নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দল-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না- বিদ্রোহী রন-ক্লান্ত। আমি সেই দিন হব শান্ত।
ছবি: সংগৃহীত।
আল্লাহ তাআ'লার প্রিয় অনুগত বান্দা, সবরকারী নবী হযরত আইয়্যুব আলাইহিস সালাম -এর শরীরে পোকা হওয়া কিংবা পচন ধরার ঘটনা কি আসলেই সত্য?
হযরত আইয়্যুব আলাইহিস সালাম -এর শরীরে পোকা হওয়া কিংবা পচন ধরার কাহিনী সম্পূর্ণ বানোয়াটঃ
হযরত আইয়্যুব আলাইহিস সালাম -এর শরীরে পোকা হওয়া কিংবা পচন ধরার কাহিনী সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং এটি ইয়াহুদিদের বানানো সম্পূর্ণ মিথ্যা কাহিনী বা নাটক। হযরত আইয়্যুব আলাইহিস সালাম ছবরকারি নবিগনের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু স্তরের বা শির্ষস্থানীয় ছিলেন। কুরআনুল কারিমের ৪ টি সূরার ৮ টি আয়াতে হযরত আইয়্যুব আলাইহিস সালাম -এর আলোচনা এসেছে। আল কুরআনের যেসব স্থানে তাঁর আলোচনা এসেছে সেগুলো হচ্ছে-
إِنَّا أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ كَمَا أَوْحَيْنَا إِلَى نُوحٍ وَالنَّبِيِّينَ مِن بَعْدِهِ وَأَوْحَيْنَا إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإْسْحَقَ وَيَعْقُوبَ وَالأَسْبَاطِ وَعِيسَى وَأَيُّوبَ وَيُونُسَ وَهَارُونَ وَسُلَيْمَانَ وَآتَيْنَا دَاوُودَ زَبُورًا
'আমি আপনার প্রতি ওহী পাঠিয়েছি, যেমন করে ওহী পাঠিয়েছিলাম নূহের প্রতি এবং সে সমস্ত নবী-রসূলের প্রতি যাঁরা তাঁর পরে প্রেরিত হয়েছেন। আর ওহী পাঠিয়েছি, ইসমাঈল, ইব্রাহীম, ইসহাক, ইয়াকুব, ও তাঁর সন্তাবর্গের প্রতি এবং ঈসা, আইয়ুব, ইউনূস, হারুন ও সুলায়মানের প্রতি। আর আমি দাউদকে দান করেছি যবুর গ্রন্থ।' সূরা আন নিসা: আয়াত-১৬৩,
وَوَهَبْنَا لَهُ إِسْحَقَ وَيَعْقُوبَ كُلاًّ هَدَيْنَا وَنُوحًا هَدَيْنَا مِن قَبْلُ وَمِن ذُرِّيَّتِهِ دَاوُودَ وَسُلَيْمَانَ وَأَيُّوبَ وَيُوسُفَ وَمُوسَى وَهَارُونَ وَكَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ
'আমি তাঁকে দান করেছি ইসহাক এবং এয়াকুব। প্রত্যেককেই আমি পথ প্রদর্শন করেছি এবং পূর্বে আমি নূহকে পথ প্রদর্শন করেছি-তাঁর সন্তানদের মধ্যে দাউদ, সোলায়মান, আইউব, ইউসুফ, মূসা ও হারুনকে। এমনিভাবে আমি সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।' সূরা আল আনআম: আয়াত-৮৪,
وَأَيُّوبَ إِذْ نَادَى رَبَّهُ أَنِّي مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَأَنتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ
'এবং স্মরণ করুন আইয়্যুবের কথা, যখন তিনি তাঁর পালনকর্তাকে আহবান করে বলেছিলেনঃ আমি দুঃখকষ্টে পতিত হয়েছি এবং আপনি দয়াবানদের চাইতেও সর্বশ্রেষ্ট দয়াবান।' সূরা আমবিয়া: আয়াত: ৮৩
فَاسْتَجَبْنَا لَهُ فَكَشَفْنَا مَا بِهِ مِن ضُرٍّ وَآتَيْنَاهُ أَهْلَهُ وَمِثْلَهُم مَّعَهُمْ رَحْمَةً مِّنْ عِندِنَا وَذِكْرَى لِلْعَابِدِينَ
'অতঃপর আমি তাঁর আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাঁর দুঃখকষ্ট দূর করে দিলাম এবং তাঁর পরিবরাবর্গ ফিরিয়ে দিলাম, আর তাদের সাথে তাদের সমপরিমাণ আরও দিলাম আমার পক্ষ থেকে কৃপাবশতঃ আর এটা এবাদত কারীদের জন্যে উপদেশ স্বরূপ।' সূরা আমবিয়া: আয়াত: ৮৪
وَاذْكُرْ عَبْدَنَا أَيُّوبَ إِذْ نَادَى رَبَّهُ أَنِّي مَسَّنِيَ الشَّيْطَانُ بِنُصْبٍ وَعَذَابٍ
'স্মরণ করুণ, আমার বান্দা আইয়্যুবের কথা, যখন সে তার পালনকর্তাকে আহবান করে বললঃ শয়তান আমাকে যন্ত্রণা ও কষ্ট পৌছিয়েছে।' সূরা আস সোয়াদ: আয়াত-৪১
ارْكُضْ بِرِجْلِكَ هَذَا مُغْتَسَلٌ بَارِدٌ وَشَرَابٌ
'তুমি তোমার পা দিয়ে ভূমিতে আঘাত কর। ঝরণা নির্গত হল গোসল করার জন্যে শীতল ও পান করার জন্যে।' সূরা আস সোয়াদ: আয়াত-৪২
وَوَهَبْنَا لَهُ أَهْلَهُ وَمِثْلَهُم مَّعَهُمْ رَحْمَةً مِّنَّا وَذِكْرَى لِأُوْلِي الْأَلْبَابِ
'আমি তাকে দিলাম তার পরিজনবর্গ ও তাদের মত আরও অনেক আমার পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ এবং বুদ্ধিমানদের জন্যে উপদেশস্বরূপ।' সূরা আস সোয়াদ: আয়াত-৪৩
وَخُذْ بِيَدِكَ ضِغْثًا فَاضْرِب بِّهِ وَلَا تَحْنَثْ إِنَّا وَجَدْنَاهُ صَابِرًا نِعْمَ الْعَبْدُ إِنَّهُ أَوَّابٌ
'তুমি তোমার হাতে এক মুঠো তৃণশলা নাও, তদ্বারা আঘাত কর এবং শপথ ভঙ্গ করো না। আমি তাকে পেলাম সবরকারী। চমৎকার বান্দা সে। নিশ্চয় সে ছিল প্রত্যাবর্তনশীল।' সূরা আস সোয়াদ: আয়াত-৪৪
হযরত আইয়্যুব আলাইহিস সালাম -এর শরীর পচে গিয়ে তাতে পোকা হওয়ার যে কাহিনী সচরাচর আমরা শুনে থাকি তা আদৌ সত্য নয়। হযরত আইয়্যুব আলাইহিস সালামকে শয়তান কি ধরনের বিপদে ফেলেছিল, কেমন রোগে তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁর দেহের সবখানে কেমন পোকা ধরেছিল, জিহবা ও কলিজা ব্যতিত দেহের সব মাংস খসে পড়েছিল, পচা দুর্গন্ধে সবাই তাকে নির্জন স্থানে ফেলে পালিয়েছিল- ইত্যাকার নানান ধরণের কাল্পনিক কাহিনী যা আল্লামা আবু আবদুল্লাহ আল কুরতুবি রহ. নিজ তাফসিরের কিতাব 'তাফসীর আল কুরতুবি' তে বর্ণনা করেছেন (কুরতুবি, আমবিয়া-৮৪) এবং অন্যান্য মুফাসসিরগন তার এই বর্ণনা উদ্ধৃত করাসহ আরও যেসব কাহিনী তাদের স্ব স্ব কিতাবে বর্ণনা করেছেন, মূলত: সেসবের কোন ভিত্তি নেই। বরং এগুলো সর্ব্বৈ ইসরাইলি ইহুদীদের মনগড়া বানোয়াট কিচ্ছা কাহিনী ও উপকথা মাত্র এবং দুঃখজনকভাবে সেসব মনগড়া কিচ্ছাকাহিনীগুলো পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যা হিসেবেই আমাদের কাছে বহুল প্রচলিত হয়ে চলে এসেছে। আসলে এগুলোকে ব্যাখ্যা বলাটা যুক্তিযুক্ত নয়, বরং আল কুরআনের আয়াতের অপব্যাখ্যা বলাটাই যুক্তিযুক্ত।
এবার আমরা বিস্তারিত পরিসরে একে একে হযরত আইয়্যুব আলাইহিস সালাম -এর প্রতি আরোপ করা মিথ্যাচারের বিষয়গুলো আলোকপাত করে যুক্তি ও বাস্তবতার নিরিখে বুঝার চেষ্টা করবো। প্রথমেই আসুন, দেখে নিই তাঁর রোগ কতদিন স্থায়ী ছিল-
আইয়্যুব আলাইহিস সালাম -এর রোগের স্থায়িত্বকালঃ
আইয়্যুব আলাইহিস সালাম কতদিন রোগ ভোগ করেন সে বিষয়ে বিভিন্ন বর্ণনা পরিলক্ষিত হয়। ৩, ৭, সাড়ে ৭, ৭ বছর ৭ মাস ৭ দিন, ১৮ বছর, ৩০ বছর, ৪০ বছর, ইত্যাদি যা কিছু বলা হয়েছে তা সবই ইসারাইলি ইয়াহুদিদের উপকথা – এসবের কোনোটিরই সঠিক কোনো ভিত্তি নেই। বরং নবিদের প্রতি ইয়াহুদিদের বা ইয়াহুদি নেতাদের বিদ্বেষপ্রসূত অপলাপ বৈ এগুলোকে আর কিছু বলার সুযোগ নেই। এগুলো তাদের নিছক কল্পনা থেকে উৎসারিত অপলাপ মাত্র।
আমাদের সমাজে সচরাচর প্রচলিত যে গল্পটি শোনা যায় তা হচ্ছে- হযরত আইয়্যুব আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তায়ালা পরীক্ষা করেছিলেন। তার ধন সম্পদ নষ্ট হয়ে যায়, সন্তান-সন্ততি সবাই মারা যায় এবং তার শরীরের সব গোশত পচে যায় এবং সারা শরীরে পোকার সংক্রমণ ঘটে। সারা শরীর পচে যাওয়া এবং পোকায় খাওয়ার পর তিনি আল্লাহ তায়ালার কাছে দুআ করলেন যে, আল্লাহ আমার সারা শরীরের গোশতো পচে গেছে এবং তাতে পোকার সংক্রমন হয়েছে এতে আমার বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই। আপনার কাছে ফরিয়াদ, আল্লাহ! আমার জিহবাটাকে অন্ততঃপক্ষে আপনি ভাল রাখুন। যেন ওটা দিয়ে আপনার নামের জিকির করতে পারি।
আশেপাশে দুর্গন্ধ ছড়ানোর কারণে সমাজের লোকেরা তাকে সমাজ থেকে বের করে লোকালয় থেকে দূরবর্তী স্থানে কোনো এক জঙ্গলে কিংবা ময়লা ফেলার স্থানে ফেলে রেখে এলো। তাঁর আত্মীয় স্বজন বন্ধু-বান্ধবদের কেউ তার কাছে গেলেন না তাঁর শরীর থেকে উৎকট দুর্গন্ধ আসার কারণে। একমাত্র তার স্ত্রী রাহীমা সর্বদা তার পাশে থেকে জঙ্গলে তার সেবাযত্ন করতে থাকেন। রাহীমা মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে করে যা দু'এক মুঠো খাদ্য উপার্জন করতেন তা এনে তাকে খাওয়াতেন। কোনো এক দিন কোনোভাবেই খাদ্য সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে একান্ত নিরুপায় অবস্থায় নিজের চুল কেটে বিক্রি করে তার বিনিময়ে নিজ স্বামীর ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাদ্য কিনে এনেছিলেন। এভাবে বেশ কয়েক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর তিনি সুস্থ হন।
বাস্তবিকপক্ষে, এ ঘটনার না কোনো প্রামান্য তথ্য পাওয়া যায়, আর না আছে এর স্বপক্ষে কোনো দলিল নির্ভর বিশ্বস্ততা। মোটকথা এই অলিক কাহিনীর কোনো বাস্তবতা না থাকায় এ কাহিনী কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য কিংবা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটা কুরআনের তাফসিরের নামে প্রচলিত মিথ্যা ও বানোয়াট কাহিনী। ইয়াহুদী খৃষ্টানরা তাদের পুরানো অভ্যাস বশত: আল কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যায় রংচং মিশিয়ে এসব অলিক কল্পকাহিনী ফেদেছে। আর এর বিপরীতে মানুষের মনযোগ আকৃষ্ট করার জন্য কিছু সংখ্যক লোক এগুলোকে আল কুরআনের তাফসীরের সাথে টীকা কিংবা সংযুক্তি হিসেবে উক্ত করেছেন। তাফসীরের কোনো কোনো কিতাবে এসব কিচ্ছা কাহিনী উদ্ধৃতির বিষয়ে বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামও এমন অভিমতই পোষন করেন। লোকমুখে প্রচলিত হতে হতে এগুলো এখন সবার কাছে সত্য হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।
এগুলোকে মানুষ কেন বিশ্বাস করে?
দুঃখজনকভাবে এই অলিক মনগড়া কল্পকাহিনীগুলোই কিছু কিছু তাফসীরের কিতাবেও স্থান পেয়েছে। এসব অলিক গালগল্প মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার এটা অন্যতম একটা কারণ। এগুলোকে বিশ্বাস করার পেছনে সাধারণ লোক, এমনকি অনেক আলেম ওলামাদেরও দাবী হচ্ছে, তারা তাফসীরের কিতবে এগুলো পেয়েছেন।
বর্ণিত অবস্থায় পাঠক সাধারণের মনে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে, এগুলোর কোনো সত্যতা না থেকে থাকলে তাফসীরের কিতাবগুলোতে এসব কথা আসলো কেন?
এর উত্তর হচ্ছে- যে সমস্ত মুফাসসির তাদের তাফসীরে এই জাতীয় কাহিনীগুলো উল্লেখ করেছেন তারা এসব ঘটনার সাথে সূত্রও উল্লেখ করে দিয়েছেন। আইয়্যুব আলাইহিস সালাম -এর ঘটনা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যেখানে যতটুকু তথ্য-উপাত্ত পেয়েছেন, তার সবকিছুই তারা তাদের কিতাবে সংকলন করেছেন এবং তথ্য সূত্র দেখে এসব বর্ণনাগুলোর কোনো বিষয় গ্রহণ কিংবা বর্জন করার স্বাধীনতা পাঠকের উপরে দিয়ে রেখেছেন। তবে, কিছু কিছু তাফসীরকারক এগুলো উল্লেখ করার পাশাপাশি বলেও দিয়েছেন যে, এটা ইসরাইলী রেওয়ায়েত তথা ইয়াহুদী খৃষ্টানগণ কর্তৃক বর্ণিত ঘটনা।
এই ধরণের ইয়াহুদী খৃষ্টানদের থেকে উল্লেখিত ঘটনা এসেছে তাফসীরে ইবনে কাসীর, তাবারী (এর অপর নাম তাফসীরে ইবনে জারীর), ইবনে আবী হাতেম ও দুররুল মানসুরে। তাফসীরে জালালাইনেও ইহুদী-খৃষ্টানদের এ ধরণের কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়।
এ ঘটনা যে সূত্র থেকে এসেছে তা হচ্ছে- এটা বর্ণনা করেছেন “ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বিহ”। মুহাক্কিক ওলামায়ে কেরামগনের অভিমত: ওহাব ইবনে মুনাব্বিহ হককে বাতিল এবং মিথ্যাকে সত্যের সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন। (আল ইসরাইলিয়াত ওয়াল মাউদুয়াত ফি কুতুবিত তাফসীর)
এ ঘটনার আরেকটা সূত্র হচ্ছে- এর বর্ণনাকারী “সুদ্দী আস সাগীর”। তার সম্বন্ধে আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেছেন: “সুদ্দী আস সাগীর কালব হতে তিনি আবু সালেহ থেকে তিনি ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন” এই সিরিয়ালটা হচ্ছে খাটি মিথ্যা সিরিয়াল; এটা সত্য সিরিয়াল নয়।
আসলে আইয়্যুব (আঃ) এর কী হয়েছিল?
প্রিয় পাঠক, এবার আসুন! দেখে নিই, আসলে আইয়্যুব (আঃ) -এর কী হয়েছিল। তিনি আল্লাহ তাআ'লার নিকট রোগমুক্তির জন্য দুআ করেছিলেন, যা আল কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। কোন রোগ থেকে তিনি আল্লাহ তাআ'লার নিকট পানাহ চেয়েছিলেন? কি ছিল তাঁর রোগ?
আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজিদে ইরশাদ করেন:
“যখন তিনি তার রবকে ডাকলেন, “আমি রোগগ্রস্ত হয়ে গেছি এবং আপনি করুণাকারীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ করুণাকারী”। সূরা আল আম্বিয়া: আয়াত-৮৩।
তিনি রোগগ্রস্ত হয়েছিলেন। এটা সঠিক। এ কথাটা সরাসরি কুরআনের উপরোক্ত আয়াতেই বলা হয়েছে। তবে, তার শরীরে পোকা হওয়ার মত পর্যায়ে পৌঁছেনি। তিনি এমন এক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন যা ঘৃণার উদ্রায়ক কিংবা সমাজ থেকে মানুষ তাকে তাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়ে থাকবে- এমনটাও ছিল না। কোন মানুষের হাড়ে ব্যথা হলে যেমন বাহ্যিকভাবে দেখা যায় না, ঠিক সেরকমই তার একটি রোগ হয়েছিল; যা বাইরে থেকে দেখা যায় না। অথবা, তা বুঝার কোন পন্থা থাকে না।
আগেকার বিভিন্ন উলামাদের লেখা থেকে একটা সুত্র পাওয়া যায় যে,
“আল্লাহ তায়ালা কোন নবীকে এমন কোন রোগ দেননি যার কারণে মানুষ তাদেরকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে। এবং কোন নবীর স্ত্রী যত বড়ই নাফরমান হোক না কেন তারা ব্যভিচারী ছিলেন না।”
আর সেই রোগে তিনি ধৈর্য্য ধারণ করেছিলেন বলে আল্লাহ তায়ালা তাঁর ধৈর্য্যের প্রশংসা করে বলেছেন:
وَجَدْنَاهُ صَابِرًا نِعْمَ الْعَبْدُ إِنَّهُ أَوَّابٌ
'আমি তাকে ধৈর্য্যশীল হিসেবে পেয়েছি। তিনি কতইনা ভাল বান্দা, তাওবাকারী'। সূরা আস সোয়াদ, আয়াত-৪৪।
আল্লাহ তাআ'লা অন্যত্র বলেন:
وَأَيُّوبَ إِذْ نَادَى رَبَّهُ أَنِّي مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَأَنتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ
'এবং স্মরণ করুন আইয়্যুবের কথা, যখন তিনি তাঁর পালনকর্তাকে আহবান করে বলেছিলেনঃ আমি দুঃখকষ্টে পতিত হয়েছি এবং আপনি দয়াবানদের চাইতেও সর্বশ্রেষ্ট দয়াবান।' সূরা আল আমবিয়া, আয়াত ৮৩
فَاسْتَجَبْنَا لَهُ فَكَشَفْنَا مَا بِهِ مِن ضُرٍّ وَآتَيْنَاهُ أَهْلَهُ وَمِثْلَهُم مَّعَهُمْ رَحْمَةً مِّنْ عِندِنَا وَذِكْرَى لِلْعَابِدِينَ
'অতঃপর আমি তাঁর আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাঁর দুঃখকষ্ট দূর করে দিলাম এবং তাঁর পরিবরাবর্গ ফিরিয়ে দিলাম, আর তাদের সাথে তাদের সমপরিমাণ আরও দিলাম আমার পক্ষ থেকে কৃপাবশতঃ আর এটা এবাদত কারীদের জন্যে উপদেশ স্বরূপ।' সূরা আল আমবিয়া, আয়াত ৮৪
কিভাবে রোগ ও কষ্ট দূর করা হয়েছিল সে বিষয়ে আল্লাহ তাআ'লা বলেন যে,
ارْكُضْ بِرِجْلِكَ هَذَا مُغْتَسَلٌ بَارِدٌ وَشَرَابٌ
'তুমি তোমার পা দিয়ে ভূমিতে আঘাত কর। ঝরণা নির্গত হল গোসল করার জন্যে শীতল ও পান করার জন্যে। সুরা আস সোয়াদ, আয়াত-৪২।
তিনি তাকে ভূমিতে পদাঘাত করতে বলেন। তারপর সেখান থেকে পরিষ্কার পানির ফোয়ারা বা ঝরনা বেরিয়ে আসে। যাতে গোসল করায় দেহের উপরের কষ্ট দূর হয় এবং সেই পানি পান করায় তার দেহের ভিতরের কষ্ট দূর হয়।
যুক্তির আলোকেও বুঝা সহজ যে, এগুলো মিথ্যাচার:
স্বাভাবিকভাবেই অনুধাবনযোগ্য যে, মানুষের নিকট ঘৃণ্য এমন কোনো রোগ সম্মানিত একজন নবীর ক্ষেত্রে যুক্তিবিরুদ্ধ। সহজভাবে আমরা যে যুক্তিগুলো দেখি-
প্রথমত: আল্লাহ তায়ালা নবীদেরকে পাঠিয়েছেন তাদের বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ বংশে। তাহলে, সর্বশ্রেষ্ঠ বংশ কি একজন রোগীকে সেবা শুশ্রুষা কিংবা তার পানাহারের ব্যবস্থা না করে তাকে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসতে পারে?
দ্বিতীয়ত: অন্যদের কথা বাদ দিলাম; যারা নবীর উপর ঈমান এনেছেন তারা কি তাদের নবীকে এভাবে সমাজ থেকে দূরে ফেলে আসতে পারেন? যখন নবীকে জঙ্গলে ফেলে আসা হল তখন তার অনুসারীগণ কোথায় ছিলেন? অথচ, এটা ঈমানের পরিপন্থী কাজ।
তৃতীয়ত: কেমন করে এটা সম্ভব হতে পারে যে, সমাজের শ্রেষ্ঠ বংশের সন্তান এই নবীর স্ত্রী লোকের বাড়ীতে কাজ করে কিংবা নিজের মাথার চুল বিক্রি করে স্বামীর জন্য আহার সংগ্রহ করবেন?
চতুর্থত: নবীদের কাজ হচ্ছে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করা। যদি তাকে এমন কোন রোগ দেয়া হয় যা মানুষকে তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, তাহলে এর পিছনে কী স্বার্থকতা থাকতে পারে?
পঞ্চমত: ইয়াহুদী খৃষ্টানরা আল্লাহ তাআ'লার কিতাবকে পরিবর্তন করে তদস্থলে নিজেদের মনগড়া কথা লিখে মানুষকে বলতেন যে, এটা আল্লাহর বাণী। উদ্দেশ্য ছিল দুনিয়ার সামান্য স্বার্থসিদ্ধি করা। তারা যদি আল্লাহ তাআ'লার কিতাবকে পরিবর্তন করার সাহস দেখাতে পারেন এবং আল্লাহ তাআ'লাকে ফকীর ও নিজেদেরকে ধনী বলার সাহস দেখাতে পারেন, তাহলে নবীদের ব্যপারে আজেবাজে কথা বলাতো তাদের পক্ষে আরও সহজ। অতএব, তাদের কাছ থেকে এগুলো গ্রহণ করা কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না। (আল ইসরাইলিয়াত ওয়াল মাউদুআত নামক কিতাব থেকে সারকথা )।
হাদিসের আলোকে ইয়াহুদিদের মিথ্যাচার:
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন: তোমরা আহলে কিতাবদের (ইয়াহুদী ও খৃষ্টান) কাছে কেমন করে কোনো বিষয় জিজ্ঞাসা কর অথচ, তোমাদের কিতাব যা রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর নাযিল হয়েছে- তোমরা অবিকল আল্লাহ তাআ'লা যেমন নাযিল করেছেন সেভাবেই তিলাওয়াত কর। তা এখনও পুরাতন হয়ে যায়নি। আর সেটাই তোমাদেরকে জানিয়েছে যে, আহলে কিতাব তথা ইয়াহুদী খৃষ্টানরা তাদের প্রতি আল্লাহ তাআ'লার দেয়া কিতাবকে পরিবর্তন করে নিজেদের হাতে ইচ্ছামত কথামালা সংযোজন করে বলে যে, এটা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে। দুনিয়ার তুচ্ছ মূল্য লাভের আশায়। সহিহ বুখারী।
অন্যান্য যুক্তি:
আল্লামা তাবরুসী বলেন: মুহাক্কিক আলেমগণের অভিমত হচ্ছে, নবীদের অবস্থা কখনও এমন হতে পারে না, যা মানুষের কাছে ঘৃণার উদ্রেক ঘটায়। কেননা, তা তাদেরকে তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। তবে, আল্লাহ তাআ'লার পক্ষ থেকে পরিক্ষা স্বরূপ দারিদ্রতা, স্বাভাবিক রোগ কিংবা আত্মীয়-স্বজন তার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারে। (তাফসীরে রুহুল মাআনী)।
কোন কোন আলেমের মতে- অন্যান্য মানুষের মত নবীদেরও বিভিন্ন মানবিক সমস্যা হতে পারে, তবে, তাদের কাছ থেকে অপছন্দনীয় কিংবা নিষিদ্ধ কোন কিছু পাওয়া যেতে পারে, এমনটা সম্ভব নয়। কিংবা এমন কোন সমস্যা তাদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে না যার কারণে মানুষেরা তাকে খারাপ ভাববে কিংবা তার কাছ থেকে দূরে সরে থাকবে। (রুহুল মাআনী)।
আইয়্যুব আলাইহিস সালাম -এর ইনতিকাল:
আইয়্যুব আলাইহিস সালাম ৭০ বছর বয়সে রোগ দ্বারা পরিক্ষায় পতিত হন। পরিক্ষা থেকে মুক্ত হবার অনেক পরে ৯৩ বছর বয়স বা তার কিছু বেশি বয়সে তিনি ইনতিকাল করেন। আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় এই বান্দার প্রতি রহমত বর্ষন করুন।
পরিশেষে:
আল কুরআনের ভাষায়, শয়তান সর্বাবস্থায় মুমিনের প্রকাশ্য দুশমন। নানান ছলচাতুরিতে ভুল, বিভ্রান্তি আর মিথ্যাচার ছড়িয়ে দিয়ে আমাদের ঈমান হরণ করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকে সে। নেক ছুরতে ধোঁকা দিয়ে আমাদের বিশ্বাসকে নড়বড়ে করে দেয়ার চেষ্টাও তার সার্বক্ষনিক অপচেষ্টারই অংশ। শিরকি চিন্তাধারার জাল বিস্তার করে সে সব সময় মুমিনকে আল্লাহ তাআ'লার পথ থেকে সরিয়ে নিতে চায়। আল্লাহ তাআ'লার প্রতি একনিষ্ঠ নির্ভরতা, দৃঢ়তার সাথে তাওহিদের উপর অনঢ় অটল বিশ্বাস এবং জীবনের প্রতি পদক্ষেপে সামগ্রিক সতর্কতাই মুমিনকে শয়তানের মিথ্যা ফাদ থেকে রক্ষা করতে পারে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা আমাদের শয়তানের ধোঁকার বেড়াজাল থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন।
১৩ ই এপ্রিল, ২০২০ সকাল ৯:২৭
নতুন নকিব বলেছেন:
একমাত্র আল্লাহ পাক ভালো জানেন। তাঁর কাছে আশ্রয় চাই।
ভালো থাকুন সবসময়।
২| ৩১ শে মার্চ, ২০২০ রাত ৯:৪১
রাজীব নুর বলেছেন: নিজ দায়িত্বে বাসায় থাকুন। নিজেকে বাঁচান, দেশকেও বাঁচতে দিন। দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিন।
১৩ ই এপ্রিল, ২০২০ সকাল ৯:২৮
নতুন নকিব বলেছেন:
জ্বি, ভালো বলেছেন। ধন্যবাদ।
৩| ১২ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১০:০৪
আল আমিন সেতু বলেছেন: জাযাকাল্লাহু খাইরান। আপনি মূল উৎস থেকে খুব সুন্দর লিখেছেন।
১৩ ই এপ্রিল, ২০২০ সকাল ৯:২৮
নতুন নকিব বলেছেন:
শুকরিয়া। জাজাকুমুল্লাহু তাআ'লা।
©somewhere in net ltd.
১| ৩১ শে মার্চ, ২০২০ দুপুর ১:৫৭
নেওয়াজ আলি বলেছেন: জানি না মানুষের জীবনমরণ কোথায় ঠেকে