![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এটা গল্প হলেও পারতো
নয়নতারা
৫ম পরিচ্ছেদ
মেজ মামির চিৎকার শুনে ছুটে আসে প্রীতুর ছোট মামি।
কিছু না বলে প্রীতুকে মেঝে থেকে উঠিয়ে ঘরে নিয়ে যায়। খারাপ ব্যবহার করলেও অন্যসবার থেকে তুলনামূলক একটু ভাল ব্যবহার করে প্রীতুর ছোট মামি। প্রীতুকে নিয়ে হাতে একটা কাপড় বেঁধে দিয়ে শুইয়ে দেয়।
তারপর নিজের মনেই গজগজ করতে থাকে প্রীতুর ছোট মামি মারিয়া।
"যে রাজ কপাল নিয়ে জন্মেছে, মার তো খেতেই হবে! ছেলে হলে এক উপায় ছিল, পথে পথে ঘুরলেও কাজ হতো, আর যে রূপ নিয়ে উনি জন্মেছেন অমানুষের দল সব হা করে আছে"
প্রীতুর কানে এসব ঢুকছে না। আগে বুঝতে না পারলেও এখন হাতের ব্যথাটা খুব টের পাচ্ছে।
"তোর তো মানুষের বাড়ি কাজ ও জুটবে না, শয়তানের দল ছিঁড়ে খাবে!" প্রীতুর গায়ে কাঁথা টেনে দিতে দিতে বললেন মারিয়া। মামির কথায় চমকে উঠল প্রীতু।
সঙ্গে সঙ্গে গর্ভধারিণী মায়ের পরিণতির কথা মনে পড়ল। আতঙ্কে একেবারে চুপসে গেল ও।
চুপচাপ পাশ ফিরে শুয়ে রইল প্রীতু। মন চলে গেছে বহুদূর!
"লামিয়া ঘুমিয়েছে, তোর পাশে রেখে গেলাম। আমি কাজ করব"
প্রীতুর পাশে মেয়েকে শুইয়ে দিয়ে গেলেন মারিয়া।
সেদিন দুপুর গড়িয়ে গেলেও আর কেউ খেতে ডাকল না প্রীতুকে। হাতের ব্যথায় আর ক্ষুধায় বিছানায় কাতরাতে লাগল প্রীতু। কিন্তু সাহস হলো না কাউকে ডাকে। মনে মনে আল্লাহকে ডেকে কাঁদতে লাগল ও। এভাবেই আধপেটা খেয়ে না খেয়ে, মার খেয়ে আর গাধার খাটনি করে প্রীতুর দিন কাটতে লাগল।
প্রথম দিকে রাহেলা খোঁজ নিতেন এখন তাও পারেন না। শেষবার লুকিয়ে দশ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন। সেই শেষ। নিজের অত্যাচারের কথা কখনো জানায়নি প্রীতু। কি হবে মানুষটার কষ্ট বাড়িয়ে? পরশের কথা খুব মনে। খুব কষ্ট হলে মাঝরাতে ল্যাপটপ খুলে সবার ছবি গুলো দেখে। যদি এবাড়ির কেউ যদি জানতে পারে প্রীতুকে কারেন্ট বিলের অজুহাতে মার খেতে হবে।
অনেক দিন পর দিনের বেলায় ল্যাপটপ ওপেন করেছে প্রীতু।
কারণ আজ প্রীতুর রেজাল্ট দিবে! কাঁপা কাঁপা হাতে ইন্টারনেট থেকে রেজাল্ট বের করল প্রীতু। দেখে চোখে পানি চলে এলো তার। প্রীতু গোল্ডেন এ+ পেয়েছে! আজ প্রচন্ড খুশি সে।
অনেকদিন যাবত খুশি নামক বিষয়টার সাথে দেখা হয়নি তার। এ যেন প্রচন্ড তপ্ত মরুভূমির মাঝে একফোঁটা পানি, মূহুর্তের মাঝে শুষে নেয়!
সন্ধ্যা বেলা প্রীতু বড় মামার ঘরে যায়, মামা টিভি দেখছে। প্রীতুর দিকে তাকালেন একবার তারপর চোখ ফিরিয়ে আবার টিভি দেখতে লাগলেন। বিশেষ কোনো গুরুত্ব দিলেন বলে মনে হলোনা।
"মামা আমি গোল্ডেন এ+ পেয়েছি!"
"ও" কোনো আগ্রহ দেখালেন না তিনি।
"মামা আমি পড়তে চাই" ভয়ে ভয়ে বলল প্রীতু।
"কি বললি?" সরু চোখে তাকালেন প্রীতুর মামা।
"আমি পড়াশোনা করব" আবার বলে প্রীতু।
প্রচন্ড জোরে ধমক দেয় প্রীতুর মামা। তারপর মুখ ভেঙিয়ে বলতে থাকেন, "পড়তে চাই! শখ কত! পড়তে চাস তো টাকা কি তোর বাপ দেবে?"
ধমক খেয়ে দমে গেল না প্রীতু। বলল,
"মামা আমি টিউশনি করব"
এবার আরো জোরে ধমক দিল মামা। এরই মাঝে পুরো বাড়ির সবাই ছুটে আসে। বড় মামা বলতে থাকেন,
"আসছেন আমার বিদ্যেধরী, টিউশনি করাবেন, দু'কলম পড়েই আমি টিউশনি করব! আপন জ্ঞাতিভাই আপন হয়না আর এ কোথায় কে! মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টাকা কামাই করি, আর যত জঞ্জাল টেনে ঘরে তুলতে হচ্ছে, গোল্ডেন, হুহ!"
এই মামাই আবার জেলার "পথশিশুর পাশে" নামক সংগঠনের সম্পাদক। সপ্তাহে সপ্তাহে যিনি গলা ফাটিয়ে বক্তৃতা দেন!
প্রীতুর রেজাল্ট যে খুব ভাল এ সবাই বুঝতে পারে। তাদের গ্রামের স্কুলে টেনেটুনে এ গ্রেড পায় না কেউ! কিন্তু সবাই যখন নিচু এই মেয়ে এত ভাল রেজাল্ট করবে এটা আর যেই মেনে নিতে পারুক প্রীতুর আশেপাশের এই মানুষগুলো হজম করতে তো পারবেই না বরং বদহজম হবে।
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল প্রীতু। কেউ কোনো কথা বলছে না। বিনে পয়সার গালি, মার আর উপদেশ নিত্য জোটে প্রীতুর। রেজাল্ট শুনে সবার মন সায় দিচ্ছে কিন্তু টাকার বেলায় সব নিরব।
প্রীতু আর কোনো কথা বলল না। আস্তে আস্তে নিজের রুমে চলে এলো। আজ সারাদিনের খুশিটা এক নিমেষে বিষাদের পরিনত হলো ওর।
সময় মানুষকে কত রকম পরিস্থিতির মাঝে ফেলে দেয়!
প্রচন্ড কাঁদছে প্রীতু। প্রচন্ড!
"আমি কেন মারা যাচ্ছি না! কেন!"
ঠিক তখনই প্রীতুর মোবাইলে কল এলো,
সালাম দিতেই প্রীতু শুনতে পেল সেই চিরচেনা কন্ঠ!
"মা!" আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে প্রীতু।
রাহেলা কি বলে থামাবেন কিছু খুঁজে পেলেন না৷ প্রীতু কাঁদতে কাঁদতে বলে,
"মা আমাকে নিয়ে যাও, এত অপমান এত মার আমি আর সহ্য করতে পারছি না"
চমকে উঠলেন রাহেলা! কখনো মেয়ের গায়ে কোনো আঁচড় দেননি তিনি,
"ওরা তোর গায়ে হাত দিয়েছ?"
"মা কেউ না কেউ রোজ মারে কারণে অকারণে, আমি আর পারছি না, আমি আর পারছিনা" আজ আর নিজেকে সামলাতে পারে না প্রীতু।
রাহেলা কি করবেন, কি বলবেন, কি বললে মেয়ে স্বান্তনা পাবে বুঝতে পারছেন না তিনি।
আসাদ শেখের এক ব্যবসায় লস হয়েছে। জাফরের টাকা আর নতুন করে ব্যবসার টাকা দিতে নারাজ তিনি। প্রীতুকে জাফরের বাসায়ই কাজ করতে দেবেন।
আর তাই রাহেলাকে বলেছেন পরশু প্রীতুকে আনতে যাবেন তিনি। এ কথা ভাবতেই জাফরের মুখ ভেসে উঠে রাহেলার চোখে। কি বিশ্রি লোকটা, কখনোই ভাল মানুষ বলে মনে হয়না তার।
ফোনের ওইপাশে তখনো কাঁদছে প্রীতু। খুব নরম স্বরে ডাকলেন,
"রাইয়্যানা আম্মু?"
"আম্মু আমি গোল্ডেন পেয়েছি" কাঁদতে কাঁদতে বলে প্রীতু।
"শুনেছি আর তাই বলছি থামলে হবে না"
"কিন্তু মা এরা আমাকে পড়তে দিবে না।"
"পালা ওখান থেকে, তোর বাবা নিতে যাবে তোকে, তার আগেই পালিয়ে যা প্রীতু, তোর নিজের মায়ের মত সর্বনাশ হওয়ার আগে পালিয়ে যা মা!" কেঁদে ফেললেন রাহেলা।
প্রীতুর আর কিছু বলার শক্তি পেল না। জানতেও চাইল না কোথায় পালাবে! মুখটা রক্তশূন্য হয়ে গেল ওর। এই মূহুর্তে প্রীতুর মনে হচ্ছে বিশাল সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে সে।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল দুজনেই। রাহেলা কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বললেন,
"মা শোন, তুই আজ রাতে না পারলেও কাল সকালের আগে যেকোনো সময় পালাবি। তোর কাছে টাকা তো আছে, মেয়েদের হোস্টেল আছে, দূরে কোনো কলেজে ভর্তি হয়ে যা, কাজটা কঠিন, মা তুই হাল ছেড়ে দিস না৷ তোর নিজের নানাবাড়িতেও এখন তোকে বিদ্রুপ করবে সবাই, কারণ তোর সময়টাই এমন।
আর তুই তো ভাল ছাত্রী তোর কোনো সমস্যা হবে না।"
"মা আমি একা..." অসহায় ভাবে বলল প্রীতু।
"প্রীতু! তোকে পারতেই হবে! তোকে আমি নিঃস্ব করে পাঠায়নি। তোর কাছে টাকা আছে! তোর বাবার ব্যবসায় লস হয়েছে, জাফর তোকে চায়, আর তোর বাবাও মাতাল হয়ে গেছে। এখন তোকে পেলে কি হবে জানিস তুই!" রূঢ় স্বরে একটানা কথা বললেন রাহেলা।
তারপর আবার বললেন,
"তোর গহনা গুলোও দিতাম, কিন্তু তুই হারিয়ে ফেলিস কিনা! আমি বেঁচে থাকলে আর যদি আগলে রাখতে পারি তো পাবি সব, জানি তোর বয়স কম, কিন্তু আমি এত ঝুঁকি নিচ্ছি আর তুই.. তোকে পালাতেই হবে!" রূঢ়ভাবে কথা বলতে প্রচন্ড খারাপ লাগছে রাহেলার। কিন্তু উপায় নেই!
আবার বললেন,
"আমি আছি তো যতটা পারি! আমি যদি আর ফোন না করি তবুও ভাবিস না। আমার দোয়া তোর জন্য! আল্লাহর কাছে ছেড়ে দিলাম তোকে"
"বলো কি করতে হবে?" চোখ মুছে বলল প্রীতু।
"পালিয়ে যা"
"কোথায় যাব?" নিষ্প্রাণ কন্ঠে প্রশ্ন করে প্রীতু।
"রাজশাহীর দিকে বা খুলনার দিকে যা, আর ট্রেনে যাবি আর...."
আরো কিছু বলার ইচ্ছে থাকলেও আসাদ শেখ কে দেখে তাড়াতাড়ি ফোন রেখে দিলেন রাহেলা। প্রীতুকে না পেলে তার উপর যে কি দুর্যোগ নেমে আসবে তা তার অগোচরে নেই।
মায়ের ফোন রেখে প্রীতু নিজের সুটকেসটা দ্রুত গুছিয়ে নিলো। প্ল্যান করে নিলো কিভাবে পালাতে হবে।
তারপর ঘুমিয়ে গেল সে।
ঠিক রাত সাড়ে তিনটে বাজে। গরমের দিন। ভোর হতে বেশি সময় লাগবে না।
বালিশের তলায় রাখা ফোনের মৃদু এলার্মের শব্দে দ্রুত উঠে পড়ে প্রীতু। ঘরে রাখা পানিতেই জানালা দিয়ে কোনো রকম হাত মুখ ধুয়ে নেয়। ব্যাগ গুলো নিয়ে সোজা ছাদে চলে যায়।
যাওয়ার পথে নিয়ে নেয় বারান্দায় মেলে দেওয়া মামিদের তিনটা শাড়ি। কাজগুলো খুব দ্রুত করে। একমাত্র ছাদের দরজাতেই তালা মারা নেই। প্রচন্ড বুক কাঁপছে প্রীতুর!
ছাদে গিয়ে হঠাৎ মনে হয় মোবাইল আনেনি।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে বাথরুমের লাইট জ্বলতে দেখে ভয় পেয়ে আবার ছাদে উঠে যায়।
হাতঘড়িতে তখন তিনটা পঁয়তাল্লিশ বাজে। ছাদে বসে না থেকে আবার খুব নিশব্দে শাড়ি তিনটার প্রান্তে প্রান্তে গিট দেয় লম্বা করে নেয়। তারপর চিলেকোঠার একটা পিলারের সাথে বেঁধে নেয় শাড়িটাকে। শক্ত করে বাঁধে, আপাতত তার জীবনের সিঁড়ি!
তারপর আবার নিচে আসে প্রীতু, খুব সন্তর্পণে মোবাইলটা নিয়ে নেয়।
বুকের ভিতর কে যেন হাতুড়ি পিটাচ্ছে।
ছাদে গিয়ে প্রথমে ব্যাগটাকে শাড়ির শেষ প্রান্তের সাথে বেঁধে আস্তে আস্তে নিচে নামিয়ে দেয়। তারপর ছাদের দরজাটা বাইরে থেকে ঠেলে দিয়ে আস্তে আস্তে ছাদের কার্নিশে পা রাখল প্রীতু, কিন্তু কার্নিশ থেকে হঠাৎ মাথা ঘুরে পা টলে গেল প্রীতুর!
.
(চলবে)
©somewhere in net ltd.