নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আলহামদুলিল্লাহ। যা চাইনি তার চেয়ে বেশি দিয়েছেন প্রিয়তম রব। যা পাইনি তার জন্য আফসোস নেই। সিজদাবনত শুকরিয়া। প্রত্যাশার একটি ঘর এখনও ফাঁকা কি না জানা নেই, তাঁর কাছে নি:শর্ত ক্ষমা আশা করেছিলাম। তিনি দয়া করে যদি দিতেন, শুন্য সেই ঘরটিও পূর্নতা পেত!

নতুন নকিব

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দল-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না- বিদ্রোহী রন-ক্লান্ত। আমি সেই দিন হব শান্ত।

নতুন নকিব › বিস্তারিত পোস্টঃ

জিহবা আমার সিক্ত থাকুক জিকিরের বৃষ্টিতে

১৭ ই মার্চ, ২০২১ সকাল ১০:৪৪

ছবি: অন্তর্জাল।

ক্যালিগ্রাফি পরিচিতিঃ

أَلاَ بِذِكْرِ اللّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ

জেনে রাখ, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়। -সূরা আর র'দ, আয়াত ২৮

জিহবা আমার সিক্ত থাকুক জিকিরের বৃষ্টিতে

জিকির। হ্যা, জিকির। জিকরে ইলাহি। এর চেয়ে মধুর, এর চেয়ে প্রশান্তির, এর চেয়ে বিমল বিমুগ্ধ অনুভূতির আর কিছু নেই। মহান মালিক আল্লাহ সুবহানুহু ওয়া তাআ'লাকে ডাকার মাঝে, তাঁর স্মরণের মাঝে নিহিত জগতের তাবত সুখানুভূতি। তাঁকে ডেকে ডেকে পাগলপাড়া হওয়ার মাঝে সত্যিকারের প্রেমানুভূতির প্রকাশ। তাকে ডাকলে চোখ উজ্জ্বল হয়। হৃদয় আলোকিত হয়। অন্তর প্রশান্ত হয়। অন্ধকারে আলোর দিশা মেলে। তাই তো ডাকতে হবে তাকেই। ডাকতে হবে ডাকার মত। জিকিরের ধ্বনিতে দূরিভূত হবে শয়তানের ওয়াসওয়াসা। কেটে যাবে বিভ্রান্তির মোহজাল। পার্থিব অসাড়তা, মরিচিকা আর শুন্যতার পেছনে ছুটে চলার অন্তহীন মিছে মায়া। তাই জিকিরের সাথে যুক্ত করেছি বৃষ্টি শব্দটি। বৃষ্টি বটে। জিকিরের বৃষ্টি। জিহবা আমার সিক্ত থাকুক জিকিরের বৃষ্টিতে। সারাদিন আমি কথাবার্তা বলি যত, জিকির কি তার সমপরিমান করি! আধাআধি অর্থাৎ, অর্ধেক করি! আরে, সমপরিমান আর অর্ধেক! বলি, সিকি পরিমাণ করি! আদৌ কোনো জিকিরই কি করা হয় প্রতি দিন! হায় হায়, দরকারি-বেদরকারি, জায়েয-নাজায়েয কত রকম কথাবার্তায় অতিবাহিত হয় আমার দিনরাত, কিন্তু জিকিরের জন্য সারাটি দিনের, সারাটি রাতের সামান্য কিছু অংশও কি ব্যয় করা হয়! আফসোস, আসল মালিককেই ডাকলাম না! প্রকৃত মুহাব্বত যার সাথে থাকার কথা তাকেই চিনলাম না! জীবনদাতাকেই স্মরণ করলাম না! জীবনে সবই করলাম; পালনকর্তা, সুস্থ রাখার মালিকের সাথেই শুধু সম্পর্কটা গড়লাম না! কাছে টানলাম সবাইকে; ভুলে থাকলাম শুধু তাকেই! অথচ, কতই না দরদে ভরা কন্ঠে তিনি কাছে ডাকেন আমাকে! কুরআনে পাকের কাছে গিয়ে কান পাতলেই আমি হৃদয়ের তন্ত্রী ছেঁড়া সে দরদিয়া আহবান শুনি! আমি একটু বিগড়ে গেলে, একটু দূরে সরে গেলেই কুরআনুল হাকিম আমাকে বলে ওঠে-

يَا أَيُّهَا الْإِنسَانُ مَا غَرَّكَ بِرَبِّكَ الْكَرِيمِ

হে মানুষ, কিসে তোমাকে তোমার মহামহিম দরদি পালনকর্তা সম্পর্কে বিভ্রান্ত করল? -সূরা আল ইনফিতর, আয়াত ০৬

আহারে! এমন আহবান শুনেও হুঁশ হয় না আমার! কি নিদারুন আত্মভোলা আমি! কি বিভ্রমে নিপতিত আমি! কি মোহময়তার কুয়াশায় আচ্ছন্ন আমি!

এই আমিটাই বা কে? 'আমি' বলতেই তো কিছুর অস্তিত্ব ছিল না! থাকবেও না! তিনি তো সে কথাও জানিয়েছেন আমাকে!

هَلْ أَتَى عَلَى الْإِنسَانِ حِينٌ مِّنَ الدَّهْرِ لَمْ يَكُن شَيْئًا مَّذْكُورًا

মানুষের উপর এমন কিছু সময় অতিবাহিত হয়েছে যখন সে উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না। -সূরা আল ইনসান/ আদ দাহর, আয়াত ০১

আমি কে? কি আমার পরিচয়? রক্ষা করেন কে আমায়?

যিনি আমাকে মায়ের কোলে পাঠালেন তিনি কে? কে তিনি? পরম দয়ালু মালিক তিনি। পরম দয়ালু অসীম দয়াময় তিনি। পৃথিবীতে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি। তাকিয়ে রয়েছেন আমার দিকে। প্রতিটি মুহূর্ত আমাকে হেফাজতের দায়িত্বে নিযুক্ত করে দিয়েছেন তাঁর সৃষ্ট মালাইক তথা, ফিরিশতাদের। নিষ্পাপ ফিরিশতাগন আমার খেদমতে নিযুক্ত। মালিকের হুকুমে। যিনি আমাকে ডানে বামে ফিরিশতা দিয়ে হেফাজত করেন, আর আমিই কি না ভুলে গেছি আমার সেই প্রিয়তম মনিব মালিককে। তিনি যে আমাকে হেফাজত করিয়ে যাচ্ছেন তার বর্ণনাও রয়েছে তাঁর বিঘোষিত বাণীতে-

لَهُ مُعَقِّبَاتٌ مِّن بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ يَحْفَظُونَهُ مِنْ أَمْرِ اللّهِ إِنَّ اللّهَ لاَ يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُواْ مَا بِأَنْفُسِهِمْ وَإِذَا أَرَادَ اللّهُ بِقَوْمٍ سُوءًا فَلاَ مَرَدَّ لَهُ وَمَا لَهُم مِّن دُونِهِ مِن وَالٍ

তাঁর পক্ষ থেকে অনুসরণকারী রয়েছে তাদের অগ্রে এবং পশ্চাতে, আল্লাহর নির্দেশে তারা ওদের হেফাযত করে। আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে। আল্লাহ যখন কোন জাতির উপর বিপদ চান, তখন তা রদ হওয়ার নয় এবং তিনি ব্যতীত তাদের কোন সাহায্যকারী নেই। -সূরা আর র'দ, আয়াত ১১

হায় হায়! মালিকরে ভুলিয়া....

শিল্পীর সুরে সুরে মন গেয়ে ওঠে....

হঠাৎ আজরাইল পাঠাইয়া তোরে নিতে পারে তুলিয়া,
কিসের আশায় রইলিরে মন মালিকরে ভুলিয়া,
ও তুই মালিকরে ভুলিয়া।২
ধন সম্পদ পাইয়া হাতে করলি জমিদারি,
ক্ষমতার অহংকারে করলি বাহাদুরি ২
ও তোর রেশমি পোষাক সোনার আংটি ২
নেবে স্বজনরা খুলিয়া, কিসের আশায় রইলিরে মন মালিকরে ভুলিয়া
ও তুই মালিকরে ভুলিয়া।
মালিকরে ভুলিয়া, ও তুই মালিকরে ভুলিয়া।
ক্ষনে ক্ষনে কবর ডাকে আইরে আমার বাড়ী,
মাটির উপর থাকবিরে তুই দিন কয়েক চারি
ও তুই দিন দুই এক চারই ২
আসতে তোর হবে একদিন ২
সাদা কাফন পরিয়া
কিসের আশায় রইলিরে মন মালিকরে ভুলিয়া
ও তুই মালিকরে ভুলিয়া।
হঠাত আজরাইল পাঠাইয়া তোরে নিতে পারে তুলিয়া,
কিসের আশায় রইলিরে মন মালিকরে ভুলিয়া,
ও তুই মালিকরে ভুলিয়া। ২

শুনতে ইচ্ছে করে চমৎকার এই গজলটি? কলরবের ছেলেদের কন্ঠে শুনে আসতে পারেন-

হঠাৎ আজরাইল পাঠাইয়া তোরে নিতে পারে তুলিয়া

মন, তুমি মালিককে ভুলো না!

পার্থিব ব্যস্ততা জীবন জুড়ে আছে। থাকবে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। জীবন পরিচালনার জন্য শত কষ্ট হলেও সেসব কাজ আমরা করি। কিন্তু আখেরাতের অন্তহীন জীবনের কথা স্মরণ করার সময় তো বের করে নিতে হবে এরই ভেতর থেকে।

যত দীর্ঘায়ুই লাভ করি না কেন, দুনিয়ার জীবন তো অতি সংক্ষিপ্ত। আখেরাতের জীবনের সামনে দুনিয়ার জীবন তো কোনো হিসাবেই আসে না। দুনিয়ার এ ক্ষণস্থায়ী জীবনের জন্যই যদি যিন্দেগীর পুরোটা এভাবে ক্ষয় করে ফেলি, ব্যয় করে দিই, বিশাল আখেরাতের জন্য তাহলে কী থাকলো? আমাকে যে করেই হোক আখেরাতের পুঁজি সঞ্চয় করতে হবে, দুনিয়াবী সব কাজের উপরে আখেরাতকেই প্রাধান্য দিতে হবে। আর আখেরাতের সবচেয়ে বড় অর্জন হবে আমার মালিক, রবের জিকির। তাঁর জিকিরে যেন সদা তাজা থাকে আমার জিহবা, ওষ্ঠ, কন্ঠ, অন্তর, প্রাণ।

জিকরে ইলাহির গুরুত্ব, বরকত ও ফযিলত অবর্ণনীয়ঃ

কুরআনে কারীম এবং হাদীস শরীফে জিকির ও জিকিরকারীদের অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা কুরআনে ইরশাদ করেছেন-

وَ لَذِكْرُ اللّٰهِ اَكْبَرُ.

অর্থাৎ আল্লাহর জিকিরই সবচেয়ে বড়। -সূরা আনকাবুত, আয়াত : ৪৫

আরেক স্থানে ইরশাদ করেছেন-

اِنَّ الْمُسْلِمِیْنَ وَ الْمُسْلِمٰتِ ... وَ الذّٰكِرِیْنَ اللهَ كَثِیْرًا وَّ الذّٰكِرٰتِ اَعَدَّ اللهُ لَهُمْ مَّغْفِرَةً وَّ اَجْرًا عَظِیْمًا.

নিশ্চয় মুসলিম পুরুষ এবং নারী... বেশি বেশি আল্লাহর জিকিরকারী পুরুষ এবং নারী এদের জন্য আল্লাহ মাগফিরাত এবং বিরাট আজর প্রস্তুত করে রেখেছেন। -সূরা আহযাব, আয়াত : ৩৫

তিনি অন্যত্র বলেন-

وَاذْكُرُواْ اللّهَ كَثِيرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلَحُونَ

এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর যাতে তোমরা উদ্দেশ্যে কৃতকার্য হতে পার। -সূরা নং ৮, আয়াত : ৪৫

তিনি অন্য আয়াতে বলেন-

الَّذِينَ آمَنُواْ وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكْرِ اللّهِ أَلاَ بِذِكْرِ اللّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ

যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর জিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখ, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি পায়। -সূরা নং ১৩, আয়াত : ২৮

আরেক আয়াতে বর্ণিত হয়েছে-

إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَاخْتِلاَفِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لآيَاتٍ لِّأُوْلِي الألْبَابِ

নিশ্চয় আসমান ও যমীন সৃষ্টিতে এবং রাত্রি ও দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধসম্পন্ন লোকদের জন্যে। -সূরা নং ০৩, আয়াত : ১৯০

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-

الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىَ جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذا بَاطِلاً سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

যাঁরা দাঁড়িয়ে, বসে, ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষযে, (তারা বলে) পরওয়ারদেগার! এসব আপনি অনর্থক সৃষ্টি করেননি। সকল পবিত্রতা আপনারই, আমাদিগকে আপনি দোযখের শাস্তি থেকে বাঁচান। -সূরা নং ০৩, আয়াত : ১৯১

আরেক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

اللَّهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتَابًا مُّتَشَابِهًا مَّثَانِيَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْ وَقُلُوبُهُمْ إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ ذَلِكَ هُدَى اللَّهِ يَهْدِي بِهِ مَنْ يَشَاء وَمَن يُضْلِلْ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ

আল্লাহ উত্তম বাণী তথা কিতাব নাযিল করেছেন, যা সামঞ্জস্যপূর্ণ, পূনঃ পূনঃ পঠিত। এতে তাদের লোম কাঁটা দিয়ে উঠে চামড়ার উপর, যারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করে, এরপর তাদের চামড়া ও অন্তর আল্লাহর স্মরণে বিনম্র হয়। এটাই আল্লাহর পথ নির্দেশ, এর মাধ্যমে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন। আর আল্লাহ যাকে গোমরাহ করেন, তার কোন পথপ্রদর্শক নেই। -সূরা নং ৩৯, আয়াত : ২৩

অন্য এক আয়াতে সতর্ক করা হয়েছে-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَن ذِكْرِ اللَّهِ وَمَن يَفْعَلْ ذَلِكَ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ

মুমিনগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল না করে। যারা এ কারণে গাফেল হয়, তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত। -সূরা নং ৬৩, আয়াত : ০৯

এক স্থানে জিকির না করার ভয়াবহ পরিনাম সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে-

وَمَنْ أَعْرَضَ عَن ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى

এবং যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে এবং আমি তাকে কেয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করব। -সূরা নং ২০, আয়াত : ১২৪

لِنَفْتِنَهُمْ فِيهِ وَمَن يُعْرِضْ عَن ذِكْرِ رَبِّهِ يَسْلُكْهُ عَذَابًا صَعَدًا

যাতে এ ব্যাপারে তাদেরকে পরীক্ষা করি। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তিনি তাকে উদীয়মান আযাবে পরিচালিত করবেন। -সূরা নং ৭২, আয়াত : ১৭

اسْتَحْوَذَ عَلَيْهِمُ الشَّيْطَانُ فَأَنسَاهُمْ ذِكْرَ اللَّهِ أُوْلَئِكَ حِزْبُ الشَّيْطَانِ أَلَا إِنَّ حِزْبَ الشَّيْطَانِ هُمُ الْخَاسِرُونَ

শয়তান তাদেরকে বশীভূত করে নিয়েছে, অতঃপর আল্লাহর স্মরণ ভূলিয়ে দিয়েছে। তারা শয়তানের দল। সাবধান, শয়তানের দলই ক্ষতিগ্রস্ত। -সূরা নং ৫৮, আয়াত : ১৯

أَفَمَن شَرَحَ اللَّهُ صَدْرَهُ لِلْإِسْلَامِ فَهُوَ عَلَى نُورٍ مِّن رَّبِّهِ فَوَيْلٌ لِّلْقَاسِيَةِ قُلُوبُهُم مِّن ذِكْرِ اللَّهِ أُوْلَئِكَ فِي ضَلَالٍ مُبِينٍ

আল্লাহ যার বক্ষ ইসলামের জন্যে উম্মুক্ত করে দিয়েছেন, অতঃপর সে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে আগত আলোর মাঝে রয়েছে। (সে কি তার সমান, যে এরূপ নয়) যাদের অন্তর আল্লাহ স্মরণের ব্যাপারে কঠোর, তাদের জন্যে দূর্ভোগ। তারা সুস্পষ্ট গোমরাহীতে রয়েছে। -সূরা নং ৩৯, আয়াত : ২২

وَمَن يَعْشُ عَن ذِكْرِ الرَّحْمَنِ نُقَيِّضْ لَهُ شَيْطَانًا فَهُوَ لَهُ قَرِينٌ

যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণ থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়, আমি তার জন্যে এক শয়তান নিয়োজিত করে দেই, অতঃপর সে-ই হয় তার সঙ্গী। -সূরা নং ৪৩, আয়াত : ৩৬

হাদীস শরীফে আছে, হযরত আবুদ দারদা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে উত্তম, তোমাদের রবের নিকট সবচেয়ে প্রিয়, তোমাদের মর্যাদা সবচেয়ে বেশি উন্নতকারী, স্বর্ণ রৌপ্য আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার চেয়েও বেশি উত্তম এবং শত্রুর মুখোমুখি হয়ে শত্রুকে হত্যা করা এবং শত্রুর হাতে তোমাদের শহীদ হওয়ার চেয়েও বেশি উত্তম আমলের কথা বলব?

সাহাবীগণ বললেন, অবশ্যই ইয়া রাসূলাল্লাহ! তখন তিনি বললেন, তা হচ্ছে আল্লাহ তাআলার জিকির। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৩৭৭

হযরত আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, মুফাররিদরা অগ্রগামী হয়ে যাচ্ছে। সাহাবারা জিজ্ঞাসা করলেন, মুফাররিদ কারা, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তখন তিনি বললেন, বেশি বেশি আল্লাহর জিকিরকারী পুরুষ এবং নারী। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৮৯১

এমন আরো অনেক ফযীলতপূর্ণ হাদীস বর্ণিত আছে। অনেক জিকির আছে, যেগুলো আদায় করতে খুব কম সময় লাগে, কিন্তু আজর বা সাওয়াবের দিক থেকে অনেক বড়। যেমন, সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী সুবহানাল্লাহিল আযীম। পড়তে কতক্ষণ লাগে? কিন্তু তার আজর! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এই দুটি বাক্য পড়তে খুবই সহজ, অথচ সেগুলো রহমানের নিকট প্রিয় এবং মীযানের পাল্লায় হবে ভারী। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪০৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯০৪

এই তাসবীহের আরো একটি ফযিলত বর্ণিত আছে। তা হল, যে ব্যক্তি দিনে একশ বার সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী পড়বে তার সকল সগীরা গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। যদিও তা সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪০৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯০৮; জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৬৬

কতভাবে কত সময়ই তো চলে যায় তোমার, জিকরের স্বাদ আস্বাদনেও বের করে নাও কিছুটা সময়

সারাদিন কতভাবেই তো সময় নষ্ট করি। কত ধরনের কথাবার্তায় সময় পার করি। অথচ এসব সময়ে জিকির-তিলাওয়াত, অযীফায় মশগুল থাকলে দুনিয়া-আখেরাত উভয় দিক থেকে কত লাভবান হতাম! যবানের গোনাহে আমলনামা ভরে উঠত না।

জিকিরের সাথে ইস্তিগফারের আমল করা খুবই জরুরি। কারণ, নাজায়েয কোনো কথা বলে ফেললে তারপরে যদি বেশি বেশি ইস্তিগফার বা জিকির করি তাহলে তা সেই গোনাহের কাফফারা হয়ে যায়! আমাদের প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও দিনে সত্তুর বারের বেশি ইস্তিগফার করতেন। তাহলে গোনাহগার উম্মতের জন্য কী পরিমাণ ইস্তিগফার প্রয়োজন? আমাদের বেশিরভাগ গোনাহই যবানের দ্বারা হয়। তাই সারা দিন বেশি বেশি ইস্তিগফার পড়া উচিত।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় কন্যা হযরত ফাতিমা রা.-কে খাদেমা দেওয়ার বদলে তাসবীহ শিখিয়েছেন এবং বলেছেন, এই তাসবীহ গোলাম-বাদী থেকেও উত্তম। রাতে ঘুমানোর সময় তেত্রিশবার সুবহানাল্লাহ, তেত্রিশবার আলহামদু লিল্লাহ, চৌত্রিশবার আল্লাহু আকবার পড়া।

আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন দুআ শিখিয়েছেন। ঘুমানোর দুআ, ঘুম থেকে ওঠার পরের দুআ, খাওয়ার আগে-পরের দুআ, ইস্তিঞ্জার আগে-পরের দুআ, সকাল-সন্ধ্যার দুআ। যাতে এসকল দুআর মাধ্যমে সবসময়ই আল্লাহকে স্মরণ করতে পারি; কোনো অবস্থায়ই যেন আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল না থাকি।

দৈনন্দিন দুআ-জিকিরের সাথে সাথে প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ তিলাওয়াত, মুনাজাতে মাকবূল এবং অন্যান্য ওযীফাও আদায় করা উচিত।

জীবন আছে যত দিন, কাজ থাকবে তত দিন, জিকরে ইলাহির সময় বের করে নিতে হবে এর মাঝেইঃ

আমি হয়ত বলতে পারি, সারা দিন আমার কত কাজ! এত কাজকর্ম সংসার সামলে এত আমল করার সুযোগ কোথায়! কিন্তু পূর্ববর্তী মহীয়সী নারী পুরুষদের জীবনের দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখা যাবে, তাঁদেরও কাজকর্ম ছিল, সংসার ছিল, আমার চেয়েও তাঁদের ব্যস্ততা, সাংসারিক ঝামেলা অনেক বেশি ছিল। কিন্তু এত কষ্ট, এত ব্যস্ততা সত্ত্বেও তাঁদের জীবন ছিল আমলে-জিকিরে ভরপুর। এসব ছিল তাদের মূল কাজ। বাকিগুলো করতেন প্রয়োজনের তাকিদে। আমিও তাঁদের মতো হিম্মত করলে, দুনিয়া এবং আখেরাতকে তাঁদের মতো করে ভাবলে আমার জন্যও জিকির-আমল সহজ হয়ে যাবে।

তাছাড়া কাজ তো করি হাত-পা দিয়ে। মুখ তো অবসরই থাকে। তাই অবসর সময়ে তো বটেই, ব্যস্ত সময়েও জিকির, ইস্তিগফারে লেগে থাকতে পারি।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ইসলামে তো অনেক বিষয় আছে (সবগুলোর উপর আমল করা হয়তো আমার পক্ষে সম্ভব হবে না) সুতরাং আমাকে এমন কোনো আমলের কথা বলে দিন, যাতে আমি সবসময় লেগে থাকতে পারি। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

لَا يَزَالُ لِسَانُكَ رَطْبًا مِنْ ذِكْرِ اللهِ.

তোমার যবান যেন সর্বদা আল্লাহর জিকিরে সিক্ত-সতেজ থাকে। -সুনানে তিরমিযী, হাদীস ৩৩৭৫

শেষের কথাঃ

যারা জিকির করেন তারা প্রজ্ঞাময় এবং তাদের ইহকালীন ও পরকালীন জীবনে সাফল্য, শান্তি, সুখ, করুণা, ক্ষমা এবং মহান প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

যারা জিকির থেকে গাফিল তাদের হেরে যাওয়া শ্রেনি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। তারা বাহ্যিক শান শওকতে থাকলেও অন্তরের প্রশান্তিবিহীন সংকীর্ণ জীবন যাপন করবে, তারা দুর্দশায় পূর্ণ হবে এবং হায় আফসোস, এই জীবনে শাস্তিপ্রাপ্তির পাশাপাশি পরকালে অন্ধ হয়ে উঠবে এবং যে সময়গুলো আল্লাহ তাআ'লার স্মরণে কাটায়নি তার জন্য অনন্ত অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকবে। নিজেদের ধিক্কার দিতে থাকবে। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-

وَمَنْ أَعْرَضَ عَن ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى

এবং যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে এবং আমি তাকে কেয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করব। -সূরা ত্ব-হা-, আয়াত : ১২৪

এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে-

যিনি তাঁর পালনকর্তাকে স্মরণ করেন এবং যিনি তাঁকে স্মরণ করেন না তার সাদৃশ্য জীবিত ও মৃতদের মধ্যে সমান। -সহিহ বুখারী

প্রার্থনায় মগ্ন হই, রুজু হই তাঁরই দিকেঃ

আমাদের অবস্থাও যেন হয় পূর্ববর্তী অলী আউলিয়ায়ে কিরামের মত। যারা জিকিরের স্বাদে মগ্ন হয়ে ভুলে যেতেন দুনিয়ার তাবত সুখ, শান্তি এবং আরাম আয়েশ। আল্লাহ তাআ'লা প্রত্যেকের অন্তরে তাঁর জিকিরের মুহাব্বত পয়দা করে দিন। আমাদের প্রত্যেকের প্রতিক্ষণের প্রার্থনা হোক, জিহবা আমার সিক্ত থাকুক জিকিরের বৃষ্টিতে!

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই মার্চ, ২০২১ দুপুর ১:২৭

মোহামমদ কামরুজজামান বলেছেন: মহান আল্লাহপাক রাববুল আলামিন আমাদেরকে ধর্মের সকল বিধি-বিধান যথাযথ ভাবে পালন করার এবং সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করার তথা যিকির করার তওফিক দান করুন।

১৭ ই মার্চ, ২০২১ দুপুর ২:০৬

নতুন নকিব বলেছেন:



জাজাকুমুল্লাহ। আমিন।

২| ১৭ ই মার্চ, ২০২১ দুপুর ২:০২

রাজীব নুর বলেছেন: মহান আল্লাহপাক রাববুল আলামিন আমাদেরকে ধর্মের সকল বিধি-বিধান থেকে আমাকে দূরে রাখুক। এটাই আমার চাওয়া।

১৭ ই মার্চ, ২০২১ দুপুর ২:১১

নতুন নকিব বলেছেন:



ক্ষমা করবেন, আপনি তো এর আগে এরকম ছিলেন না। কুরআন নিয়ে লিখতেন। বলতেন, প্রতি দিন সকালে কুরআন তিলাওয়াত শোনেন। মসজিদে যেতেন, তা-ও বলেছেন। কিছু দিন যাবত বিপরীত কথাবার্তা বলছেন। এগুলো বলার পেছনে কারণ কি? শুধুই পশ্চিমের কোনো দেশে অভিবাসনপ্রাপ্তির সুযোগ গ্রহণ?

জানি না, আমার ধারণা সঠিক কি না। ভুলও হতে পারে। ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করবেন।

ধন্যবাদ।

৩| ১৭ ই মার্চ, ২০২১ বিকাল ৩:২৬

নেয়ামুল নাহিদ বলেছেন: অনেক সুন্দর লিখেছেন। অনেক ভালো লেগেছে পড়ে, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
লেখাটি দুইটা পোস্টে দিলে আরো বেশি লোকের কাছে পৌঁছত হয়তো। কারণ অতি দীর্ঘ লেখা অনেকে পড়তে চায় না - হতে পারে এটা নিতান্তই আমার ধারণা।

১৮ ই মার্চ, ২০২১ সকাল ৮:৫৯

নতুন নকিব বলেছেন:



অনেক সুন্দর লিখেছেন। অনেক ভালো লেগেছে পড়ে, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

-মোবারকবাদ। লেখাটি আপনার কাছে ভালো লেগেছে- এটা নিঃসন্দেহে খুশির ব্যাপার। আর এটা খুবই স্বাভাবিক যে, আল্লাহ তাআ'লার জিকিরের আলোচনা তাঁর প্রিয় কিছু বান্দাদেরই ভালো লাগবে। তাদের মন আন্দোলিত হবে, আলোড়িত হবে, আলোকিত হবে, আদিগন্ত প্রসারিত আলোকের ঝলকানিতে উজ্জ্বল-প্রোজ্জ্বল-উদ্ভাসিত হবে।

লেখাটি দুইটা পোস্টে দিলে আরো বেশি লোকের কাছে পৌঁছত হয়তো। কারণ অতি দীর্ঘ লেখা অনেকে পড়তে চায় না - হতে পারে এটা নিতান্তই আমার ধারণা।

-সুপরামর্শ এবং আন্তরিক মতামতের জন্য কৃতজ্ঞতা। তবে একটা ব্যাপার হচ্ছে, পার্ট পার্ট করে পোস্ট দেয়ার সুফল এবং কুফল দু'টিই রয়েছে। এ কারণে পারতপক্ষে পোস্ট এক সাথেই দেয়ার চেষ্টা থাকে। সর্বোপরি, আপনার পরামর্শ আমাদের কাছে বিশেষ গুরুত্ববহ। পরবর্তীতে পোস্টের ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ লক্ষ্য রাখার চেষ্টা থাকবে।

শুভকামনা।

৪| ১৭ ই মার্চ, ২০২১ বিকাল ৪:৩২

নেওয়াজ আলি বলেছেন: জিকির করা নিয়ে মতভেদ আছে কেউ বলে উচ্চস্বরে কেউ বলে মনে মনে কোনটা সঠিক ।

১৮ ই মার্চ, ২০২১ সকাল ৯:২৬

নতুন নকিব বলেছেন:



নিঃশব্দে জিকির নিয়ে যেমন দলীল রয়েছে, তেমনি সশব্দে বা জেহরী জিকিরের পক্ষেও দলীল রয়েছে। জেহরী জিকিরের অকাট্য পর্যাপ্ত দলীলের কারণে তার গুরুত্ব অনুধাবন করে আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রহ.) এ বিষয়ে একটি দালীলিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার নাম হচ্ছে–نتيجة الفكر في الجهر بالذكر (নাতীজাতুল ফিকরি ফিল জাহরি বিজ্ জিকরি)। সেখানে তিনি জিকরে জেহেরের পক্ষে ২৫টি দলীল বর্ণনা করেছেন এবং এ নিয়ে আরোপিত বিভিন্ন প্রশ্নের সমাধান দিয়েছেন। ইন্টারনেটে উক্ত বইয়ের পিডিএফ কপি নিম্নোক্ত লিঙ্কে পাবেন–

https://www.nafahat-tarik.com/2016/01/sufism_23.html

তেমনি এ বিষয় নিয়ে আরো অনেক মুহাক্কিক আলেম বিস্তারিত দলীল-প্রমাণ দিয়ে স্বতন্ত্র পুস্তক রচনা করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন আল্লামা আবদুল হাই লাখনবী (রহ.)। তার রচিত সেই পুস্তকের নাম হচ্ছে–سباحة الفكر في الجهر بالذكر (সাবাহাতুল ফিকরি ফিল জাহরি বিজ্ জিকরি)। উক্ত কিতাবকে তাহকীক-বিশ্লেষণ দ্বারা বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে আরব কান্ট্রিতে প্রকাশ করেছেন শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ,)। নিম্নোক্ত লিঙ্ক থেকে উক্ত কিতাব সংগ্রহ করতে পারেন–

https://www.alsufi.net/…/2094-سباحØ%A…

জিকরে খফীর ন্যায় জিকরে জলী বা জেহেরী জিকিরের পক্ষে পবিত্র কুরআনে ও অসংখ্য হাদীসে অকাট্য দলীল-প্রমাণাদি রয়েছে। নিম্নে সেসব দলীল পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হচ্ছে–

পবিত্র কুরআনে জেহেরী বা উচ্চ স্বরে জিকিরের দলীল :
——————————————
পবিত্র কুরআনের সূরাহ আ‘রাফের ২০৫ নং আয়াতে সশব্দে জিকির ও নিঃশব্দে জিকির উভয় প্রকার জিকিরের নির্দেশনা রয়েছে। উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন–

وَاذۡکُرۡ رَّبَّکَ فِیۡ نَفۡسِکَ تَضَرُّعًا وَّخِیۡفَۃً وَّدُوۡنَ الۡجَہۡرِ مِنَ الۡقَوۡلِ بِالۡغُدُوِّ وَالۡاٰصَالِ وَلَا تَکُنۡ مِّنَ الۡغٰفِلِیۡنَ

'এবং স্বীয় পালনকর্তার জিকির করুন চুপে চুপে (নিঃশব্দে) বিনম্রভাবে ও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে এবং খুব জোরের চেয়ে কম আওয়াজে (সশব্দে) সকালে (সূর্যোদয়ের পূর্বে) ও বিকালে (সূর্যাস্তের পূর্বে)। আর গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না।' -সূরাহ আ‘রাফ, আয়াত নং ২০৫

উক্ত আয়াতের দু’টি অংশে দু’প্রকার জিকিরের কথা বলা হয়েছে : وَاذۡکُرۡ رَّبَّکَ فِیۡ نَفۡسِکَ অংশে সিররী জিকির এবং وَّدُوۡنَ الۡجَہۡرِ مِنَ الۡقَوۡلِ অংশে জেহেরী জিকিরের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আর تَضَرُّعًا وَّخِیۡفَۃً শব্দদ্বয় দ্বারা সেই উভয় প্রকার জিকিরই বিনম্র হয়ে ও আল্লাহভীতির সাথে করার জন্য বলা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে তাফসীরে বাগাভীতে বলা হয়েছে–এ আয়াতে প্রত্যহ সকালে ও বিকালে তথা ফজরের নামাযে ও আসরের নামাযে মহান আল্লাহর জিকির করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং উক্ত জিকিরের পন্থা বর্ণনা করা হয়েছে। এ মর্মে এখানে জিকিরের দু’টি পন্থার কথা উল্লেখ করা হয়েছে : ১. وَاذۡکُرۡ رَّبَّکَ فِیۡ نَفۡسِکَ দ্বারা নিঃশব্দে বা মনে মনে জিকির করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ২. وَّدُوۡنَ الۡجَہۡرِ مِنَ الۡقَوۡلِ দ্বারা সশব্দে অল্প আওয়াজে জিকির করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে–যা আশপাশের মানুষেরা শুনতে পারে।
-তাফসীরে বাগাভী, সূরাহ আ‘রাফ, ২০৫ নং আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য

অপরদিকে তাফসীরে কুরতুবীতে রয়েছে–হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর বর্ণনা মতে এখানে ফজর ও আসরের নামাযে কুরআন তিলাওয়াত সম্পর্কে বলা হয়েছে। অর্থাৎ এ আয়াতে ফজরের নামাযে কুরআন তিলাওয়াত জেহেরী বা সশব্দে করতে এবং আসরের নামাযে কুরআন তিলাওয়াত সেররী বা নিঃশব্দে করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। -দ্রষ্টব্য : তাফসীরে কুরতুবী, ২য় খণ্ড, ২৪১ পৃষ্ঠা

তেমনি তাফসীরে ইবনে কাছীরে আল্লামা ইবনে কাছীর (রহ.) বলেন–এ আয়াতটি মি‘রাজে পাঁচওয়াক্ত নামায ফরজ হওয়ার পূর্বে নাযিল হয়েছে। তখন এ দু’টি নামায পড়া হতো। তাই এখানে উক্ত নামাযদ্বয়ের ব্যাপারে বলা হয়েছে। -দ্রষ্টব্য : তাফসীরে ইবনে কাছীর, ৩য় খণ্ড, ৬২৬ পৃষ্ঠা

আরেক ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.) মাজমূউল ফাতাওয়ায় বর্ণনা করেছেন–হযরত আয়িশা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, এ আয়াত দু‘আর ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। অর্থাৎ মহান আল্লাহর নিকট বিনম্র হয়ে ভয়ের সাথে চুপে চুপে অথবা অল্প আওয়াজে দু‘আ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

তাফসীরে ওয়াসীতে আল্লামা তানতাভী (রহ.) বর্ণনা করেন–এ আয়াতে কুরআন তিলাওয়াত, দু‘আ, জিকির-তাসবীহ, তাহমীদ, তাহলীল প্রভৃতির পন্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে। -তাফসীরে ওয়াসী, উক্ত আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য

তেমনিভাবে কোনরূপ শর্তবিহীনভাবে জিকিরের নির্দেশনা দিয়ে পবিত্র কুরআনে সূরাহ আহযাবের ৪১ ও ৪২ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন–

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اذۡکُرُوا اللّٰہَ ذِکۡرًا کَثِیۡرًا وَّسَبِّحُوۡہُ بُکۡرَۃً وَّاَصِیۡلًا

'হে মুমিনগণ! তোমরা অধিক পরিমাণে আল্লাহর জিকির করো এবং সকালে ও বিকালে তাঁর তাসবীহ পড়ো।' -সূরাহ আহযাব, আয়াত নং ৪১ ও ৪২

এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে খুব বেশী পরিমাণে জিকির করতে বলেছেন।

আল্লামা সা‘দী (রহ.) স্বীয় তাফসীরে বলেন–এখানে অধিক পরিমাণে জিকির করার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো–আল্লাহর বান্দাগণ তাঁর তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ জিকির), তাহমীদ (আলহামদুলিল্লাহ জিকির), তাহলীল (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ জিকির), তাকবীর (আল্লাহু আকবার জিকির) প্রভৃতি সদা-সর্বদা পাঠ করবে। বিশেষ করে সকাল-বিকালের সুন্নাত ওজীফা, পাঁচওয়াক্ত নামাযের পরের জিকির-দু‘আ এবং বিভিন্ন সময় ও প্রেক্ষাপটে মাসনূন দু‘আ-কালাম প্রভৃতি যথারীতি আদায় করবে।

তবে এ আয়াতে জিকির-তাসবীহকে কোন নির্দিষ্ট পদ্ধতির সাথে খাস করা হয়নি। তাই সেসব জিকির-আজকার নিঃশব্দেও করা যাবে এবং সশব্দে করাও যাবে আয়াতের নির্দেশের ব্যাপকতা হিসেবে। এভাবে পবিত্র কুরআনে আরো বহু আয়াত রয়েছে–যেগুলোতে শর্তহীনভাবে জিকির করার নির্দেশনা রয়েছে। সেসব ক্ষেত্রে কোন বিশেষ শর্ত না থাকার কারণে সিররী জিকির ও জেহেরী জিকির উভয় প্রকার জিকিরেরই অবকাশ রয়েছে।

সুতরাং এ আয়াতসমূহ দ্বারা মহান আল্লাহর তাসবীহ, তাহলীল, তাহমীদ ইত্যাদি জিকির করার আদব ও পদ্ধতি স্পষ্ট হয়ে যায়। এতে জিকরে খফী ও জিকরে জলী উভয় প্রকার জিকিরের বৈধতা পাওয়া যাচ্ছে। আর এ বিষয়টিও স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে–জিকরে জলী জোরে চিৎকার করার চেয়ে কম আওয়াজে করা বাঞ্ছনীয়।

তেমনি হাদীস শরীফে জিকরে খফীর পাশাপাশি জিকরে জলী বা জেহেরী জিকিরের পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম-এর একটি হাদীসে রয়েছে–

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : يَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ : أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِي بِي ، وَأَنَا مَعَهُ حِينَ يَذْكُرُنِي ، إِنْ ذَكَرَنِي فِي نَفْسِهِ ، ذَكَرْتُهُ فِي نَفْسِي ، وَإِنْ ذَكَرَنِي فِي مَلَإٍ ، ذَكَرْتُهُ فِي مَلَإٍ هُمْ خَيْرٌ مِنْهُمْ

'হযরত আবূ হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা (হাদীসে কুদসীতে) ইরশাদ করেন, “আমি আমার সম্পর্কে আমার বান্দার ধারণার নিকটে থাকি। আর আমি তার সাথে থাকি যখন সে আমার জিকির করে। যদি সে আমায় চুপে চুপে জিকির করে, আমি তাকে চুপে চুপে স্মরণ করি। আর যদি সে আমায় কোন জমায়েতের মধ্যে জিকির করে, তখন আমি তাকে তাদের চেয়ে উত্তম জমায়েতের মধ্যে স্মরণ করি।' -সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭৪০৫/ সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৬৭৫

এ হাদীসে জমায়েতে জিকির করাকে চুপে চুপে বা নিঃশব্দে জিকিরের বিপরীত পন্থারূপে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং এর দ্বারা উদ্দেশ্য হবে–জমায়েতের মধ্যে সশব্দে জিকির করা।

এ প্রসঙ্গে তাজুল মুহাাক্কিকীন আল্লামা ইবনুল জাযরী (রহ.) “মিফতাহুল হিসনিল হাসীন” গ্রন্থে বলেন–

فيه دليل على جواز الجهر بالذكر، خلافا لمن منعه

'এ হাদীসে জেহেরী জিকির জায়িয হওয়ার পক্ষে দলীল রয়েছে। আর এ হাদীস তাদের বিরুদ্ধে যায় যারা জেহেরী জিকিরকে নিষেধ করেন।' -মিফতাহুল হিসনিল হাসীন, ১৩৭ পৃষ্ঠা

অনুরূপভাবে এ হাদীসের ব্যাপারে আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রহ,) স্বীয় “নাতীজাতুল ফিকরি ফিল জাহরি বিজ্ জিকরি” গ্রন্থে বলেন–

والذكر في الملأ لا يكون إلا عن جهر

'মজমার মধ্যে জিকির জেহের (সশব্দে উচ্চারণ) ছাড়া হতেই পারে না। -নাতীজাতুল ফিকরি ফিল জাহরি বিজ্ জিকরি, ২৪ পৃষ্ঠা

সুতরাং এ হাদীস দ্বারা অকাট্যভাবে জেহেরী জিকিরের বৈধতা প্রমাণিত হচ্ছে। যা দিবালেকের ন্যায় স্পষ্ট। তেমনিভাবে প্রসিদ্ধ হাদীসের কিতাব মুস্তাদরাকে হাকীম-এর মধ্যে জেহেরী জিকিরের মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে فضيلة رفع الصوت بالذكر (উঁচু আওয়াজে জিকির করার ফজীলত) নামে আলাদা শিরোনাম দিয়ে বিশেষ পরিচ্ছেদ প্রণয়ন করা হয়েছে। সেখানে জেহেরী জিকিরের ফজীলত বর্ণনা করে নিম্নোক্ত হাদীস উদ্ধৃত করা হয়েছে–

عَنْ جَابِرٍ رضي الله عنه أَنَّ رَجُلًا كَانَ يَرْفَعُ صَوْتَهُ بِالذِّكْرِ، فَقَالَ رَجُلٌ: لَوْ أَنَّ هَذَا خَفَضَ مِنْ صَوْتِهِ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «فَإِنَّهُ أَوَّاهٌ» . قَالَ: فَمَاتَ فَرَأَى رَجُلٌ نَارًا فِي قَبْرِهِ، فَأَتَاهُ فَإِذَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِيهِ وَهُوَ يَقُولُ: «هَلُمُّوا إِلَى صَاحِبَكُمْ» . فَإِذَا هُوَ الرَّجُلُ الَّذِي كَانَ يَرْفَعُ صَوْتَهُ بِالذِّكْرِ

হযরত জাবির (রা.) হতে বর্ণিত, জনৈক সাহাবী (রা.) (তাঁর নাম আবদুল্লাহ যুল বিজাদাইন আল-মুযানী) উচ্চস্বরে জিকির করতেন। তখন অন্য একজন বললেন, যদি এই লোক নীচু আওয়াজে জিকির করতেন (ভাল হতো)! তা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, সে তো ‘আওয়্যাহ্’ (নিবেদিত জিকিরকারী)। হযরত জাবির (রা.) বলেন, এরপর সেই ব্যক্তি মারা গেলেন। তখন এক লোক তার কবরে আলো দেখতে পেলেন। তা দেখে তিনি সেখানে গেলেন। অকস্মাৎ তিনি দেখেন, স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) কবরের মধ্যে রয়েছেন এবং তিনি বলতেছেন, তোমাদের সাথীকে দাও। তখন দেখা গেলো যে, তিনি সেই ব্যক্তি যিনি উঁচু আওয়াজে জিকির করতেন। (তাঁর দাফনের জন্য স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) কবরে নেমেছেন!) -মুস্তাদরাকে হাকিম, ১ম খণ্ড, ২৯৮ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ১৩৬১/ অনুরূপ : সুনানে বাইহাকী–শু‘আবুল ঈমান, হাদীস নং ৫৭৮ প্রভৃতি

অপরদিকে বিভিন্ন সময়কালীন জিকির উঁচু আওয়াজে করার জন্য শরীয়তে বিশেষভাবে নির্দেশনা এসেছে। যেমন, পাঁচওয়াক্ত নামাযের পর, ঈদুল আজহায় ঈদগাহে যাওয়া-আসার পথে, তাকবীরে তাশরীক পাঠে, হজ্বের তালবিয়া পাঠে প্রভৃতি। এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে।

অনুরূপভাবে অনেক লোক একত্রিত হয়ে বা জিকিরের মজমা কায়িম করে জিকির করারও বিশেষ ফজীলত সম্পর্কে বহু হাদীস রয়েছে। আর সেই জিকির যে জেহেরীই হবে–তা বলাই বাহুল্য।

জেহেরী জিকিরে আওয়াজের মাত্রা :

পূর্বে উল্লেখকৃত পবিত্র কুরআনের সূরাহ আ‘রাফের ২০৫ নং আয়াতে জিকিরের ধরণ সম্পর্কে বলা হয়েছে–

وَاذۡکُرۡ رَّبَّکَ فِیۡ نَفۡسِکَ تَضَرُّعًا وَّخِیۡفَۃً وَّدُوۡنَ الۡجَہۡرِ مِنَ الۡقَوۡلِ

'এবং স্বীয় পালনকর্তার জিকির করুন চুপে চুপে বিনম্রভাবে ও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে এবং খুব জোরের চেয়ে কম আওয়াজে।' -সূরাহ আ‘রাফ, আয়াত নং ২০৫

এ আয়াতে বর্ণিত জিকিরের ধরনের ব্যাখ্যায় তাফসীরে মা‘আলিমুত তানযীলে আল্লামা বাগাভী (রহ.) বলেন, বিশিষ্ট তাফসীরবিদ হযরত মুজাহিদ (রহ.) ও হযরত ইবনে ‍জুরাইজ (রহ.) বলেন– 'আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন যে, একাগ্রতার সাথে অন্তর দিয়ে তাঁর জিকির করবে এবং তাঁকে খুব জোরে আওয়াজ করে ও চিৎকার করে ডাকবে না।' -তাফসীরে মা‘আলিমুত তানযীল, সূরাহ আ‘রাফ, ২০৫ নং আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য

উক্ত আয়াতে জেহেরী জিকিরের ক্ষেত্রে “খুব জোরের চেয়ে কম আওয়াজে” মাত্রার ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন–اَلْجَهْر (আল-জাহর) অর্থ খুব জোরে বলা। আয়াতটিতে دُوۡنَ الْجَهْرِ (দূনাল জাহর) বলে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
-দ্রষ্টব্য : মাজমূ‘উল ফাতাওয়া, ১৫ নং খণ্ড, ১৭৫ পৃষ্ঠা

জেহেরী জিকিরের সেই মাত্রাকে বিশ্লেষণ করে তাফসীরে ইবনে কাছীরে বলা হয়েছে–এতে বুঝানো হয়েছে যে, এমনভাবে জোরে চিল্লিয়ে বলবে না যেমন দূরের কাউকে ডাকা হয়, আবার এমন আস্তে বলবে না যে, পাশের লোকেরা শুনতে না পায়। বরং এতদুভয়ের মাঝামাঝি স্বাভাবিক আওয়াজে বলবে। -দ্রষ্টব্য : তাফসীরে ইবনে কাছীর, ৩য় খণ্ড, ৫৩৯ পৃষ্ঠা

এ প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন–এটা পবিত্র কুরআনের সূরাহ ইসরা’র ১১০ নং আয়াতের নির্দেশনার অনুরূপ। উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন–

وَلَا تَجۡہَرۡ بِصَلَاتِکَ وَلَا تُخَافِتۡ بِہَا وَابۡتَغِ بَیۡنَ ذٰلِکَ سَبِیۡلًا

'আপনি আপনার নামাযে (ক্বিরাআত) খুব উচ্চ স্বরে পড়বেন না এবং নিঃশব্দেও পড়বেন না। এতদুভয়ের মধ্যম পন্থা অবলম্বন করুন।' -সূরাহ ইসরা’, আয়াত নং ১১০

তার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন–

نَزَلَتْ وَرَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُخْتَفٍ بِمَكَّةَ ، كَانَ إِذَا صَلَّى بِأَصْحَابِهِ رَفَعَ صَوْتَهُ بِالقُرْآنِ ، فَإِذَا سَمِعَهُ المُشْرِكُونَ سَبُّوا القُرْآنَ وَمَنْ أَنْزَلَهُ وَمَنْ جَاءَ بِهِ ، فَقَالَ اللَّهُ تَعَالَى لِنَبِيِّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : { وَلَا تَجْهَرْ بِصَلاَتِكَ } أَيْ بِقِرَاءَتِكَ ، فَيَسْمَعَ المُشْرِكُونَ فَيَسُبُّوا القُرْآنَ { وَلَا تُخَافِتْ بِهَا } عَنْ أَصْحَابِكَ فَلاَ تُسْمِعْهُمْ ، { وَابْتَغِ بَيْنَ ذَلِكَ سَبِيلًا }

'এ আয়াত সেসময় নাযিল হয়েছে যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কায় সংগোপনে রয়েছেন। (অর্থাৎ এ আয়াত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মক্কী জীবনে ইসলামের প্রাথমিক যুগে নাযিল হয়েছে।) সে সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন সাহাবীগণকে নিয়ে নামায পড়তেন, কুরআন পাঠে আওয়াজকে উচ্চ করতেন। তখন সেই আওয়াজ মুশরিকরা শুনে তারা কুরআনকে এবং কুরআন যিনি নাযিল করেছেন (মহান আল্লাহ) এবং যিনি কুরআন নিয়ে এসেছেন (মুহাম্মদ সা.)কে গালমন্দ করলো। এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা‘আলা উক্ত আয়াত নাযিল করেন। এতে তিনি স্বীয় নবী (সা.)কে বলেন–আপনি কুরআন মাজীদ এত উচ্চস্বরে পাঠ করবেন না যে, আওয়াজ বাহিরে গিয়ে কাফির-মুশরিকরা শুনে গালমন্দ করার প্রয়াস পায়। আবার এত নিম্নস্বরে পড়বেন না যে, পাশের সাহাবীগণ শুনতে না পান। বরং মধ্যম পন্থা অবলম্বন করুন। -সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৪৬৬

অপর ‍রিওয়ায়াতে হযরত সাঈদ ইবনে যুবাইর (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন–সে সময় জোরে কুরআন পাঠ শুনে মুশরিকরা (গালি দিয়ে) রাসূূলুল্লাহ (সা.)কে বললো, আপনি জোরে পড়বেন না। কারণ, এতে আপনি আমাদের মা‘বূদগণকে কষ্ট দেন। তাই আমরা আপনার মা‘বূদকে গালি দেই। -দ্রষ্টব্য : ইরশাদুস সারী শরহে বুখারী, ৭ম খণ্ড, ১৪৮ পৃষ্ঠা

এতে বুঝা গেলো- “খুব জোরের চেয়ে কম আওয়াজে পড়া”-এর নির্দেশনা ইসলামের প্রাথমিক যুগে মক্কায় বিশেষ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে দেয়া হয়েছিলো। অতঃপর যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনায় হিজরত করলেন এবং মুসলমানগণের শক্তিমত্তা বৃদ্ধি পেলো, তখন সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়।

এ জন্য মদীনায় রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবীগণের (রা.) আমলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চস্বরে জিকির করার প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন, সহীহ বুখারীতে রয়েছে–

عن ابْن عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا : أَنَّ رَفْعَ الصَّوْتِ بِالذِّكْرِ حِينَ يَنْصَرِفُ النَّاسُ مِنَ المَكْتُوبَةِ كَانَ عَلَى عَهْدِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ كُنْتُ أَعْلَمُ إِذَا انْصَرَفُوا بِذَلِكَ إِذَا سَمِعْتُهُ

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, জিকিরে আওয়াজকে উচ্চ করা যখন মানুষেরা ফরজ নামায থেকে ফিরেন তা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর যমানায় বিদ্যমান ছিলো। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, 'আমি বুঝতে পারতাম যে সময় তারা উচ্চস্বরে যিকিরের দ্বারা ফিরতেন যখন আমি তা শুনতাম।' -সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৮৪১

তেমনি সহীহ বুখারীতে আরো বর্ণিত হয়েছে–

وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ وَأَبُو هُرَيْرَةَ يَخْرُجَانِ إِلَى السُّوقِ فِي أَيَّامِ الْعَشْرِ يُكَبِّرَانِ، وَيُكَبِّرُ النَّاسُ بِتَكْبِيرِهِمَا

'হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) ও হযরত আবু হুরাইরা (রা.) যিলহজ্বের দশকে বাজারে যেতেন তাকবীর বলতে বলতে এবং তাদের তাকবীর শুনে মানুষেরা তাকবীর বলতেন।” (হযরত আফফান (রহ.)-এর রিওয়ায়াতে রয়েছে : তাঁরা তখন তাকবীর বলে মানুষদেরকে তাদের সাথে তাকবীর বলানোর জন্যই বাজারে যেতেন।' -দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, ২য় খণ্ড, ৪৫৮ পৃষ্ঠা

অনুুরূপভাবে সহীহ বুখারীর শিরোনাম-বিবরণে তা‘লীকরূপে বর্ণনা করা হয়েছে–

وَكَانَ عُمَرُ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ يُكَبِّرُ فِي قُبَّتِهِ بِمِنًى فَيَسْمَعُهُ أَهْلُ الْمَسْجِدِ فَيُكَبِّرُونَ وَيُكَبِّرُ أَهْلُ الْأَسْوَاقِ حَتَّى تَرْتَجَّ مِنًى تَكْبِيرًا

'হযরত উমর (রা.) মিনায় স্বীয় হুজরায় তাকবীর বলতেন। সেই তাকবীর মসজিদের মুসল্লীগণ শুনতেন, তখন তাঁরা তাকবীর বলতেন। এবং বাজারের লোকজন (তাদের তাকবীর শুনে) তাকবীর বলতেন। তা এ পর্যন্ত হতো যে, মিনা তাকবীর ধ্বনিতে কেঁপে উঠতো।' -দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, ৩৩০ পৃষ্ঠা

অপরদিকে পবিত্র কুরআনে জিকির সম্পর্কে অসংখ্য আয়াত রয়েছে–যেগুলোতে শর্তবিহীনভাবে জিকির করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তাই বর্ণনার ব্যাপকতার দ্বারা সেগুলো সিররী জিকির ও জেহেরী জিকির উভয় প্রকার জিকিরকেই শামিল করে।
যেমন, সূরাহ আহযাবের ৪১ ও ৪২ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন–

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اذۡکُرُوا اللّٰہَ ذِکۡرًا کَثِیۡرًا وَّسَبِّحُوۡہُ بُکۡرَۃً وَّاَصِیۡلًا

'হে মুমিনগণ! তোমরা অধিক পরিমাণে আল্লাহর জিকির করো এবং সকালে ও বিকালে তাঁর তাসবীহ পড়ো।'

তেমনিভাবে সূরাহ আনফালের ৪৫ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন–

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا لَقِیۡتُمۡ فِئَۃً فَاثۡبُتُوۡا وَاذۡکُرُوا اللّٰہَ کَثِیۡرًا لَّعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ

'হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন কোন বাহিনীর সাথে মুখোমুখি হও, তখন সুদৃঢ় থাক এবং অধিক পরিমাণে আল্লাহর জিকির কর। এতে আশা করা যায়, তোমরা কৃতকার্য হবে।'

অনুরূপভাবে মহান আল্লাহ সূরাহ জুমু‘আর ১০ নং আয়াতে ইরশাদ করেন–

فَاِذَا قُضِیَتِ الصَّلٰوۃُ فَانۡتَشِرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ وَابۡتَغُوۡا مِنۡ فَضۡلِ اللّٰہِ وَاذۡکُرُوا اللّٰہَ کَثِیۡرًا لَّعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ
'
অতঃপর যখন নামায সম্পন্ন হয়, তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর। আর অধিক পরিমাণে আল্লাহর জিকির কর। এতে তোমরা সফলকাম হবে।'

এভাবে বহু আয়াত রয়েছে–যেগুলোতে জোরে বা আস্তে কিংবা মনে মনে ইত্যাদি কোন ধরনের শর্ত ছাড়া জিকির করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সুতরাং জিকির সশব্দে বা নিঃশব্দে যে কোনভাবে আদায় করলেই সেসব আয়াতের ‍উপর আমল হয়ে যাবে।

তবে জেহেরী জিকির করার ক্ষেত্রে নিজের প্রতি খিয়াল রেখে কষ্টদায়কভাবে খুব জোরে বা চিৎকার করে জিকির করা পরিহার করার জন্য হাদীস শরীফে বিশেষ নিদের্শনা এসেছে। এ সম্পর্কে সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে–

عَنْ أَبِي مُوسَى رضي الله عنه قَالَ : كُنَّا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي سَفَرٍ ، فَكُنَّا إِذَا عَلَوْنَا كَبَّرْنَا (وَفِيْ رِوَايَةِ مُسْلِمِ : فَجَعَلَ النَّاسُ يَجْهَرُونَ بِالتَّكْبِيرِ) ، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : أَيُّهَا النَّاسُ ارْبَعُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ ، فَإِنَّكُمْ لاَ تَدْعُونَ أَصَمَّ وَلاَ غَائِبًا ، وَلَكِنْ تَدْعُونَ سَمِيعًا بَصِيرًا –

হযরত আবু মূসা আশ‘আরী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন–“আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে এক সফরে ছিলাম। সে সময় যখন আমরা কোন উঁচু স্থানে উঠতাম, তাকবীর বলতাম। (সহীহ মুসলিমের রিওয়ায়াতে রয়েছে : সে সময় লোকেরা উচ্চস্বরে তাকবীর বলতে থাকেন।) তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন– 'হে লোক সকল! তোমরা নিজেদের উপর নম্রতা করো। কেননা, তোমরা কোন বধির বা অনুপস্থিত কাউকে ডাকছো না। বরং তোমরা ডাকছো সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টাকে।' -সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬০৪৭/ অনুরূপ : সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫০০২

এ হাদীস দ্বারা বুঝা গেলো–জেহেরী জিকির করা সাহাবায়ে কিরাম (রা.)-এর আমলের মধ্যে ছিলো। আর এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদেরকে জেহেরী জিকির করতে নিষেধ করেননি, বরং উম্মতের প্রতি দরদী হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) হিতাকাংখামূলকভাবে বলেছেন, খুব জোরে জিকির করে যেন নিজের জানকে কষ্ট না দেয়া হয়, বরং জেহেরী জিকির যেন নম্রতার সাথে বা সহনীয়ভাবে করা হয়।

এ সম্পর্কে ফাতহুল মুলহিমে নিম্নরূপ ব্যাখ্যা করা হয়েছে–

كانت السنة رفع الصوت بالتكبير والتهليل كلما علا مرتفعا وكلما هبط واديا لكن بعض الصحابة بالغوا في رفع الصوت ظنوه كلما رفعوا أصواتهم زاد ثوابهم فقال لهم صلى الله عليه وسلم ارفقوا بأنفسكم واخفضوا أصواتكم فإن رفع الصوت إنما يفعله الإنسان لبعد من يخاطبه أو لصممه ليسمعه وأنتم تدعون الله تعالى وليس هو بأصم ولا غائب ولا بعيد بل هو سميع قريب وهو معكم

'জিকিরের সুন্নাহ পদ্ধতি হলো–যতবার কোন উঁচু স্থানে উঠবে এবং নীচু স্থানে নামবে, যথাক্রমে উচ্চস্বরে “আল্লাহু আকবার” ও “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ” বলবে। কিন্তু কিছু সাহাবী (রা.) উচ্চস্বর করতে গিয়ে খুব বেশী করে ফেলেছেন। তারা ভেবেছিলেন, যত স্বর বৃদ্ধি করবেন, ততবেশী নেকী হবে। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদেরকে বললেন, তোমরা তোমাদের জানের প্রতি নম্রতা করো এবং তোমাদের আওয়াজকে খাটো করো। কেননা, খুব উচ্চস্বর মানুষ করে থাকে যাকে বলছে সে দূরে থাকলে কিংবা বধির হলে তাকে শোনানোর জন্য। আর তোমরা তো আল্লাহকে ডাকছো। তিনি তো বধিরও নন, অনুপস্থিতও নন এবং দূরেও নন। বরং তিনি সর্বশ্রোতা ও নিকটের সত্তা। তিনি তোমদের সাথে আছেন।' -ফাতহুল মুলহিম শরহে মুসলিম, ১০ম খণ্ড, ২৫৯ পৃষ্ঠা

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.