নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ঢাকার আজিমপুরে জন্মেছি। বেড়েও উঠেছি এখানে। ঐতিহ্যবাহী ওয়েষ্ট এন্ড হাই স্কুল থেকে এসএসসি সনদপ্রাপ্ত আমার পৈত্রিক নিবাসটা কিন্তু ‘ইলশে পাড়া’- চাঁদপুরের হাজিগঞ্জ উপজেলার সাদরা গ্রামে।
।। নাসীমুল বারী ।।
গোছল সেরে বেরিয়েছে মিলা।
প্রকৃতির নির্যাসিত কোমলতায় বিকশিত মিলার মুখায়ব। ভেজা চুলগুলো পুরো পিঠে ছড়িয়ে আছে। টিউভওয়েলের শীতল জলের স্পর্শে এমন সজীবতা মিলাকে বেশ ফুরফুরে করে তুলেছে।
ভেজা কাপড়গুলো মেলে দিতে উঠোনে আসে। ছিটেফোঁটা ভেজা গায়ের কাপড়ে বাতাসের পরশ শীতল একটা অনুভব ছড়িয়ে দিয়েছে। এমন নির্মল পরিবেশে মনটা ভালো থাকার কথা, কিন্তু মিলার নেই। মনটা একদম ভালো নেই।
ত্রিশ পেরোয় নি এখনো বয়স।
বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেক আগে। এরই মধ্যে স্বামীর সান্নিধ্য পেয়েছে মোটে এক সপ্তাহ। বিয়ে, বৌভাত, আড়াইল্লা এবং সর্বোপরী বাসর রাত— সবই এ সাতদিন। তারপর এ অনন্ত সময় শুধু একাকী।
সাতদিন পরেই স্বামী আবদুল করিম চলে যায় আবার প্রবাসে— মধ্যপ্রাচ্যে। প্রবাসে থাকলেও প্রযুক্তির বদৌলতে দু একদিন পর পরই কথা হয়। ফোনে কথা। লম্বা সে কথা। ভালবাসার কথা। প্রাণের কথা। মান অভিমানের কথা। চাওয়া পাওয়ার কথা। সন্তানের আদর সোহাগের কথা। অর্থ প্রাযুর্যের অভাব নেই সংসারে। গ্রামিণ পরিবেশে প্রাচুর্য বেশই। সবকিছু পেলেও কিছু চাওয়া পায় না, পাওয়া সম্ভবও না।
মনটা তাই ভাল নেই।
থাকতেও পারে না। আর তাই ফাগুনের দুপুরে গোছল করা এ শীতল শরীরে ফুরফুরে বাতাসের আলতো ছোঁয়াটা মন দিয়ে অনুভব করতে পারে না। আবেগ দিয়ে অনুভব করতে পারে না।
উঠোনে ভেজা কাপড়গুলো মেলছে। বাড়ির বাইরের রাস্তাটা দিয়ে যাচ্ছে পাশের বাড়ির জয়নাল। সম্পর্ক-টম্পর্ক নেই, তবে করিমকে ভাই বলেই ডাকে। রাস্তা থেকে উঠোনটা দেখা যায়। দেখা যায় মিলাকেও। মিলাকে দেখে একটু এগিয়ে এসে নরোম কণ্ঠে বলে, ভাবী - - -!
চমকে উঠে মিলা।
মেয়েলি শরীরের ঝাঁকুনিটা বেশ স্পষ্টই হয়ে ওঠে। জয়নাল তাকায়। মিটি মিটি হাসিতে বলে, বড়লোকে বৌ, আমাগরে দাওয়াত টাওয়াত দিয়া খাওয়ান না একদিন।
মুচকি হেসে মিলা বলে, ঘরে মুরুব্বি আছে তাদেরকেই না বলবা।
মিলার হাসি আর কথার মোহময়তায় আড়ষ্ট হয় জয়নাল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকে ওর দিকে। এমন হাসিটা দেখার জন্যেই অনাহুত এ আসা ও কথা। তাই আরও একটু কথা শোনার জন্যে বলে, বিদেশি টাকার মেনেজার আপনি, আর খাওয়াইব বুঝি মুরুব্বি?
মিলা কোনো কথা না বলে বাড়ির ভেতর চলে আসে।
শাশুড়ি ওর একমাত্র সন্তান নাফিজকে গোছল করিয়ে ঘরে এনেছে। প্রায় চার বছর পেরোনো নাফিজ ঘরে ঢুকেই বলে আমি ভাত খাব না। দুধভাত খাব।
সাথে সাথে দাদী হেসে দিয়ে বলে, ভাত খাইবা না, দুধভাত খাইবা। এইটা কেমুন কথারে ভাই?
—ভাত ঝাল। দুধভাত মজা।
মা-দাদী দুজনেই হেসে দেয়। ঠিক তখনি বানদুয়ার দিয়ে আসে জয়নাল। চোখোচোখি হয় মিলার। মিলা সরে যায় ভেতরের রুমে। জয়নাল একটু জোরেই ডাক দেয়, চাচী, ও ভাবী - - - করিম ভাইয়ের ফোন নাম্বারটা একটু দিবেন নি।
শাশুড়ি দরজায় এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেন, কী দরকার?
—আমরা গেরামের ঈদগাটা ঠিক করুম। তাইনের থে কিছু লমু।
—বাবা আমরা তো জানি না। তোর চাচা জানে। আর এইডা লইয়া তো মেম্বার সাবের সাথে কথা অইছে তোর চাচার।
কথা বলতে বলতেই শাশুড়ি ঘরে ঢুকে যায়। জয়নাল দাঁড়িয়েই আছে। আবার ডাক দেয়, ও ভাবী একগ্লাস পানি খাওয়ান তো।
মিলা দেয় নি।
শাশুড়িই পানি নিয়ে আসে। দেয়। জয়নাল ঢক্্ ঢক্ করে খেয়ে চলে যায়।
ইট সিমেন্টে করা লম্বা ঘরটা দক্ষিণমুখি।
প্রবাসি টাকায় আজকাল গ্রামিণ অবকাঠামোতে দালান উঠছে। কোথাও কোথাও বহুতলও তৈরি হচ্ছে। তবে এ বাড়িটা একতলাই। প্রবাসি আবদুল করিমের মরুশ্রমে একসময়ের মরচে পড়া টিনের ঘরটা আজ দালান হয়েছে। বড় বারান্দা দিয়েছে দক্ষিণে। বারান্দায় চেয়ারে বসে সে আর বৌ গল্প করবে, চা খাবে। এমনই স্বপ্ন। স্বপ্নকে বাস্তব করতে দালান উঠেছে। বারান্দা হয়েছে। বৌ এসেছে ঘরে ঠিকই— কিন্তু স্বপ্ন বাস্তবায়নের সময় আর হয় নি। টাকার ভালবাসায় স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেছে। বৌ ভালবাসা একাকীই মরছে।
মিলা কিন্তু বসে বারান্দায়।
জুটি নেই, তাতে কি চা খাওয়া হবে না? শাশুড়িও বসে বিকেলে। চা খায়। এটা সেটা গল্প করে। নাফিজও কোল জুড়ে বসে থাকে— কখনো মায়ের, কখনো দাদীর। ভালই লাগে বৈকালিক সময়টা বারান্দায় বসে কাটাতে। ডিশ লাইনেও টিভি দেখা হচ্ছে আজকাল। প্রবাসি অর্থনীতিতে শহুরে আমেজ এখন গ্রামেও। জীবনের মান-ধরনও বদলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
আজ বিকেলে শাশুড়ি বসে নি। পাশের বাড়ি গেছে এক চাচীশাশুড়িকে দেখতে। অসুস্থ মানুষ। বারান্দায় মিলা আর নাফিজ। নাফিজ মায়ের কোলে, ঘাড়ে বসছে নামছে। পুট পুট একথা ওকথা বলছে। চঞ্চলায় এক মুহুর্তও অবসর নেই নাফিজের। পাশের গ্রামের স্বামী পরিত্যক্তা আসমাকে ঘরের কাজের জন্য রাখা হয়েছে। ও চা নিয়ে আসে।
আসমা আসার সাথে সাথেই নাফিজ চিপস্্ চায়। শুধু চেয়েই ক্ষান্ত নয়— এখনই দেবার জন্যে বিরক্ত করে তোলে। মিলা উঠে টাকা দিয়ে নাফিজকে আসমার সাথে দোকানে পাঠায়। ওদের বিদায় করে আবার বসে বারান্দায়। আলতো বাতাস বইছে। এ বাতাসেই মিলার চুল উড়ছে। দুপুরের গোছলের পর আর চুল বাঁধা হয় নি।
বারান্দার সামনেই বানদুয়ারের ছোট্ট উঠোন। উঠোনের পুবপাশে একটা টিউভওয়েল। এ বাড়ির আদি টিউভওয়েল। উঠোনের দক্ষিণে খোলা জায়গায় গাছগাছড়ার ঝোঁপ। ঝোঁপটার বাইরে দিয়ে একটা মেঠোপথ বয়ে গেছে। এ ঝোঁপের মধ্যেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে দুটো কদম গাছ। হঠাৎ মিলার নজরে পড়ে একটা গাছে ঘুঘু বাসা বেঁধেছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে— তাই ঘুঘুটা বাসায় এসে বসে। ঠিক তখনই ওই ঝোঁপটার বাইরের মেঠোপথ দিয়ে জয়নাল যাচ্ছে। তাকায় নি বারান্দার দিকে, তবে মিলি একটু আড়ে সরে বসে।
জয়নাল বেশ সুঠাম দেহের মায়াবী চেহারার।
উচ্চমাধ্যমিক পাশ। এখন স্থানীয় বাজারে ব্যবসা করছে। পারিবারিক ব্যবসা— কসমেটিকের ব্যবসা। বাড়ির অবস্থাও মন্দ নয়। দেশেই থেকে বেশ সচ্ছল। মনে মনে ভাবে মিলা— কী দরকার আর করিমের বিদেশে থাকা? চলে এসে এমন একটা দোকান দিয়ে বসতে পারে। বেশ সংসার চলবে। সামাজিকতা চলবে। একাকী কি থাকা যায় এ বয়সে?
চিন্তÍাটা হঠাৎ বেঁকে বসে মিলার।
এক সপ্তাহের দাম্পত্য জীবন! তারপর দূর দূরান্তে অবস্থান দুজনের। কী নিষ্ঠুর এ সমাজ! পেশার মোহে জীবনের কাছাকাছি হতে পারছে না এ মোক্ষম সময়গুলোতে। সমাজের দায়িত্ববান লোকদেরও এ নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। শুধু আয় করাটাই মূল কাজ। জীবনের একান্তই লেন-দেন কি দূরের আয়ে মেটে: কিংবা ফোনের কথায় মেটে?
মনটা আবারও খারাপ হয়ে যায়।
নাফিজ এসে আচমকা জড়িয়ে ধরে মাকে। চিন্তাটা কেটে যায়, কষ্টটা থেকে যায়। কষ্ট নিয়েই নাফিজকে জড়িয়ে ধরে আদর করে। তারপরই শান্ত কণ্ঠে আসমাকে বলে, মাকে নিয়ে আয়। সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
বউ-শাশুড়ি ভালই জুটি।
মিলামিশও ভাল— গ্রামে যা দেখা যায় না। সাধারণত এমন পরিবেশে বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্বই প্রধান্য পায়। সংসার আর টাকা খরচের কর্তৃত্ব নিয়েই এমন দ্বন্দ্ব বিকশিত হয়।
মিলা কলেজে পড়েছে।
পড়েছে পাঠ্যসুচির বাইরেও অনেক পত্র-পত্রিকা, বই— সে সবে এমন কাহিনী ছিল অনেক। সংসার জীবনে এসে তেমন জানা থেকে, বই পড়া থেকে নিজেকে সাবধানে রেখেছে। সামলে নিয়েছে। শ্বশুরবাড়ি মেয়েদের স্থায়ী নিবাস। আজীবনের ঠিকানা। এখানে শ্বশুর শাশুড়ির সাথে দ্বন্দ্ব মানেই নিজের ঘরে নিজেই অশান্তি টেনে আনা। এমন বোকামী করবে কেন মিলা? তাই তো চমৎকার মানিয়ে নিয়েছে স্থায়ী ঠিকানার সাথে নিজেকে। আজ শ্বশুর বাড়ির অতি প্রিয় একজন মিলা।
শাশুড়ি এসে ঘরে ঢোকে। নামায পড়তে তাড়াহুড়ো করে। ঠিক তখনি ফোন বেজে ওঠে।
করিম করেছে।
প্রবাস থেকে ফোন। শাশুড়ি জিজ্ঞেস করে, কার ফোন রে বৌ?
— আপনার ছেলে। নেন কেথা কন।
নামাযের সময়। তবু কথা বলে। মিনিট তিনেক সাংসারিক কথা বলে বৌকে ফোনটা দিয়ে নামাযে দাঁড়ায়। মিলা ফোনটা হাতে নিয়ে ওর রুমে চলে আসে। তারপর প্রথম কথাই— বাড়ি আসবা কবে?
— বাড়ি আসব মানে? আমি বলেছি নাকি বাড়ি আসব?
সুদূর মরুপ্রান্ত থেকে অবলীলায় কথাটা বলে করিম। বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ফোনটা কানেই লাগিয়ে রাখে। চুপচাপ। করিম আরও অনেক কথা বলে। অর্থের কথা বলে। মিলার আজ তাতে আগ্রহ নেই। অর্থও এখন তার কাছে অনর্থ। কিছুই বলছে না। কোনো উত্তরও দিচ্ছে না। ফোনকলের মাঝেই মিলার মনের কোণে জয়নালের চেহারার অস্পষ্ট বিমূর্ত ছাপ ভেসে উঠে।
মিলার নিরবতায় বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেটে দেয় করিম।
মিলার মাঝে কোনো ভাবান্তর নেই। রেখে দেয় সেও ফোনটা।
রাতে খাবার শেষে মিলা শ্বশুরকে বলে, কাইল মাকে দেখতে বাড়ি যামু।
— হঠাৎ কেন মা?
— মনটা ভালা নাই।
— ঠিক আছে।
বাজার থেকে এক রিকসাতেই ওর মায়ের বাড়ি যেতে হয়। যাতায়াতে বেশ সুবিধাই। বাজারে গিয়ে কিছু কেনাকাটা করবে। মায়ের জন্যে একটা শ্যাম্পু আর নারকেল তৈল। শ্বশুর টাকা দেয়। শ্বশুড়ের পক্ষ থেকে কিছু আম কিনে নিতে বলে। শাশুড়ি থেকে বিদায় নিয়ে মিলা আর নাফিজ বাজারে আসে।
বাজারে ঢুকতেই জয়নালের সাথে দেখা। জয়নাল এগিয়ে এসে বলে, বাপের বাড়ি যাইতাছেন?
— হ। তোমার দোকানে চল সদায় কিনুম।
— চলেন।
জয়নাল দোকানে নিয়ে আসে মিলাকে। এসেই একটা জুস দেয় নাফিজের হাতে। আর একটা দেয় মিলাকে। মিলা বলে, আমি খাই না।
— আরে একটু খান। আর মন দিয়া কন কী নামামু।
জুসটা একপাশে রেখে বসে মিলা। তার অর্ডার মত নারকেল তেলের বড় বোতল, শ্যাম্পু, সাবান ইত্যাািদ নামায়। পেকেট করতে করতে দেখে একটা লিপস্টিকও দিয়েছে পেকেটে। মিলা সাথে সাথে বলে, আরে লিপস্টিক দিলেন যে। আমি তো এটা বলি নাই।
— এটা ফ্রি।
— ও।
— খান তো জুসটা ভাবী?
তারপরই হাসতে হাসতে আবার জয়নাল বলে, না খাইলে দামডা দিয়া যাইতে অইব।
মিলাও একটু মুচকি হেসে বলে, দাম দিমু কেন? আমি দিতে বলছি?
জয়নাল তাকিয়ে থাকে মিলার হাসির দিকে। তারপর একটু সামনে ঝুঁকে বলে, ভাবী রিকসায় যাইবেন তো?
— হ।
— রিকসা কইরা দিমু?
কথাটা বলেই উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে কর্মচারী ছেলেটাকে বলে— এই যা একটা রিকসা কইরা দে।
দোকানী ছেলেটা চলে যায় রিকসা করতে। এবার জয়নাল একটু হেসে বলে, ভাবী একা যাইতে পারবেন? না আমি আগাইয়া দিয়া আমু?
মিলা চুপসে যায়।
জয়নাল কেন কাছে ভিড়তে চায়— বুঝে মিলা। মিলা আনমনা হয়ে যায়। এমন পৌরষদৃপ্ত জয়নাল তার সাথে যেতে চায়। সাথে নিবে? আচ্ছা করিম কেমন? মাত্র তো সাতদিন দেখেছে। তাও আবার নতুন বউ ছিল, ভাল করেও দেখা হয় নি। এ পাঁচ বছরে স্মৃতিতে আর কতটুকু ধরে রাখতে পেরেছে সেই সময়ের করিমকে? কিন্তু পৌরষদৃপ্ত জয়নাল তো বেশ। কাছে ভিড়তে চায়, সাথে যেতে চায়, নেবে? একটু ভাবে। না, মোটেই না। সে তো অন্য পুরুষ। সব ভাবনা ফেলে দিয়ে মিলা বলে, আমার বাপের বাড়ি আমি চিনি। এমুন কথা আর কোনো দিন মুখে কইবা না।
মিলা দোকান থেকে বেরিয়ে ওর রিকসার অপেক্ষায় আর থাকে নি। অন্য রিকসায় উঠে বাড়ি আসে।
বাড়িতে পৌঁছার পর মা ওকে দেখেই বলে, কীরে মা, না কইয়া আইলি যে?
— মনটা ভালা নাই, আইয়া পড়লাম। কয়দিন থাইকা যামু।
মা খুশিমনে বলে, হ এইবার অনেকদিন থাকতে অইব। জামাই তো নাই, জাওনের লাইগা তাড়াহুড়া করিস না।
— মা, আমারে না পাাইলে শাশুড়ির খাওয়া হজম হয় না। এ জইন্যই বেশিদিন থাকি না। তুমি যেমন আমার মা, শাশুড়িও তেমন।
— পাগলী মেয়ে।
হাসতে হাসতে মা ওর ব্যাগটা ঘরে নিয়ে রাখে।
রাতে ব্যাগ খুলে সে জয়নালের দোকান থেকে কেনা সদায়গুলো ভাল করে দেখে। না, কোথাও লিপস্টিক ফ্রি দেওয়ার কথা নেই। তবে কোন কারণে দিল? মনে মনে ভাবতে থাকে, জয়নাল একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছে।
তিনদিন বেড়িয়ে আবার শ্বশুরবাড়ি ফিরে আসে মিলা। রিকসা এসে থামে বাজারে। রিকসা থেকে নেমেই জয়নালের দোকানে যায়। একটু মেজাজ নিয়েই জিজ্ঞেস করে, লিপিস্টিক দিছে কোনডার সাথে?
— আরে কোম্পানি দেয় নাই। আমি দিছি ফ্রি।
কথাটা বলে মিটি মিটি হাসে জয়নাল। মিলা একশত টাকার একটা নোট এগিয়ে দিয়ে একটু গম্ভীর গলায় বলে, দামডা লও। এমুন কাম আর কোনোদিন কইর না কিন্তু।
বলেই বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয় মিলা। জয়নাল আলতো স্বরে ডাকে, ভা-বী - - -।
মিলা আড়চোখে দেখল।
মনের ভাবনাটা আবারও বাঁক খায়। সত্যি জয়নাল দেখতে বেশ। আচরণটাও। করিমের অনুপস্থিতিটাও বেশ অনুভব করছে। ক্ষণিকের দাম্পত্যজীবন— উহ! মনে মনে ধিক্কার দেয় বাবাকে। প্রবাসী বর আর তার অর্থ-প্রাচুর্য পেয়ে বাবা-মা খুশি, কিন্তু মিলা? শুধু মিলা নয়— এ সমাজে এমন রংধনুর দাম্পত্যজীবনের মেয়ে অনেক অনেক আছে। এমন প্রবাসী অর্থ-প্রাচুর্যের চেয়ে জয়নালদের মত বরই ভাল।
ডাইনিং টেবিলে রাখা মিলার ফোনটা হঠাৎ বেজে ওঠে।
নিশ্চয় করিমের ফোন। সন্ধ্যার এমন ক্ষণগুলোতেই ওর ফোন আসে সাধারণত। আগ্রহ নেই ফোন ধরার— তবু এগিয়ে যায়। ফোনটা হাতে নিয়েই চমকে যায়। অচেনা ফোন। ভাবছে মিলা কে হতে পারে?
ভাবতে ভাবতেই ফোনটা রিসিভ করে মিলা। ও প্রান্ত থেকে বলে, ভা-বী - - -! আমি জয়নাল।
ফোনটা কেটে দিয়ে বন্ধ করে রাখে।
রাতে ঘুমুতে গিয়ে ভাবছে মিলা জয়নাল কী বাড়াবাড়িই না করছে। আবার পরক্ষণেই ভাবছে, নাকি সত্যি ভালবাসার হাতছানি দিচ্ছে। ওর এককীত্ব নিয়ে জয়নালের ভাবনা। স্বামী নেই পাঁচ বছর। বয়সের যৌবনত্ব কিন্তু বসে নেই তাতে। এমনি সময়ে মিলার নীড়ে ভিন্ন অতিথির আগমনের বার্তা— এ যেন এ সময়ের অবধারিত একটা বিষয়ই। নীড়ে কি সেই অচেনা অতিথিকে জায়গা দেবে?
বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে মিলা। রাতে আবার ফোন আসে জয়নালের। সাথে সাথেই রিসিভ করে কিন্তু কোনো কথা বলছে না। ওপাশ থেকে জয়নাল আবেগী স্বরে বলে, ভা-বী - - -।
কোনো কথা বলে না। ওর কথা শুনে আর পুলক অনুভব করে।
এক সময় ঘুম এসে যায়।
সকালে প্রতিদিনের মতই ঘুম থেকে ওঠে। প্রতিদিনের মতই দৈনন্দিন কাজ সারে। এরই মাঝে বেলা এগারটা বেজে যায়। এ সময় আবার ফোন আসে জয়নালের। মিলা রিসিভ করে বলে, এই ফোন করতাছ কেন?
— তোমার কথা হুনার লাইগা।
— তুমি! আমারে ‘তুমি’ বললা কেন?
— তুমি না বললে কি মনের কথা কওন যায়?
মিষ্টি একটা ধমকে বলে, মনের কথা কওন লাগব না। পুরুষ মাইনষের কথা!
লাইনটা কেটে দেয় মিলা। ক্ষণিক পরেই আবার ফোন আসে। রিসিভ করে কোনো কথা বলে না মিলা। জয়নাল বলে, তুমি লিপিস্টিকে সাইজ্যা আমার দোকানে আইবা একদিন, হের লাইগা লিপিস্টিকটা দিছিলাম।
মিলা রাগে না। মনে মনে আবারও পুলক অনুভব করে। শাশুড়িকে ঘরের দিকে আসতে দেখে ফোনটা কেটে দিয়ে নাফিজকে কোলে নেয়।
আজ রাতেও জয়নাল আবার ফোন করে। মিলা রিসিভ করে। জয়নাল ফিসফিসিয়ে বলে, ঘুমাইছ?
মিলাও ততোধিক ফিসফিসিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে, না।
— আমার দিকে দেহ না একটু।
— তোমারে তো দেহিই পত্তিদিন।
— এই দেহন না।
মিলা একটু হেসে বলে, আর ফোন করবা না কিন্তু।
— ভা-বী - - -।
আজ সকালে সকালে একটু দেরি করে শ্বশুর বাজারে গেছে। অমনি জয়নালের ফোন আসে আবার। শাশুড়ি এগিয়ে জিজ্ঞেস করে, কার ফোনরে বৌমা?
একটু আমতা আমতা করে বলে, জয়নালের ফোন।
চোখটা বড় করে শাশুড়ি বলে, কোন জয়নাল? অই বাড়ির জয়নাল?
— হ।
— ফোন করছে কেন্।
— জানি না।
— আচ্ছা বৌ মা একটা কথা শুনছি, কও তো কথাডা ঠিক কিনা?
ভড়কে যায় মিলা। কী শুনেছে শাশুড়ি? চুপ থাকে। শাশুড়িই আবার বলে, জয়নাল তোমারে নাকি এটা সেটা দেয়। লিপিস্টিক, শেম্পু দেয়। কথাাডা কি ঠিক?
অপ্রস্তুত হয়ে যায় মিলা। চমকে যায় ভীষণ। এমন কথা কবে শুনেছে? কার কাছ থেকে শুনেছে? ভাবতে ভাবতেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, কে বলছে আপনারে?
শাশুড়ি কণ্ঠটা একটু দৃঢ় করে বলে, হাছা কথা কও। এমুন কথা সবাই জানে। অই বাড়ির মেয়েগুলা পর্যন্ত জানে। আমি এতদিন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আইজ জয়নালে তোমারো ফোন করছে, তাইলে ত ঠিকই।
মিলা এবারও চুপ থাকে। পরক্ষণেই বলে, মা আমি জানি না। আমি সদাই কিনছি, এর মধ্যে লিপিস্টিক দিছে। জিগাইলাম তহন কইছে ফ্রি। আমি তাই মনে করছি। পরে জাইন্না দাম দিয়া দিছি।
— আরও কত কি বলে দেয়? তুমি রাইতেও ফোনে কথা কও। এইসব কী অইতাছে, বৌমা।
আরও ভীষণ চমকে যায় মিলা। ভাঙা কণ্ঠে বলে, মা আমি কিচ্ছু জানি না।
— হেই দিন জয়নাল আইয়া তোমার কাছে পানি চাইল কেন্্?
— অমা! এইডা আমি কি জানি? আপনেই তো কথা কইছেন, পানি দিছেন।
— এর কয়দিন পরেই আচকা তুমি বাপের বাড়ি গেলা কেন্? অইহানে গিয়া কি জয়নালের লগে দেহা করছ?
— ছি, ছি মা!
আর কোনো কথা না বলেই ডুকরে কেঁদে ঘরে ঢুকে যায় মিলা।
আস্তে আস্তে কথাটা করিমের কানেও যায়। সুদূর প্রবাসে এমন একটা খবর শুনে রেগে করিম মিলাকে বলে, এই তুমি সেদিন আমারে জিগাইছ কবে বাড়ি আমু! এহন বুঝছি কেন তুমি জিগাইছ? আরেকজনের লগে মইজ্জা থাহনের লাইগা?
করিমের মুখেও এ কথা! ছি!
শ্বশুর-শাশুড়ির মুখে, এলাকার মানুষের মুখেও। সত্যি কি সবাই জেনে গেছে ফোনের কথা? কীভাবে জানল? জানার তো কথা নয়। নাকি জয়নালই ইচ্ছে করে রটিয়েছে করিম থেকে মিলাকে দূরে সরিয়ে নিজের কাছে পেতে।
মিলা ভাবছে এসব।
ভাবছে আর চিন্তা করছে জয়নালের কথা। ও বারবার মিলাকে ফোন করছে। ওর ঘরে চলে আসার কথাও বলেছে। জয়নালের কথায়, আচরণে, চেহারায় মোহময়তা আছে। মাদকতা আছে। করিম কবে আসবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সে কবে আসবে, তা জানতে চাওয়াটাও এখন অপরাধ হয়ে গেছে। কী করবে মিলা এখন? করিম— সুদূর প্রবাসে; জয়নাল হাতের নাগালেই। যখন তখন জীবনের কাছাকাছি হতে পারে।
ঝড়!
প্রচ- ঝড় বইছে মিলার মনের আকাশে।
দুপুরে খেয়ে শোয় নি। আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন। বাতাসও বইছে। প্রকৃতিতে ঝড় বইতে শুরু করেছে। মিলার মনেও ঝড়, প্রকৃতিতেও ঝড়! মিলা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।
ক্ষণিকের মধ্যেই ঝড়ের তীব্রতা বেড়ে যায়। গাছগুলো হেলে দুলে ঝড়ের তীব্রতাকে জানান দেয় স্পষ্ট করে। কলপাড়ের কদম গাছ দুটোও বেশ দুলছে। ঘুঘুটা তার আপন নীড়কে আঁকড়ে ধরে বসে আছে। বাতাসের প্রচ- বেগের সাথে গাছ দুলছে— কিন্তু ঘুঘু তার নীড় ছাড়ছে না। একদম আঁকড়ে আছে।
মিলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে তা দেখছে আর দেখছে। আপন নীড়েই শান্তি। আপন নীড়েইর শক্তি।
#
আমার অন্যান্য গল্প পড়তে ক্লিক করুন :
নিষিদ্ধ গল্প
কবিতার গল্প
গল্প : শিশির
গল্প : প্রজাপতি
গল্প : হৃদপিন্ড
গল্প : যে বাঁশি ভেঙে গেছে
গল্প : সিদ্ধান্ত
গল্প : বাঁশির সুরে নদীর গান
০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৪৮
নাসীমুল বারী বলেছেন: ধন্যবাদ গল্পটি পড়ার জন্য।
আমাদের গ্রামিণ সমাজে এখনও তিনমাসের ছুটি নিয়ে বিদেশ থেকে আসা পাত্রই অভিভাবকদের প্রথম পছন্দ। এক্ষেত্রে পাত্রির মতামতের প্রয়োজন নেই। বিয়ে করে দীর্ঘ সময়ের জন্য আবার বিদেশ। এই পরিস্থিতিতে পাত্রি যে মানসিক ও সামাজিক সমস্যায় পড়ে, সে দিকটা অভিভাবকরা দেখতে বা বুঝতে চেষ্টা করে না। গল্পের উদ্দেশ্য অভিভাবকদেরকে তা জানানো।
২| ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ৮:০৯
অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: ভালো লাগলো ভ্রাতা +++++
শুভেচ্ছা রইলো
০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৫০
নাসীমুল বারী বলেছেন: ধন্যবাদ, গল্পটি পড়ার জন্য।
৩| ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:২৬
কলমের কালি শেষ বলেছেন: বাস্তব জীবনের না পাওয়ার নিমিত্তে নোংরা চর্চা । এই দীর্ঘ একাকিত্বে বহিরাগত আবেগ নতুন নয় । কেউ ঘর থেকে এগিয়ে যায় কেউ বাহির থেকে এসে টেনে নেওয়ার চেষ্টায় ।
সুন্দর করে লিখেছেন । ভাললাগলো ।
৪| ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:৩২
খেলাঘর বলেছেন:
দেশে চাকুরী সৃস্টি করেনি ইডিয়টগুলো, বাংগালীরা ক্রীতদাস হিসেবে বাইরে বিক্রী হচ্ছে, তাদের বউদের অন্যেরা খেলছে।
©somewhere in net ltd.
১| ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ৮:০৯
সুফিয়া বলেছেন: ভাল লাগল। আমাদের দেশের আজকালকার চিরাচরিত চিত্র।
এক জায়গায় মিলা নামটা মিলি হয়ে েগছে।