![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মানুষের ভীড়ে অমানুষ একটা। বাস্তবতার সাথে তাল মেলে না। গতিশীল ফুটবল এর মত ভবঘুরে আমি
( এই ছবিতে পাহাড়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেডিকেল ক্যাম্পেনের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে।)
©মেজর জেনারেল (অবঃ) সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিম স্যার
নোটশিট ও সামারি
দু’টি শব্দ এখানে লিখলাম। একটি শব্দ ‘সারসংক্ষেপ’, ইংরেজিতে সামারি। আরেকটি শব্দ ‘নোটশিট’। এই দু’টি শব্দের সাথে সরকারি চাকরিজীবীরা নিবিড়ভাবে পরিচিত। নোটশিট মানে ছাপানো কাগজ, যেখানে অফিসের কর্মকর্তারা কোনো বিষয়ে বা প্রস্তাবে তাদের মন্তব্য লিখে ওপরের দিকে পাঠান এবং আবার ওপরের দিক থেকে নিচের দিকে পাঠান। সামরিক বাহিনীসহ সরকারি অফিসে এ ধরনের কাগজ এবং এ ধরনের নোট লেখা সুপ্রচলিত। সামরিক বাহিনীতে নোটশিট না বলে অনেক সময় বলা হয় মাইনিউটস (বা মিনিটস) লেখা তথা মিনিট-শিটে লেখা। নোট মানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য। কারণ জ্যেষ্ঠ স্টাফ অফিসার বা অতি জ্যেষ্ঠ দায়িত্বশীলদের হাতে এত সময় থাকে না যে, তারা সব বিষয়ে বিস্তারিত শুনবেন বা পড়বেন। কোন কোন বিষয়ে বিস্তারিত জানা উচিত এবং কোন কোন বিষয়ে সারমর্ম বা সামারি জানলেই চলবে, এই সিদ্ধান্তটি অবশ্যই সংশ্লিষ্ট জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিত্বকেই নিতে হয়।
খাগড়াছড়িতে ব্রিগেড কমান্ডার হলাম
১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি হঠাৎই জানানো হলো, আমাকে রাঙ্গামাটি ব্রিগেড কমান্ডারের দায়িত্ব থেকে খাগড়াছড়ি ব্রিগেড কমান্ডারের দায়িত্বে বদলি করা হয়েছে। ডিসেম্বরের ২০ তারিখ আমি খাগড়াছড়ি ব্রিগেডের দায়িত্ব নিয়েছিলাম এবং সাত দিন পর ডিসেম্বরের ২৭ তারিখ রাঙ্গামাটি ব্রিগেডের দায়িত্ব অন্যের বরাবরে হস্তান্তর করেছিলাম। অর্থাৎ সাত দিন, আমি দুটি ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার ছিলাম। ওই সময় বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে শান্তিবাহিনী নামক জঙ্গি দল বা সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী কর্তৃক পরিচালিত কর্মকাণ্ডের উত্তাপ চরমে ছিল। সরকারের পক্ষ থেকে দু-মুখী চেষ্টা চলছিল। একমুখী চেষ্টা হলো নিরাপত্তা বাহিনীর মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা ও সশস্ত্র বিদ্রোহীদের যথাসম্ভব দমন করা। আরেকমুখী চেষ্টা ছিল, শান্তিবাহিনীর সাথে শান্তি স্থাপনের জন্য আলোচনা চালিয়ে যাওয়া। আমার আগে যিনি খাগড়াছড়ির ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন তিনি (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফারুক আহমেদ চৌধুরী, পিএসসি, পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমী কাকুল ৪০তম লং কোর্স) প্রক্রিয়াটি শুরু করে গিয়েছিলেন; কিন্তু আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরুর সময়েই তিনি বদলি হয়ে যান। অতএব ওই অভিনব গুরুদায়িত্ব আমার ঘাড়ে পড়ে। দায়িত্বটি কী? দায়িত্বটি হলো, শান্তি আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করা, পরিবেশ অব্যাহত রাখা এবং আলোচনায় নেতৃত্ব দেয়া। একজন ব্রিগেড কমান্ডারের স্বাভাবিক দায়িত্ব যা-ই ছিল, তার অতিরিক্ত এই বিষয়গুলোর উপর গুরুত্ব ছিল।
বিস্তারিত বিবরণ সংবলিত পুস্তক
পার্বত্য চট্টগ্রামে সমস্যাটি অনেকদিন যাবত ধীরে ধীরে পুঞ্জিভূত হয়েছে। তারপর একদিন ডিসেম্বর ১৯৭৫-এ, এটা বিস্ফোরিত হয়েছে। সমস্যা উদ্ভাসিত হওয়ার পর সমাধানের জন্য চেষ্টা শুরু হয়েছিল। সমাধানের নিমিত্তে গৃহীত পদক্ষেপগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভালো ছিল, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিহার্য ছিল। বাংলাদেশ সরকার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুল করেছে, শান্তি বাহিনী অনেক ক্ষেত্রে ভুল করেছে। তারপরও দীর্ঘ সার্বিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি স্থাপন প্রক্রিয়া অনেকদূর অগ্রসর হয়েছে। ২০১৬ সালে হঠাৎ করেই এটি একটি বিপদজনক দিকে মোড় নিয়েছে। আমার আবেদন, সচেতন পাঠকগণ পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান সমস্যা নিয়ে জানার জন্য চেষ্টা করবেন।
শান্তিবাহিনীর দাবিনামা : জুম্মল্যান্ড
সংক্ষেপে স্মৃতিচারণ করি। ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শান্তিবাহিনীর সাথে চতুর্থ আনুষ্ঠানিক আলোচনা বৈঠক হয়। হাবভাব দেখে বুঝলাম, শান্তিবাহিনী আরেক দফা রক্তারক্তি করবে। উদ্দেশ্য, সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যেন, সরকার তাদের দাবিনামা মেনে নেয়। ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারির কথা বলছি। দাবিনামাটি ছিল পাঁচ দফা। পাঁচ দফার পুরোটাই এখানে লিখব না, স্থানাভাবে। শুধু প্রথম দফা লিখলাম। ‘বর্তমান বাংলাদেশকে দু’টি প্রদেশে ভাগ করা হবে। একটি প্রদেশের নাম হবে বাংলাদেশ; রাজধানী ঢাকা। আরেকটি প্রদেশের নাম হবে জুম্মল্যান্ড; রাজধানী রাঙ্গামাটি। দু’টি প্রদেশ মিলে একটি ফেডারেশন হবে; ফেডারেশনের নাম হবে ফেডারেল রিপাবলিক অব বাংলাদেশ; রাজধানী ঢাকা। সাংবিধানিকভাবে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে বিষয় বণ্টন হবে; শুধু চারটি বিষয় থাকবে কেন্দ্রের হাতে, বাকি সব প্রাদেশিক সরকারের হাতে।’ শান্তিবাহিনীর পাঁচ দফা দাবিনামা ছিল অনেকটাই ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কর্তৃক পাকিস্তান সরকারের বরাবরে উপস্থাপিত ছয় দফা দাবিনামার অতি-কিঞ্চিৎ সংশোধিত রূপ। পাঁচ দফা দাবিনামা মেনে নেয়া মানে ছিল, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মানচিত্র আবারো অঙ্কন করা। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ বছর যাবৎ শান্তিবাহিনী সশস্ত্র যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। এই প্রথমবার, ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে এসে তারা লিখিতভাবে তাদের দাবি উপস্থাপন করেছিল। দাবিগুলো সংবিধানবহির্ভূত হওয়ার কারণে, বাংলাদেশ সরকার তথা সরকারের প্রতিনিধিদল ওই দাবিনামার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছিল, সেহেতু শান্তিবাহিনী উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আরেকবার একটি বড় আকারের রক্তাক্ত নাটক তারা মঞ্চস্থ করবে। আমার সামরিক অভিজ্ঞতার আলোকে এবং গোয়েন্দাদের মূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে আমিও উপসংহারে এলাম যে, শান্তি বাহিনী আসলেই আরো একবার বড় রকমের রক্তপাত ঘটাবে।
রক্তারক্তি এবং প্রেসিডেন্টের সফর
এটি ১৯৮৮-এর মার্চের শেষ এবং এপ্রিলের শুরুর কথা। আমি আমার মূল্যায়ন বা ফোরকাস্ট ওপরোস্থ কর্তৃপক্ষ এবং সরকারকে জানালাম। পরিষ্কার বললাম, সেটি ঠেকানোর মতো যথেষ্ট সেনাবাহিনী বা নিরাপত্তা বাহিনী আমাদের মজুদ নেই। ১৯৮৮ সালের এপ্রিল মাসের ২৪ তারিখ, রমজান মাসের আট বা নয় এরকম একটি তারিখ; এশার নামাজের পর শুরু হলো শান্তিবাহিনীর আক্রমণ। ঘটনাক্রমে কিন্তু একান্তই অপরিকল্পিতভাবে, তৎকালীন বাংলাদেশ টেলিভিশনের অন্যতম জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ম. হামিদ ক্যামেরাসহ খাগড়াছড়িতে অবস্থান করছিলেন, পর্যটনমুখী একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানানোর জন্য। ২৪ এপ্রিল রাত আটটা-সাড়ে আটটার দিকে তিনি ব্রিগেড কমান্ডারের অফিসের ভেতরেই অবস্থান করছিলেন। ২৪ এপ্রিল রাত এবং পরবর্তী দু-তিন দিনের সব সন্ত্রাসী তৎপরতা বিটিভি ক্যামেরাবন্দী করে এবং জাতির সামনে উপস্থাপন করে। ইতোপূর্বে, শান্তিবাহিনীর আক্রমণে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য এবং বাঙালিদের হতাহত হওয়ার খবর জনগণ পেতেন না; পাহাড়ি-বাঙালি দাঙ্গার কারণে পাহাড়ি মানুষের হতাহতের খবরও জনগণ পেতেন না; পাহাড়ি মানুষ সীমান্তের অপর পারে শরণার্থী হওয়ার খবরও জনগণ পেতেন না। এই প্রথমবার, বিটিভির বদৌলতে বাংলাদেশের আপামর জনগণ শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি নিয়ে কম হোক বেশি হোক, ভালো হোক মন্দ হোক, একটি ধারণা পেলো। শান্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে ওইরূপ আগ্রাসী কর্মকাণ্ড পরবর্তী দিনগুলোতেও অব্যাহত ছিল। ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ সরকার মানসিকভাবে চাপের মধ্যে পড়ে। চাপটি কী? পার্বত্য চট্টগ্রামে এত রক্তারক্তি কেন হচ্ছে? শান্তিবাহিনীর হাতে এত বাঙালি কেন মরছে? সরকার কী করছে? সেনাবাহিনী কী করছে? ইত্যাদি। এই প্রেক্ষাপটে, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পরিস্থিতি সরেজমিন দেখার জন্য এবং মূল্যায়নের জন্য খাগড়াছড়ি সফরে আসেন। ওই দিন পর্যন্ত প্রায় চল্লিশটি বাঙালি গ্রাম শান্তিবাহিনীর গুলি ও আগুন-আক্রমণের শিকার হয়েছিল, শতাধিক বাঙালি নিহত হয়েছিল, শত শত বাঙালি আহত হয়েছিল, শত শত উপজাতীয় মানুষ ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে দিয়েছিল। সরকারের প্রচেষ্টার কারণে, তাৎক্ষণিক এবং পূর্ব হতেই গৃহীত অনেক পদক্ষেপের কারণে, পাহাড়ি-বাঙালি দাঙ্গা সৃষ্টি হতে পারেনি। তৎকালীন উপজাতীয় নেতৃবর্গ এবং বাঙালি নেতৃবর্গ আন্তরিকভাবে এবং কঠোর পরিশ্রমের সঙ্গে আমাদেরকে সহায়তা করেছিলেন যেন দাঙ্গা না বাধে। প্রেসিডেন্টের সফরের তারিখটি ছিল ৫ মে ১৯৮৮। প্রেসিডেন্টের সাথে তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আতিকুর রহমান এবং চট্টগ্রামের জিওসি মেজর জেনারেল আব্দুস সালামও ছিলেন। এলাকা ঘুরে, রাষ্ট্রপতি তার দলবলসহ খাগড়াছড়ি সেনানিবাসে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে আসেন। আমাদের অপারেশনস রুমে বসেন। আংশিকভাবে উত্তেজিত (ইংরেজিতে : এনয়ড), আংশিকভাবে বিমর্ষ রাষ্ট্রপতি জানতে চান শুনতে চান, কী হচ্ছে? কেন হচ্ছে? এই কলামের তথা এই পোস্ট-এর সম্মানিত পাঠক, এবার মহামান্য প্রেসিডেন্ট এবং আমার মধ্যে আলাপন বা ডায়ালগ অনুসরণ করুন। কথাবার্তা সব না, কিন্তু বেশির ভাগ ইংরেজিতে হয়েছিল। পাঠকের জন্য বাংলায় লিখলাম।
প্রেসিডেন্টকে ব্রিফিং দিতে কেন দুই ঘণ্টা প্রয়োজন?
প্রেসিডেন্ট বললেন, ‘ইবরাহিম, বলো এসব কী হচ্ছে? হোয়াট দ্য হেল ইজ হ্যাপেনিং? হোয়াই সো মেনি পিপল আর বিইং কিলড? হোয়াট দ্য হেল আর ইউ ডুইং?’ মানে : এত লোক মারা যাচ্ছে কেন? তোমরা কী করছ? কী ঘটছে? কর্নেল ইবরাহিম বলল, ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতি, আপনি এবং আমরা সবাই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করি যে, অনেক কম মারা গিয়েছে। আরো অনেক বেশি মারা যেতে পারত; কিন্তু আমরা বাঁচাতে পারিনি এটাই বাস্তবতা, আমি দুঃখিত।’ প্রেসিডেন্ট বললেন, ‘পুরো জাতি উদ্বিগ্ন, আমাকে জবাব দিতে হচ্ছে। ইউ হ্যাভ টু এক্সপ্লেইন হোয়াই ইউ কুড নট প্রোটেক্ট?’ আমি বললাম, ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতি, আমি অবশ্যই ব্যাখ্যা করব; আমাকে সময় দিন।’ প্রেসিডেন্ট : ‘ঠিক আছে তুমি বলো, তোমাকে বিশ মিনিট সময় দিলাম।’ ইবরাহিম : ‘স্যার, আমি বিশ মিনিট সময়ে বলব না। কারণ, আমি বিশ মিনিটে বলে সারতে পারব না। আপনি আমাকে অন্তত দুই ঘণ্টা সময় দিন।’ প্রেসিডেন্ট যুগপৎ আশ্চর্য এবং রাগান্বিত হয়ে আমাকে বললেন, ‘তুমি স্টাফ কলেজের ডিএস (ইন্সট্রাক্টর) ছিলে; তুমি সামারি করা শিখিয়েছ ছেলেদের; আর এখন তুমি বলছ, তুমি বিশ মিনিটে বলতে পারবে না। কেন পারবে না? তুমি আমাকে সামারি বলো।’ আমি আবারো বিনীতভাবে উত্তর দিলাম যে, ‘আমি অবশ্যই সামারি করতে পারি কিন্তু আমি এখন করব না, কারণ সামারিতে সমাধান হবে না।’ প্রেসিডেন্টের সাথে তার সামরিক সচিব উপস্থিত ছিলেন; র্যাংক ব্রিগেডিয়ার; আমার থেকে এমনিতেও সিনিয়র এবং আমার সুপরিচিত। সামরিক সচিব আমাকে বললেন, টঙ্গী খালের ওপরে দ্বিতীয় ব্রিজ উদ্বোধনের অনুষ্ঠান আছে; প্রেসিডেন্টকে ওখানে যেতে হবে। অতএব তোমাকে দুই ঘণ্টা সময় দেয়া যাবে না। আমি মহামান্য প্রেসিডেন্টকে উদ্দেশ করে বললাম : ‘স্যার, আপনিই ঠিক করুন, টঙ্গী খালের ওপর ব্রিজ উদ্বোধন করবেন, নাকি আমার কাছ থেকে ব্রিফিং শুনবেন? ব্রিজ উদ্বোধন অন্য কোনো মাননীয় মন্ত্রী করলেও ব্রিজের ওপর দিয়ে গাড়ি চলতে অসুবিধা হবে না; কিন্তু আজ যদি পার্বত্য পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাখ্যা আপনার বদলে অন্য কোনো মন্ত্রী শোনেন, তাতে কিন্তু আপনার চাহিদা মিটবে না।’ প্রেসিডেন্ট এরশাদ গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘দুই ঘণ্টা সময়ই তোমাকে দিলাম। আমাকে যেহেতু ঢাকা ফেরত যেতে হবে, সময় হিসাব করেই ব্রিফিং শেষ করবে।’
টঙ্গী ব্রিজ প্রসঙ্গ
পাঠকের জন্য একটু ডাইভারশন। ঢাকা মহানগর থেকে উত্তর দিকে উত্তরা মডেল টাউন এবং টঙ্গী শিল্প শহরের মধ্যে সীমানা হলো টঙ্গী খাল। ওই খালের উপরে পুরনো একটি ব্রিজ ছিল। পুরনো ব্রিজ ট্রাফিক সামলাতে পারে না বিধায় সরকার একটি নতুন ব্রিজ বানিয়েছিল; ওই নতুন ব্রিজটির উদ্বোধনের কথাটিই বলা হচ্ছে।
সামারি কেন করিনি?
এরপর আমি ঘড়ির কাঁটা ধরে, ম্যাপের সামনে দাঁড়িয়ে মহামান্য প্রেসিডেন্টকে দুই ঘণ্টাব্যাপী একটি ব্রিফিং দিলাম। স্থান খাগড়াছড়ি সেনানিবাসে অবস্থিত ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের অপারেশন্স রুম; তারিখ ৫ মে ১৯৮৮; সময় অপরাহ্ণ সাড়ে ৩টা থেকে সাড়ে ৫টা। ব্রিফিংয়ের মধ্যে ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার ব্যাপ্তি, সমস্যা সমাধানে সরকারের উদ্যোগগুলো, সমস্যা বাড়ানোর জন্য শান্তিবাহিনীর প্রচেষ্টা, শান্তিবাহিনীর প্রতি প্রতিবেশী ভারতের সমর্থনের ব্যাপ্তি, শান্তি প্রক্রিয়ার অগ্রগতি ও দুর্বলতা, বাংলাদেশ সরকার ও সেনাবাহিনীর দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা, বাঙালিদের নিরাপত্তাহীনতার কারণগুলো এবং আমার পক্ষ থেকে সুপারিশমালা। দুই ঘণ্টাব্যাপী ব্রিফিং চলাকালে প্রেসিডেন্ট ও সেনাবাহিনী প্রধান ছোট ছোট প্রশ্ন করেছেন, উত্তরও দিয়েছি; যেগুলোর বিবরণ এখানে রাখলাম না। মোটামুটি দুই ঘণ্টার মধ্যে ব্রিফিং শেষ হলো। শোনার পর রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ উদ্বেগ ও হতাশা মিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, ‘আমি তো এত কিছু জানতাম না। আমাকে তো কেউ এতো কিছু বলেনি।’ মহামান্য রাষ্ট্রপতির উদ্বেগ ও হতাশা মিশ্রিত মন্তব্য শুনে, আমি দুষ্টুমি করতে বাধ্যই হয়েছিলাম। সিরিয়াস কণ্ঠে বললাম, ‘স্যার, আপনি এত কিছু জানতেন না; কারণ আপনি সব সময় সামারি শুনেছেন। সামারি শুনলে ওইটিই আপনি জানবেন যেটি সামারি-করনেওয়ালা আপনাকে জানায়। এর বাইরে যা কিছু সব আপনার অগোচরে থেকে যাবে।’
বঙ্গভবনে ব্রিফিং:
আমরা মহামান্য প্রেসিডেন্টকে বললাম, আপনি যখন সব শুনলেন, এখন দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। কিছু সামরিক পদক্ষেপ, কিছু রাজনৈতিক পদক্ষেপ, কিছু অর্থনৈতিক পদক্ষেপ সম্মিলিতভাবে শান্তি স্থাপনের পরিবেশ সৃষ্টি করবে। ঐ পর্যায়ে মহামান্য প্রেসিডেন্ট তখন বলেছিলেন, ‘আমি সব কিছু একলা সামলাতে পারব না, সরকারকে পূর্ণাঙ্গভাবে জড়িত হতে হবে।’ অতএব, প্রেসিডেন্টের আদেশে ১৯৮৮ সালের মে মাসের ৮ তারিখ বিকেলবেলা বঙ্গভবনে, সেনাসদরের পক্ষ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান পরিস্থিতির ওপর একটি ব্রিফিং দেয়া হয়। কেবিনেটের সব সদস্য, সরকারের সব সচিব, ঢাকা অঞ্চলের সব জেনারেল এবং ডিআইজি ও ওপরস্থ সব পুলিশ অফিসার সেই ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। প্রেসিডেন্ট পূর্ণ সময় উপস্থিত ছিলেন। প্রত্যেকে পাঁচ মিনিট করে সূচনা বক্তব্য রেখেছিলেন : মহামান্য প্রেসিডেন্ট, সেনাবাহিনী প্রধান মহোদয় এবং চট্টগ্রামের মাননীয় জিওসি।
বাকি এক ঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলাম আমি। বঙ্গভবনের ঐ ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে, মহামান্য প্রেসিডেন্ট এবং তার সরকারের জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের মধ্যে সচেতনতা বা অবহিতি মোটামুটি একটা কমন মানদণ্ডে এসে দাঁড়ায়। বঙ্গভবনের ঐ ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাটি সমাধানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকারকে এবং রাজনৈতিক মহলকে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট করার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
২| ৩০ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ১২:৫০
নিলয় নীল বলেছেন: আপু পরার জন্য ধন্যবাদ
©somewhere in net ltd.
১|
২৯ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ১১:২১
নুরুন নাহার লিলিয়ান বলেছেন: খুব গুরুত্বপূর্ন পোষ্ট। অনেক কিছু জানলাম। ধন্যবাদ