নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

তখন সত্যি মানুষ ছিলাম, এখন আছি অল্প

আলোকিত পৃথিবী

মাথার ভিতর অসংখ্য পোকাদের বসবাস। সুখ পোকা, দুখ পোকা, স্বপ্ন পোকা...। আমিও তো আসলে একটা পোকা। পোকার জীবন-যাপন আমার...

আলোকিত পৃথিবী › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার লাঙ্কাউই ভ্রমণের গল্প

১৭ ই মে, ২০১৫ রাত ৯:৪৮

লোকটার নাম যাইদ অথবা যাওদ হবে। বিশালদেহী লোকটি লাঙ্কাউই বিমানবন্দরে আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। আজ, আগামীকাল এবং পরশুদিন কুয়ালালামপুরের বিমানের ওঠার আগমুহুর্ত পর্যন্ত এই যাওদ বা যাইদই আমাদের দেখভাল করবে। প্রশিক্ষিত ট্যুর গাইড যেমন হয় আর কী? প্রথম সাক্ষাতেই সবাইকে আপন করে নিলো। হাবেভাবে বুঝিয়ে দিলো, সে থাকতে আমাদের আর কোন সমস্যা নয়। দেশের বাইরে অচেনা শহরে প্রথমে প্রথমে সবারই অসহায়বোধ হয়। স্থানীয় কারও উপর নির্ভর করতে হয়। আমাদের জন্য যাওদ বা যাইদ সেই নির্ভরতার নাম।
[লাঙ্কাউই বিমানবন্দর]
দেশের বাইরে আসলে, বিমানবন্দরে নামার পরপরই প্রথমেই যেই দুইটা ব্যাপারে সবাই ব্যাকুল হয়ে উঠে। তার একটা হচ্ছে ডলার ভাঙানো আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে দেশে রেখে আসা পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা। যোগাযোগের জন্য সিম কেনা। ভাইবারের ভরসায় আমি সিম কেনার প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি না করলেও ডলার ভাঙানো অতিআবশ্যকীয়। ডলার ভাঙানোর জন্য্ যাওদ বা যাইদ এর উপরই ভরসা করতে হলে। তার কথা মতো বিমানবন্দের এক্সচেঞ্জ বুথ থেকেই একশ ডলার ভাঙালাম এবং পরেরদিন বুঝতে পারলাম শপ্রতি ডলারে পনের রিংগিট কম পেয়েছি। মন খারাপ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু হলে না। লাঙ্কাউইতে আসার পর কারও মন খারাপ থাকতে পারে না। প্রকৃতি উজার করে তার সৌন্দর্য্য এখানে মেলে ধরেছে।
২০০৭ সালে ইউনেস্কো লাঙ্কাউইকে 'ওয়ার্ল্ড জিওপার্ক' হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। আন্দামান সাগরে বুকে ভাসমান ছোটবড় ১০৪টি দ্বীপের সমন্বয়েই এই লাঙ্কাউই। মূল দ্বীপটার আয়তন আয়তন প্রায় ২৫ বর্গকিলোমিটার। দ্বীপের দুই-তৃতীয়াংশই বন-আচ্ছাদিত পাহাড়, পর্বত ও প্রাকৃতিক গাছপালাবেষ্টিত। আমাদের ট্যুর গাইড প্রথমেই আমাদের নিয়ে গেল লাঙ্কাউই আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ডে।

এখানে প্রবেশ মূল্য মালয়দের জন্য ৩০ রিংগিট আর বিদেশীদের জন্য ৪০ রিংগিট। ট্যুর গাইড আমাদের ৩০ রিংগিটে আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ডে প্রবেশের ব্যবস্থা করে দিল। দুইজোড়া ম্যাকাও পাখি, গোটা পাচেক দুষ্ট বানর আর একটা বুড়ো কচ্ছপ আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ডের গুহামুখ ধরে আমরা মাটির নিচে প্রবেশ করলাম। পেঙ্গুইনের দল এই মধ্য দুপুরে অলস সময় কাটাচ্ছে। ভয়ংকর দর্শনীয় কাকড়ার দল কাচের ভিতর ঘুরঘুর করছে। হাঙরের দল ঝাক বেধে ঘুরছে। জেলিফিস, হর্সফিস আরও নানাবর্ণের নানা রংয়ের জলজ প্রাণী তার বৈচিত্রময় জলের নিচের জীবনকে কাচের ভিতরের কৃত্রিম ঘরে দিনাতিপাত করছে।

আমার ধারণা ছিল আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ডটা হবে সমুদ্রের নিচে। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। আশা করেছিল দেখবো যে হঠাৎ হাঙর এসে মাছ শিকার করছে। অক্টোপাস তার বর্ণ পরিবর্তন করে ফেলেছে। এখানকার আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ডটা তেমন নয়। সংগ্রহশালা প্রচুর। কিন্তু প্রত্যেকটা জলজ প্রাণীই আলাদা কাচের ঘরে সংরক্ষণ করা। অনেকটা চিড়িয়াখানা টাইপের। পার্থক্য এই যে এখানে সামুদ্রিক অনেক দুর্লভ প্রাণী আপনি সহজেই দেখতে পাবেন। সমুদ্রের নিচের অনেকপ্রাণীর সাথেই আপনি সেলফি তুলতে পারবেন। কিন্তু হাঙর, তিমি, জেলিফিস একই সাথে বসবাসের যে চিত্র আপনি এখানে পাবেন না। আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ডে ঘুরঘুর করতে করতে কখন যে চকলেট আর পারফিউমের দোকানে চলে এসেছি বুঝতেই পারলাম না। প্রথমে বুঝি নাই। পরে বুঝলাম এইটা এদের ব্যবসায়িক কৌশল। আপনি যেকোন দর্শণীয় স্থানে যান বা ফুটওভারে উঠেন, নামার সময় আপনাকে নামতে হবে চকলেটের দোকানের ভিতর দিয়ে। আর চকলেট বা সুভ্যনুরের দোকানের ভিতরে হাটতে হাটতে কখন যে আপনার হাতে শপিং ব্যাগ জমা হতে শুরু করেছে আর পকেট থেকে রিংগিট খরচ হতে শুরু করেছে আপনি বুঝবেনই না। তবে লাঙ্কাউই ডিউটি ফ্রি দ্বীপ। এইখানে বিশেষত অল্পখরচে খুবই ভালোমানের চকলেট কিনতে পারবেন।
শুরু করেছিলাম আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ড দিয়ে, কথা প্রসঙ্গে চকলেটে চলে এসেছি। দেখলেন তো, কিভাবে ওরা শপিঙে প্রভাবিত করে। মালয়েশিয়া শপিঙয়ের জন্য আমাদের আশেপাশের দেশের ভিতরে ভালো। বিয়ের বাজার, বিশেষ উৎসবে বিত্তশালীরা কেন মালয়েশিয়ায় যায় এখানে আসলেই বোঝা যায়। যাইহোক কেনাকাটার গল্প পরে হবে। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চলল। দুপুরের খাবারটা খেয়ে নি। আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ডের অপরপাশেই এক ভারতীয় রেস্তোরায় আমরা ঢুকলাম। ভাত, পাপড় ভাজা, মুরগী, ফিস ফ্রাই আর ডেজার্ট। এর ভিতরে ফিস ফ্রাইটা অসাধারণ ছিল। টাটকা সমুদ্রের মাছ ভাজা (নাম জানি না) । ওফ, অসাধারণ। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমরা এবার হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সেই গতকাল রাতে মালিন্দ এয়ারে কুয়ালালামপুরের উদ্দেশ্যে উড্ডয়ন করেছিলাম। মাঝরাতে কুয়ালালামপুরে নেমে তিনঘন্টা এয়ারপোর্টে ঝিমিয়ে সকালের মালিন্দ এয়ারের ফ্লাইটে লাঙ্কাউই। লাঙ্কাউইতে এসেই আমাদের ট্যুরের জন্য ভাড়া করা নির্দিষ্ট টুরিস্ট বাসে লাগেজ রেখেই এতক্ষনে ঘুরেফিরে এইমাত্র হোটেলে উঠলাম।

হোটেলের নাম বেলাভিস্টা। একটু পুরানো আমলের ঘরানায়। ১৪ একর জমির উপর বিশাল বড় হোটেল। হোটেলের পাদদেশে আন্দামান সমুদ্রের ঢেউ আছরে পরছে। অনেকটা জায়গা জুড়ে ফুলের বাগান। লবিতে দাড়ালেই সমুদ্র, নীল আকাশ, শীতল বাতাস হাতছানি দেয়। শুধু সমস্যা একটাই, হোটেলটা দ্বীপের এককোনায়। মূল যে সমুদ্র সৈকত বা পর্যটন কেন্দ্র সেখান থেকে ৪০ মিনিটের দূরত্বে হোটেলটা অবস্থিত। যারা একটু নিরিবিলি প্রকৃতির সানিধ্যে থাকতে চান তাদের জন্য আদর্শ।
আজকের দিনটা আর আগামীকাল লাঙ্কাউইতে আছি। এত অল্পসময়ে সম্পূর্ণ দ্বীপটা ঘুরে দেখা সম্ভব না। তাই হাতে যতটুকু সময় আছে কাজে লাগানোর চেষ্টা করলাম। রুমে এসে হাতমুখ ধুয়েই আমি আর আমার ভ্রমণ সঙ্গী মাসুম ভাই, জোহা ভাইকে নিয়ে লাঙ্কাউই ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের ট্যুর গাইড সন্ধ্যায় আসবেন। তাই এই সময়টা নিজেদের মতো করেই ঘুরতে হবে। হোটেলের লবি থেকে লাঙ্কাউই এর একটা ম্যাপ সংগ্রহ করলাম। মাসুম ভাই কোথাও ভ্রমণের আগেই সেই এলাক সম্পর্ক অল্প বিস্তর গবেষণা করে আসেন। তাই উনার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা ঠিক করলাম প্রথমেই যাবো 'কিলিম কার্স্ট জিওফরেস্ট পার্ক' এ। আন্দমান সাগের বুকের উপর ভাসমান দ্বীপের মাঝে নদী। অবাক করা বিষয়। আরও অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, এই নদীর তীরেই গড়ে উঠেছে ম্যানগ্রোভ বন। তবে এখন শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় নদীর পানির পরিমাণ কম। ম্যানগ্রোভ বনগুলো কেমন শুষ্ক মাটিতে দাড়িয়ে আছে। পর্যটকদের ভীর কম। খটখটে দুপুরের কারণে পর্যটক সংখ্যা একদমই হাতে গোনা। এখানে নদীতে ঘুরে বোড়ানোর জন্য বড় বোট ভাড়া পাওয়া যায়। দুইঘন্টা ৩০০ রিংগিট প্যাকেজের আওতায় আপনাকে ম্যানগ্রোভ বনের ভিতর নিয়ে যাবে, পাশেই একটা গুহা আছে সেই গুহা ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে। একটা বোটে দশ-বারজন যাওয়া যায়। আমরা দলে মাত্র তিনজন হওয়ায় ৩০০ রিংগিট আমাদের কাছে বিলাসিতার সমান। আমরা বোটে ওঠার বিলাসিতা সংবরণ করে পরবর্তী গন্তব্যের জন্য রওনা দিলাম। ম্যাপ দেখে মাসুম ভাই বলল, আমরা দ্বীপের যে পাশটায় আছি এইদিকে দুইটা সমুদ্রসৈকত আছে। একটা সাদাবালুর সমুদ্রসৈকত অন্যটা কালোবালুর (black sand) সমুদ্রসৈকত। সাদাবালুর সমুদ্রসৈকতটা এই দ্বীপের এককোনায়। ঠিক আমাদের হোটেলের অন্যপ্রান্তে। সিদ্ধান্ত হলো সাদাবালুর সমুদ্রসৈকত ঘুরে, যাওয়ার পথে কালোবালুর সমুদ্রসৈকত হয়ে আমরা হোটেলে ফিরে যাবো। কিন্তু সমস্যা হলো পরিবহন। এই দ্বীপের একমাত্র পরিবহন হচ্ছে প্রাইভেটকার অথবা মটরসাইকেল আর বিয়াল্লিশসিটের ট্যুরিস্ট বাস। আপনি চাইলে প্রাইভেটকার অথবা মটরসাইকেল নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভাড়াও নিতে পারবেন। আমরা যেহেতু কোন পরিবহন ভাড়া নেই নি, তাই আমাদেরকে ট্যাক্সিক্যাবের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এইদিকে যেহেতু পর্যটকসংখ্যা কম আর যারাই এসেছেন তারাই ট্যাক্সিক্যাব ভাড়া নিয়ে এসেছেন তাই আমরা পড়লাম মহাবিপদে। আসার সময় যে ট্যাক্সিক্যাবে এসেছিলাম, ওইটা ছেড়ে দিয়েছি। এখন আশেপাশে কোথাও ট্যাক্সিক্যাবের চিহ্ন নাই। স্থানীয়দের জিজ্ঞাসা করলাম কিভাবে ট্যাক্সিক্যাব পেতে পারি? তারা বলল, মূল সড়কে যেতে। ওখানে ট্যাক্সিক্যাব পাওয়া গেলেও যেতে পারে। প্রায় পনের মিনিট পায়ে হেটে মূল সড়কে পৌছালাম। দু-একটা ট্যাক্সি কিছুক্ষণবাদে হুস করে ছুটে যাচ্ছে কিন্তু সবগুলোই রিজার্ভ। স্থানীয়দের সবারই মটর সাইকেল আছে। ছেলে-মেয়ে সবাই যে যার মটর সাইকেল নিয়ে দ্বীপের এমাথা থেকে ওমাথা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা অসহায়ের মতো দাড়িয়ে আছি। অপেক্ষার পালা শেষে অবশেষে একটা ট্যাক্সিক্যাব পাওয়া গেল। সে আমাদের বিপরীত দিকে যাচ্ছিল। আমাদের ইশারায় ক্যাব ঘুরালো। আমরা ম্যাপ দেখালাম, আমাদের গন্তব্যস্থল টানজিঙ রুহ বিচ। সে রাজী হলো। আর আমরা হাফ ছেড়ে বাচলাম।
যতই সামনের দিকে এগোতে থাকি ততই রাস্তার দুইপাশের পাহাড় আমাদেরকে ঘিরে ধরে। লোকালয় ছেড়ে আমরা গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করতে থাকি। মাঝে মাঝে দুই একটা রিসোর্ট ছাড়া জনবসতির আর কোন চিহ্ন চোখে পড়ে না।
ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাদের যেখানে নামিয়ে দিলো তারপরে আর কোন রাস্তা নাই। রাস্তার বাম পাশে বেশ বড়সড় একটা হোটেল। সৈকতের পাশেই দুই একটা সুভ্যেনুর দোকান আর রেস্টুরেন্ট। ডানপাশে বোটের জেটি। পর্যটক আর স্থানীয়দের ধরে সবমিলিয়ে গোটা বিশেক মানুষের দেখা মিলল। আমাদের ভাড়া করা ক্যাবের বিল মেটানোর সময় খেয়াল করলাম তিনটা ট্যাক্সিক্যাব দাড়িয়ে আছে। তাই আমাদের ক্যাবটাকে পয়সা দিয়ে বসিয়ে না রেখে ছেড়ে দিলাম। সামনে নীল সমুদ্র ডাকছে। আমরা সমুদ্রের দিকে ছুটলাম। সমুদ্রের অসাধারণ সম্মোহনী শক্তি আছে। যাকে অগ্রাহ্য করা প্রায় অসম্ভব। জোহা একটু পিছিয়ে পড়লেও আমি আর মাসুম পাগলের মতো সমুদ্রে দিকে এগোতে থাকি। সমুদ্রের এক পাশে পাহাড়। সেই পাহাড়ের ওপর ওয়াচটাওয়ার। খুবই ইচ্ছা করছে সেই ওয়াচটাওয়ারে উঠতে। কিন্তু পাহাড়টা অনেক উচু। তারচেয়েও বড় ব্যাপার পাহাড়ে উঠতে হলে আমাকে সমুদ্র পাড়ি দিতে হবে। আন্দামান সমুদ্রের বুক ফুড়ে পাহাড়টা সগর্বে দাড়িয়ে আছে।

তার পাশেই ছোট ছোট আরও দুইটা পাহাড়। সৈকতের পাশেই জঙ্গল। আমরা বেলাভুমি ধরে সামনে এগোতে। সামনের বাক পেরোতেই অপার সৌন্দর্য্য তার অপরুপ রুপ নিয়ে রাজপুত্রের অপেক্ষায় রয়েছে। নীল সমুদ্রের দুই পাশে সবুজ বন, বনের গা ঘেষে পাহাড়। সৈকতের এই পাশটায় আমরা তিনজন ছাড়া আরও কেউ নাই। একলা প্রকৃতি সমুদ্রের মিহি হাওয়ায় উথাল পাতাল করছে। আমরা ঢাকা শহরের মানুষের গাঘাষাঘেষি করে থেকে অভ্যস্ত। তাই এই নিসীম নিরবতা বেশি সময় উপভোগ করতে পারলাম না। একটা অজ্ঞাত ভয় আমাদের আকড়ে ধরে। ঘরিতেও তখন সাড়ে পাচটা বাজে। ঢাকাতে ছয়টায় সন্ধ্যা হয়। সেই হিসাবে এখানেও সন্ধ্যা সন্নিকটে। দিনের আলো থাকতে থাকতেই আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত।
আমরা মূল সড়কে এসে দেখি কোন গাড়ি নাই। অদূরে জেটির কাছে দুইটা প্রাইভেট কার দাড়িয়ে থাকতে দেখে ছুটলাম জেটির কাছে। কিন্তু সবগুলোয় রিজার্ভ। স্থানীয় একজনকে জিজ্ঞাস করলাম, 'কিভাবে ট্যাক্সিক্যাব পেতে পারি?' সে বলল, এটস রিয়েলি টাফ নাউ।' আমরাও বুঝতেছি একটা ঝামেলায় পড়ে গেছি। এখন উপায় একটাই। পায়ে হাটা। পায়ে হাটার জন্য পরিবেশটা দারুন। মসৃণ রাস্তা। দুইপাশে সারি সারি বৃক্ষরাশি। অদূরে নীল সমুদ্র। কিন্তু পথের দূরত্ব অনেকবেশি। ঘরি কাটাও থেমে নেই। তাই অজানা শঙ্কা মনের ভিতর উকি দিতে থাকে। এই নির্জন রাস্তায় কেউ যদি আমাদের কাছ থেকে ক্যামেরা, লেন্স, ট্রাইপড, মানিব্যগ কেড়ে নিয়ে যায় আমাদের কিছুই করার উপায় থাকবে না। আসার সময় মাইলখানেক দূরে একটা 'সিকিউরিটি পোস্ট' দেখেছিলাম। প্রাথমিক লক্ষ্য ওই সিকিউরিটি পোস্ট পর্যন্ত যাওয়া। ওইখানে যেতে পারলে একটা ব্যবস্থা হবেই। আমরা সেইলক্ষ্যেই হাটছি।
একটা ঘটনা আমাদেরকে আরও বেশি প্রভাবিত করলো। হঠাৎ দুইটা মটরসাইকেল পিছন থেকে আমাদের পেরিয়ে একশ গজ সামনে দাড়িয়ে কাউকে যেন ডেকে কিছু একটা বলে চলে গেল। আমরা ওইজায়গায় যেতেই রাস্তার পাশ থেকে এক ট্যাক্সিড্রাইভার (পরনে ট্যাক্সিড্রাইভারের পোশাক) আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করলো, "ট্যাক্সি লাগবে কিনা?"। ঢাকা শহরের চোর-ছিনতাইকারীর সাথে থাকতে থাকতে আমাদের মন হয়ে গেছে সন্দেহপ্রবণ। দুইটা মটর সাইকেল, ক্যাবওয়ালার আগ্রহ দুই মিলিয়ে আমরা অন্যকিছু আচ করে নিলাম। তাই ক্যাব ড্রাইভারের আমন্ত্রণ প্রত্যক্ষাণ করে হাটতে থাকলাম এবং অবশেষে সেই কাঙ্খিত 'সিকিউরিটি পোস্ট' এ আমরা নিরাপদেই পৌছে গেলাম।
নিরাপত্তাকর্মী নেপালী। আমাদেরকে পেয়ে সে খুশিই হলো। আমাদের একটা ট্যাক্সি লাগবে শুনে সে চেচিয়ে কাউকে কী যেন বলল। আমাদের জানালো পাচমিনিটের ভিতর জানাচ্ছে। নিরাপত্তাকর্মীর কার সাথে কথা হচ্ছে আমরা তাকে দেখতে পাচ্ছি না। কারণ সে রাস্তার ডানপাশের ঢালুতে রাস্তা নেমে যেয়ে কিছুদূর যে বাক নিয়েছে, সেই বাকের ওপাশে দাড়িয়ে। বাকের আড়ালে দাড়ানো লোকটার হাতে নিশ্চয় ওয়ারলেস আছে। কারণ আমরা ওয়ারলেসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। মূলত আমরা যেখানে দাড়িয়ে আছি এইটা একটা সংরক্ষিত এলাকা। আমাদের উপস্থিত থাকাকালীন সময়েই এক বিদেশী কুটনীতিকের গাড়ি বহর নিচের ঢালু থেকে উঠে এসে আমাদের সামনে দিয়ে চলে গেল। টানজিঙ রুহ হচ্ছে কুটনীতিক, বড় ব্যবসায়ী, বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য নির্মিত রিসোর্ট। পয়সাওয়ালা ব্যক্তিরা নির্জনে সময় কাটানোর জন্য এখানে আসেন। আমরা সেই সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকে বসে আছি। এদিকটাই সাধারণ পর্যটকরা খুব একটা আসে না। তাই ট্যাক্সিক্যাবের পরিমাণও কম। কিছুক্ষণ বাদে ওয়ারলেসওয়ালা খবর দিলো, হোটেলে একটা ট্যাক্সিক্যাব আছে। ওইটা আসতেছে। আমাদের কাছ থেকে ভাড়াটা নিশ্চিত করলো। ট্যাক্সি আসার পর আমি ব্যাপারটা ধরতে না পারলেও জোহা আর মাসুম ধরে ফেলল। এই সেই ট্যাক্সি ড্রাইভার। কিছুক্ষণ আগে যার আমন্ত্রণ আমরা প্রত্যক্ষাণ করে এসেছি। ব্যাপারটা আমাদের কাছে এখন পরিষ্কার হলো। মটরসাইকেলের আরোহীরা আমাদের অসহায় অবস্থা বুঝতে পেরে সে ওই ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ডেকে আমাদেরকে গন্তব্যে পৌছে দিতে বলেছিল। কিন্তু আমরা ভেবেছিলাম অন্য কিছু। লাঙ্কাউইতে নিরাপত্তা নিয়ে খুব একটা সমস্যা নেই। পর্যটকরাই এদের রুটিরোজগারের মূল উৎস। তাই পর্যকদের নিরাপত্তা এরা নিজেরেই নিশ্চিত করে। বলছি কারণ, দুই দিনে আমি লাঙ্কাউইতে কোথায় কোন নিরাপত্তা কর্মী দেখতে পাইনি।
বিনা পয়সায় থ্রিলার নিয়ে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। আসার সময় ট্যাক্সিতে বসেই রক্তিম সূর্যকে আন্দমানের বুকে ডুবে যেতে দেখেছি। ট্যাক্সি থেকে যখন নামি ঘড়িতে স্থানীয় সময় সাড়ে সাত। নেমেই সুইমিংপুলের দিকটায় ছুটলাম। কারণ এখানে সূর্যাস্ত সাতটা পচিশে। (এত বড় দিন আমাদের জানা ছিল না) সূর্যের লাল আভা এখনও আকাশে ছড়িয়ে আছে। এই হোটেলের সুইমিংপুলে বসে সমুদ্র দেখা যায়। (কিন্তু সৈকত না থাকায় সমুদ্রে নামা যায় না।) মাসুম ভাই তার ট্রাইপডে ক্যামেরা সেট করলো। আমি মাটিতে শুয়ে ল্যান্ডস্কেপটা ক্যামেরার ফ্রেমে আনার চেষ্টা করলাম। চারপাশটা লাল। সমুদ্রের বুকে ইয়ট, দূরের সন্ধ্যা বাতি; অভাবনীয় দৃশ্য।

সূর্য ডুবে রাতের অন্ধকার নামার পরপরই আমাদের ট্যুর গাইড উপস্থিত। আমাদেরকে ট্যুরিস্ট বাসে উঠানো হলো। যেখানে রেস্টুরেন্টে খেতে যাবো সেইখানকার দূরত্ব বাসের হিসাবে ৪০-৫০মিনিট। জায়গাটার নাম পানটাই চেনাঙ (Pantai Chenang)। পানটাই চেনাঙই মূলত পর্যটক অধ্যুষিত এলাকা। এখানে প্রচুর হোটেল, বিভিন্নরকমের রেস্টুরেন্ট, শপিঙ মল রকমারী আলোয় ঝকমক করছে। লাইভ গান হচ্ছে, গিটারের টুঙটাঙ শব্দ ভাসছে, বিদেশী পর্যটকরা ঘুরছে, কেনাকাটা করছে, আড্ড দিচ্ছে, ফুর্তি করছে। রমরমা পরিবেশ। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, প্রচুর মানুষ আছে এখানে। আহ মানুষের কোলাহল কেন আমার এত ভালো লাগে?
রাত দশটার পরেই দ্বীপটা নিশ্চুপ হয়ে যায়। খাবারের দোকানগুলো বাদে বাকিসব বন্ধ হয়ে যায়। দ্বীপ জুড়েই শুনশান নিরবতা। আমাদের হোটেলে এই নিরবতা আরও একটু বেশিই। রাতে হোটেলটাকে অনেকটা হ্যারী পটারেরর যাদুর যাদুঘরের ভবনের মতো মনে হয়। [রাতের হোটেল বেলাভিস্টা]

নির্জন রাস্তায় এলোমেলো ঘোরাঘোরি করে সেই ভবনের একটা কক্ষে ঘুমাতে গেলাম। আজ এই পর্যন্তই। আগামীকাল দিনব্যাপী কর্মসূচীতে ঠাসা। আজ একটু বিশ্রাম করি। শুভ রাত্রি
(চলবে..)
আমার লাঙ্কাউই ভ্রমণের গল্প (পর্ব-২)

মন্তব্য ১১ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই মে, ২০১৫ রাত ১০:২১

লিখেছেন বলেছেন: ডারুন।
ভিডেসে সাবঢানের মার নেয়, াবার মারের ো সাবঢান নেি।
হোটেল ভারা কট নিয়েচে?

২| ১৭ ই মে, ২০১৫ রাত ১০:৩৩

ভ্রমরের ডানা বলেছেন: বাহ!!! অসাধারণ লাগলো আপনার ভ্রমন কাহিনী। সব মিলিয়ে কত দিন ছিলেন ভাই আর খরচাপাতি কেমন ??

১৯ শে মে, ২০১৫ রাত ১০:২৬

আলোকিত পৃথিবী বলেছেন: কুয়ালালামপুর আর লাঙ্কাউই মিলিয়ে পাচদিন মালয়েশিয়াতে ছিলাম। অফিস থেকে গিয়েছিলাম, তাই আমাদের খরচের হিসাবটা একটু অন্যরকম। তবে পয়তাল্লিশ হাজার টাকার প্যাকেজে বিভিন্ন ট্যুর অপারেটর পাচদিনের মালয়েশিয়া ভ্রমণের অফার করে থাকে।

৩| ১৮ ই মে, ২০১৫ বিকাল ৩:৫১

মোঃমোজাম হক বলেছেন: খুবই ভাল লাগলো।

১৯ শে মে, ২০১৫ রাত ১০:১৬

আলোকিত পৃথিবী বলেছেন: এতবড় লেখা কষ্ট করে পড়ার জন্য আপনাকে ধণ্যবাদ

৪| ১৮ ই মে, ২০১৫ রাত ১১:২৭

সুমন কর বলেছেন: ছবিগুলো দেখে গেলাম। সুন্দর।

৫| ১৯ শে মে, ২০১৫ সকাল ৯:৫৮

বঙ্গভূমির রঙ্গমেলায় বলেছেন:
বাহ!!! অসাধারণ লাগলো আপনার ভ্রমন কাহিনী। সেই সাথে ছবিগুলোও চমৎকার।

১৯ শে মে, ২০১৫ রাত ১০:১৫

আলোকিত পৃথিবী বলেছেন: মন্তব্যের জন্য ধণ্যবাদ

৬| ১৯ শে মে, ২০১৫ রাত ১০:২৩

ভ্রমরের ডানা বলেছেন: জনপ্রতি ৪৫ হাজার ৫ দিন তাই না ভাই। একবার ঘুরে দেখার সাধ ছিল কি না হে হে হে :P :P

১৯ শে মে, ২০১৫ রাত ১০:৩০

আলোকিত পৃথিবী বলেছেন: হুম। তবে আমাদের প্যাকেজটা কাস্টমাইজ ছিল। খরচটাও রেগুলার প্যাকেজগুলো থেকে বেশি ছিল

৭| ২০ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:৪২

ভ্রমন কারী বলেছেন: দুইবার গিয়েছি....মনে হচ্ছে আপনার সাথে আবার গেলাম। ভাবতেছি ব্যাবসা বাদ দিয়ে বিডি জবসে চাকরি নিব আর কয়দিন পর পর ফ্রি বিদেশ ভ্রমন করবো ;)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.