নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আলহামদুলিল্লাহ। যা চাইনি তার চেয়ে বেশি দিয়েছেন প্রিয়তম রব। যা পাইনি তার জন্য আফসোস নেই। সিজদাবনত শুকরিয়া। প্রত্যাশার একটি ঘর এখনও ফাঁকা কি না জানা নেই, তাঁর কাছে নি:শর্ত ক্ষমা আশা করেছিলাম। তিনি দয়া করে যদি দিতেন, শুন্য সেই ঘরটিও পূর্নতা পেত!

নতুন নকিব

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দল-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না- বিদ্রোহী রন-ক্লান্ত। আমি সেই দিন হব শান্ত।

নতুন নকিব › বিস্তারিত পোস্টঃ

বৈচিত্র্যপূর্ণ, বিস্ময়কর এবং সুবিশাল সাগর মহাসাগর: মহান প্রতিপালকের অফুরন্ত নিআমতের ভাণ্ডার

২৭ শে জুলাই, ২০১৯ সকাল ৯:১৯

বৈচিত্র্যপূর্ণ, বিস্ময়কর এবং সুবিশাল সাগর মহাসাগর: মহান প্রতিপালকের অফুরন্ত নিআমতের ভাণ্ডার



সাগরের তলদেশের আকর্ষনীয় একটি দৃশ্য। গাছপালায় ভরা মনোরম কোনো বাগানের ছবি ভেবে দৃষ্টিবিভ্রম হতেই পারে।

প্রাককথন:

আমাদের বসবাসের ঠিকানা অনিন্দ্য সুন্দর এই বসুন্ধরাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বহুমাত্রিক নৈপুন্য দিয়ে মনোরম এবং দৃষ্টিনন্দন করে সাজিয়েছেন। পাহাড়, গিরি, ঝর্ণা, সাগর, বৃক্ষ, পুষ্প আর বিচিত্র প্রাণীজগত দ্বারা সুশোভিত করেছেন। জল এবং স্থল; দুই ভাগে বিন্যস্ত করে গোটা পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী করেছেন প্রাণীকুলের জন্য। বিশাল এই ভূ-ভাগকে প্রাণীকূলের বসবাসযোগ্য করে তুলতে, সৃষ্টির বৈচিত্র্যকে যথার্থভাবে ফুটিয়ে তুলতে; সর্বোপরি আমাদের জন্য শস্য, শ্যামল, সজিব এবং হাস্যোজ্জ্বল আবাসোপযোগী একটি পৃথিবীর জন্য পানির অফুরন্ত আধারের প্রয়োজন ছিল বৈকি। সেই প্রয়োজন তিনি পূরণ করেছেন সাগর মহাসাগরের অথৈ জলরাশি দিয়ে। সাগর মহাসাগরের মত বিশাল বিশাল বারিধি মহান স্রষ্টা আল্লাহ জাল্লা শানুহূর অভাবনীয় সৃষ্টি কৌশল আর অসীম ক্ষমতাকে আমাদের সামনে তুলে ধরে। সৃষ্টি যার এত বিশাল, তিনি তাহলে কত বড়! সৃষ্টি যার এত সুনিপূন সৌন্দর্য্যে ভরপুর, তিনি তাহলে কেমন! কতটা সুন্দর তিনি! না জানি কতই না মহান তিনি! শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে তাঁর অফুরান নিআমতরাজি দর্শনে! শুধু এই পৃথিবী নয়, অন্তহীন এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা তিনি। তিনি বিশ্বচরাচরের সকল নিআমতরাজি সৃষ্টি করেছেন মানুষের প্রয়োজন পূরণের নিমিত্তে। আর তিনি মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদত-আরাধনার জন্য। একমাত্র তাঁর আদেশ নির্দেশ মেনে পার্থিব জীবন পরিচালনা করবে তারা। এসব নিআমত ভোগ করার সাথে সাথে ব্যাপৃত হবে পারলৌকিক অন্তহীন জীবনের অফুরন্ত সাফল্যলাভে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লার নিআমতরাজি এত বিশাল ও ব্যাপক যে, এসবের বর্ণনা করার ক্ষমতাও আমাদের নেই। তাই তো তিনি ঘোষনা করেছেন-

وَإِن تَعُدُّواْ نِعْمَةَ اللّهِ لاَ تُحْصُوهَا إِنَّ اللّهَ لَغَفُورٌ رَّحِيمٌ

যদি আল্লাহর নিআমত গণনা কর, শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু। -সূরাহ আন নাহল, আয়াত-১৮

If ye would count up the favours of Allah, never would ye be able to number them: for Allah is Oft-Forgiving, Most Merciful.

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লার বিস্ময়কর সৃষ্টিরাজির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাগর মহাসাগর। সাগর মহাসাগর আল্লাহ তাআ'লার এমন এক বিশাল বিপুলায়তন সৃষ্টি যা মানুষের জন্য অফুরন্ত কল্যাণের ভাণ্ডার। স্বমহিমায় বেগবান সাগর যেন মহান স্রষ্টার সৃষ্টির বিস্ময়গাথা ঘোষনা করে চলেছে। কুলুকুলু শব্দে। নিরবধি বয়ে চলে। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই মানুষের নিরন্তর কৌতূহল সাগরের অথৈ জলরাশিতে। সাগর মহাসাগর নিয়ে মানুষের বিরামহীন গবেষণা, অনুসন্ধান এবং নিরন্তর সাধনার যেন শেষ নেই। সাগরের সলিলে যেন মিশে আছে মানুষের আদি প্রেম, আদি ভালোবাসা।

আল কুরআনে সাগর মহাসাগর প্রসঙ্গঃ

কুরআনে সাগর এবং মহাসাগর প্রসঙ্গে বিভিন্ন বাণী রয়েছে। এখানে কিছু উল্লেখযোগ্য আয়াত দেওয়া হলো:

"তিনিই দু’টি সমুদ্র প্রবাহিত করেছেন, একটি মিষ্টি ও সুপেয়, অপরটি লোনা ও তিতো; এবং উভয়ের মাঝে একটি অন্তরায় স্থাপন করেছেন এবং অবরোধ নির্মাণ করেছেন।" -সূরা আল-ফুরকান, আয়াত ৫৩

"তিনিই দু’টি প্রবাহমান নদী প্রবাহিত করেছেন, যারা পরস্পর মিশে যায়। তাদের মাঝে রয়েছে এক প্রাচীর, তারা পরস্পর সীমালঙ্ঘন করে না।" -সূরা আর-রহমান, আয়াত ১৯-২০

"তোমাদের রবের কুদরতের নিদর্শনাবলী একটির মধ্যে রয়েছে, স্থল ও সমুদ্রে তাঁর আদেশে তোমরা চলাফেরা কর।" -সূরা ইউনুস, আয়াত ২২

এগুলো থেকে বোঝা যায় যে আল্লাহ তাআলা সাগর এবং মহাসাগরের মধ্যে বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করেছেন এবং এদের মাধ্যমে মানুষের উপকার ও শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দিয়েছেন।



সাগরতলের অপূর্ব দৃশ্য।



সাগরতলের মুগ্ধ করা আরেকটি দৃশ্য।

সাগর বলতে কী বুঝায়?

উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, A sea is a large body of salty water. অর্থাৎ, সমুদ্র হল নোনা জলের বিশাল একটি আধার। সাধারণত ‘সাগর’, 'মহাসাগর' বা 'সমুদ্র' বলতে অতি বৃহৎ লবণাক্ত জলাশয়কে বুঝানো হয়ে থাকে। আবার বিরাটাকায় লবণাক্ত জলের হ্রদ বোঝাতেও ‘সাগর’ শব্দটির ব্যবহার রয়েছে। উদাহরণত: কাস্পিয়ান সাগর।

পৃথিবীর উপরিভাগের ৭০% শতাংশের অধিক স্থান দখল করে রেখেছে সাগর:

সমুদ্র, সাগর বা মহাসাগর হল লবণাক্ত জলের পরস্পর সংযুক্ত জলরাশি, যা পৃথিবীর উপরিতলের ৭০ শতাংশেরও বেশি অংশ আবৃত করে রেখেছে। সমুদ্র পৃথিবীর জলবায়ুকে সহনীয় করে রাখে এবং জলচক্র, কার্বন চক্র ও নাইট্রোজেন চক্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ সমুদ্র পরিভ্রমণ করছে ও সমুদ্রাভিযান চালিয়ে আসছে। তবে সমুদ্র-সংক্রান্ত বিজ্ঞানসম্মত চর্চা বা সমুদ্রবিজ্ঞানের সূচনা ঘটে মোটামুটিভাবে ১৭৬৮ থেকে ১৭৭৯ সালের মধ্যে ক্যাপ্টেন জেমস কুকের প্রশান্ত মহাসাগর অভিযানের মধ্য দিয়ে। 'সমুদ্র' শব্দটির মাধ্যমে অবশ্য বিভিন্ন মহাসাগরের ছোট এবং আংশিকভাবে ভূ-বেষ্টিত অংশগুলিকেও বোঝানো হয়ে থাকে।

সমুদ্রজল অনেক মৌল বস্তুরও বিশাল আধার:

সমুদ্রের জলে সর্বাধিক পরিমাণে যে ঘনবস্তু দ্রবীভূত অবস্থায় রয়েছে, তা হল সোডিয়াম ক্লোরাইড। এছাড়া অন্যান্য অনেক মৌলের সঙ্গে রয়েছে ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম ও পটাসিয়ামের লবন। কয়েকটি মৌল রয়েছে অতিসূক্ষ্ম কেন্দ্রীভূত অবস্থায়। সমুদ্রজলের লবণাক্ততা সর্বত্র সমান নয়। পৃষ্ঠতল ও বড়ো বড়ো নদীর মোহনার কাছে জলের লবণাক্ততা কম; অন্যদিকে সমুদ্রের গভীরতর অংশে লবণাক্ততা বেশি। যদিও মহাসাগরগুলোর মধ্যে দ্রবীভূত লবনের আপেক্ষিক অনুপাতের পার্থক্য কমই হয়। সমুদ্রের পৃষ্ঠতলের উপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ু তরঙ্গ সৃষ্টি করে। সেই তরঙ্গ সমুদ্রের অগভীর স্থানে প্রবেশ করে ভেঙে পড়ে। সমুদ্রের উপরিতলের সঙ্গে বায়ুর ঘর্ষণের ফলে সমুদ্রস্রোতেরও সৃষ্টি হয়। এই সমুদ্রস্রোতগুলো ধীরগতিতে অথচ নিয়মিতভাবে মহাসাগরগুলোর মধ্যে জল প্রবাহিত করে। মহাদেশগুলোর গড়ন ও পৃথিবীর আবর্তন (কোরিওলিস প্রভাব) ইত্যাদি কয়েকটি কারণ এই প্রবাহের অভিমুখ নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্ব পরিবহণ বেষ্টণী নামে পরিচিত গভীর-সমুদ্রস্রোতগুলো মেরু অঞ্চল থেকে ঠান্ডা জল প্রত্যেকটি মহাসাগরে বহন করে আনে।

জোয়ার-ভাটা হয় যে কারণে:

নিজের অক্ষের চারদিকে পৃথিবীর আবর্তন, পৃথিবীর চারদিকে পরিক্রমণরত চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ বল, সামান্য পরিমাণে সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে সাধারণত দিনে দু’বার সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান ও পতন ঘটে। এই উত্থান ও পতন জোয়ার-ভাটা নামে পরিচিত। উপসাগর ও নদীর মোহনায় জোয়ার-ভাটার মাত্রা অত্যন্ত বেশি হয়।

সুনামির উদ্ভব কেন ঘটে?

মহাসমুদ্রের নিম্নবর্তী ভূগর্ভে ভূসাংগাঠনিক পাতের নড়াচড়ার ফলে সমুদ্রের তলদেশে ঘটা ভূমিকম্পের ফলে বিধ্বংসী সুনামির উদ্ভব ঘটে। অবশ্য আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, প্রবল ভূমিধ্বস অথবা উল্কাপিণ্ডের সংঘাতেও অনেক সময় সুনামির সৃষ্টি হয়ে থাকে।

সাগর একটি বৈচিত্র্যময় বাসস্থান:

সমুদ্রে বিভিন্ন ধরনের ব্যাক্টেরিয়া, প্রোটিস্ট, শৈবাল, উদ্ভিদ, ছত্রাক ও প্রাণীর সন্ধান পাওয়া যায়। এই জন্য সমুদ্রে একটি বৈচিত্র্যময় সামুদ্রিক বাসস্থান ও বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠেছে। এই জাতীয় বাসস্থান ও বাস্তুতন্ত্র সমুদ্রের উপরিতলের সূর্যালোকিত জলভাগ ও তটরেখা থেকে উল্লম্বভাবে শীতল ও অন্ধকার সমুদ্রতলস্থ ক্ষেত্রের জলের উচ্চচাপযুক্ত সুগভীর অংশ এবং উত্তর মেরু অঞ্চলের বরফের তলায় স্থিত শীতল জল থেকে অক্ষরেখা বরাবর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের বর্ণবৈচিত্র্যময় প্রবাল প্রাচীরগুলো পর্যন্ত প্রসারিত রয়েছে। উদ্ভিদ ও প্রাণীদের বেশ কিছু প্রধান গোষ্ঠীর বিবর্তন ঘটেছে সমুদ্রে। জীবনের উৎপত্তিও সম্ভবত সমুদ্রেই ঘটেছিল।

সাগর: আমাদের বহুমাত্রিক উপকারের কেন্দ্রবিন্দু:

সমুদ্র মানবজাতিকে প্রচুর খাদ্য সরবরাহ করে। এর মধ্যে মাছই প্রধান। তবে শেলফিস, স্তন্যপায়ী প্রাণী ও সামুদ্রিক শৈবাল পাওয়া যায় সমুদ্র থেকে। এগুলি হয় জেলেরা জাল ফেলে ধরে অথবা জলের তলায় চাষ করা হয়। এছাড়াও মানুষ সমুদ্রকে ব্যবহার করে থাকে বাণিজ্য, পর্যটন খনিজ উত্তোলন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, যুদ্ধ ও সাঁতার, প্রমোদ ভ্রমণ ও স্কুবা ডাইভিং ইত্যাদি অবকাশ যাপনের কাজে। এই সব কাজকর্মের জন্য সমুদ্র দূষিত হয়। মানব সংস্কৃতিতেও সমুদ্রের গুরুত্ব অসীম। হোমারের ওডিসি মহাকাব্যের যুগ থেকে সাহিত্যে, সামুদ্রিক শিল্পকলায়, থিয়েটারে ও উচ্চাঙ্গ সংগীতে সমুদ্রের উপস্থিতি লক্ষণীয়। পৌরাণিক সাহিত্যের সিলা ইত্যাদি কয়েকটি ক্ষেত্রে সমুদ্র প্রতীকীভাবে দৈত্য হিসেবে চিত্রিত হয়েছে এবং অচেতন মন ও স্বপ্ন ব্যাখ্যার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।

সাগর: বৈচিত্র্য ও বিস্ময়ের অফুরন্ত উৎস:

সাগরের কলতান, জোয়ার ভাটার বিচিত্র দৃশ্য, কখনো বিশাল গুরুগম্ভীর ভারিক্কি অবয়ব, কখনো নিরব বয়ে চলা, কখনো ভয়ঙ্কর গর্জনে ত্রাস সঞ্চারের ভেতরে জ্ঞানীদের হৃদয়ে ভাবনার উদ্রেক হয়। সৈকতে এসে আছরে পড়া একের পর এক পাহাড়সমান উঁচু ঢেউ হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়। অন্তরে ভয় ধরিয়ে দেয়। সমুদ্রে জোয়ার-ভাটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লার সুবিশাল কুদরতের বহিপ্রকাশ। জোয়ার ভাটা যেন মানুষকে একথাই স্মরণ করিয়ে দেয়, দেখো, আমি ক্ষনে ধনী আবার ক্ষনে ঋণী। তোমরাও তো আমারই মত। তোমাদেরও জীবন আমারই মতন। তোমাদের জীবনও আমারই মত। বিচিত্রতায় ভরা। তোমরাও ভুলে যেয়ো না, আজ তুমি ধনী আছ, কালই হয়তো তুমি হয়ে যেতে পার কপর্দকহীন, নির্ধন। অথবা আজ তুমি রিক্তহস্ত, কালই হয়ে যেতে পার সহায় সম্পদের অধিকারী। সমুদ্রের বুকে ভাটায় যখন পানি শুকিয়ে যায় তখন যেন ঠিক মানুষের দারিদ্র্য এবং বার্ধক্যের এক নিরব চিত্রের প্রকাশ ঘটে। চাঁদের অমাবস্যা এবং পূর্ণিমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাগরে জোয়ার-ভাটার আগমন প্রত্যাগমন। প্রকৃতপক্ষে সাগর হলো বৈচিত্র্য ও বিস্ময়ের অফুরন্ত উৎস। সাগর নিয়ে মানুষ যত জানছে, যত গবেষণা করছে, নিত্য-নতুন চমকপ্রদ সব তথ্য আবিষ্কৃত হয়েই চলেছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা মানুষের জন্য যে অফুরান কল্যাণের ভাণ্ডার সুপ্ত রেখেছেন সাগরে, প্রাকৃতিক গ্যাসসহ বহুবিধ খনিজ সম্পদ মজুদ রেখেছেন সাগরবুকে, তা গবেষণা ও আবিষ্কারের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব। উপকৃত হচ্ছে মানবতা। মানবতার কল্যানের জন্যই যেন সাগরের এই বিশাল জলরাশি নিরবধি বয়ে চলেছে কুলুকুলু রবে। প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে। পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যে। এজন্যই মানবতার কল্যাণের ধর্ম ইসলামে সাগর নিয়ে চিন্তা-গবেষণায় উতসাহ প্রদান করা হয়েছে। যেমন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ইরশাদ করেন,

أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ سَخَّرَ لَكُم مَّا فِي الْأَرْضِ وَالْفُلْكَ تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِأَمْرِهِ وَيُمْسِكُ السَّمَاء أَن تَقَعَ عَلَى الْأَرْضِ إِلَّا بِإِذْنِهِ إِنَّ اللَّهَ بِالنَّاسِ لَرَؤُوفٌ رَّحِيمٌ

'তুমি কি দেখ না যে, ভূপৃষ্টে যা আছে এবং সমুদ্রে চলমান নৌকা তৎসমুদয়কে আল্লাহ নিজ আদেশে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন এবং তিনি আকাশ স্থির রাখেন, যাতে তাঁর আদেশ ব্যতীত ভূপৃষ্টে পতিত না হয়। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি করুণাশীল, দয়াবান।' -সূরা আল-হজ, আয়াত: ৬৫

'Seest thou not that Allah has made subject to you (men) all that is on the earth, and the ships that sail through the sea by His Command? He withholds the sky (rain) from failing on the earth except by His leave: for Allah is Most Kind and Most Merciful to man'.

চিন্তাশীল প্রত্যেকের নিকটই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লার অপরিসীম কুদরতের সাথে পরিচিত হতে সাগর ভ্রমণের বিশেষ উপকার স্বীকৃত। মহান স্রষ্টা আল্লাহর অতুলনীয় সৃষ্টিকুশলতার বিন্দুমাত্র মানুষ উপলব্ধি করতে পারে সমুদ্রের বুকে গিয়ে। আমরা তো দয়ালু ও দাতা আল্লাহকে চেনার মতো চিনতে কসুর করি, আল্লাহর অসীমতা উপলব্ধি করে তাঁর নির্দেশানুযায়ী জীবন পরিচালনায় ত্রুটি করি। এক্ষেত্রে সুবিস্তৃত আকাশ, সুউচ্চ পর্বত ও সুবিশাল সাগর প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞানই পারে মানুষকে মহান আল্লাহর কুদরতের বাস্তব উপলব্ধি এনে দিতে। সাগরের বুকে ঘুরতে গিয়ে দিগন্তহীন অথৈ জলরাশির বিশাল তরঙ্গমালায় কেউ যখন মৃত্যুর খুব কাছে নিজেকে আবিষ্কার করে, তখনই সত্যিকার উপলব্ধি করে আল্লাহর অসীমতার অর্থ কী আর সৃষ্টির ক্ষুদ্রতা ও সীমাবদ্ধতার বাস্তবতা কী। এজন্যই আল্লাহর নির্দেশ,

قُلْ سِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانظُرُوا كَيْفَ بَدَأَ الْخَلْقَ ثُمَّ اللَّهُ يُنشِئُ النَّشْأَةَ الْآخِرَةَ إِنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

'বলুন, তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ, কিভাবে তিনি সৃষ্টিকর্ম শুরু করেছেন। অতঃপর আল্লাহ পুর্নবার সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষম।' -সূরা আল-‘আনকাবূত, আয়াত: ২০

Say: "Travel through the earth and see how Allah did originate creation; so will Allah produce a later creation: for Allah has power over all things.

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَاخْتِلاَفِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَالْفُلْكِ الَّتِي تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِمَا يَنفَعُ النَّاسَ وَمَا أَنزَلَ اللّهُ مِنَ السَّمَاء مِن مَّاء فَأَحْيَا بِهِ الأرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَبَثَّ فِيهَا مِن كُلِّ دَآبَّةٍ وَتَصْرِيفِ الرِّيَاحِ وَالسَّحَابِ الْمُسَخِّرِ بَيْنَ السَّمَاء وَالأَرْضِ لآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَعْقِلُونَ

'নিশ্চয়ই আসমান ও যমীনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের বিবর্তনে এবং নদীতে নৌকাসমূহের চলাচলে মানুষের জন্য কল্যাণ রয়েছে। আর আল্লাহ তা’ আলা আকাশ থেকে যে পানি নাযিল করেছেন, তদ্দ্বারা মৃত যমীনকে সজীব করে তুলেছেন এবং তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সবরকম জীব-জন্তু। আর আবহাওয়া পরিবর্তনে এবং মেঘমালার যা তাঁরই হুকুমের অধীনে আসমান ও যমীনের মাঝে বিচরণ করে, নিশ্চয়ই সে সমস্ত বিষয়ের মাঝে নিদর্শন রয়েছে বুদ্ধিমান সম্প্রদায়ের জন্যে।' -সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৬৪

Behold! in the creation of the heavens and the earth; in the alternation of the night and the day; in the sailing of the ships through the ocean for the profit of mankind; in the rain which Allah Sends down from the skies, and the life which He gives therewith to an earth that is dead; in the beasts of all kinds that He scatters through the earth; in the change of the winds, and the clouds which they Trail like their slaves between the sky and the earth;- (Here) indeed are Signs for a people that are wise.

সাগর: বিস্ময়কর প্রাণবৈচিত্র্যের আরেক জগত:

সাগর আল্লাহ তাআ'লার অপার এক সৃষ্টি। বিপুল রহস্যের অথৈ আধার এই সাগর। সাগরের সব জায়গায় বিচরণ করার সামর্থ্য মানুষের হয়ে ওঠেনি এখনও। ইচ্ছে করলেই মানুষ যখন তখন পৃথিবীর সর্বোচ্চ পাহাড়চূড়া মাউন্ট এভারেস্টে উঠছে; কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও সাগরের সর্বনিম্ন স্থানে মানুষ পৌঁছাতে পারছে না সহজেই। সাগরের সবচেয়ে গভীরতম স্থান মারিয়ানা ট্রেঞ্চের ‘চ্যালেঞ্জার ডিপ’। এর গভীরতা ১০,৯,৯৪ মিটার বা ৩৬০৭০ ফুট। আস্ত হিমালয় পর্বতটিকে (২৯০২৮ ফুট) অনায়াসে লুকিয়ে রাখা সম্ভব সাগরের এই গভীরতম স্থানে। আর সাগরের ব্যপ্তি ও প্রসারতার পরিমাণ এখনো অপরিমেয়। সুবিশাল গভীর সমুদ্রে কত জাতের, কত বর্ণের, কত আকারের কত রকম প্রাণী যে বিদ্যমান তা একমাত্র আল্লাহ তাআ'লাই সুপরিজ্ঞাত।

আমাদের বঙ্গোপসাগর কোনো সাগর নয়, মহাসাগর তো নয়ই। একটি উপসাগর মাত্র। সামান্য এ বঙ্গোপসাগরেই কত প্রাণবৈচিত্র্য বিদ্যমান। বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপের আশপাশের পানিতে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় ১৯৯৭-৯৮ সালে একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে ৫৮ প্রজাতির জীবিত এবং ২১ প্রজাতির মৃত প্রবাল, ১০১ প্রজাতির ঝিনুক এবং শামুক পাওয়া যায়। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে প্রচুর শামুক এবং ঝিনুক পাওয়া যায়। শামুক এবং ঝিনুক প্রধানত জলজ প্রাণী। এদের বেশির ভাগই সামুদ্রিক তবে কিছু স্বাদু পানিতে এবং কিছু স্থলেও পাওয়া যায়। এরা খুব আস্তে চলাফেরা করে। চলার সময় হামাগুড়ি দিয়ে চলে, আবার গর্তে লুকায়, কখনও সাঁতার কাটে। তাদের পা এই তিন কাজের উপযোগী করেই তৈরি। পরিবেশ রক্ষায় ঝিনুকেরও রয়েছে অবদান। জীব বৈচিত্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ঝিনুক নিয়ে গঠিত। সামুদ্রিক খাদ্যচক্রকে সচল রাখতে ঝিনুক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরা মৃত জৈব বস্তু খেয়ে জলজ পরিবেশের স্বচ্ছতা বাড়ায়। শামুক এবং ঝিনুক সামুদ্রিক কচ্ছপ ও বিভিন্ন প্রকার মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সাগরের মণিমুক্তা ও প্রবালকে আল্লাহ তাআ'লার নেআমত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সূরা আর রাহমানে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,

يَخْرُجُ مِنْهُمَا اللُّؤْلُؤُ وَالْمَرْجَانُ

'উভয় দরিয়া থেকে উৎপন্ন হয় মোতি ও প্রবাল।' -সূরা আর-রাহমান, আয়াত: ২২

'Out of them come Pearls and Coral:'

فَبِأَيِّ آلَاء رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ

'অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন অবদানকে অস্বীকার করবে?' -সূরা আর-রাহমান, আয়াত: ২৩

'Then which of the favours of your Lord will ye deny?'

وَلَهُ الْجَوَارِ الْمُنشَآتُ فِي الْبَحْرِ كَالْأَعْلَامِ

'দরিয়ায় বিচরণশীল পর্বতদৃশ্য জাহাজসমূহ তাঁরই (নিয়ন্ত্রনাধীন)' -সূরা আর-রাহমান, আয়াত: ২৪

'And His are the Ships sailing smoothly through the seas, lofty as mountains:'

فَبِأَيِّ آلَاء رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ

'অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন অবদানকে অস্বীকার করবে?' -সূরা আর-রাহমান, আয়াত: ২৫

'Then which of the favours of your Lord will ye deny?'

সাগরের মাছ:

সাগরের আয়তন ও গভীরতা যেমন বিশাল, বিস্তীর্ণ এবং বিস্ময়কর। তেমনি এর বৈচিত্র্যময় প্রাণী সংখ্যারও যেন ইয়ত্তা নেই। সাগরে কত জাতের কত বর্ণের জলজ প্রাণী ও মাছ যে বিচরণশীল তা এই সুবিশাল সাগরের স্রষ্টা একমাত্র মহান আল্লাহ তাআ'লাই সম্যক জ্ঞাত। আমাদের বাংলাদেশে ২৬০ প্রজাতির স্বাদুপানির (মোহনাজলসহ) এবং প্রায় ৪৭৫ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়াও ১২-এর অধিক প্রজাতির চাষকৃত বিদেশী মাছ চাষের জলাশয়ে এবং ৭০-এর অধিক জাতের বিদেশী বাহারী মাছ এ্যাকুয়ারিয়ামে পাওয়া যায়। মৎস্য অধিদপ্তরের (২০০৯) তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে মাছের মোট উৎপাদন ২৫ লক্ষ ৬৩ হাজার ২৯৬ মেট্রিক টন। যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয় (আহরিত) থেকে আসে ১০,৬০,১৮১ মেট্রিক টন, অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয় (চাষকৃত) থেকে আসে ১০,০৫,৫৪২ মেট্রিক টন এবং সমুদ্র থেকে আসে ৪,৯৭,৫৭৩ মেট্রিক টন।

সাগরের মাছগুলোর মধ্যে রয়েছে লাক্ষা, কই কোরাল, দাতিনা কোরাল, রেড স্লাপার। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক মাছ যেমন-ভেটকি, সুরমা, কাটল ফিশ, দেশি স্কুইড, রুপচাঁদা, ম্যাকারে, শ্রিম্প, টুনা, স্যামন, ম্যাকরেল, সারডিন, স্কুইড, লবস্টার, কোরাল, কড ইত্যাদির দেখা মেলে। এসব মাছ আমিষের অন্যতম প্রধান উৎস। এছাড়া সামুদ্রিক মাছে রয়েছে প্রচুর ফ্যাটি এসিড। এই ফ্যাটি এসিড মস্তিষ্ক, চোখ ও স্নায়ুতন্ত্র গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

সামুদ্রিক মাছের উপকারিতা:

সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে বলে শেষ করা যাবে না। মাছ মানুষের হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্ককে কার্যকর ও সুরক্ষিত রাখতে বিরাট ভূমিকা পালন করে। সে কারণে চিকিৎসকেরা দীর্ঘ দিন ধরেই তাদের রোগীদের গোশতের পরিবর্তে অধিক মাছ খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছেন। সাধারণত এশিয়ার মানুষের খাদ্য তালিকায় গোশতের পরিমাণ কম থাকে। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মানুষের আয় বৃদ্ধি ও ক্রমবর্ধমান নগরায়নের কারণে বর্তমানে এতদাঞ্চলের মানুষের খাদ্য তালিকায় পশুজাত খাদ্যের পরিমাণ আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু চিকিৎসক ও গবেষকেরা দীর্ঘ দিন ধরেই বলে আসছেন, গোশতের চেয়ে সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার উপকারিতা অনেক বেশি। কাজেই সামুদ্রিক মাছ বেশি পরিমাণে খেলে তা আমাদের শরীরের প্রধান দুই অঙ্গ হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে থাকে। বস্তুত সামুদ্রিক মাছ মানুষের স্বাস্থ্যরক্ষায় এক বিস্ময়কর উপাদান। এ কারণেই চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিষয়ক গবেষকগন মাছ অধিক পছন্দ করেন, ভালোবাসেন। এমনকি তারা রোগীদেরও অধিক মাছ খাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, মাছের মধ্যে থাকা উপাদানগুলো মানুষের হৃদযন্ত্র কার্যকর ও সুরক্ষিত রাখার জন্য কাজ করে। যেসব কারণে হৃদযন্ত্র অচল ও অকার্যকর হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হয়, তার বিরুদ্ধে লড়াই করে মাছের উপাদানগুলো। হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের গবেষক ড. দারিউস মোজাফফারিয়ান বলেন, কেউ যদি নিয়মিত মাঝারি মাছ খান তাহলে তার হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। সারা বিশ্বে পরিচালিত ৩০ টি বড় ধরনের গবেষণার ফলাফল উল্লেখ করে ড. মোজাফফারিয়ান আরও জানান যে, যারা প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার বা দুইবার মাছ খান তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি গড়ে ৩৬ শতাংশ কমে যায়।

ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদযন্ত্রকে সক্রিয় ও কার্যক্ষম রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর এ মূল্যবান উপাদানের শ্রেষ্ঠ প্রাকৃতিক উৎস হচ্ছে মাছের তেল। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদযন্ত্রের রিদম বা ছন্দকে দ্রুততর করে, ধমনীতে চর্বি জমার মাত্রাকে কমিয়ে দেয়, ধমনীতে পুরনো প্রদাহকে ঠাণ্ডা রাখতে সহায়তা করে ও রক্তচাপকে স্বাভাবিক রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সামুদ্রিক মাছ কেবল আপনার হৃদযন্ত্রের জন্যই উপকারী নয়, এটা আপনার মস্তিষ্ককেও সুরক্ষা দিয়ে থাকে। যারা সামুদ্রিক মাছ বেশি খান তাদের স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেকাংশে কমে যায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এ কমে যাওয়ার হার প্রায় ৪০ শতাংশ। এ ছাড়া বিভিন্ন গবেষণা থেকে এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ও দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা করে থাকে।

২০০৭ সালে প্রায় ১২ হাজার গর্ভবতী নারীর ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, যেসব নারী তাদের গর্ভকালীন সপ্তাহে অন্তত ৩৪০ গ্রাম সামুদ্রিক খাবার খেয়েছেন তাদের সন্তানের বুদ্ধি যেসব নারী অন্য ধরনের খাবার খেয়েছেন তাদের সন্তানের বুদ্ধির চেয়ে ছয় গুণ বেশি। বয়স্কদের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা চলে। সম্প্রতি একটি সুইডিশ গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব যুবক সপ্তাহে একাধিকবার সামুদ্রিক মাছ খান তাদের বুদ্ধি যারা সচরাচর সামুদ্রিক খাবার খান না তাদের চেয়ে ১১ গুণ বেশি। এ ছাড়া যারা মাছ বেশি খান তাদের শেষ বয়সে ডিমেনশিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও অনেকাংশে কমে যায়।

গবেষণায় আরো দেখা গেছে, যারা নিয়মিত সামুদ্রিক খাবার খান (সরাসরি খাদ্য হিসেবে কিংবা পরিপূরক হিসেবে) তাদের শরীর সুস্থ থাকার পাশাপাশি বিষাদগ্রস্ততা বা মনমরা ভাব দূরীভূত হয়। এর কারণ, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড মস্তিষ্কের দু’টি প্রধান রাসায়নিক উপাদান সেরোটোনিন ও ডুপামাইনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এ দু’টি উপাদানের মাত্রা বা পরিমাণ কম থাকলেই মানসিক বিষাদগ্রস্ততা বা মনমরা ভাব সৃষ্টি হয়।

সংক্ষেপে সামুদ্রিক মাছের কয়েকটি অনন্য উপকারিতা:

১. সামুদ্রিক মাছের আমিষ সহজে পরিপাকযোগ্য। এছাড়া দেহের বৃদ্ধি ও ক্ষয়রোধে সাহায্য করে।
২. ভিটামিন বি-এর উৎকৃষ্ট উৎস। বিশেষ করে স্যামন মাছে প্রচুর ভিটামিন বি-১২ রয়েছে।
৩. জিংক ও আয়োডিন আছে। জিংক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং আয়োডিন গলগণ্ড রোগ প্রতিরোধ করে।
৪. এ ছাড়া এসব মাছে প্রচুর সিলেনিয়াম রয়েছে, যা দেহে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে।
৫. স্যামন, ম্যাকরেল মাছ থেকে ভিটামিন-এ ও ডি পাওয়া যায়।
৬. সামুদ্রিক মাছের অমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড হৃদযন্ত্রের জন্য উপকারী। এই ফ্যাটি এসিড হৃদরোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।
৭. এ ধরনের মাছ রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
৮. এই মাছের আমিষ ও তেল দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
৯. ডায়াবেটিস রোগীরা খাদ্য তালিকায় সামুদ্রিক মাছ রাখতে পারেন।

আল-কুরআনে সামুদ্রিক মাছ প্রসঙ্গ:

পবিত্র কুরআনেও সামুদ্রিক মাছের কথা উল্লেখ করা হয়েছে একাধিক প্রসঙ্গে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَهُوَ الَّذِي سَخَّرَ الْبَحْرَ لِتَأْكُلُواْ مِنْهُ لَحْمًا طَرِيًّا وَتَسْتَخْرِجُواْ مِنْهُ حِلْيَةً تَلْبَسُونَهَا وَتَرَى الْفُلْكَ مَوَاخِرَ فِيهِ وَلِتَبْتَغُواْ مِن فَضْلِهِ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ

'তিনিই কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন সমুদ্রকে, যাতে তা থেকে তোমরা তাজা মাংস খেতে পার এবং তা থেকে বের করতে পার পরিধেয় অলঙ্কার। তুমি তাতে জলযান সমূহকে পানি চিরে চলতে দেখবে এবং যাতে তোমরা আল্লাহর কৃপা অন্বেষণ কর এবং যাতে তার অনুগ্রহ স্বীকার কর।' -সূরা আন-নাহল, আয়াত: ১৪

It is He Who has made the sea subject, that ye may eat thereof flesh that is fresh and tender, and that ye may extract therefrom ornaments to wear; and thou seest the ships therein that plough the waves, that ye may seek (thus) of the bounty of Allah and that ye may be grateful.

অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَمَا يَسْتَوِي الْبَحْرَانِ هَذَا عَذْبٌ فُرَاتٌ سَائِغٌ شَرَابُهُ وَهَذَا مِلْحٌ أُجَاجٌ وَمِن كُلٍّ تَأْكُلُونَ لَحْمًا طَرِيًّا وَتَسْتَخْرِجُونَ حِلْيَةً تَلْبَسُونَهَا وَتَرَى الْفُلْكَ فِيهِ مَوَاخِرَ لِتَبْتَغُوا مِن فَضْلِهِ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ

'দু’টি সমুদ্র সমান হয় না-একটি মিঠা ও তৃষ্ণানিবারক এবং অপরটি লোনা। ঊভয়টি থেকেই তোমরা তাজা গোশত (মৎস) আহার কর এবং পরিধানে ব্যবহার্য গয়নাগাটি আহরণ কর। তুমি তাতে তার বুক চিরে জাহাজ চলতে দেখ, যাতে তোমরা তার অনুগ্রহ অন্বেষণ কর এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।' -সূরা আল-ফাতির, আয়াত: ১২

Nor are the two bodies of flowing water alike,- the one palatable, sweet, and pleasant to drink, and the other, salt and bitter. Yet from each (kind of water) do ye eat flesh fresh and tender, and ye extract ornaments to wear; and thou seest the ships therein that plough the waves, that ye may seek (thus) of the Bounty of Allah that ye may be grateful.

বক্ষমান আয়াতদ্বয়ে সাগরের মাছকে আল্লাহ তাআ'লা তাজা গোশত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাজা গোশতের উপকারিতার শেষ নেই। তাজা গোশত মূলত: পূর্বোক্ত সামুদ্রিক মাছের বহুবিধ উপকারিতারই ইঙ্গিত করছে। সামুদ্রিক বড় বড় মাছের হাড় দিয়ে বিভিন্ন অলংকার ও আসবাব বানানো হয়। আল্লাহ তাআ'লা সেদিকেও ইঙ্গিত করেছেন আয়াতদ্বয়ে। আর সামুদ্রিক বিভিন্ন শৈবাল ও শামুকে মুক্তো পাওয়া যায়, যা মূল্যবান অলংকারাদিতে শোভা বৃদ্ধি করে। তাছাড়া মানুষের উপকারার্থেই আল্লাহ তাআ'লা সাগর ও এর উদরস্থ যাবতীয় সামগ্রী প্রস্তুত করেছেন। তাই তিনি এর শিকার ও তার গোশত ভক্ষণ বৈধ আখ্যা দিয়েছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

أُحِلَّ لَكُمْ صَيْدُ الْبَحْرِ وَطَعَامُهُ مَتَاعًا لَّكُمْ وَلِلسَّيَّارَةِ وَحُرِّمَ عَلَيْكُمْ صَيْدُ الْبَرِّ مَا دُمْتُمْ حُرُمًا وَاتَّقُواْ اللّهَ الَّذِيَ إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ

'তোমাদের জন্য সমুদ্রের শিকার ও সুমুদ্রের খাদ্য হালাল করা হয়েছে তোমাদের উপকারার্থে এবং তোমাদের এহরামকারীদের জন্যে হারাম করা হয়েছে স্থল শিকার যতক্ষণ এহরাম অবস্থায় থাক। আল্লাহকে ভয় কর, যার কাছে তোমরা একত্রিত হবে।' -সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ৯৬

Lawful to you is the pursuit of water-game and its use for food,- for the benefit of yourselves and those who travel; but forbidden is the pursuit of land-game;- as long as ye are in the sacred precincts or in pilgrim garb. And fear Allah, to Whom ye shall be gathered back.

মানবেতিহাসের সূচনা থেকেই দেখা গেছে, সমুদ্র তীরের মানুষ তাদের জীবিকার সন্ধানে সাগর ভ্রমণ করেছেন। সাগরের পানির পবিত্রতা, এর প্রাণী শিকার ও মাছের গোশত আহারের বৈধতা ঘোষিত হয়েছে তাই রাসূলে মাকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জবানেও। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু তাআ'লা ‘আনহু বলেন, “এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করলো, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা সমুদ্র বিহার করি। আমাদের সঙ্গে যৎসামান্য পানি থাকে। তা দিয়ে যদি আমরা অযু করি, তাহলে পিপাসার্ত হয়ে যাব। আমরা কি তাহলে সাগর থেকে (এর পানি দিয়ে) অযু করব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এর (সাগরের) পানি পবিত্র এবং এর মৃত হালাল।”

দুই সাগরের পানি মিশ্রিত হয় না পরস্পর: বিস্ময়কর অদৃশ্য অন্তরায়:

আধুনিক বিজ্ঞানের বিবিধ আবিষ্কার উদ্ভাবনের ফলে পর্যাপ্ত উপায় উপকরণ থাকার কারণে বিজ্ঞানীগণ গবেষণার মাধ্যমে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন - দুই সমুদ্রের পানি পরস্পর মিশ্রিত হয় না। একইসাথে প্রবাহিত হওয়ার পরেও দু'টি পানির ধারা সম্মিলিত হয় না পরস্পর। যেমন, রোম সাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরের পানি একটি অপরটির সঙ্গে একীভুত হতে পারে না। সেখানে রয়েছে বিস্ময়কর এক অদৃশ্য অন্তরায়। অথচ যে যুগে এই ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর কোনো যন্ত্রসামগ্রী ছিল না, আবিষ্কার উদ্ভাবনহীন সেই সময়ে, ১৪ শ বছর আগে বিষ্ময়করভাবে কুরআন বলে দিয়েছে:

مَرَجَ الْبَحْرَيْنِ يَلْتَقِيَانِ

'তিনি পাশাপাশি দুই দরিয়া প্রবাহিত করেছেন।' -সূরা আর-রাহমান, আয়াত: ১৯

'He has let free the two bodies of flowing water, meeting together:'

بَيْنَهُمَا بَرْزَخٌ لَّا يَبْغِيَانِ

'উভয়ের মাঝখানে রয়েছে এক অন্তরাল, যা তারা অতিক্রম করে না।' -সূরা আর-রাহমান, আয়াত: ২০

'Between them is a Barrier which they do not transgress:'

فَبِأَيِّ آلَاء رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ

'অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন অবদানকে অস্বীকার করবে?' -সূরা আর-রাহমান, আয়াত: ২১

'Then which of the favours of your Lord will ye deny?'

এখানে দুই সমুদ্র বলতে মিঠা ও লোনা পানির সমুদ্রকে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীতে উভয় প্রকার দরিয়া সৃষ্টি করেছেন। কোনো কোনো স্থানে উভয় দরিয়া একত্রে মিলিত হয়ে যায়, যার নজির পৃথিবীর বিভিন্ন ভূখণ্ডে পরিদৃষ্ট হয়। কিন্তু যে স্থানে মিঠা ও লোনা উভয় প্রকার দরিয়া পাশাপাশি প্রবাহিত হয় সেখানে বেশ দূর পর্যন্ত উভয়ের পানি আলাদা ও স্বতন্ত্র থাকে। একদিকে থাকে মিঠা পানি, অপরদিকে লোনা পানি। কোথাও কোথাও এ মিঠা ও লোনা পানি উপরে এবং নীচেও প্রবাহিত হয়। পানি তরল ও সূক্ষ্মপদার্থ হওয়া সত্ত্বেও পরস্পরে মিশ্রিত হয় না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

أَمَّن جَعَلَ الْأَرْضَ قَرَارًا وَجَعَلَ خِلَالَهَا أَنْهَارًا وَجَعَلَ لَهَا رَوَاسِيَ وَجَعَلَ بَيْنَ الْبَحْرَيْنِ حَاجِزًا أَإِلَهٌ مَّعَ اللَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ

'বল তো কে পৃথিবীকে বাসোপযোগী করেছেন এবং তার মাঝে মাঝে নদ-নদী প্রবাহিত করেছেন এবং তাকে স্থিত রাখার জন্যে পর্বত স্থাপন করেছেন এবং দুই সমুদ্রের মাঝখানে অন্তরায় রেখেছেন। অতএব, আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য আছে কি? বরং তাদের অধিকাংশই জানে না।' -সূরা আন-নামল, আয়াত: ৬১

Or, Who has made the earth firm to live in; made rivers in its midst; set thereon mountains immovable; and made a separating bar between the two bodies of flowing water? (can there be another) god besides Allah. Nay, most of them know not.

অন্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে:

وَهُوَ الَّذِي مَرَجَ الْبَحْرَيْنِ هَذَا عَذْبٌ فُرَاتٌ وَهَذَا مِلْحٌ أُجَاجٌ وَجَعَلَ بَيْنَهُمَا بَرْزَخًا وَحِجْرًا مَّحْجُورًا

'তিনিই সমান্তরালে দুই সমুদ্র প্রবাহিত করেছেন, এটি মিষ্ট, তৃষ্ণা নিবারক ও এটি লোনা, বিস্বাদ; উভয়ের মাঝখানে রেখেছেন একটি অন্তরায়, একটি দুর্ভেদ্য আড়াল।' -সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৫৩

It is He Who has let free the two bodies of flowing water: One palatable and sweet, and the other salt and bitter; yet has He made a barrier between them, a partition that is forbidden to be passed.

জ্যাক ভি. কোস্টা নামের এক ফরাসি বিজ্ঞানী সমুদ্রের ভেতরস্থ পানি গবেষণা বিষয়ে প্রসিদ্ধ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন রোম সাগর এবং আটলান্টিক মহাসাগর রাসায়নিক দিক থেকে একটি অন্যটির চেয়ে ভিন্ন রকম। তিনি এ বাস্তব সত্যটি অনুধাবন করার জন্য জিব্রাল্টার এর দুই সমুদ্রের মিলন কেন্দ্রের কাছাকাছি সমুদ্রের তলদেশে গবেষণা চালান, সেখান থেকে তথ্য পান যে জিব্রাল্টার উত্তর তীর (মারুকেশ) আর দক্ষিণ তীর (স্পেন) থেকে আশাতীতভাবে একটি মিষ্টি পানির ঝর্ণা উথলে ওঠে। এ বড় ঝর্ণাটি উভয় সমুদ্রের মধ্য দিয়ে ৪৫ সূক্ষ্ম কোণে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়ে চিরুনির দাঁতের আকৃতি ধারণ করে বাঁধের ন্যায় কাজ করে। এ ক্রিয়াকলাপের ফলে রোম সাগর এবং আটলান্টিক মহাসাগর একটি আরেকটির সঙ্গে মিশতে পারে না। দু’টি সমুদ্রের মিলনস্থলে যে পৃথকীকরণ বা পর্দা রয়েছে তা খালি চোখে বুঝার উপায় নেই। কেননা বাহ্যত সব সাগর একই রূপের মনে হয়।

শুধু তিনি নন; বরং অনেক মেরিন বিজ্ঞানীই এই রহস্য ভেদ করতে ব্যর্থ হন। ১৯৪২ সালে শতাধিক মেরিন স্টেশন বসিয়ে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়, কোন জিনিস দুই সাগরের মিলন কেন্দ্রে বাঁধা সৃষ্টি করে আছে? তারা সেখানে আলো পরীক্ষা করেন, বাতাস পরীক্ষা করেন এবং মাটি পরীক্ষা করে এর মধ্যে কোনো বাধা বা পর্দা সৃষ্টি করার কারণ খুঁজে পান নি। এখানে পানির একটি হালকা, একটি ঘন রং পরিলক্ষিত হয়। যা খালি চোখে প্রত্যক্ষ করা সম্ভব নয়। এমনকি বিজ্ঞানীরা আরো গভীরভাবে বিষয়টি উপলব্ধির জন্য এবং আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের দূরে থেকে অনুধাবনের পদ্ধতির মাধ্যমে এর ছবি ধারণ করেন। ভূমধ্য সাগরের পানি গাঢ় নীল এবং আটলান্টিক সাগরের পানি হালকা নীল, আর জিবরাল্টার সেল যা পাহাড়াকৃতির এবং তার রং হল খয়েরি।

ভূমধ্য সাগরের পানি আটলান্টিকের তুলনায় অনেক বেশি ঘন, উষ্ণতা এবং লবণাক্ত। আরো মজার ব্যাপার হলো, ভূমধ্য সাগরের পানি জিব্রাল্টার সেল বা সাগর তলের উঁচু ভূমির উপর দিয়ে আটলান্টিক সাগরের মধ্যে শতাধিক কিলোমিটার প্রবেশ করেছে এবং তা ১০০০ হাজার মিটার গভীরে পৌঁছার পরেও তার উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যের ও রঙ্গের কোনো পরিবর্তন সাধিত হয়নি। যদিও এতদুভয়ের মাঝে রয়েছে প্রচণ্ড ঢেউ, প্রবল খরস্রোত এবং উত্তাল তরঙ্গ তথাপিও এ উভয় পানি পরস্পর মিশ্রিত হয় না এবং একে অন্যকে অতিক্রম করতে পারে না। যেহেতু উভয়ের মাঝে রয়েছে একটি পর্দা। যেমনটি বলা হয়েছে পবিত্র কুরআনে প্রাগুক্ত আয়াতে। সাগরের এ বিস্ময়কর সৃষ্টি রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে অনেক গবেষক কুরআনের প্রাগুক্ত আয়াতে এর অলৌকিকতার সন্ধান পেয়েছেন। তাদের কেউ কেউ এ সত্যের সামনে নিজেদের বিশ্বাসকেও পাকা করে নিয়েছেন ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে, যা বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। ফ্রান্সের সমুদ্র বিজ্ঞানী ড. কোস্টাও ইসলাম গ্রহণ করেছেন বলে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়।

কেন এ অদৃশ্য পর্দা?

মিষ্টি পানি হলো সুপেয় নদীর পানি। এ পানি মানুষের পিপাসা নিবারণের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। নদীর মিষ্টি পানি না থাকলে সভ্যতা মরে যেত। আর লোনা পানি হলো সাগরের অতল জলরাশি। নদীর পানির মিষ্টতার মতো সাগরের পানির লবণাক্ততাও অতি প্রয়োজনীয়। সাগরের পানি মিঠা হলে বাতাস দূষিত হয়ে যেত। জলে-স্থলে সব প্রাণী মরে যেত। সাগরের পানি লবণাক্ত হওয়ায় বাতাস সর্বদা আর্দ্র থাকে এবং এতে মারা যাওয়া প্রাণীর দেহ পচে না। সাগরের মরদেহ পচে গেলে বাতাস দূষিত হত এবং এর প্রাণবৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ে যেত।

সাগর নিয়ে আরও কিছু তথ্য:

পৃথিবীর বারিমণ্ডল ৪ ভাগে বিভক্ত। যথা- সাগর, মহাসাগর, নদী ও হ্রদ। পৃথিবীতে ৫ টি মহাসাগর রয়েছে। যথা :
১. প্রশান্ত মহাসাগর,
২. আটলান্টিক মহাসাগর,
৩. ভারত মহাসাগর,
৪. উত্তর মহাসাগর এবং
৫. দক্ষিণ মহাসাগর। এসব ছাড়াও অনেক সাগর আছে।

প্রশান্ত মহাসাগর:

প্রশান্ত মহাসাগরের ইংরেজি নাম: Pacific Ocean; লাতিন ভাষায় একে বলে: Mare Pacificu। পৃথিবীর বৃহত্তম মহাসাগর এটি। প্রশান্ত মহাসাগর দক্ষিণে অ্যান্টার্কটিকা পর্যন্ত বিস্তৃত। পশ্চিমে এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া ঘেরা এবং এর পূর্বে রয়েছে দুই আমেরিকা মহাদেশ। প্রশান্ত মহাসাগরের আয়তন ১৬৯.২ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার (৬৫.৩ মিলিয়ন বর্গমাইল), যা পৃথিবী পৃষ্ঠের প্রায় ৩২ শতাংশ, সমস্ত জলভাগের ৪৬% এবং পৃথিবীর সমস্ত ভূপৃষ্ঠের চেয়ে আয়তনে এটি বেশি বড়। ভু-মধ্যরেখা একে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর এবং দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে ভাগ করেছে। এর গভীরতা ৪,০০০ মিটার (১৩,০০০ ফুট) এবং পশ্চিম উত্তর প্রশান্ত সাগরের মারিয়ানা টেঞ্চ হলো পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম বিন্দু যার গভীরতা ১০,৯১১ মিটার (৩৫,৭৯৭ ফুট)।

উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, প্রশান্ত মহাসাগরে মোট দ্বীপের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার, যা বাকি চারটি মহাসাগরের সম্মিলিত দ্বীপের সংখ্যার চেয়ে বেশি। বেশির ভাগ দ্বীপ দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত। প্রশান্ত মহাসাগরে মাইক্রোনেশিয়া, পলিনেশিয়ার মতো ছোট দ্বীপ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে তাইওয়ান, নিউ গায়ানার মতো বড় দ্বীপ। নাম প্রশান্ত হলেও বিশ্বের প্রায় ৭০ শতাংশ আগ্নেয়গিরি এই মহাসাগরে অবস্থিত। গ্রেট বেরিয়ার রিফ বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোরাল রিফ, যা প্রশান্ত মহাসাগরের অন্তর্গত। প্রশান্ত মহাসাগরে রয়েছে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ কিছু নৌ রুট ও বন্দর। বন্দরগুলোর মধ্যে সিডনি হারবার, সাংহাই, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, সানফ্রান্সিসকো ও লস অ্যাঞ্জেলেস অন্যতম।

প্রশান্ত মহাসাগরের রহস্যময় মারিয়ানা ট্রেঞ্চ:

গভীরতম গর্ত দেখলে আঁতকে ওঠা স্বাভাবিক। আর সেটা যদি হয় পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম খাদ তাহলে বিষয়টা কেমন হয়? পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম স্থান হল মারিয়ানা ট্রেঞ্চ বা মারিয়ানাস ট্রেঞ্চ। বলা হয়ে থাকে, চাঁদে যত জন মানুষ গিয়েছে তার চেয়ে কম মানুষ গিয়েছে মারিয়ানা ট্রেঞ্চে। এতটাই গভীর আর দূর্গম সেই স্থান। মারিয়ানা ট্রেঞ্চ প্যাসিফিক মহাসাগরে অবস্থিত। এটি সুচালো খাড়া একটি খাদ যার সর্বোচ্চ গভীরতা ১০,৯৯৪ মিটার। যদিও এই গভীরতা আরও বেশি হতে পারে বলে অনেকের ধারণা। এটি ২৫৫০ কিলোমিটার লম্বা এবং ৬৯ কিলোমিটার চওড়া।

সমুদ্র মহাসমুদ্রের তলে এরকম ২২ টি ট্রেঞ্চের সন্ধান পেয়েছেন এ পর্য্যন্ত সমুদ্র বিজ্ঞানীরা। এর আঠারোটিই রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরে। ৪.১৮৮ কিলোমিটার (১৩৭৪০ ফুট) গভীরতা নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগর হলো সবচেয়ে গভীর মহাসাগর আর এখানে দেখতে পাওয়া অনেক ট্রেঞ্চের মধ্যে মারিয়ানাই হলো গভীরতম ট্রেঞ্চ। এই “মারিয়ানা” কে? মারিয়ানা হলেন সতের শতকের স্পেনের রানী, স্পেনের রাজা চতুর্থ ফিলিপের পত্নী। ১৬৬৭ সালে স্পেনিয়াডরা প্রশান্ত মহাসাগরের যে দ্বীপগুলো দখল করে কলোনী প্রতিষ্ঠা করেন, রানীর সম্মানার্থে তার অফিসিয়াল নামকরন করেন “লা মারিয়ানাস”। আর এই ট্রেঞ্চটি মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের একদম কাছে বলে এর নামটিও হয়ে যায় “মারিয়ানা ট্রেঞ্চ”। অন্যান্য সব ট্রেঞ্চের মতো এই মারিয়ানা ট্রেঞ্চের জন্মও হয়েছে মাটির পৃথিবীর অভ্যন্তরে সচল “টেকটোনিক প্লেট”গুলোর ধাক্কাধাক্কির ফলে। প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে রয়েছে এরকম দু’দুটো সচল প্লেট। এর একটি “পেসিফিক প্লেট”।
দৈত্যাকৃতির এই পেসিফিক প্লেটটি পশ্চিমে সরতে সরতে ইওরেশিয়ান প্লেটের সাথে সংঘর্ষে জাপানের পূর্বদিকে তৈরী করেছে অসংখ্য আগ্নেয়গিরিসহ ডুবন্ত পাহাড় শ্রেনীর। আর দক্ষিন পশ্চিমে রয়েছে যে নবীন ফিলিপিনো প্লেট তার সাথে সংঘর্ষে গিয়ে লজ্জায় ডুব দিয়েছে ফিলিপিন প্লেটের নীচে।

মারিয়ানা ট্রেঞ্চেরও গভীরতম অঞ্চল হলো গুয়াম দ্বীপের ২১০ মাইল দক্ষিন-পশ্চিমে অবস্থিত “চ্যালেঞ্জার ডীপ”। এ পর্য্যন্ত মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতা মাপতে ডিরেক্ট ইনডিরেক্ট অনেক অভিযান চালানো হয়েছে তবে মাত্র তিনটি সাবমার্সিবল বা ডুবো জাহাজের অভিযান সফল বলে ধরা হয়। শুনতে আজব শোনালেও সত্যিই কিন্তু মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতা মাপা হয়েছিল “বম্বসাউন্ডিং” করে। যেখানে সাধারন ছোটখাট শব্দ উৎপন্ন করে পানির গভীরতা মাপা হয়, সেখানে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতা মাপা হয় আধা পাউন্ডের একটি টিএনটি ব্লক ব্যবহার করে প্রতিধ্বনির মাধ্যমে। যদিও বিজ্ঞানীরা জোর গলায় বলতে পারছেন না যে, এটিই আসল গভীরতা।
সবচেয়ে উত্তেজনাকর বিষয় হল সম্প্রতি এখানে দৈত্যাকার প্রাণীর উপস্থিতি টের পাওয়া গিয়েছে; বিজ্ঞানীরা যাকে এলিসেলা জাইগেনশিয়া বলে নামকরণ করেছেন, যা সাধারন এম্ফিপোডের ২০ গুণ বড়। এই দূর্গম স্থানে প্রাণের বিকাশ গবেষকদের নতুন চিন্তার ধারা উন্মোচন করেছে। প্রবল চাপের মাঝেও জীবনের এই বিকাশ হয়তো ভবিষ্যতে মহাকাশে প্রানের বিকাশ নিয়ে গবেষণা করতে সাহায্য করবে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের।

শত বছর ধরে মানুষের কৌতূহলের কেন্দ্র বিন্দু এই মারিয়ানা ট্রেঞ্চ। কত রহস্য, কত অজানা এই ট্রেঞ্চকে ঘিরে। রহস্যের নেই কোন শেষ, আছে মৃত্যুর হাতছানি- তবুও রহস্যপ্রিয় মানুষের কাছে চির আপন এই মারিয়ানা ট্রেঞ্চ।

আটলান্টিক মহাসাগর:

আটলান্টিক মহাসাগর বা অতলান্ত মহাসাগরের ইংরেজি নাম: Atlantic Ocean। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাসাগর। এর আয়তন ১০৬.৪ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার (৪১.১ মিলিয়ন বর্গমাইল)। এটি পৃথিবীপৃষ্ঠের প্রায় এক পঞ্চমাংশ এলাকা জুড়ে অবস্থিত। আটলান্টিক মহাসাগরের পশ্চিমে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ এবং পূর্বে ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশ অবস্থিত। উত্তরে উত্তর মহাসাগর এবং দক্ষিণে দক্ষিণ মহাসাগর।

ধারনা করা হয়, পৃথিবীর মহাসাগরগুলোর মধ্যে আটলান্টিক বয়সে সবচেয়ে নবীন। ভূতাত্ত্বিকেরা ধারণা করেন, এর গঠন শুরু হয় জুরাসিক আমলে। প্রথম যে মহাসাগর জাহাজ ও বিমানে পাড়ি দেওয়া হয়, সেটি আটলান্টিক। পুয়ের্তোরিকো ট্রেঞ্চ আটলান্টিকের গভীরতম এলাকা। এর গভীরতা প্রায় সাড়ে আট হাজার মিটার। আটলান্টিক মহাসাগরের সবচেয়ে বড় দ্বীপ গ্রিনল্যান্ড।

মেক্সিকোর ইউকাটান উপকূলের অদূরবর্তী ক্যানকান রিফ আটলান্টিকের সবচেয়ে বড় এবং গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রবালপ্রাচীর। আটলান্টিকের তলদেশ দিয়ে সর্বপ্রথম টেলিগ্রাফের তার বসানো হয় ১৮৬৬ সালে। এ কাজে সাহায্য নেওয়া হয়েছিল ওই সময়ের বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজ দ্য গ্রেট ইস্টার্নের। রহস্যময় বারমুডা ট্রায়াঙ্গল আটলান্টিক মহাসাগরেই অবস্থিত। প্রায়ই এই এলাকা থেকে জাহাজ কিংবা উড়োজাহাজ নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার জনশ্রুতি রয়েছে। যদিও উপকূলরক্ষীদের সংগৃহীত তথ্য এ বিশ্বাসকে সমর্থন করে না।

১৯১৯ সালে জন এলকক ও আর্থার ব্রাউন প্রথম বিরতিহীন বিমান চালিয়ে আটলান্টিক অতিক্রম করেন। এতে তাঁদের সময় লেগেছিল প্রায় সাড়ে ১৬ ঘণ্টা। ১৯১২ সালে বিখ্যাত জাহাজ টাইটানিক আটলান্টিকেই ডুবেছিল। এ ছাড়া ট্রাফালগার যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর নেপোলিয়নকে আটলান্টিকের সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত করা হয়।

ভারত মহাসাগর:

ভারত মহাসাগর হল বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মহাসাগর। পৃথিবীর মোট জলভাগের ২০ শতাংশ এই মহাসাগর অধিকার করে আছে।[১] এই মহাসাগরের উত্তর সীমায় রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশ; পশ্চিমে রয়েছে পূর্ব আফ্রিকা; পূর্বে রয়েছে ইন্দোচীন, সুন্দা দ্বীপপুঞ্জ ও অস্ট্রেলিয়া; এবং দক্ষিণে রয়েছে দক্ষিণ মহাসাগর (সংজ্ঞান্তরে অ্যান্টার্কটিকা)। ভারত মহাসাগরই একমাত্র মহাসাগর যেটির নামকরণ কোনো দেশের (এক্ষেত্রে ভারত) নামানুসারে হয়েছে।

ভারত মহাসাগর বিশ্ব মহাসাগরগুলির সঙ্গে আন্তঃসম্পর্কযুক্ত। ২০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমা আটলান্টিক মহাসাগর থেকে এবং ১৪৬°৫৫' পূর্ব দ্রাঘিমা প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগরকে বিচ্ছিন্ন করেছে।[৫] ভারত মহাসাগরের সর্ব-উত্তর অংশটি পারস্য উপসাগরের ৩০ ডিগ্রি অক্ষরেখায় অবস্থিত। দক্ষিণভাগে (আফ্রিকা থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত) ভারত মহাসাগরের প্রস্থ প্রায় ১০,০০০ কিলোমিটার (৬,২০০ মাইল)। লোহিত সাগর ও পারস্য উপসাগর সহ এই মহাসাগরের মোট আয়তন ৭৩,৫৫৬,০০০ বর্গ কিলোমিটার (২৮,৩৫০,০০০ বর্গ মাইল)।

ভারত মহাসাগরের ঘনত্ব ২৯২,১৩১,০০০ ঘন কিলোমিটার (৭০,০৮৬,০০০ ঘন মাইল)।[৭] মহাসাগরের মহাদেশীয় প্রান্তসীমায় অনেক ছোটো ছোটো দ্বীপ অবস্থিত। ভারত মহাসাগরে অবস্থিত দ্বীপরাষ্ট্রগুলি হল মাদাগাস্কার (বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম দ্বীপ), রিইউনিয়ন দ্বীপ, কোমোরোস, সেশেল, মালদ্বীপ, মরিশাস ও শ্রীলঙ্কা। ইন্দোনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জ এই মহাদেশের পূর্ব সীমায় অবস্থিত।

উত্তর মহাসাগর:

উত্তর মহাসাগর বা সুমেরু মহাসাগর উত্তর গোলার্ধের সুমেরু অঞ্চলে অবস্থিত বিশ্বের ক্ষুদ্রতম এবং সর্বাপেক্ষা কম গভীর একটি মহাসাগর। এটি পৃথিবীর পাঁচটি প্রধান মহাসাগরের অন্যতম।[১] ইন্টারন্যাশানাল হাইড্রোগ্রাফিক অর্গানাইজেশন (আইএইচও) তথা আন্তর্জাতিক জললেখচিত্রন সংস্থা এটিকে মহাসাগরের স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে কোনো কোনো সমুদ্রবিদ এটিকে সুমেরু ভূমধ্যসাগর (Arctic Mediterranean Sea) বা সুমেরু সাগর (Arctic Sea)। তাঁদের মতে এটি আটলান্টিক মহাসাগরের একটি ভূমধ্যসাগর।[২] অন্যমতে, উত্তর মহাসাগর সব মহাসাগরের সমষ্টি বিশ্ব মহাসাগরের সর্ব-উত্তরে অবস্থিত অংশ।

উত্তর মহাসাগরের প্রায় সমগ্র অংশই ইউরেশিয়া ও উত্তর আমেরিকা মহাদেশ দ্বারা বেষ্টিত। বছরের অধিকাংশ সময় এই মহাসাগরের অংশবিশেষ সামুদ্রিক বরফে ঢাকা থাকে।[৩] শীতকালে সম্পূর্ণ মহাসাগরটিই বরফে ঢাকা পড়ে যায়। উত্তর মহাসাগরের তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা ঋতু অণুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়। সমুদ্রের বরফের আবরণীর গলন ও জমাট বাঁধার কারণেই এমনটি হয়ে থাকে।[৪] পাঁচটি প্রধান মহাসাগরের তুলনায় এই মহাসাগরের জলের লবণাক্ততা কম। এর কারণ, বাষ্পীভবনের নিম্ন হার, বিভিন্ন বড়ো ও ছোটো নদী থেকে এসে মেশা মিষ্টি জলের প্রবাহ এবং পার্শ্ববর্তী উচ্চ লবণাক্ততাযুক্ত মহাসাগরগুলির সঙ্গে সীমাবদ্ধ সংযোগ ও বহির্গমন স্রোত। গ্রীষ্মকালে প্রায় ৫০% বরফ গলে যায়।[১] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশানাল স্নো অ্যান্ড আইস ডেটা সেন্টার (এনএসআইডিসি) উপগ্রহ তথ্যের মাধ্যমে গড় সময়কাল ও নির্দিষ্ট পূর্ববর্ষের সঙ্গে তুলনা করার জন্য উত্তর মহাসাগরের বরফাবরণী ও বরফ গলনের দৈনিক তথ্য রাখে।

সমুদ্রগর্ভ:

লোমোনোসোভ শৈলশিরা নামে একটি সমুদ্রগর্ভস্থ শৈলশিরা গভীর সমুদ্রের তলায় অবস্থিত উত্তর মেরু সামুদ্রিক অববাহিকাটিকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। একটি হল ইউরেশীয় সামুদ্রিক অববাহিকা; এর গভীরতা ৪,০০০ এবং ৪,৫০০ মি (১৩,১০০ এবং ১৪,৮০০ ফু)। অপরটি হল আমেরেশীয় সামুদ্রিক অববাহিকা (এটি উত্তর আমেরিকান বা হাইপারবোরিয়ান সামুদ্রিক অববাহিকা নামেও পরিচিত); এর গভীরতা ৪,০০০ মি (১৩,০০০ ফু)। সমুদ্রের তলদেশে অনেক ফল্ট-ব্লক শৈলশিরা, নিতলীয় সমভূমি, খাত ও অববাহিকা দেখা যায়। উত্তর মহাসাগরের গড় গভীরতা ১,০৩৮ মি (৩,৪০৬ ফু)।[১০] গভীরতম বিন্দুটি অবস্থিত ইউরেশীয় অববাহিকায়; এর গভীরতা ৫,৪৫০ মি (১৭,৮৮০ ফু)।

দুটি প্রধান অববাহিকা একাধিক শৈলশিরা দ্বারা ক্ষুদ্রতর অংশে বিভক্ত। এগুলি হল কানাডা সামুদ্রিক অববাহিকা (কানাডা/আলাস্কা ও আলফা শৈলশিরার মধ্যে অবস্থিত), মাকারোভ সামুদ্রিক অববাহিকা (আলফা ও লোমোনোসোভ শৈলশিরার মধ্যে অবস্থিত), ফ্রাম সামুদ্রিক অববাহিকা (লোমোনোসোভ ও গেক্কেল শৈলশিরার মধ্যে অবস্থিত) ও নানসেন সামুদ্রিক অববাহিকা (অ্যামান্ডসেন সামুদ্রিক অববাহিকা) (গেক্কেল শৈলশিরা ও ফ্রাঞ্জ জোসেফ ল্যান্ডের মহীসোপানের মধ্যে অবস্থিত)।

দক্ষিণ মহাসাগর:

পৃথিবীর একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে যে বিপুল পরিমাণ জলরাশির অবস্থান, সেটিই দক্ষিণ মহাসাগর বা অ্যান্টার্কটিকা মহাসাগর নামে পরিচিত। আয়তনে এটি পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম মহাসাগর। ধারণা করা হয়, আজ থেকে প্রায় তিন কোটি বছর আগে অ্যান্টার্কটিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা একে অন্য থেকে পৃথক হয়ে যাওয়ার ফলে এ মহাসাগরটির জন্ম। মহাসাগরগুলোর মধ্যে এটিকেই সবচেয়ে নবীন বলে মনে করা হয়। দক্ষিণ মহাসাগরের সাগরগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যামুন্ডসেন সাগর। অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের পশ্চিমাংশে এ সাগরটির অবস্থান। সাগরটির বেশির ভাগ অংশই সারা বছর বরফাবৃত থাকে। দক্ষিণ মহাসাগরের আরেকটি সাগরের নাম বেলিংশসেন সাগর। এটির আয়তন প্রায় চার লাখ ৮৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং সর্বোচ্চ গভীরতা চার হাজার ৪৭০ মিটার। কমনওয়েলথ সাগরটি প্রায় দুই লাখ ৫৮ হাজার কিলোমিটার বিস্তৃত। এটিও দক্ষিণ মহাসাগরের একটি অংশ। এ সাগরটির পূর্বে ডেভিস সাগর ও পশ্চিমে কসমোনটস সাগরের অবস্থান। কসমোনটস সাগর ও ডেভিস সাগর দুটিই দক্ষিণ মহাসাগরের অংশ। কসমোনটস সাগরের আয়তন প্রায় ছয় লাখ ৯৯ হাজার বর্গকিলোমিটার। ডেভিস সাগরটি আয়তনে খুব ছোট। এর আয়তন মাত্র ২১ হাজার কিলোমিটার এবং সর্বোচ্চ গভীরতা এক হাজার ৩০০ মিটার। পূর্ব অ্যান্টার্কটিকার উত্তরে অবস্থিত দক্ষিণ মহাসাগরের আরেকটি সাগর হলো ডি উরভিলে সাগর। ওয়েডেল সাগর এবং লাজারেভ সাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত একটি সাগর রাজা সপ্তম হাকুন সাগর। নরওয়ের প্রথম রাজার নামানুসারে দক্ষিণ মহাসাগরের এ সাগরটির নাম রাখা হয়। দক্ষিণ মহাসাগরের অন্য সাগরগুলোর মধ্যে রয়েছে- লাজারেভ সাগর, মওসন সাগর, রিসার-লার্সেন সাগর, রোস সাগর, স্কটিয়া সাগর, সমোভ সাগর এবং ওয়েডেল সাগর। লাজারেভ সাগরটি প্রায় ৯ লাখ ২৯ হাজার বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত। রাজা সপ্তম হাকুন সাগর ও রিজার-লার্সেন সাগরের মাঝে এ সাগরটির অবস্থান।

সমুদ্রজলের উপাদানসমূহ:

বিশ্বের সব সাগরের পানিতে গড়ে ৩.৫% খনিজদ্রব্য আছে। অর্থাৎ প্রতি ১০০০ গ্রাম পানিতে ৩৫ গ্রাম লবণ জাতীয় উপাদান থাকে। অন্যান্য উপাদানগুলো হলো- সোডিয়াম-ক্লোরাইড ৭৭.৫৫%, ম্যাগনেশিয়াম-ক্লোরাইড ১০.৮৭ %, ম্যাগনেশিয়াম-সালফেট ৪.৭৩%, ক্যালসিয়াম-সালফেট ৩.৬%, পটাশিয়াম-সালফেট ২.৪৬%, ক্যালসিয়াম-কার্বনেট ০.৩৪%, ম্যাগনেশিয়াম-ব্রোমাইট ০.২৫%।যাকে সহজ বাংলায় বলা হয় খাবার লবণ এবং এটা পানিতে দ্রবণীয় থাকে।

প্রসঙ্গত: ব্রাজিলের বিশাল নদী আমাজানের মোহনা থেকে ২০০ মাইল বা ৩২০ কি.মি. পর্যন্ত সমুদ্রের পানি লোনা নয় বরং মিষ্টি। ফিলিপাইনের উপকূলেও মিষ্টি পানি দেখা যায়। আবার সাগরের পানির নিচের দিকে যতই যাওয়া যায় ততই পানি লোনা। তাছাড়া সমুদ্রের পানিতে মোট ৪৫ প্রকার ধাতব লবণ মিশ্রিত থাকে। আরো আছে ৬৫ প্রকার মৌলিক ও যৌগিক পর্দাথের মিশ্রণ।

রহস্যঘেরা মহাসমুদ্র:

মহাসাগরগুলোর অর্ধেকেরও বেশি জায়গার গড় গভীরতা ৩ হাজার মিটারেরও বেশি। আমাদের ভূমণ্ডলে মহাসাগরের প্রভাব উল্লেখযোগ্য। বিশেষত মহাসাগরীয় বাষ্পীভবন প্রক্রিয়া গুরুত্ব বহন করে। এটি পানিচক্রের একটি প্রয়োজনীয় ধাপ। পৃথিবীতে বৃষ্টিপাতের উৎসস্থল হিসেবে মহাসাগরগুলো চিহ্নিত। মহাসাগরীয় তাপমাত্রা, জলবায়ু ও বাতাসের গতিপথের ওপর বৃষ্টিপাত অনেকাংশে নির্ভরশীল। এ ছাড়া মহাসাগর স্থলভাগে বসবাসকারীদের জীবন ও জীবনধারায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে। মহাসাগর গঠনের ৩ বিলিয়ন বছরের মধ্যে স্থলভাগে মানুষের চলাচল শুরু হয়। সমুদ্র উপকূলের গভীরতা এবং দূরত্ব উপকূলীয় এলাকায় জীববৈচিত্র্যে অবদান রাখে। উপকূলীয় এলাকায় বিভিন্ন ধরনের গাছপালা জন্মে এবং বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী বসবাস করে। 'চ্যালেঞ্জার ডিপ' সম্মন্ধে এই নিবন্ধে পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে বিষয়টি আরেকটু সবিস্তারে তুলে ধরার ইচ্ছে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ হিসেবে নর্দার্ন মারিয়ানা দ্বীপের খাত সমুদ্রের গভীরতম বিন্দু এটি। ব্রিটিশ নৌযান চ্যালেঞ্জার-২ ১৮৫১ সালে স্থানটি জরিপ করে এবং সবচেয়ে গভীর স্থানকে নামকরণ করেছে ‘চ্যালেঞ্জার ডিপ’ হিসেবে। এই চ্যালেঞ্জার ডিপসহ সাগরতলের বিস্ময়কর আরও কয়েকটি বিষয় হচ্ছে-

চ্যালেঞ্জার ডিপ:

প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশের একটি খাদ মারিয়ানা ট্রেঞ্চ। বিশ্বের গভীরতম বিন্দু রয়েছে এখানেই। মারিয়ানা ট্রেঞ্চ প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম প্রান্তে মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের ঠিক পূর্বে অবস্থিত। মারিয়ানা খাদ একটি বৃত্তচাপের আকারে উত্তর-পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় ২ হাজার ৫৫০ কি.মি. ধরে বিস্তৃত। এর গড় বিস্তার ৭০ কি.মি.। এই সমুদ্র খাতটির দক্ষিণ প্রান্তসীমায় গুয়াম দ্বীপের ৩৪০ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে পৃথিবীপৃষ্ঠের গভীরতম বিন্দু অবস্থিত। এই বিন্দুর নাম চ্যালেঞ্জার ডিপ এবং এর গভীরতা প্রায় ১১ হাজার ৩৩ মিটার।

১৯৬০ সালের জানুয়ারি মাসে সুইস মহাসাগর প্রকৌশলী জাক পিকার ও মার্কিন নৌবাহিনীর লিউট্যানান্ট ডনাল্ড ওয়ালস ফরাসি-নির্মিত বাথিস্কাফ ত্রিয়েস্ত করে চ্যালেঞ্জার ডিপে অবতরণ করেন। জাক পিকারের বাবা ওগুস্ত পিকার বাথিস্কাফ উদ্ভাবন করেন। জাক ও ডনাল্ড ত্রিয়েস্তকে ১০ হাজার ৯১৫ মিটার গভীরতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হন। এটি ইতিহাসের সবচেয়ে গভীরতম ডিপ। মারিয়ানা ট্রেঞ্চ প্রায় ২ হাজার ৫৫০ কিলোমিটার। চওড়ায় এটি মাত্র ৬৯ কিলোমিটার। গভীর সাগরের তলদেশে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে এখনো রয়ে গেছে নানা সমস্যা। ফলে বিজ্ঞানীদের ধারণা খাদের গভীরতা আরও বেশি হতে পারে। সে জন্যই তারা চালাচ্ছেন নিত্যনতুন অভিযান। মারিয়ানা ট্রেঞ্চের সবচেয়ে গভীর অংশটি শেষ হয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের নিচে চ্যালেঞ্জার ডিপ’ নামের ভ্যালিতে গিয়ে। খাদের শেষ অংশে পানির চাপ এতটাই যে, সমুদ্রপৃষ্ঠের স্বাভাবিক বায়ুচাপের তুলনায় তা ১০০০ গুণেরও বেশি। এ কারণেই এখানে স্বাভাবিকের চেয়ে পানির ঘনত্বও প্রায় ৫ শতাংশ বেশি। খাদের সবচেয়ে নিচু জায়গা চ্যালেঞ্জার ডিপ’ নামটি রাখা হয়েছে জলযান এইচএমএস চ্যালেঞ্জার-২-এর নাম থেকে নিয়ে। স্থানটির তাপমাত্রা এতই কম যে, বিজ্ঞানীরা বলেন, সাগরতলের সর্বনিম্ন তাপমাত্রার স্থান এটিই। কখনো হাইড্রোজেন সালফাইডসহ বিভিন্ন ধরনের খনিজ সমৃদ্ধ গরম পানিও বের হয় চ্যালেঞ্জার ডিপের ছিদ্রপথ দিয়ে। এগুলো প্রধান খাদ্য ব্যারোফিলিক জাতীয় ব্যাকটেরিয়ার। এসব ব্যাকটেরিয়াকেই আবার খায় শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখতে হয় এমন কতগুলো ছোট ছোট জীব। এদের খেয়ে বেঁচে থাকে মাছেরা। এভাবেই সাগরতলের এত গভীরেও জীবনের চক্র কিন্তু ঠিকই চলতে থাকে, যেমনটি চলে সাগরের ওপর। অতি ক্ষুদ্র কিছু ব্যাকটেরিয়ারও দেখা মেলে মারিয়ানা খাদে।

সাধারণত সমুদ্রতলের গভীরে মৃত প্রাণীর কঙ্কাল, খোলস জমা পড়তে থাকে। মারিয়ানার তলও আলাদা নয়। এখানকার পানির রং সে জন্যই খানিকটা হলুদ। মারিয়ানা ট্রেঞ্চ চাঁদের মতোই বিরান বলে মন্তব্য করেছেন বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার জেমস ক্যামেরন। পৃথিবীর গভীরতম তলদেশে দুঃসাহসিক অভিযান শেষে উঠে এসে তিনি এই মন্তব্য করেন। বিশ্বনন্দিত এই পরিচালক সাগরের তলদেশে ৩৫ হাজার ৭৫৬ ফুট গভীরে পাড়ি জমান। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ গুয়ামের অদূরে অবস্থিত মারিয়ানা ট্রেঞ্চ বলে অভিহিত এই খাদের সবচেয়ে গভীর বিন্দুতে পৌঁছায় ক্যামেরনের সাবমেরিন। মারিয়ানা ট্রেঞ্চ অভিযানে বিশেষভাবে তৈরি একটি সাবমেরিন ব্যবহার করেন তিনি। ১২ টন ওজনের এই সাবমেরিনটি নিয়ে তিনি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাগরতলে প্রায় ১১ কিলোমিটার নিচে নেমে যান। সেখানে পানির চাপ হলো ১০৮.৬ মেগাপ্যাসকেল, অর্থাৎ প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে প্রায় ১৫,৭৫০ পাউন্ড। এই সমুদ্র গভীরতায় দেখা মেলে অবাক করার মতো মাছের। এখানকার বাসিন্দারা সংখ্যায় যেমন অনেক, তেমনি বৈচিত্র্যেও কম নয়।

বিচিত্র সৌন্দর্য্যের আধার প্রবাল:

সাগরতলে সৌন্দর্য্যের আধার বলা হয় প্রবালকে। শুধু রঙের দিক থেকেই নয়, সাগরতলের ইতিহাস লেখকও সে। প্রবাল মূলত অ্যান্থজোয়া শ্রেণিভুক্ত সামুদ্রিক প্রাণি। এরা কলোনি তৈরি করে বসবাস করে। প্রাণি হলেও জীবনের পূর্ণ বয়স্ক অবস্থায় সাগরতলে কোনো দৃঢ়তলের ওপর গেড়ে বসে বাকি জীবন পার করে দেয় নিশ্চল হয়ে। প্রতিটি প্রবাল পলিপ যেখানে গেড়ে বসে সেখানে নিজের দেহের চারপাশে ক্যালসিয়াম কার্বনেট নিঃসরণের মাধ্যমে শক্ত পাথুরে খোলস তৈরি করে। প্রবালে বৈচিত্র্যের শেষ নেই। প্রবালের তালিকায় চোখ ধাঁধিয়ে দেবে নীল প্রবাল। এ ছাড়া খোঁজ মিলেছে লোবের। এই প্রবাল দেখতে অনেকটা সূর্যের মতো। অনেকেই একে সমুদ্রতলের সূর্য বলে উপমা দিয়ে থাকেন। এর বয়স কমপক্ষে ৫০০ বছর। পৃথিবীর ইকোসিস্টেমের এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যবহন করছে এটি। লোব কোরালের দেখা পাওয়া যায় প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ দিকে, লাইন দ্বীপের কাছে।

সাগরতলের আরেক আশ্চর্য সমুদ্রকাঁটা:

সমুদ্রতলদেশে উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের শেষ নেই। বিশ্লেষকরা দাবি করেন, মাটির ওপর নয়, সমুদ্রতলেই উদ্ভিদবৈচিত্র্য বেশি। এর কারণ আর কিছুই নয়, গবেষণার স্বল্পতা। এখনো সমুদ্রতলে উদ্ভিদজগত নিয়ে খুব কম গবেষণার সুযোগ মিলেছে। একে তো গবেষণার বিশাল খরচ অন্যদিকে জলতলে দীর্ঘদিন থাকার প্রযুক্তিগত স্বল্পতা। সমুদ্রতলে দেখা মিলবে কাঁটা। গায়ে ফুটলে এগুলোর কোনোটি প্রাণঘাতী হতে পারে। এ ধরনের কাঁটাকে বলা হয়, ‘সি-আর্চিন’। এগুলো দৃষ্টিনন্দন ও রঙিন হওয়ায় যে কাউকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু ডুবুরি ও সৌখিন সাঁতারুদের কাছে এটি বাড়তি আতঙ্ক। কিছু কিছু সি-আর্চিন কিন্তু খাওয়া যায়। কিছু প্রজাতির মাছের প্রিয় খাবার এগুলো। রেড সি-আর্চিন ব্রিটিশ কলম্বিয়ার বনে কার্পেটের ন্যায় বিছানো অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়। সমুদ্রতলেও এটি যেন লাল গালিচা। অন্যদিকে নিউজিল্যান্ডে রয়েছে যাপার। ভ্যানকুভারেও সি-আর্চিনের দেখা পাওয়া যায়।

ইলেক্ট্রিক বা বৈদ্যুতিক মাছ:

সমুদ্রজগতে মাছের রাজত্ব। অসংখ্য প্রজাতির মাছের বসবাস সেখানে। তালিকা দিয়ে সেটি শেষ করার নয়। ইলেকট্রিক ইল নামক মাছ নিজের শরীরে বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারে। যে বিদ্যুতের শকে মানুষ আহত কিংবা মারাও যেতে পারে। কুমির পর্যন্ত মারাÍকভাবে আহত হয়। এগুলো পাওয়া যায় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে। এ মাছ দেখতে আমাদের দেশের মাগুর মাছের মতো; কিন্তু আকারে বড়। ইলেকট্রিক ইল তার শরীরের বিশেষস্নায়ুতন্ত্র ব্যবহার করে বিদ্যুৎ তৈরি করে। এ মাছের শরীরে বিদ্যুৎ তৈরির জন্য চাকতির মতো কতকগুলো কোষ রয়েছে। শরীরের বিশেষ একটি অংশ, যেটিকে বিদ্যুৎ তৈরির অঙ্গ বলা হয়।স্নায়ুতন্ত্রের কাজ হলো এসব কোষ যাতে সমন্বিতভাবে কাজ করে তা নিশ্চিত করা।স্নায়ুতন্ত্র থেকে সংকেত পাওয়ার পর,স্নায়ু থেকে অ্যাসেটিল কোলাইন নামের খুব সামান্য পরিমাণ এক ধরনের রাসায়নিক নির্গত হয়। এ রাসায়নিকটি নিউরো-ট্রান্সমিটার হিসেবে কাজ করে।

পৃথিবীর বৃহত্তম প্রাণি নীল তিমি:

আলাদা করে বলতে হয় নীল তিমির কথা। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণী। এটির ওজন প্রায় ১৫০ টন এবং এরা দৈর্ঘ্যে ৩০ মিটারের (৯৮ ফিট) হতে পারে। অনেকের ধারণা, সাগরে সাঁতরে বেড়ানো তিমিরা হলো একধরনের মাছ; কিন্তু তিমি কোনো মাছ নয়, স্তন্যপায়ী প্রাণী। তিমিও উষ্ণ রক্তের প্রাণী। জম্নের সময়ই নীল তিমির একেকটা বাচ্চা হয় হাতির মতো, বাচ্চার ওজন দাঁড়ায় প্রায় ২৭ টন আর দৈর্ঘ্যে প্রায় ২৭ ফুট। তিমি স্কুইড, বড় মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী শিকার করে খায়। ঘণ্টায় প্রায় ৩০ কিলোমিটার বেগে সাঁতরাতে পারে। মাঝে মধ্যে তিমিরা সাগরের বুকে শুধু মাথাটা উঁচু করে একবার ঘুরে চার পাশটা দেখে নেয়, দেহকে পানির উপরে তোলে না।

তিমিরা নানা রকম শব্দ করে নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান করে। এমনকি তিমিরা গানও গায়। বিশেষজ্ঞরা হ্যাম্পব্যাক বা কুব্জপৃষ্ঠ তিমির ৩০ মিনিট পর্যন্ত গান রেকর্ড করেছেন। তিমি কেন গান গায়, সে আর এক রহস্যের জাল। নীল তিমি যত জোরে শব্দ করতে পারে অত জোরে পৃথিবীর আর কোনো প্রাণী শব্দ করতে পারে না। সাগরে নীল তিমির কণ্ঠস্বর ৫০০ কিলোমিটার দূর থেকেও শোনা যায়।

সমুদ্রের জীবনও আজ বিপন্ন প্রায়:

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের লরা পার্কার গত বছরই বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেন সমুদ্র হত্যায় মানুষের উৎসবের কথা। পৃথিবীর অনেকেই জানত না, সমুদ্রবাসীর কী সর্বনাশ হয়েছে গত কয়েক দশকে। মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স ৩৭০ নিখোঁজের পর মহাসাগরজুড়ে তল্লাশি শুরু করে বিভিন্ন দেশ। তখনই সবার চোখে ধরা পড়ে আরেক দৃশ্য। সমুদ্রজুড়ে শুধুই আবর্জনা। অস্ট্রেলিয়ান উপক‚লজুড়ে আবর্জনা ছেয়ে গেছে। মাছ ধরার টুকরো উপাদান, কার্গো জাহাজগুলোর বাতিল অংশ, প্লাস্টিকের শপিং ব্যাগসহ আবর্জনার এই স্তপ পুরো সাগরকে যেন গিলে নিয়েছে। বিজ্ঞানীরা স্যাটেলাইট ছবি দেখে আর স্থির থাকতে পারেননি। সমুদ্রগভীরে পৌঁছার কথা ভাবতেই তারা শিউরে উঠলেন। সমুদ্রতলে যাত্রা শুরু হয়, যা ভাবা হয়েছিল ঠিক তাই। কোথাও কোথাও আবর্জনার পাহাড় তৈরি হয়ে গেছে। দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, এই আবর্জনার বেশির ভাগ অংশই সহজে পচে যায় না। প্যাসিফিক আর আটলান্টিকের অতলের এই দৃশ্যকে সমুদ্র হত্যা বলা হয়। উত্তর ও দক্ষিণে সরে এসেও একই দৃশ্য দেখা গেল। ভারত মহাসাগর, আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যাংশ সমুদ্রতল আবর্জনায় ডুবে গেছে। এতে সমুদ্রতলের প্রাণীবৈচিত্র্য অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।

ভয়ানক সি ক্রেইট:

সমুদ্রে বাস করে বিষাক্ত সাপের দলও। সি ক্রেইট তাদেরই একটি। এই সাপের বিষে মানুষের মৃত্যু অনিবার্য। একটু ভুলেই এটি হয়ে উঠতে পারে যে কোনো সাঁতারু বা ডুবুরির দুঃস্বপ্ন। পৃথিবীর স্থলে অন্যতম বিষধর হিসেবে র‌্যাটলস্রেকের কথা বলা হয়। র‌্যাটল স্রেক সি ক্রেইটের বিষের কাছে নেহায়তই ছেলেখেলা। কারণ সি ক্রেইট র‌্যাটল স্রেক থেকে কমপক্ষে দশগুণ বেশি বিষাক্ত। সমুদ্রের গভীরে চলাচল বেশি বলে এটি মানুষকে কম আক্রমণ করে। এটি সমুদ্রজলে ঘুরে বেড়ায়, প্রবালের আনাচে-কানাচে বাস করে। ম্যানগ্রোভ বনেও এদের দেখা যায়। সমুদ্রে বিষধরের অভাব নেই। অনেক ভয়ানক মাছ রয়েছে, উদ্ভিদ রয়েছে। কিন্তু সি ক্রেইট সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায়। সমুদ্রের ছোট-বড় সব প্রাণী তাকে ভয় পায়। এরা সমুদ্রের আরেক আতঙ্ক বৈদ্যুতিক ইলকে অনায়াসে পেটে পুরে নেয়। ছোট মাছ, মাছের ডিম এদের প্রধান খাবার।

মৎস্যকন্যা:

সমুদ্রে মিথের শেষ নেই। মৎস্যকন্যা যুগে যুগে সমুদ্রবাসীর কাছে সবচেয়ে আলোচিত মিথ। মিথ বলে, জাহাজডুবির ফলে কোনো কোনো নাবিককে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছে এই মৎস্যকন্যারা। ১৪৯২ সালে সমুদ্রে ভ্রমণের সময় কলম্বাস তিনটি মৎস্যকন্যা দেখেছিলেন। ১৬০৭ সালে জেনরি হার্ডসন উত্তর সাগর পাড়ি দেওয়ার সময় তিনটি প্রাণীকে দেখেন, যাদের নাভির ওপর থেকে দেখতে হুবহু মেয়েদের মতো, কিন্তু নিচের অংশটা মাছের মতো। ১৯১৭ সালে লিওনদাসের ক্যাপ্টেন মানুষ আকৃতির একটি প্রাণীকে দেখতে পান, যার শরীরের উপরের অংশে কালো চুল, ত্বক সাদা, কিন্তু হাতের নিচ থেকে মাছের আকৃতি। ১৮০৩ সালে স্কটিশ সমুদ্র উপকূলে একটি মৎস্যকন্যা ধরা পড়ে। এক মিটারের মতো লম্বা, সেটার শরীরের উপরের অংশ অবিকল মেয়েদের মতো।

মহান স্রষ্টার কুদরতের কারিশমা: সাগরতলের আগ্নেয়গিরি:

বিজ্ঞানীরা দাবি করেন পৃথিবীর ৮০ শতাংশ আগ্নেয়গিরি সমুদ্রের তলদেশে রয়েছে এবং এগুলো নিয়মিত অগ্ন্যুৎপাত করে থাকে। এই আগ্নেয়গিরির বেশির ভাগই সমুদ্রের হাজার ফুট গভীরে রয়েছে। এগুলো সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। ২০০৯ সালের মে মাসে বিজ্ঞানীরা সমুদ্রের সবচেয়ে গভীরে অগ্ন্যুৎপাতের চিত্র ধারণ করতে সক্ষম হন। প্রশান্ত মহাসাগরের সামাও, ফিজি এবং টোঙ্গার মধ্যবর্তী অংশে অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনাটি ঘটে। সেটি প্রশান্ত মহাসাগরের তলভাগ থেকে কমপক্ষে চার হাজার গভীরে ছিল। অগ্ন্যুৎপাতের পরপরই লাভা নির্গত হয়ে সমুদ্রতলে পুরো অঞ্চল কুয়াশায় আচ্ছন্ন করে ফেলে। গলিত পাথরের স্রোত বয়ে যায়। পরীক্ষার পর জানা যায়, এটি ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তপ্ত অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা। সমুদ্রে দ্বীপ গড়ে ওঠার সঙ্গে বিজ্ঞানীরা অগ্ন্যুৎপাতের একটি সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। সমুদ্রতলদেশের প্রকৃতি নির্ণয়েও এ ধরনের আগ্নেয়গিরির ভূমিকা মূল্যায়ন করা হচ্ছে।

সাগরের গহীনে লুকিয়ে অবর্ণনীয় সৌন্দর্য্য:

সাগর অসাধারণ সব সৌন্দর্যের ভাণ্ডার সাজিয়ে রেখেছে নিজের গভীর বুকের মাঝে। শুধু সৌন্দর্যই নয়, সাগরের অতল গভীরতার ভেতরে লুকিয়ে আছে অনেক অনেক রহস্যও!

এমন কিছু অমীমাংসিত রহস্য চুপটি করে লুকিয়ে আছে সাগরের মাঝে যেগুলোর কোনো ধরণের সমাধান আজ অব্দি পাওয়া যায়নি। সাগরের এমনই কিছু অদ্ভূত রহস্য-

ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেল:

পৃথিবীতে মোট ১২টি এমন স্থান রয়েছে বলে মনে করা হয় যেখানে এর চৌম্বকীয় আকর্ষণ প্রচণ্ড বেশি। আর এমনই এক স্থান হচ্ছে ডেভিলস সি বা শয়তানের সাগরের ভেতরে অবস্থিত ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেল। জাপান আর বোনিন দ্বীপের মাঝখানে সাগরের মাঝে অবস্থিত এই স্থানটিকে জাপানীরা সবসময়ই ড্রাগনের আস্তানা বলে ভেবে এসেছে।

জাপানিজ পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, এখানে এক ভয়ঙ্কর ড্রাগন বাস করে যার ক্ষুধা দূর করা একেবারেই সম্ভব না। আর তাই প্রায়ই সেটা নিজের কাছে আসা জাহাজ আর মানুষকে খেয়ে ফেলে নিজের ক্ষুধা মেটায়। সেই থেকে এর নাম হয়ে গিয়েছে ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেল। ১২০০ শতাব্দীর দিকে কুবলাই খান বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছেন জাপানকে দখলে নিতে। এগোতে চেয়েছেন শয়তানের সাগরের মাঝ দিয়ে। প্রতিবারেই ব্যাপক সংখ্যক মানুষ আর জাহাজ হারাতে হয়েছে তাকে।

শুধু তিনিই নন, আজ অব্দি অগণিত জাহাজ আর উড়োজাহাজ স্রেফ হাওয়া হয়ে গিয়েছে এখানটায় এসে। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের বিপরীতে অবস্থিত হলেও ঠিক ওটার মতনই রহস্য জমা হয়ে আছে ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেলকে ঘিরেও। কারো কারো মতে মাঝে মাঝেই এক রহস্যময় নারীকে দেখতে পাওয়া যায় সাগরের ঐ বিশেষ জায়গাটিতে।

১৯৫০ সালে ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেলকে অনিরাপদ বলে ঘোষণা দিলেও এরপর অনেকেই চেষ্টা করেছেন এখানকার রহস্য ভাঙতে। আর তাদের ভেতরে একজন ল্যারি কুছে নিজের বইয়ে জানান, ওখানে আর কিছুই না, রয়েছে এক বিশাল আগ্নেয়গিরি। আর যতসব রহস্যময় উধাও হওয়ার ঘটনা ঘটেছে আজ অব্দি সবগুলোর পেছনে হাত রয়েছে একমাত্র ঐ সমুদ্র আগ্নেয়গিরিরই! তবে আগ্নেয়গিরিই বা কীভাবে জাহাজ গ্রাস করে সে ব্যাখ্যাও কল্পনার বাইরে। আসল রহস্যটা থেকেই গেল।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল:

ব্যাপারটা অনেকটা একই রকম। ঠিক গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের মতনই আরেকটা ট্রায়াঙ্গেল খুঁজে পাওয়া যায় সমূদ্রের ভেতরে। যেখানটায় একের পর এক ঘটে যেতে থাকে অদ্ভূত সব ঘটনা। হাওয়া হয়ে যেতে থাকে এক এক করে অনেক মানুষ, বিমান, জাহাজ- সবকিছু!

কি এমন আছে ওখানে? কি ওটার রহস্য? আজও জানতে পারেনি কেউ। শয়তানের ট্রায়াঙ্গেল নামে পরিচিত রহস্যময় স্থানটিতে ভিনগ্রহবাসীদের হাত আছে বলে মনে করেন অনেকে। নির্দিষ্ট করে কোন স্থানটিতে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল আছে সেটা বলা যায় না। তবে আটলান্টিক মহাসাগরের ভেতরেই কোনো একটা জায়গায় আছে সেটা। অনেকের অনেক মত আছে একে নিয়ে।

তবে অনুসন্ধানকারী লেখক কুছে জানান, কোনো একটা মাত্র কারণকেই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্য বলে মনে করাটা বোকামি। এরচাইতেও বড় বোকামি হচ্ছে যতগুলো জাহাজ হারিয়েছে সেগুলোর সবগুলোকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের শিকার বলে ধরে নেওয়া। হতেও তো পারে সেটা অন্য কোনো কারণে হারিয়ে গেছে বা ধ্বংস হয়েছে।

তবে যে যাই বলুক, এখনো পর্যন্ত ব্যাপারটা ঠিক সেখানটাতেই আটকে আছে যেখান থেকে একদিন এটার শুরু হয়েছিল।

আর্কটিক সাগরের রহস্য:

জাহাজ আর মানুষকে উধাও করে দেওয়ার ব্যাপারে এগিয়ে আছে যে তৃতীয় সাগরটি সেটা হচ্ছে আর্কটিক সাগর। প্রায়ই কোনো না কোনো কারণে হুট করে উধাও হয়ে যাচ্ছে এর ওপর দিয়ে ভাসতে থাকা জাহাজগুলো। তবে মাঝে মাঝে জাহাজগুলো বেঁচে গেলেও রক্ষা পাচ্ছেনা এর ভেতরের মানুষ।

১৮৭২ সালে সাগরের ওপর হঠাৎ মেরি ক্যালেস্টে জাহাজটিকে দেখতে পাওয়া যায়। সওদাগরী জাহাজটিতে প্রচুর খাবার আর ঠিক স্থানে ঠিক জিনিসপত্র বজায় থাকলেও কেবল ছিল না ভেতরের মানুষগুলো। সবকিছু ফেলে মাঝ সাগরে কোথায় গেল তারা? প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি আজও। সেই শুরু।

এরপর এইচএমএস সাপ্পোহ, ইউএসএস সাইক্লোপস, এমভি জয়তা, ফ্লাইং ডাচম্যান, বেচিমো, ক্যারোল এ. ডেরিং, লেডি লোভিবন্ড ও অক্টাভিয়াসের মতন বিখ্যাত সব ভুতুড়ে জাহাজের জন্ম দিয়েছে সাগরটি। কখনো মানুষ উধাও, কখনো মানুষসহ জাহাজ। কখনো ছায়াময় ভুতুড়ে জাহাজের উৎপত্তি আবার কখনো পাগল কিছু মানুষকে উপহার দেওয়া- এভাবেই এখন পর্যন্ত নিজের রহস্যকে বজায় রেখেছে আর্কটিক। যেগুলোর উত্তর জানে না কেউ!

একটু পেছন ফিরে দেখা: বাংলাদেশের সমুদ্র জয়:

৭ জুলাই ২০১৪ সোমবার নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী সালিসি আদালতের রায়ে বঙ্গোপসাগরের বিরোধপূর্ণ ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা বাংলাদেশ পেয়েছে। বাকি ছয় হাজার ১৩৫ বর্গকিলোমিটার পেয়েছে ভারত। ইতিপূর্বে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির ফলে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর অধিকার নিশ্চিত হয়েছে।এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সুসংবাদ।

আমাদের করণীয়:

সাগর মহাসাগরের অফুরন্ত এসব নেআমতের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এগুলো যেন মানবকল্যানে ব্যবহার হতে পারে বিশ্ববাসীকে সেদিকে নজর দিতে হবে। একইসাথে এসব নেআমতের যিনি মালিক এবং স্রষ্টা তাকে চেনার এবং জানার চেষ্টা করাও আমাদের অন্যতম দায়িত্ব। এত বিশালাকার একেকটি সাগর-মহাসাগর তিনি কিভাবে সৃষ্টি করলেন! আবার এই বিপুল প্রাচুর্য্যের আধার সাগর মহাসাগরকে কিভাবে মানুষের পদানত করে দিলেন! আর এতে কতই না নেআমতসম্ভার সন্নিবেশিত করে দিয়েছেন আমাদের জন্য! এসব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা-গবেষণা করা আমাদের কাজ। নানাবিধ ঝুঁকি, বিপদ এবং অসংখ্য প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সাগরতলের নেআমতরাজি আহরনে মনোনিবেশ করা এবং মানবকল্যাণে তা নিয়োজিত করা। আমাদের কর্তব্য হওয়া উচিত, একমাত্র আল্লাহ তাআ'লার একত্ববাদের সামনে নিজেদের মস্তককে অবনত করা, তাঁর একচ্ছত্র সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে একমাত্র তাঁরই ইবাদত আরাধানায় নিজেদের নিযুক্ত করা। আল্লাহ তা‘আলা এ কথাই বলেছেন নিম্নোক্ত আয়াতে:

أَمَّن جَعَلَ الْأَرْضَ قَرَارًا وَجَعَلَ خِلَالَهَا أَنْهَارًا وَجَعَلَ لَهَا رَوَاسِيَ وَجَعَلَ بَيْنَ الْبَحْرَيْنِ حَاجِزًا أَإِلَهٌ مَّعَ اللَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ

'বল তো কে পৃথিবীকে বাসোপযোগী করেছেন এবং তার মাঝে মাঝে নদ-নদী প্রবাহিত করেছেন এবং তাকে স্থিত রাখার জন্যে পর্বত স্থাপন করেছেন এবং দুই সমুদ্রের মাঝখানে অন্তরায় রেখেছেন। অতএব, আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য আছে কি? বরং তাদের অধিকাংশই জানে না।' [সূরা আন-নামল, আয়াত: ৬১] সমাপ্ত

Or, Who has made the earth firm to live in; made rivers in its midst; set thereon mountains immovable; and made a separating bar between the two bodies of flowing water? (can there be another) god besides Allah. Nay, most of them know not.

তথ্যসূত্র:
১. http://www.quraanshareef.org/
২. বিবিসি বাংলা।
৩. উইকিপিডিয়া।
৪. দৈনিক যুগান্তর অনলাইন।
৫. দৈনিক প্রথম আলো অনলাইন।
৬. মাসিক অন্য দিগন্ত।
৭. তিরমিযী, হাদীস নং ৬৯; আবু দাউদ, হাদীস নং ৮৩।
৮. কুরআনের আলো ডট কম।
৯. ইউকিপিডিয়া।
১০. বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪।
১১. নয়া দিগন্ত, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪।
১২. এবং ইন্টরনেটে ছড়িয়ে থাকা গবেষণামূলক একাধিক প্রবন্ধ নিবন্ধ অনুসরণে।

ছবি: অন্তর্জাল।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে জুলাই, ২০১৯ সকাল ৯:২৫

রাজীব নুর বলেছেন: বিজ্ঞান প্রতিদিন সমুদ্রের তলদেশ থেকে কিছুনা কিছু আবিস্কার করছে এবং করে আসছে কয়েক শতাব্দী ধরে।

২৭ শে জুলাই, ২০১৯ দুপুর ১২:০৯

নতুন নকিব বলেছেন:



অন্তহীন রহস্যঘেরা সমুদ্রের কিছু কিছু জানার চেষ্টা চলছে।

প্রথম মন্তব্যে সাধুবাদ। শুভকামনা সবসময়।

২| ২৭ শে জুলাই, ২০১৯ সকাল ৯:৩৬

ইসিয়াক বলেছেন: কিন্তু আল্লাহর দেওয়া সব সম্পদ আমরা একে একে সব নষ্ট করে ফেলছি।
শুভসকাল

২৭ শে জুলাই, ২০১৯ দুপুর ১২:১৮

নতুন নকিব বলেছেন:



সঠিক বলেছেন। আমাদের সর্বভুক কালোহাতের থাবায় সাগরও আজ বিপন্ন প্রায়। সাগরের তলদেশও ভরে উঠছে অপচনশীল পলিথিন, প্লাস্টিকসহ নানাবিধ বর্জ্য আবর্জনায়। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

ধন্যবাদ। শুভকামনা সবসময়।

৩| ২৭ শে জুলাই, ২০১৯ সকাল ৯:৩৯

ইসিয়াক বলেছেন: +++

২৮ শে জুলাই, ২০১৯ সকাল ৯:২৯

নতুন নকিব বলেছেন:



প্লাস দেয়ায় শুকরিয়া।

আপনার জন্য শুভকামনা সবসময়।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.