![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এটা গল্প হলেও পারতো
নয়নতারা
১১ তম পরিচ্ছেদ
প্রীতুর আজ অনেক কথাই মনে হচ্ছে। সে কি পাপ করেছে! হোস্টেলের রুমে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছে প্রীতু, বুকের ভিতর উথালপাতাল করা কান্না! কাঁদুক!
কান্না ছাড়া কি করবে ও!
তবে ফায়াজ সাহেব প্রীতুকে একেবারে রাস্তায় রেখে আসেননি, সবার অগোচরে গিয়ে একটা ব্যবস্থা করে এসেছিলেন তিনি। প্রীতুর কলেজ থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট পাঠিয়ে দিলেন বড় একটা কলেজে, রেখে এলেন কলেজ হোস্টেলে। একমাত্র জাহিনই জানতে পারল এসব, সে প্রীতুকে যথার্থই ভালবাসত, এখন ঠিক ততটাই ঘৃণা করে জারিফকে!
জাহিন জানতো প্রীতু আর জারিফের কথা।
অচেনা জায়গার সাথে মানিয়ে নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে গেছে সে!
প্রীতু ইদানিং বড্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে, চোখের প্রদীপ্ত আলো কালো দাগের মাঝে লুকিয়ে গেছে। খাওয়া গোসল পড়াশোনা কোনো কিছুই ভাল লাগে না তার। দুর্বিষহ জীবন!
অনেকবার গিয়েছে আত্মহত্যা করবে, কিন্তু পারেনি।
একবার ভেবেছে ফিরে যাবে নানাবাড়িতে, কিন্তু ঠিকানাটা খুঁজে পায়নি, আবছা মনে আছে, কিন্তু সেখানে গিয়ে হবে তাদের বোঝা বাড়ানো ছাড়া! মা!...
এই ছোট্ট একটা "মা" নামক শব্দটি প্রীতুকে প্রাণ হারাতে দেয় না।
কিন্তু জারিফের কথা মনে হলে আর নিজেকে সামলাতে পারে না।
দুঃখ কষ্ট সুখ আনন্দ কোনোকিছুই জীবনকে থামাতে পারে না যদি না সে নিজে থেমে যায়! কয়েকমাস পর,
এভাবেই একঘেয়েমি জীবন কাটছিল তার। যত বড় দুঃখই হোক না কেন ধীরে ধীরে তা তিরোহিত হয়ে যায়, কারণ তখন তা মানুষের সহ্য ক্ষমতার ভিতরে চলে আসে।
প্রীতুর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। জারিফকে সে এখন শুধু একটা 'ভালবাসার ফাঁদ' মনে করে। তবে মনের গহিনে কি ছিল তা প্রীতুই জানে!
তবে এতকিছুর মাঝেও প্রীতু ভালবাসতে ভোলেনি।
আজও প্রীতু ভালবাসতে ভালবাসে।
ক্লাসে বসে আছে প্রীতু। কিন্তু আজ ক্লাস করতে একেবারেই ভাল লাগছে না। অবশ্য এখন অফ ক্লাস।
ব্যাগ থেকে নিজের পছন্দের ডায়েরি টা বের করল.... তারপর লিখতে শুরু করল,
"আমার আমিতে আমি আমিময়... আমিত্ব নিয়ে বড়াই করার দুঃসাহস আমার নেই...... জানিনা... দিনশেষে অপ্রয়োজনীয়দের তালিকাভুক্ত হব কিনা... তবে সত্যি বলতে ভালবাসা আর বিশ্বাসের প্রতি সাহস হারালেও আমি ভালবাসতে ভালবাসি, বিশ্বাস করতে ভালবাসি... অবিশ্বাস করতেই ভয় পাই...
কারণ বঞ্চিত হয়েছি যেসব কিছু থেকে সেগুলোর উপর দোষারোপ করলে বিশ্বাসযোগ্য কিছুই পাবো না!!!
রাইয়্যানা প্রীতু"
এতটুকু লিখে বাইরে তাকিয়ে রইল প্রীতু। এই মূহুর্তে প্রীতুর মনে হচ্ছে, একটু যদি মাথায় হাত রাখতো কেউ! একটু!
ছলছল করে উঠে প্রীতুর চোখ। ওখান থেকে উঠে আরেকটা ফাঁকা রুমে গিয়ে বসে ও। আজ খুব বেশি মনে পড়ছে সবার কথা!
মা, দাদু, পরশ কি স্নিগ্ধ সেই প্রিয় মুখগুলো, তারপর ফায়াজ, তানিয়া, জাহিন আর সবশেষে জারিফ!
বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে ওর। আচ্ছা ওর জীবনে কি কখনোই আলোর মুখ দেখবে না! এ কি জীবন তার!
একটু ভালবাসা তো প্রত্যাশা করতেই পারে! আবার ডায়েরি বের করে লিখতে শুরু করল প্রীতু,
"কোনো এক অজানা অচেনা ভালবাসার উদ্দেশ্যে.......
প্রচন্ড মেঘের মাঝে হালকা রোদ্রের খেলা দেখেছ কখনো? আর রঙটা? ভালবাসবে আমায়? প্রকৃতির ওই অপরূপ রঙের মতো?
তোমার ভালবাসার সাথে আমার ভালবাসা মিশিয়ে ভালবাসার সাতটি অমরাবতী বানাব আমি! বাকি জীবনটা সেখানেই কাটিয়ে দিতে চাই যদি!...দেবে?
তোমার সাথে হাঁটতে বের হবো উদাসী বিকালে, হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে ফেলব তোমাকে! আমার আকাশে তখন মেঘের ঘনঘটা, ছলছল নয়ন দুটি খুঁজতে থাকবে তোমার উপস্থিতি... হঠাৎ রাস্তার পাশের গাছ থেকে একরাশ সোনালু ফুল হাতে নিয়ে আসবে সামনে
মুখে তোমার বিশ্বজয়ের হাসি... আনন্দাশ্রুতে চোখ আমার তখন কানায় কানায় পূর্ণ!
তুমি কি আমার সেই ছলছল নয়নের ভালবাসা হবে? সোনালু ফুলের মতো একরাশ ভালবাসা??? আমার আনন্দাশ্রু?
তোমার ভালবাসায়...."
এটুকু লিখেই থেমে গেল প্রীতু, টপটপ করে পড়া অশ্রু ভিজিয়ে দিলো ডায়েরির পাতাকে। লেখাটা আর শেষ করল না প্রীতু। প্রচন্ড লজ্জা লাগছে তার। মনে হচ্ছে অনধিকারচর্চা করে ফেলছে। সেই লজ্জা কাটাতেই নিচে বড় বড় করে লিখল,
"ভালবাসা রাইয়্যানা প্রীতুর অধিকারে নেই"
লিখেই অঝোরে কাঁদতে লাগল সে। আর চোখের পানি সেই লেখাটাকে ভিজিয়ে দিয়ে যেন উপহাস করতে লাগল!
কি ভেবে প্রীতু ছিঁড়ে ফেলল পৃষ্ঠাটা, তারপর দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে দিয়ে ব্যাগ নিয়ে এক প্রকার দৌড়ে চলে গেল হোস্টেলে৷ উদ্দেশ্য "একটু কাঁদবে!"
"হ্যাঁ মা বলো ঠিকানা আর নাম্বারটা"
"নাম্বার কিন্তু দুইটা"
"উফ মা! আচ্ছা দেখি কাগজ নেই সাথে"
"কি লেখাপড়া করেছিস এতদিন কাগজ থাকেনা!"
"আহহা মা! এইতো পেয়েছি, বলো" এক কুঁচকে যাওয়া কাগজ সোজা করে নাম্বার লিখে নেয় সামির।
মায়ের ফোন রেখে কাগজটা থেকে নাম্বারের অংশ টুকু ছিঁড়ে নিতে গিয়ে সুন্দর একটা লেখা চোখে পড়ে সামিরের। হাতের লেখা দেখে অস্ফুট একটা শব্দ করে সামির, "অসাধারণ"
কলেজে একটা পেপার উঠাতে এসেছে সে, কিছুদিন আগেই একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে জব পেয়েছে ও।
লেখাটা পড়তে থাকে সামির।
কিন্তু শেষের লেখাটা পড়েই মন খারাপ হয়ে যায় সামিরের। কাগজটা ফেলে দেয় না। সাথে নিয়ে নেয়।
সামির সম্পর্কে একটু বলে নেওয়া প্রয়োজন,
সামিররা দুই ভাইবোন৷ সামিরের পুরো ফ্যামিলিই খুলনাতে থাকে। সামির রাজশাহীতে পড়াশোনা করেছে। সামিরের বাবা মাহমুদ রহমান সরকারি ব্যাংকে জব করেন, বছরের তিনচারের মাঝেই অবসর নেবেন। মা গৃহিণী। বোন সারিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে। সুন্দর একটা পরিবারের দৃষ্টান্ত হিসেবে সামিরের পরিবারকে উপস্থাপন করলে খুব একটা ভুল করা হবে না।
বাসায় ফিরে সামির সেই কাগজটা বারবার পড়ছে। যতই পড়ছে ততই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। বারবার ইচ্ছে করছে সেই মুখটাকে দেখতে। কি করবে ও!
এখন সমাধান হচ্ছে, "মা"
সামির কাগজটা নিয়ে উঠে যায় মায়ের কাছে।
"আম্মু, একটা কথা"
সবশুনে কাগজ টা দেখে হেসে ফেললেন আফরিদা রহমান।
"কি রে কাহিনী কি!"
বন্ধুর মতো প্রশ্ন করলেন আফরিদা।
"আরে মা তেমন কিছু না!"
"বুঝেছি বুঝেছি, যা খোঁজ নিয়ে আয়, বাসায় সারাদিন একা একা লাগে!"
মুখ টিপে হাসলেন আফরিদা!
"আহ মা!"
কপট রাগ দেখিয়ে চলে এলো সামির।
'না দেখেও যে এত সহজে কাউকে ভালবেসে ফেলা যায়, আজকের এই দিনটা সামনে না এলে কখনো বুঝতে পারা তো দূরের কথা বিশ্বাসই করতাম না।' এটুকু লিখে ডায়েরির পাতার সাথেই পিন মেরে রাখে সেই কাগজটুকুও!
তারপর ফোন করে রাজশাহীতে থাকা বন্ধু নাহিদের কাছে,
"দোস্ত আমি আসছি তোর কাছে, আগের বার তো ব্যস্ত ছিলাম"
খুশি হয় নাহিদ,
"সত্যি তো! থাকবি রে?"
"হুম"
.
প্রীতুর পরীক্ষা এসে গেছে আর প্রীতুর প্রিপারেশন প্রচন্ড খারাপ৷ হতাশা প্রীতুকে একেবারে জাপ্টে ধরেছে!
জীবনটাকে ছন্নছাড়া মনে হচ্ছে।
ক্লাসরুমে বসে বসে সেই কথাই ভাবছিল প্রীতু।
একটা মেয়ে নাহিদ আর সামিরকে দূর থেকে প্রীতুকে দেখিয়ে বলল,
"ওইটা প্রীতু, সবসময়ই একা থাকে!" বলেই মেয়েটা চলে গেল।
খুব ঝামেলা করে প্রীতুকে খুঁজে বের করতে হয়েছে। ভাগ্যিস নাম টা জানা ছিল।
"ভাবি তো মাশআল্লাহ, আর দেরি কেন, কবুল বল দোস্ত?"
নাহিদের কথা শুনে হেসে ফেলে সামির, "কবুল কবুল কবুল" বলেই আবার হাসতে থাকে...
"চল যাই!" নাহিদ হাত ধরে টান দেয় সামিরের।
"আরে নাহ! আমি কি প্রেম করব নাকি যে প্রোপোজ করব! ওর গার্ডিয়ান এর সাথে কথা বলব, আমার বাবামাকে বলব, ওর মতামত শুনে, সব ভাল হলে সোজা বিয়ের পিঁড়িতে"
নাহিদের বাসার উদ্দেশ্যে ফিরে চলল দু'জনেই।
প্রীতু জানতে পারল না এসবের কিছুই।
বাসায় ফিরে নাহিদ বলল,
"কি করবি এবার?"
"হোস্টেলের খাতা থেকে ওর গার্ডিয়ানের যে নাম্বার ছিল সেটা মনে রেখেছি, বাকিটা কাল" বলে মুচকি হাসি দিল সামির।
অবাক চোখে তাকাল নাহিদ,
"ভাবাই যায় না, যে কোনো মেয়েকেই এত দিন পাত্তা দিলো না সে আজ এত্ত কিছু শিখে গেল! ক্যামনে গুরু!"
নাহিদের কথার ভঙ্গিতে হেসে ফেলে সামির।
সামিরের পায়ের গিয়ে বসে পড়ল নাহিদ,
"দোয়া করো গুরু তোমায় দেখে যেন কিছু শিখতে পারি!"
দুজনেই হাসতে লাগলো।
.
ফায়াজ ছেলেদুটোর কাছে সব শুনে বললেন,
"মিথ্যে মায়ায় জড়িয়ো না, তোমাদের চোখে এখন রঙিন মনে হচ্ছে সব।"
সবদিক থেকেই পার্ফেক্ট ছিল সামির। তবুও এমন উত্তর পেয়ে অবাক হলো সে,
"আঙ্কেল আমি কিছু বুঝলাম না"
"অবাক হচ্ছ তাই না?"
"তাতো অবশ্যই" পাশ থেকে উত্তর দেয় নাহিদ।
"বেশ শুনো তবে" বলে সেই পুরানো কথাগুলোই বিবৃতি করলেন ফায়াজ, জাহিনের কাছ থেকে জারিফের কথাটাও শুনেছিলেন তিনি, সেটাও বাদ দিলেন না। তিনজনের চোখ থেকেই টপটপ করে পানি পড়ছে৷ সব শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল সামির। তারপর সামলে নিয়ে বলল,
"আঙ্কেল আমরা ওর অতীত শুনেই চোখের পানি আটকাতে পারছি না, না জানি ওইটুকু বয়সে মেয়েটা কত কষ্ট সহ্য করেছে! আঙ্কেল আমি ওর পাশে থাকতে চাই, শুধু বাবা মাকে একবার বলব!"
"হয়তো রাজি হবে না প্রীতু!" দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন ফায়াজ।
"সে আমরা দেখছি, আর আপনি একটু..... আঙ্কেল আমি আবার আসবো!"
বেশ কিছুটা বিষন্ন হয়ে রয়েছে সামির আর নাহিদ, "এত কষ্ট ওইটুকু বুকে সহ্য করল কি করে!"
সামির বলল,
"এতকিছুর পরেও ও যে ভালবাসতে পারে সেটাই অনেক আমার জন্য!"
.
"প্রীতু আফা একজন দেখা করতে আইছেন"
"কে এসেছে?" অবাক হয়ে প্রশ্ন করে প্রীতু।
"জানিনা"
"আচ্ছা তুমি যাও আন্টি, আমি আসছি।"
কে আসতে পারে ভাবতে ভাবতে ওয়েটিং রুমের দিকে গেল প্রীতু।
সেই সৌম্যদর্শন শান্ত মানুষটি!
"কেমন আছ মা!"
চোখের পানি আর বাঁধা মানতে চাইল না প্রীতুর। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু চোখের পানি টপটপ করে পড়তে লাগল।
অনেক কথা হলো সেদিন ফায়াজ আর প্রীতুর।
সামিরকে খুব পছন্দ হয়েছে ফায়াজের, তবে প্রীতুর কাছে সামিরের আভাসমাত্র ও দিলেন না তিনি।
আফরিদা সোফার উপর বসে আছেন, আর মেঝেতে বসে সামির মায়ের কোলে মাথা দিয়ে আছে। পৃথিবীর অনন্য সুন্দর দৃশ্যগুলোর মধ্যে একটি।
ছেলের কাছে সবশুনে ভাবতে কিছুক্ষণ সময় নিলেন।
"মা তুমি কি ভাবছ! তুমি রাজি নও তাই না?" কোল থেকে মাথা তুলে মায়ের মুখের দিকে তাকাল সামির।
"আমি বলেছি একবারও?"
"তাহলে রাজি?" উজ্জ্বল চোখে প্রশ্ন করল সামির।
"তাও তো বলিনি, বাবা সিদ্ধান্ত যত ছোটই হোক ভেবে দেখা উচিত! আমি তোর বাবার সাথে কথা বলব, রাজি হবেন হয়তো তোর বাবা, কিন্তু তার আগে আমাকে বলতো, তোর আফসোস হবে না তো এইদিনটার জন্য?"
"কেন মা?" মায়ের কথাতে রীতিমতো অবাক হয়ে গেল সামির।
আফরিদা একটু থেমে বলতে লাগলেন, "তোর বাবা খুব নীতিবান মানুষ, তোদের দুই ভাইবোন কেও সেভাবে বড় করেছি আমরা, আজ যাকে দেখে ভালবেসে পাশে দাঁড়াতে চাইছিস, সে তো বড্ড দুঃখিনী, কাল তাকে তুই-ই দুঃখ দিবি না তো? যদি ভাল রাখতে না পারিস সে যেমন আছে তেমন থাকুক"
মায়ের কথা উপলব্ধি করতে পেরে আবার মায়ের কোলে মাথা রাখলো সামির তারপর বলল,
"পারবো ইনশাআল্লাহ"
আফরিদার চোখে পানি চলে এলো এই ভেবে যে তিনি ছেলেকে মানুষ করতে পেরেছেন।
মেয়েটা সম্পর্কে ফায়াজের কাছে আগে থেকে সব শুনলেন আফরিদা আর মাহমুদ।
আর অবশেষে কারোরই অমত হলো না!
(চলবে)
©somewhere in net ltd.