![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এটা গল্প হলেও পারতো
নয়নতারা
৩য় পরিচ্ছেদ
সময় ছুটে চলে।
খুব ভালোভাবেই বড় হচ্ছিল প্রীতু। রাহেলা তার চেষ্টার সবটুকু দিয়ে বড় করছিলেন তাকে।
আসাদ শেখও খুব আদর করতেন প্রীতুকে।
আসাদ শেখের বৃদ্ধা বাবা প্রীতুকে ভালোভাবে মেনে নিতে পারলেও পারেননি তার মা। তার কথা একটাই,
"কোথাকার কার পাপের ফল, জারজ সন্তান আমরা টানব কেন? বংশ রক্ষা না হয় না হোক,
নইতো আসমার ছেলে আছে"
প্রীতু ছোট থাকতে নীরবে সহ্য করত রাহেলা। কিন্তু কড়াভাবে একদিন নিষেধ করে দিয়েছিলেন শাশুড়িকে,
"মা আপনার নিজের মেয়ের সাথে যদি এমন হতো?"
চোখ কপালে তুলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন,
"ছি ছি ছি! ওমন মুখে সাত ঝাটা মারি, ওমন কথা কি বলতে আছে! আর শোনো মেয়ে! আমার মেয়েকে নিয়ে কোনো বাজে কথা বলার আগে হাজারবার ভেবে নেবে"
"কিন্তু আমি তো খারাপ কিছু বলিনি মা!" স্বপক্ষে বলতে চাইলেন রাহেলা।
"চুপ! আমার মেয়ের কিছু হয়নি আর হবেও না"
ঝংকার দিয়ে উঠেছিলেন রাহেলার শাশুড়ি।
রাহেলাও পালটা জবাব দেয়,
"বেশ আপনিও আমার মেয়েকে নিয়ে কিচ্ছু বলবেন না!"
রাহেলার কথা শুনে বিদ্রুপের হাসি হেসে উঠলেন তিনি,
"এহ মেয়ে, আমাদের মতো যদি পেটে ধরতে হতো তবে বুঝতাম! মেয়ে! হুহ!"
শাশুড়ির কথাগুলো তীরের মতো বিঁধল রাহেলার বুকে। কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল সেখান থেকে।
রাহেলাকে বিয়ে করাটা একদম পছন্দ করতে পারেননি তার শাশুড়ি, কারণ তার ইচ্ছে ছিল বউ যতটা রূপ আনবে তার সাথে পাল্লা দিয়ে টাকাও! যদিও কোনো দিক থেকে কম ছিল না তাদের৷ কিন্তু আশা পূরণ হয়নি! তবুও বউয়ের রূপ আর ছেলের ধমকে চুপ করে ছিলেন।
কিন্তু রাহেলার বাচ্চা না হওয়াতে আবার বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন আসাদ শেখকে। একমাত্র ছেলেই যদি বংশরক্ষা না করে তো কে করবে!
সাহস করে বউয়ের অগোচরে ছেলের কাছে গিয়ে বলেছিলেনও একদিন।
প্রচন্ড রেগে যায় আসাদ শেখ। সে আর যাই হোক রাহেলাকে ভালবাসে।
সেখানে দমে গেলেন রাহেলার শাশুড়ি। কিন্তু এরপর যখন প্রীতুকে নিয়ে আসল রাহেলা, তিনি একেবারে রাগে ফেটে পড়লেন,
"কোথাকার কোন অজাত-কুজাতের সন্তান! আমার আসমার ছেলেকে আমি সব দেবো, কার না কার পাপের বোঝা আমি টানব কেন!"
স্বামীর সামনে বা অগোচরে একথা প্রায়ই শুনতে হতো রাহেলাকে।
কিন্তু সেদিন আর রাহেলা চুপ থাকেননি। আসাদ শেখের কাছে গিয়ে কেঁদে পড়লেন।
রাহেলার কাছে সব শুনে মনে মনে রাহেলার পক্ষপাতিত্ব না করতে পারলেও মাকে নিষেধ করে দেন তিনি। রাহেলার শ্বশুর খুব ভালবাসতেন প্রীতুকে। তবে আসমা বাবার মতো হলেও মায়ের উপর সন্তুষ্ট ছিল কারণ তার ছেলে! মাঝে মাঝে সেও ইন্ধন যোগাত মাকে। স্বার্থ মানুষকে অন্ধ করে দেয়।
রাহেলা চাইতেন না কোনোভাবেই প্রীতুর উপর এসব প্রভাব ফেলুক। প্রীতুর ব্যাপারে তিনি সবসময়ই ছিলেন প্রচন্ড সাবধান! আর তাই এসবের মাঝেও খুব সুন্দরভাবে বড় হচ্ছিল প্রীতু।
পড়ালেখায় প্রীতু ছিল সেরা আর সব দিক থেকেও। এ যেন গোবরে ফোটা এক মায়াবি পদ্ম, যে স্বমহিমায় উজ্জ্বল আলো ছড়ায়।
তবে প্রীতু ছিল একটু রাগী, যাকে বলে ক্ষনিকের রাগ।
তবুও রাইয়্যানা প্রীতু ছিল সবার আদরের তার সুন্দর ব্যবহারের জন্য। প্রীতুর জীবনটা এভাবেই চলতে পারত। কিন্তু জীবন নিজ নিয়মে চলে, না কোনো বাঁধা, কারোর দুঃখ কষ্ট এসব ভেবে চলে না।
প্রীতুর বয়স যখন তেরো, স্রষ্টার ইচ্ছেই খুব অলৌকিকভাবে এক ছেলে সন্তানের মা হলেন রাহেলা।
জীবনে প্রথম মা হওয়ার আনন্দের মাঝেও বুকের ভিতরটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠছিল তার!
প্রীতু তার নিজের মেয়ে না হলেও তিনি ছিলেন প্রীতুর মা, প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ তিনি প্রীতুর থেকেই পেয়েছেন।
রাহেলার ছেলে হওয়ার সাথে সাথে শাশুড়ির কি আদর! এত বছর এই বাড়িতে পা দিয়ে কোনোদিন সেটা জানতে পারেননি। প্রীতুর ভাইয়ের নাম রাখা হলো, রাইয়্যানার সাথে মিলিয়ে রাইয়্যান। আর প্রীতুর সাথে মিলিয়ে পরশ।
পরশের প্রতি সবার আদর যেমন বাড়তে লাগল তেমনি সমানুপাতিক ভাবে বাড়তে লাগল প্রীতুর প্রতি অবহেলা। ব্যতিক্রম ছিল রাহেলা আর তার শ্বশুর। এভাবেই একে একে দিন চলে যায়। রাহেলার শাশুড়ি দিনরাত পরামর্শ দিতে থাকেন ছেলেকে।
"আরে পরের মেয়েকে কেন মানুষ করবি বলতো! প্রীতু প্রীতু করে ওর মা আমার সোনা টুকরো পরশকেও সময় দিতে পারে না!"
মায়ের পরামর্শ এবার আর একেবারে ফেলনা মনে হয়না আসাদ শেখের।
প্রীতুর বয়স এখন ষোল। এবার এসএসসি দেবে। প্রীতুকে পরীক্ষা দেওয়ানোর ইচ্ছে একেবারেই ছিল না আসাদ শেখের। আবার বিয়ে দিতে চাইলে বাঁধা দেন রাহেলা আর রাহেলার শাশুড়ি।
রাহেলার ইচ্ছে, মেয়ে আরো বড় হোক। আর রাহেলার শাশুড়ির ইচ্ছে, "ওসব জঞ্জালের পিছনে টাকা খরচ কেন! আবার ছোটখাটো ভাবে বিয়ে দিলে সমাজের লোক অনেক কথা বলবে। তবুও ওর জন্য টাকা খরচ করা যাবে না, যা হয়েছে অনেক। ওকে কোথাও কারোর কাছে দিয়ে আয়, কাজ করে খাক।"
প্রস্তাবটা মন্দ লাগেনি আসাদ শেখের কাছে।
ব্যাধিই সংক্রামক স্বাস্থ্য নয়- মনীষীর এই কথাটা এখানে পুরোপুরি ভাবে মিলে যায়।
হাজার চেষ্টায় আসাদ শেখের মা যেমন তার স্বামীর ভালটা নিতে পারেননি, আসাদ শেখ ও রাহেলার ভালটুকু নিতে পারেননি। কিন্তু মায়ের থেকে খারাপ উদ্দেশ্যগুলো মনের গহিনে লেপন করতে পেরেছিলেন।
কিন্তু রাহেলার কান্নার জন্য প্রীতুকে বাড়িতে রাখতে বাধ্য হন।
কিন্তু হাল ছাড়েননি রাহেলার শাশুড়ি আর ননদ।
প্রীতু এসবের কিছুই জানতো না, বিশাল ছায়ার মতো এসব কলুষিত রোদ থেকে আলাদা করে রেখেছিল প্রীতুর মা।
দেখতে দেখতে প্রীতুর পরীক্ষা শেষ।
পড়াশোনা নেই, কেমন যেন মুক্ত মুক্ত লাগছে প্রীতুর।
বারান্দায় বসে আছে সে।
ভাইয়ের সাথে একটু খেলতে ইচ্ছে করছে, যা পাকা হয়েছে পরশ!
"সারাজীবন আমার থেকে আলাদা করব না সোনা ভাইটাকে"
নিজের মনেই একবার হাসলো প্রীতু। সেদিন প্রীতুর ইচ্ছে আর হাসি দেখে অন্তরীক্ষে মহান ভাগ্যরচয়িতা হেসেছিলেন কিনা জানিনা। কিন্তু তার পরের ঘটনাতে তাইই মনে হয়!
পরশকে নিতে বাবা মায়ের রুমের দিকে যেতে প্রীতু বাবার রূঢ় গলা শুনতে পেল,
"তোমার কথা শুনতে শুনতে এই পর্যন্ত, মা হয়েছো শখ মেটেনি?"
রাহেলা কোনো উত্তর দিচ্ছেন না। প্রীতু শুনলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
আসাদ শেখ থামলেন না, "প্রীতুকে আমি আমার বন্ধু জাফরের বাসায় রেখে আসব। আর এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত"
আসাদ শেখের কথা শুনে রাহেলা যেমন চমকে গেলেন তেমনি চমকে গেল দরজার বাইরে থাকা প্রীতু।
জাফর মোটেই সচ্চরিত্রবান নয়। বরং প্রচন্ড অসৎ। রাহেলা ধীরেধীরে উঠে এলেন রুমের বাইরে। উদ্দেশ্য শ্বশুরের কাছে একটু মিনতি করবেন। বাইরে বেরিয়ে প্রীতুকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে গেলেন তিনি। প্রীতুর চোখ ছলছল করছে।
"ঘরে যাও মা" খুব শান্ত স্বরে প্রীতুকে বললেন তিনি। তারপর শ্বশুরের রুমে যেতে যেতে নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টালেন।
শ্বশুর পাশে গিয়ে সব খুলে বললেন।কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন দুইজন। তারপর রাহেলা শান্ত অথচ দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
"প্রীতুকে আমি এখান থেকে পাঠিয়ে দিব"
চমকে গেলেন আবিদ শেখ, ভীত কন্ঠে বললেন,
"কোথায়?"
"বাবার বাড়িতে, অন্তত নিরাপদ থাকুক, জনমদুখী হতভাগীটা কপাল করে এসেছিল বাবা। আমি আর কি করব, আর কত! আজ বাদে কাল ওকে পাঠিয়ে দিবেই মা নয়তো আপনার ছেলে" কেঁদে ফেললেন রাহেলা।
কথাটা কতখানি সত্য তা অন্তরে খুব ভালভাবেই উপলব্ধি করছেন আবিদ শেখ। ধীরে ধীরে বললেন,
"মা দেখো কি করবে! আমার হাতে কিছুই নেই পারলে তোমার কোল থেকে তোমার মেয়েকে নিতে দিতাম না।"
রাহেলা বেগমের চোখ ছলছল করে উঠল, "জানি বাবা, দোয়া করেন আমার প্রীতুর যেন কিছু না হয়, ও যেন অনেক বড় হয়"
আবার কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন তিনি। শুনেছি "নীরবতা হিরন্ময়" নাকি! এই ক্ষেত্রে কথাটা কত বড় মিথ্যা তা এই নিস্তব্ধতার মাঝে কিছুক্ষণ বসে থাকলেই উপলব্ধি করা যায়।
তারপর চোখের পানি আর নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে রাহেলা খুব আস্তে আস্তে এগোলেন প্রীতুর রুমের দিকে। কিন্তু পা দুটো উঠতে চাইছে না তার, যেন চোরাবালিতে আটকে গেছে।
প্রীতু রুমে নেই! বুকটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো তার!
রাহেলা বারান্দায় গিয়ে দেখেন প্রীতু দাঁড়িয়ে। ছোট্ট একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন যেটা প্রীতুর কান পর্যন্ত পৌঁছালো না। নরম সুরে ডাকলেন,
"মামনি.."
"বলো মা" না তাকিয়েই উত্তর দিল প্রীতু। গভীর ভাবনায় ডুবে আছে সে।
"তোকে পালাতে হবে, চলে যেতে হবে তোকে" কোনো ভূমিকা না করেই বললেন রাহেলা।
"কিহ!" প্রীতু চমকে গেল মায়ের কথায়!
প্রীতুর চমকে ওঠা রাহেলার অন্তরে কতটা বেজেছিল সে রাহেলাই জানেন। তবুও সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে রাহেলা আবার বললেন,
"তোর সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো গুছিয়ে নিবি। তবে ব্যাগ ভারী করে ফেলিস না, তাতে তোরই কষ্ট বাড়বে, সকালে তৈরি থাকিস"
মায়ের শান্ত অথচ আশ্চর্য দৃঢ় কন্ঠ শুনে প্রীতু বজ্রাহত পথিকের মতো দাঁড়িয়ে রইল। এই মায়ের সাথে তার পরিচয় ঘটেনি।
কি বলবে কিচ্ছু ভেবে পাচ্ছে না। তার কি কিছু বলা উচিত?
তাকিয়ে দেখে মা চলে গেছে।
বারান্দা থেকে বাগানের কামিনী ফুলের গাছটা চোখে পড়ছে তার। ফুলে ফুলে ভরে আছে গাছটা। বারান্দা থেকেও মৃদু ঘ্রান পাচ্ছে প্রীতু, কি সুন্দর মিষ্টি সেই ঘ্রাণ!
.
ডায়েরিটা বন্ধ করলো প্রীতু। চোখ বন্ধ করে বসে রইল কিছুক্ষণ!
সারাজীবন যাকে বাবা বলে জেনে এসেছে সে তার বাবা নয়!
তার মা তার নিজের মা নয়? ভাবতে ভাবতে কান্নায় ভেঙে পড়ল প্রীতু! কেন এমন হলো তার সাথে!
তার বাবা একজন ধর্ষক! নিজের দিকে তাকিয়ে ঘৃণা হচ্ছে তার।
ছিঃ! একজন ধর্ষকের রক্ত বইছে তার শরীরে! প্রচন্ড কাঁদছে প্রীতু, এ কান্না কে থামাবে! "স্রষ্টা! এমন কি কোনো উপায় নেই যাতে আমি আমার নিজেকে নিঃশেষ করে পারতাম! আমার শরীরের রক্ত পরিবর্তন করে দিতে পারতাম!"
বেশ কিছুক্ষণ পর নিজেকে একটু শান্ত করল প্রীতু।
মায়ের কথা অনুযায়ী চিঠিটা খুলল। না জানি আর কত ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য!
"প্রিয় প্রীতু সোনা"
চিঠি পড়তে শুরু করল প্রীতু..
.
(চলবে)
©somewhere in net ltd.