নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

Noyontara Natasha

Noyontara Natasha › বিস্তারিত পোস্টঃ

এটা গল্প হলেও পারতো(২য় পরিচ্ছেদ)

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:২৬

এটা গল্প হলেও পারতো
নয়নতারা
২য় পরিচ্ছেদ
.
ঠিক সতের বছর আগে..........
এক গগনবিদারী চিৎকারে এলাকার সবাই ছুটে গিয়েছিল পাশের ভাঙা মন্দিরটার কাছে।
অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে এক পাগলী, গায়ের পোশাক ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। চিনতে কারোর দেরি হয় না এ মসজিদের মুয়াজ্জিন জলিলের পাগলী মেয়ে পলি।
কেউ একজন দৌড়ে যায় পলির বাবা মাকে খবর দিতে। মেয়ের এমন অবস্থা দেখার চেয়ে মৃত্যু অনেক শ্রেয় বলে মনে হয়েছিল জলিলের।
কলুষিত সমাজ এই পাগলীটাকেও ছেড়ে দেয়নি।
খুবলে খেয়েছে এক মানুষরূপী শকুন, যাদের দেখলে কার্তিকের হন্যে কুকুরও লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নেবে। সেদিন পাগলী পলি শুধুই ধর্ষিত হয়নি! ধর্ষিত হয়েছিল এই সমাজ, এই সমাজের সমাজব্যবস্থা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা! সেদিন ধর্ষিত হয়েছিল সমাজের বিবেক! কে করবে এই জবাবদিহিতা! কে?
পলির আর্তচিৎকারে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠেছিল।
সেদিন মেয়ের অবস্থা দেখে অসহায় মা সেদিন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। এই কান্না এই কষ্টের দায়ভার চাইলেই কি আমরা এড়াতে পারব?
হাসপাতালের কয়েকমাসের চিকিৎসার পর বাড়িতে ফিরেছিল পলি।
তবে একা নয়, গর্ভে এনেছিল নিষ্পাপ এক প্রাণ!
আর সেই ধর্ষক ছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে। পাওয়া যায়নি তার কোনো খোঁজ।
সেদিন সেই ফুলের মতো বাচ্চাটাকে গর্ভেই শেষ করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল প্রতিবেশীরা। প্রতিকারের তো খোলাই রইল, তবে প্রতিরোধ!
রাজি হননি জলিল আর মজিদা। কোনো নিষ্পাপ প্রাণের পৃথিবীর আলো হাওয়ার পাওয়ার আকুতিকে শেষ করে দিতে পারেননি তারা।
একটু একটু করে পাগলী মায়ের মাতৃগর্ভে বড় হয়েছে প্রীতু। মজিদা বেগম খুব পরিশ্রম করেছেন পলির পিছনে। পাগলীটা বুঝত না তার মাঝে দিনেদিনে বেড়ে উঠছে আরেকটি নতুন ফুলের কলি! পলি যখন অতিরিক্ত পাগলামী করত তখন ভয় হতো মজিদা বেগমের,
"বাঁঁচবে তো মাইয়াডা! নাকি দুটোকেই...!" আর ভাবতে পারেননা মজিদা। পাগলী হলেও মায়ের সন্তান সেরা।
আবার নামাযে বসে কাঁদতে থাকেন,
"আল্লাহ এত কষ্ট দিছ তাও আমার দুঃখ নাই, মাইয়াডারে আমার কোল থেইকা নিও না" অঝোরে কাঁদতে থাকেন তিনি। দুখিনী মায়ের আকুতি শুনে স্রষ্টা অন্তরালে থেকে হয়তো পূরণ করেছিলেন সেই আর্জি!
আর তাই অবশেষে পৃথিবীতে এলো ধর্ষক বাবা আর পাগলী মায়ের সন্তান...
প্রীতু, রাইয়্যানা প্রীতু!
প্রীতুর মায়ের বয়স তখন মাত্র উনিশ!
মায়ের মতোই মায়াবী চেহারা নিয়ে জন্মেছিল প্রীতু। যেন ডানাকাটা পরী, নাতনিকে দেখে দুচোখ আবারো অশ্রু ঝরানোর খেলায় নেমেছিল।
"তুই এত রূপ নিয়ে কেন জন্মালি! আর জন্মালিই তো আমার পোড়া ঘরে কেন" পাগলের মতো কেঁদেছিলেন মজিদা।
মজিদা আর তার স্বামী চেয়েছিলেন প্রীতুকে নিজেদের কাছে রাখতে।
"আমরা নাতনীটারে আমাগো কাছে রাখবার পারি না?"
"সে কথা আমিও ভাইবা দেখছি পলির মা, কিন্তু আমাগোর কাছে কি পরিচয় নিয়া থাকবো? কি লেখব আমরা ওর বাপের নাম!"
চুপ হয়ে গিয়েছিলেন মজিদা বেগম। মজিদার কাছে যেমন এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই তেমনি আমাদের সমাজ সংস্কার সংস্কৃতি এসবের কোনো উত্তর দিতে পারে কি! দুইদিন পর যখন বড় হবে মেয়েটা, কিছু ব্যতিক্রম বাদে এই সমাজের সিংহভাগই সামনেপিছনে,
"জারজ সন্তান, অবৈধ সন্তান" বলে চিৎকার ছাড়বে!
জলিল আর মজিদার একমাত্র সন্তান পলি, জন্মের পর থেকেই মানসিক রোগী, তবে ডাক্তার বলেছিল ভালো ভাবে চিকিৎসায় সেরে উঠতে পারে। কিন্তু অভাবের সংসারে তা আর পারেননি জলিল। পলির পরে আর কোনো সন্তানের মা হতে পারেননি মজিদা। সন্তানের এই অবস্থা তার বুকের ভিতর কত বড় ক্ষত তৈরী করেছিল তা কেবল সেই জানে!
আর আজ....! অঝোরে রক্ত ঝরাচ্ছে সেই ক্ষত!
আচমকা ডুকরে কেঁদে উঠেন মজিদা। জলিল কান্না থামাতে চেষ্টা করেনা। কারণ সে শক্তি তার নিজের মধ্যেও নেই। সারাজীবন সৎ পথে থেকেছেন৷ কিন্তু সৃষ্টিকর্তা এ কোন পরীক্ষায় ফেললেন তাকে!
চাইলেও নিজের কাছে রাখতে পারবেন না পলির বাচ্চাটাকে। বড় হয়ে বাচ্চাটা নিজের ইতিহাস শুনলে সহ্য করতে পারবে না।
তাই বুকে পাথর বেঁধে সিদ্ধান্ত নিলেন বাচ্চাটাকে কোনো ধনীঘরে বিক্রি করে দেওয়ার৷ আর সেই টাকা দিয়ে চিকিৎসা হবে পলির। মজিদা বেগমকে কথাটা বলতেই তিনি চমকে উঠেন।
জড়িয়ে ধরেন স্বামীর দুই পা।
"তুমি এমনি কইরা বাচ্চাডারে নিও না, পলিরে তো মানুষ করবার পারি নাই, কিন্তু তুমি দেইখো এই বাচ্চারে আমি অনেক বড় করব"
জলিল বুঝতে পারছেন মজিদার কষ্ট কিন্তু তাদের কাছে ভাল থাকবে না বাচ্চাটা। স্ত্রীকে উঠিয়ে পাশে বসালেন তিনি,
"পলির মা, কাইন্দো না, দ্যাখো মানুষে পলির মাইয়ারে ভালো থাকবার দিবো না, তুমি ওরে আর মায়া কইরো না, আমি বুঝতাছি তোমার কষ্টডা কিন্তু...!" দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জলিল।
মজিদা আর কিছুই বললেন না।
ধীরে ধীরে জলিল আবার বললেন,
"আমরা কাউরে দিয়া দিলে তারা মানুষ করবো, মাইয়াডা ভালো থাকবো!"
নিজেকে স্বান্তনা দেন মজিদা।
হঠাৎ পলি আর বাচ্চাটার চিৎকার শুনে ছুটে যান মজিদা আর জলিল।
পলি তার মেয়ের গলা চেপে ধরেছে! ভাগ্যের হায়, ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস!
পলি যদি বুঝতো!
জলিল দ্রুত পলিকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। মজিদা বাচ্চাটাকে কোলে নেন। গলা লাল হয়ে গেছে ছোট্ট বাচ্চাটার। হাঁপাচ্ছে খুব। ভয় পেয়ে যান মজিদা।
নিজেই সিদ্ধান্ত নেন কোনো নিঃসন্তান দম্পতিকে বাচ্চাটা দিয়ে দেওয়ার।
.
"না, আমরা এত কম টাকা নিয়া মাইয়াটারে দিতে পারব না"
মরিয়া কন্ঠে বলে মজিদা বেগম।
জলিল খুব শান্ত দৃষ্টিতে স্ত্রী মজিদার দিকে তাকালেন।
এসব দরদাম করতে খুব ঘৃণা লাগছিল নিজের কাছে।
একবার ভাবলেন একটু বাঁধা দেবেন, কিন্তু মনে হলো বাঁধা দিয়ে কি হবে টাকাটা যে খুব দরকার।
চোখের কোণায় অশ্রু চিকচিক করে জলিলের ভিতরে থাকা কষ্টটা যেন মুখের উপর স্পষ্ট ছাপ এঁকে দিল।
সেদিকে খেয়াল করলে আসাদ শেখ হয়তো আবার অজুহাত দেখাতে পারতেন না।
"আমাদের দিকটাও একবার ভাবুন"
মজিদার কথার উত্তরে বললেন আসাদ শেখ।
"আরো অনেকেই নিতে চাইছে আমরা ওইখানেই দিয়া দিব"
স্বামীর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বলে মজিদা।
জলিলের অন্তর পর্যন্ত স্পষ্ট হয়ে খুব কষ্ট হয় তার।
তাই মুখ শক্ত করে আবার বলল,
"কি বলেন আপনারা? নিবেন নাকি না?"
মজিদা বেগমের কথা শুনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলেন আসাদ শেখ আর তার স্ত্রী রাহেলা।
চুপচাপ দেখে উৎসাহ পায় মজিদা।
নেহাৎ কপালের ফেরে আজ আমাগো এই হাল, নইলে কি চান্দের মতন নাতনীডারেই....."
কথা শেষ করতে পারেনা মজিদা বেগম।
ডুকরে কেঁদে উঠে সে।
অগত্যা নিঃসন্তান স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বিশ হাজার টাকার বিনিময়ে বাচ্চাটাকে নিতে রাজি হয়ে যান আসাদ শেখ।
"আমরা তাহলে পরশু টাকা দিয়ে ওকে নিয়ে যাব?"
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জলিলের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে আসাদ শেখ।
কিন্তু জলিল সেভাবেই বসে নির্লিপ্ত ভাবে জবাব দেয়,
"আইচ্ছা"
কন্ঠস্বর শুনে মনে হয় অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে, যেন কোনো এক ঘোরের মাঝে আসে সে।
কিছুক্ষণ থাকবেন ভেবেও স্ত্রীকে নিয়ে গাড়িতে উঠেন আসাদ শেখ।
আরেকবার হাত নেড়ে গাড়ি স্টার্ট দেন তিনি৷ জীবনের বাঁকে বাঁকে কত মানুষ চোখে পড়ে!
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আনমনা হয়ে যান রাহেলা।
বছর ছয়েক আগে বিয়ে হয়েছে রাহেলার।
শ্বশুরবাড়িতে এসে কো কোনো অভাব না পেলেও মা হতে পারেননি রাহেলা।
কত বছর ধরে এই মা ডাক শোনার জন্য আকুল হয়ে আছে তার মন।
ডাক্তার আশা দিয়েছেন, সৃষ্টিকর্তা যেদিন মুখ তুলবেন সেদিন হয়তো...!
তবুও মাতৃত্বের নেশায় বাচ্চা দত্তক নেওয়ার কথা ভেবেছেন তিনি।
স্বামীকে রাজি করিয়েছেন।
"কি রাহেলা খুশি তো তুমি?"
"গাড়ি চালাতে চালাতে একবার পিছন তাকিয়ে নিলেন আসাদ শেখ"
কোনো উত্তর দিলেন না রাহেলা, কিন্তু একরাশ হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে পড়লো তার চোখে মুখে।
সেটা লক্ষ্য করে মুচকি হাসলেন আসাদ শেখ। এখানেই আসাদ শেখের পরিচয় দেওয়া দরকার,
আসাদ শেখ, পেশায় ব্যবসায়ী। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে সন্তান হিসেবে বাবার ব্যবসার উত্তরাধিকারী হয়েছেন। নিজের চেষ্টায় আরো বাড়িয়েছেন তার ব্যাবসার পরিধি। মার্কেটে ছোট বড় বিভিন্ন দোকান আর মোটামুটি সব ব্যবসাই তার আছে।
দিনের আলোতে ব্যবসার পাশাপাশি রাতের আঁধারে কিছু কালো টাকার উৎস ও তার আছে, তবে সেটা বেশ নগণ্য বলে লোকচক্ষুর অন্তরালেই আছে।
সাবধানী আসাদ শেখ বেশ ধৈর্যশীল, মনে ভয়ও আছে। তাই "আর কিছু টাকা জমলেই ছেড়ে দিব" এই প্রতিজ্ঞা করে আসছেন। তবে "কিছু টাকা" কত সেটা তিনি জানেন না।
স্ত্রীর অনুরোধে সন্তান দত্তক নিতে রাজি হয়েছেন।
নিজের ইচ্ছা একেবারে ছিল না তা নয়। বাবা ডাক শুনতে কার না সাধ হয়! তবুও নিজের রক্ত বলে কথা আছে তো!
আসাদ শেখের এখন পরিবার বলতে বৃদ্ধা বাবা মা, স্ত্রী আর বাড়ির চাকরবাকর গুলো।
সন্তানকে কিভাবে বড় করবেন সেই চিন্তায় একেবারে ডুবে ছিলেন রাহেলা।
স্বামীর ডাকে সম্বিত ফিরে এলো তার,
"আসমা কথা বলবে"
বলে ফোন এগিয়ে দিলেন আসাদ শেখ।
আসমা, আসাদ শেখের ছোট বোন। আসমার স্বামী একটা সরকারি ব্যাংকে চাকরি করে। একটা দুই বছরের ছেলে আছে আসমার, চয়ন।
"ভাবি বাচ্চাটাকে দেখেছ?"
উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করে আসমা।
বাচ্চা দত্তক নেওয়ার ব্যাপারে আসমা রাজি ছিল না আবার একেবারে নারাজও নয়।
ভাবির বিষয়টা চিন্তা করেই রাজি হয়েছিল সে।
আসমার কথাতে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,
"আসমা একদম চাঁদের টুকরো"
আসমা কথাটাকে বিদ্রুপ হিসেবেই নেয়।
"তাই নাকি ভাবি! বড় করো, মানুষ করো, দেখি কেমন চাঁদের টুকরো!"
"চয়ন কেমন আছে?"
"ভাল, খেলছে"
আসমার সাথে কথা বলার শেষে রাহেলা আবার বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সবার কিছুটা বিপরীতে আছে সে, তবুও...... বাচ্চা তার চাইই চাই!

আসাদ শেখ চলে যাওয়ার পর থেকেই অঝোর ধারায় কাঁদছেন মজিদা।
কোনো ভাবেই নিজেকে সামলে রাখতে পারছেন না তিনি।
জলিল কয়েকবার স্বান্তনা দিতে গিয়ে না পেরে চলে গিয়েছেন। তার চোখের পানিও বাধা মানছে না।
ঠিক দুইদিন পর আসাদ শেখ আর রাহেলা বাচ্চাটাকে নিতে এলেন। যাওয়ার সময় মজিদা রাহেলার হাত ধরে বললেন,
"মা ওর নামটা আমরা যেইটা রাখছি সেইটাই রাইখো?"
মজিদা বেগমের দিকে তাকিয়ে রাহেলার চোখেও পানি চলে এলো,
"কি নাম খালাম্মা?"
"রাইয়্যানা"
"আচ্ছা ওর মায়ের নাম কি যেন?"
"পলি"
"আচ্ছা ওর নাম থাক রাইয়্যানা প্রীতু"
রাহেলার কথা শুনে চোখে পানি চলে আসে মজিদার,
"তোমার কাছে ও ভালোই থাকবার পারবে মা, ভালো রাইখো"
রাহেলা কিছু বললেন না।
রাহেলা আর আসাদ শেখ চলে যাওয়ার সময় জলিল বললেন,
"আমাগো নাতনীটারে দেইখো, আর কোনোদিন যদি ও জানবার পারে ওর অতীত, আমাগোরে যদি দেখবার চায় বাঁধা দিও না, আমার অনুরোধ!"
হ্যাঁ সূচক উত্তর দিয়ে গাড়িতে উঠলেন রাহেলা আর আসাদ শেখ।
রাহেলা দের গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলেন মজিদা আর জলিল।
মুখ যদি মনের আয়না হয় তবে জলিল আর মজিদাকে দেখলে বোঝা যায় কষ্টের কালো ছায়া তাদের মুখটাকে কতটা ঘিরে রয়েছে!

(চলবে)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.