নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

Noyontara Natasha

Noyontara Natasha › বিস্তারিত পোস্টঃ

এটা গল্প হলেও পারতো(৪র্থ পরিচ্ছেদ)

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সকাল ৭:১৩

এটা গল্প হলেও পারতো
নয়নতারা
৪র্থ পরিচ্ছেদ


প্রীতু চিঠি পড়তে থাকল,
"ডায়েরি পড়ে সবটাই জেনে গেছিস।
তুই জীবনের যে প্রান্তে আছিস, সেখানে না থাকলে কেউই বুঝবে না তোর কষ্টটা। মা তোর জীবনের শুরু হয়েছিল এক ভুল দিয়ে কিন্তু তুই ভুল না। জেনে রাখিস তোকে এই পৃথিবীর প্রয়োজন বলেই স্রষ্টা তোকে পাঠিয়েছেন পৃথিবীতে। ডায়েরিটা পড়ার পর তোর আত্মহত্যার কথা মনে এসেছে আমি জানি, কিন্তু মা ভুলেও ওই পথে পা বাড়াস না। এ এমন এক মহাপাপ, মৃত্যুতেও যে পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয় না। প্রীতু তুই তো গল্পপ্রেমী, সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন পড়েছিস তো?
মনে আছে ওই দীপাবলীর কথা... পথ তুমি কার.... উত্তরটা কি ছিল বলতো মা? পথিকের!
পথটা কে তৈরি করে দিলো তোর জানার প্রয়োজন নেই।
তুই পথিক! পথ তোর, তাই তুই পথ চলবি!
প্রীতু সবার জীবনের শুরুটা সুন্দরভাবে হয়না। আমি তোকে আপাতত তোর মামা বাড়িতে পাঠাচ্ছি, তবে সেখানে ঠিক কতদিন থাকতে পারবি জানিনা।
প্রীতু আমি তোর জন্মদাত্রী মা নই, তোকে পেটে ধরিনি। কিন্তু তুই আমাকেই প্রথম মা ডেকেছিস আর মাতৃত্বের স্বাদ আমি তোর থেকেই পেয়েছি। তাই কখনো তোর মায়ের জায়গা থেকে আমাকে সরিয়ে দিস না মা!
সোনা আমার!
আমি জানি তোর খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমার যে কিছুই করার ছিল না রে মা! তোর মোবাইলে একটা নাম্বার আছে, আমিই তোকে কল করব তুই না। আর যদি না কল করি না, তুই ভাবিস না। তুই ভাবছিস তোর জীবনটা ধ্বংস হয়ে গেল। কিন্তু না! তোকে পারতেই হবে!
প্রীতু আল্লাহ কারোর উপর তার সাধ্যতীত বোঝা চাপিয়ে দেন না। তাই তুই সামলে নিতে পারবি।
প্রীতু জীবনে সবকিছুরই অর্থ আছে। তবে তার ভুল অর্থ খুঁজে বের করবি না। মরীচিকাও মিথ্যে নয়! কিন্তু মানুষ মরীচিকাকে পানি ভেবে ভুল অর্থ তৈরি করে সেটাই মিথ্যে।
চলার পথে এক মূহুর্তের জন্য থেমে থাকিস না।
পৃথিবী থেমে যাওয়া ব্যর্থ মানুষদের কথা মনে রাখে না। জীবনে সেটাই করিস যেটা তোর মন নয় বিবেক করতে বলে।
ভাল থাকিস, আল্লাহর ভরসায় তোকে ছেড়ে দিলাম।
তোর মা।

পুনশ্চঃ চিঠির সাথে আরেকটা ছোট কাগজে তোর নানাবাড়ির ঠিকানা আছে, চাইলে যেতে পারিস। কিন্তু এখন যাবি নাকি কয়েকবছর পরে যাবি তুই ঠিক করিস মা!"

মায়ের চিঠিটা বন্ধ করে ডায়েরিসহ চিঠিটা ব্যাগের ভিতর রাখল।
জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। একটু পরেই হাসবে সূর্য, সাথে রক্তিম লাল আলো।
প্রীতু দরজা খুলে বাইরে বের হলো। অনেকদিন পর খালি পায়ে ঘাসের উপর জমে থাকা শিশিরের উপর পা দিয়ে হাঁটতে লাগল।
শিশিরকণা ধুইয়ে দিতে লাগল প্রীতুর সুন্দর পা দুটো। মামা বাড়ি থেকে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর চলে এসেছে। নিজেকে আর শান্ত রাখতে পারলো না প্রীতু।
ভেজা ঘাসের উপর বসেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল সে। মুক্তোর মতো অশ্রু ঝরতে লাগল দুইচোখ দিয়ে।
আজ অনেক অভিমান ওই চোখের অশ্রুতে।
এই মূহুর্তে প্রীতুর মনে হচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে শরীরের সব শক্তি নিঃশেষ করে দিতে পারত।
.
"প্রীতুকে দেখছি না যে?"
"বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি" শান্ত কন্ঠে বললেন রাহেলা।
"মানেহ!" টেবিলে জোরে চড় মারলেন আসাদ শেখ।
"মানে এখন তো আর তোমাকে ওর খরচ টানতে হবে না, আর আমি ওকে কাছে আনতেও চাইব না"
খাওয়া ফেলে উঠে গেলেন আসাদ শেখ।
রাহেলা ও কোনো দ্বিরুক্তি করলেন না। বিন্দুমাত্র ভাল লাগছে না কোনোকিছুই! মেয়েটা কেমন আছে, কি করছে! ধীরে ধীরে উঠে শুয়ে পড়লেন তিনি। এমন সময় পরশ কেঁদে উঠল।
তাকে থামাকে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন রাহেলা।
"কি ব্যাপার আসাদ?"
আসাদের চিন্তিত মুখের দিকে তাকালেন তিনি।
"প্রীতুকে ওর মা নানাবাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে"
ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড রেগে গেলেন জাফর। কিন্তু বাইরে সামলে নিলেন,
"দেখ আসাদ তোকে তো বললাম ওই মেয়েকে আমাকে দে, তোর ভাবির কাজের লোক লাগবে, আর তুই যে ষাট হাজার টাকা নিয়েছিস সেটা দিতে হবেনা"
আসাদ শেখ তাকালেন জাফরের মুখের দিকে।
কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গীতে জাফর বলে, "আহা ভাল থাকবে তো, আর একটা পাগলীর মেয়ের জন্য এত মায়া করে কি হবে! কম তো করিসনি" অদ্ভুত নিষ্ঠুর ব্যাখ্যা দিলেন জাফর।
আসাদ শেখ যে প্রচন্ড খারাপ লোক সেটা বললে সত্যের অপলাপ করা হবে। কিন্তু চারপাশের স্বার্থপর মানুষগুলো আসাদ শেখকে আরো বেশি খারাপ করে দিয়ে দিয়েছে। তিনি মনে মনে জাফরের কথাই সমর্থন করলেন। কিন্তু মুখে বললেন,
"থাক না! ওর মা ওকে ছাড়তে চাইছে না, থাকগে পড়ে, তোর টাকাটা আমার দিতে তো কষ্ট হবেনা!"
জাফর ভিতরে ভিতরে একটা ক্রুর হাসি হেসে বললেন, "বেশ কিন্তু ভেবে দেখ নিজের কষ্টের টাকা কত খরচ করেছিস! এখনো..." বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
তারপর কপট মায়া দেখিয়ে বললেন, "আমি তোর বন্ধু বলেই বলছি, আচ্ছা এখন না হয় থাক!"
ঠিক সেই মুহূর্তে দুজনের মানসপটেই প্রীতু অবয়বটা ফুটে উঠল। শুধু তাদের উদ্দেশ্যটা ভিন্ন ছিল!
বেশ কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করার পর প্রীতুর মনে হচ্ছে বুকের ভিতরটা হালকা হয়ে গেছে। খুব ক্লান্ত লাগছে, পা তুলে হাঁটতে ইচ্ছে করছে না।
এই সুন্দর একটা সকাল প্রীতুকে স্পর্শ করতে পারছে না। সব কিছু বিষাক্ত লাগছে!
আজ সমগ্র পুরুষজাতিকেই প্রীতু স্বার্থপর, লোভী আর হিংস্র মনে হচ্ছে। এতে প্রীতুর কি দোষ!
মেয়েদের জন্মের পর প্রথম পুরুষ হয় বাবা, কিন্তু প্রীতুর বাবা!
তারপর আসাদ শেখ, কিন্তু সেও আজ স্বার্থের নেশায় অন্ধ!
প্রীতুর মনে হচ্ছে মা ছাড়া সবাই তাকে ব্যবহার করেছে। তার সন্তান ছিল না তাকে এনেছে আর পরে চাহিদা পূরণ হয়েছে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। আর ভাবতে পারেনা প্রীতু!
ধীরে ধীরে বাড়িতে ঢুকে দেখে তখনো সবাই ঘুমাচ্ছে। রুমে গিয়ে প্রীতু মোবাইলটা অন করল। মোবাইলটা খুব সুন্দর, কিন্তু প্রত্যেকটা সুন্দর পরিবর্তিত হয়ে কালো ছায়ার রূপ নিয়ে প্রীতুর উপর পড়ছে আর সেই আতঙ্কে সরে যাচ্ছে!
"প্রীতু, উঠেছিস?"
"হ্যাঁ মামি" ছোট মামির ডাকে উত্তরে বলল প্রীতু।
"উঠে আয়, খেয়ে নে"
প্রীতুর ছোট মামি বেশ রূপবতী। দরজা খুলে বাইরে এসে বলল,
"মামি আমার রাতে একদম ঘুম হয়নি, একটু ঘুমিয়ে নিই?"
প্রীতুর লাল চোখ দেখে ওর মামি সত্যি বলেই বিশ্বাস করলেন।
"কেন ঘুম হয়নি কেন?"
"তাতো জানিনা মামি" মৃদু হেসে উত্তর দিল প্রীতু।
মামি চলে গেলে আবার বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল।
আসার সময় নিজের ল্যাপটপটা আনতে ভোলেনি প্রীতু। তার মোবাইল ছিল না কিন্তু ল্যাপটপ ছিল। কে জানে বাকি জীবনটা কোথায় কাটবে!
ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেল সে।
এরই মাঝে এক সপ্তাহ কেটে গেছে।
প্রীতুর কোনো সমস্যা হয়নি এর মাঝে। শুধু মায়ের সাথেই কোনো যোগাযোগ নেই।
সকাল সন্ধ্যায় মামাতো ভাইবোনদের পড়ায়, বাকি সময়টা ল্যাপটপ মোবাইল নিয়ে থাকে কিংবা ঘুমায়। কিছু ভাবতে ইচ্ছে করে না ওর, ভাবলেই অস্বস্তি শুরু হয়।
কোনো সমস্যা হচ্ছে না ভেবেই প্রীতু মনে মনে ঠিক করল এখানকার কলেজেই ভর্তি হবে।
কিন্তু ভাগ্য কি আর সবসময় সঙ্গ দেয়! প্রীতু ঠিক যে মূহুর্ত থেকে একটুখানি ঠিক হয়েছে তখনই প্রীতুর মামিরা জানতে পারল প্রীতু বেড়াতে নয় তাদের ঘাড়ের বোঝা হয়ে এসেছে।
রাহেলা খুব ভয়ে ছিলেন, আসাদ শেখ কবে না সেখানে হাজির হয়, তাই তার ভাবিদের বারবার অনুরোধ করেলেন প্রীতু ভাল রাখতে।
আগেই বলেছি স্বভাবে হোক বা অবস্থা বৈগুণ্যে হোক স্বার্থই এদের কাছে প্রধান, সমালোচনাই উপভোগ্য!
শুরু হলো অত্যাচার! কে কত খাটিয়ে নিতে পারে! বসিয়ে বসি৫য়ে খাওয়াবে কে! তার চেয়ে কাজ করিয়ে যতটুকু পুষিয়ে নেওয়া যায়। বিলাসিতায় মানুষ প্রীতু টুকটাক কাজ শিখেছে মায়ের কাছে, লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকার জন্য হোক আর ধনী পরিবারের একজন হয়ে থাকার জন্য হোক, বেশ কিছুটা অপটু প্রীতু।
প্রীতু অবস্থাটা একটা ঘটনা দিয়ে খুব ভালভাবে বোঝা যায়,
মেজ মামির রান্না ঘরে বসে তরকারি কাটছে প্রীতু! পাশের রান্নাঘর থেকে ঝংকার দিয়ে উঠল তার বড় মামি,
"কিনে রেখেছে, মেয়েরে ওরা কিনে রেখেছে, সারাদিন অসুস্থ শরীর নিয়ে খাটতে খাটতে হাড়মাস কালি হয়ে গেল!" কিছুক্ষণ আগেই যে প্রীতু তার সব ঘরবাড়ি মুছে দিয়ে এসেছে এটা তিনি খুব সাবধানতার সাথে ভুলে গেলেন।
মেজ বউ বা কমে ছাড়বে কেন!
"রাতভর দিনভর তোমার কাছেই তো থাকে ভাবি! তাও তোমায় পোষায় না?"
"মেজ বউ বুঝে কথা বলবি" তেড়ে এলো প্রীতুর বড় মামি।
প্রীতু শুধু অবাক হয় এরা কারা! মামারাও কিছু বলে না৷ কি দরকার পরের জন্য নিজেদের সংসারে শান্তি নষ্ট করার! নিজের বোনের মেয়ে তো নয়!
রাগ হলে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যান প্রীতুর মেজ মামি।
হঠাৎ প্রীতুর মেজ মামি বটিতে বসে থাকা প্রীতুর মাথা চেপে দুবার ঝাঁকিয়ে বললেন,
"এই শয়তানটার জন্য এত কিছু, তোর এখনো এইকয়টা তরকারি কাটা হয়নি!"
আচমকা আক্রমণে হতবিহ্বল হয়ে গেল প্রীতু। বটিতে অনেকখানি হাত কেটে গেল।
এই পর্যন্ত কেউ তার গায়ে হাত তোলেনি। বিস্ময়ে সে কাঁদতে পর্যন্ত ভুলে গেল। বিপদ বুঝে সরে গেলেন প্রীতু বড় মামি।
রাগে প্রীতুর হাত কেটে যাওয়াটাও অসহ্য লাগলো মেজ মামির।
বটি থেকে তুলে চুল ধরে মেঝেতে ধাক্কা দিল,
"হতভাগী জারজ সন্তান কোথাকার! মরতে আসে সব! কোথা থেকে এসে জুটে! মরিস না কেন তুই! তোর জায়গায় আমি হলে গলায় দড়ি দিতাম! আ মরন!"
নির্বাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল প্রীতু!
সকাল থেকে অভুক্ত প্রীতু। শক্তি হচ্ছে না মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ানোর।
আজ হাতে ক্ষত হয়ে যত বেশি রক্ত ঝরছে তার থেকে বেশি ক্ষত বিক্ষত হয়েছে প্রীতুর বুকের ভিতরটা!


(চলবে)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.