে হবে তো?
—হাঁ, উনি তো প্রতি মাসে একলক্ষ মিটার কাপড় নেবেন। কিন্তু তার দরটা . . .।
কথা শেষ হয় না রাসেলের। মারুফ থামিয়ে বলে, দর তো ভালোই। কিন্তু তুমি কি তার শর্ত মনছো? তার শর্ত মানলেই তো চুক্তি হয়ে যায়। পেমেন্টও ভালো— ক্রস চেকে ক্যাশ পেমেন্ট। প্রয়োজনে অগ্রিমও। আমরা প্রোডাকশনের সময় কাপড়ের লট নাম-নাম্বারে তাদের দেওয়া বিদেশি কোম্পানির নাম লোগো করে দের। এটুকুতে আর সমস্যা কী? কেন রাজি হচ্ছ না?
টেবিলে কলম ঠুকতে ঠুকতে রাসেল বলে, এখানেই আমার সমস্যা। এ ক'দিন ভেবেও এর সাথে একমত হতে পারি নি। আমাদের ব্যবসা, রাষ্ট্রীয় নীতি— সবকিছুর সাথে আমি ঠকের কাজ করছি। সবাইকে ঠকাচ্ছি— এটা তো হতে পারে না। আচ্ছা জরুরি বোর্ড মিটিং ডাকো।
সন্ধ্যায় জরুরি বোর্ড মিটিং।
মিলি ছাড়া সব সদস্যই আসে; তেরো জনের মধ্যে বারো জন। মিলির কলেজে জরুরি কাজ, তাই আসতে পারে নি। সভার প্রধান এজেন্ডাই নিজেদের কাপড়ে বিদেশি কোম্পানির নাম-লোগো লাগিয়ে দেওয়া। সব সদস্যই কথা বলে। চেয়ারম্যান রাসেল ছাড়া সবাই তানিয়া ম্যাডামের প্রস্তাবে রাজি। রাসেল একদম রাজি নয়। রাসেলের কথা, আমরা তিনটি অন্যায় করছি তাতে। এ কাপড় দিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী-ভোক্তাদের চরমভাবে ঠকাচ্ছি। দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছি। ফৌজদারি অপরাধ করে আমার দেশের কাপড়ে অন্য দেশের নাম লিখছি। আমি এ মহা ঠকের কাজ করতে পারব না। যদিও লোকসান কাটিয়ে আমাদের অতিরিক্ত লাভ হবে।
বোর্ডের সদস্য কাইউম আহমেদ বলেন, দেখুন গত ক'বছর ধরেই আমরা লোকসানে আছি। আমাদের প্রোডাক্ট বাজার পেতে কষ্ট হচ্ছে। সেখানে এখন নিশ্চিত বিক্রি, দরও ভালো— আমাদের ক্ষতি কোথায়? আর আপনি ভোক্তাদের কথা বলছেন, তারা তো আমাদের সর্বোচ্চ মানের কাপড়ই পাচ্ছে। আমরা মান তো কমাচ্ছি না, তবে তাদের ঠক কোথায়?
রাসেল গম্ভীরভাব নিয়ে বলে, কাপড়টা কার? দোকানিরা কোন দেশের কাপড় বিক্রি করছে? ভোক্তা কোন কাপড় কিনছে? এসব কি ঠক নয়?
—কেন, দেশ যা-ই হোক, কাপড় তো আমাদের। আমাদের কাপড়ই কিনছে ভোক্তা। দেশের টাকা দেশেই থাকছে।
—না, সবাই জানছে এটা বিদেশি কাপড়। এটাই তো বড় প্রতারণা। বড় অপরাধ। আমরা দেশের, রাষ্ট্রিক সব সুযোগ নিয়ে প্রচার করছি, গুণ গাচ্ছি অন্য দেশের। দেশের সাথে, ভোক্তাদের সাথে এমন প্রতারণা, ঠক অন্তত আমি করতে পারবো না। আমার বাবা আমাকে প্রতারক-ঠক হওয়ার জন্যে জন্ম দেন নি। মীরজাফর আর আমার মধ্যে তফাৎ কী? মনে রাখবেন, আগে পেশার সততা, তারপর মুনাফা।
—রাখেন আপনার নীতিকথা! আগে নিজে বাঁচি, পরে নীতি।
একটু রেগেই বলেন কাইউম সাহেব। তার সাথে সায় দেয় আরও ক'জন। মারুফ শান্ত কণ্ঠে বলে, চেয়ারম্যান সাহেব আপনি একটু ভাবুন। স্বার্থ সবারই। বেঁচে থাকার স্বার্থ। আমাদের টিকে থাকার বাস্তবতা। দেশ-রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরাই তো আমাদের শিল্পকে লালন করে না। বিকাশ হতে দেয় না। আইনের গ্যাড়াকলে আমরা নিষ্পেষিত। বেঁচে থাকার জন্য আমরা বিকল্প কিছু করলে আমাদের দোষ হবে কেন?
সিদ্ধান্ত ছাড়াই মিটিং শেষ হয়।
রাসেলের ভাবনাটা আরও বেড়ে যায়। এমন ঠকবাজী প্রস্তাবে কোনো যুক্তিতেই বিবেকের কোনো সায় পায় না রাসেল। কিছুতেই নিজেকে মানাতে পারছে না। অথচ কোম্পানির সবাই রাজি। সবাই শুধু ব্যবসা চায়।
ভাবতে ভাবতে আজও বাসায় ঢোকে রাসেল।
এমন চিন্তাক্লিষ্ট রাসেলকে দেখে আর সহ্য হচ্ছে না মিলির। এক তানিয়াকে নিয়ে এতো কী ভাবছে রাসেল। খাওয়া শেষে বিছানায় আসে দুজন। মিলি ধৈর্যের শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে বলে, তোমার কী হয়েছে? তানিয়া কে?
—তানিয়া! কী তোমাকে ফোন করেছে?
—কেন?
—না, ভাবলাম তোমাকেও আবার ফোন করে কিনা?
—কেন আমাকে ম্যানেজ করার জন্যে?
—ঠিক, ঠিক তাই। তুমি ঠিক ধরে ফেলেছ। যে স্মার্ট মেয়েরে বাব্বা। তোমাকে ফোন করাও অসম্ভব কিছু না। ওর প্রস্তাবে কোম্পানির সবাই রাজি শুধু আমি ছাড়া।
—তানিয়াকে তোমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চায় সবাই, এই তো!
—অনেকটা তাই।
মিলির মেজাজ আরও চড়ে যায়।
ভীষণ মেজাজ নিয়ে বলে, সবাই মিলে তোমার সংসার ভাঙতে চায় কেন? আমি তাদের কী করেছি? তানিয়া কী তোমার সাথে তাদেরও সুখ দেবে?
একটু থমকে যায় রাসেল।
তারপর শান্ত ভাব নিয়ে রাসেল বলে, দেখ না মিলি সবাই কেমন ঠগবাজ হয়ে গেছে। আচ্ছা বলো তো মিলি, আমি কি দেশের সাথে, দেশের মানুষকে ঠকিয়ে ব্যবসা করতে পারি?
—ঠকের ব্যবসা! কী বলছ তুমি? কী যেন বললে একটু আগে তানিয়ার ব্যাপারে। সবাই তোমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চায়। আর এখন বলছ ঠকের ব্যবসা!
চমকে যাওয়ার মতো ব্যাপার মিলির চোখে-মুখে।
রাসেল নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, তানিয়ার প্রস্তাবের দায়টা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চায় কোম্পানির সবাই। আমার উৎপাদিত কাপড়ে অন্য দেশের তৈরি কথাটা লিখে দিতে হবে। বলো তো ঠকের এমন প্রস্তাবে ব্যবসা করলে মানুষের আত্মা আমাকে ক্ষমা করবে? তানিয়ার এ প্রস্তাব নিয়ে গত কিছুদিন ধরে ভাবতে ভাবতে আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি কোম্পানি থেকে পদত্যাগ করব। আমার অংশীদারিত্ব প্রত্যাহার করে নেব। এমন ঠক ব্যবসা আমি করব না। হয়তো তুমিও আজ আমাকে ভুল বুঝবে? আমি চাই তোমরটাও তুলে নাও। এ জন্যেই এতোদিন মনটা খারাপ ছিল।
জ্বলন্ত কয়লায় পানি পড়েছে। মিলির আচমকা হিম-শীতল মুখে কোনো কথা নেই। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে রাসেলের দিকে।
#
আমার অন্যান্য গল্প পড়তে টোকা দিন :
গল্প : হৃদপিন্ড
গল্প : যে বাঁশি ভেঙে গেছে
কবিতার গল্প
গল্প : প্রজাপতি
গল্প : শিশির
গল্প : বাঁশির সুরে নদীর গান
নিষিদ্ধ গল্প
©somewhere in net ltd.