![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অনেকটা নীরবে, নিভৃতে অথবা অভিমানে, অভিযোগে লুকিয়েছিলেন শফিকুল কবির চন্দন। তার এই লুকিয়ে থাকা দু’এক দিন বা মাসের নয়, এক দশকের। তিনি ১০ বছরেরও বেশি সময় নিয়ে লুকিয়ে আছেন ইতালির অন্যতম প্রধান শহর মিলানোয়। লিওনার্দো দা ভিনচির স্মৃতি জড়ান এই শহরে চন্দন লুকিয়ে আছেন সত্যি, কিন্তু অলস সময় কাটাননি এক দিনও। প্রতিনিয়ত বুনে চলেছেন স্বপ্ন। গোটা ইউরোপের শিল্প বাজারে ছড়িয়ে দিয়েছেন তার শৈল্পিক ভাবনা। যেখানে খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিশে আছে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের প্রিয় বাংলাদেশ।
২০১২ সাল ছিল বাংলাদেশ এবং ইতালির কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৪০তম বছর। সে হিসেবে কূটনৈতিক সম্পর্কের পা এখন ৪১-এর ঘরে। সম্পর্কের ৪০তম বছরকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য অনেক কিছু করা যেত। নাচে গানে মাতিয়ে রাখা যেত একটি দিন। কিন্তু বাংলাদেশ মিশনের মিলানোস্থ কনস্যুলেট দপ্তর তা করেনি। তারা গতানুগতিক ধারা ভেঙে একটি শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর আয়োজন করে। ‘শেকড় অন্বেষণ’ শীর্ষক এ প্রদর্শনীটি ছিল প্রবাসী তন্তুশিল্পী শফিকুল কবির চন্দনের একক ৮ম শিল্প প্রদর্শনী।
বাংলাদেশ মিশনের মিলানোস্থ কনস্যুলেট দপ্তরের প্রশংসনীয় এ উদ্যোগে দুটি কাজ হয়েছে। বাংলাদেশ এবং ইতালির মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের বাইরে আরও একটি সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। তা হলো শৈল্পিক সম্পর্ক। অপরটি হলো শিল্পী শফিকুল কবির চন্দনের নিজেকে গুটিয়ে রাখার বা অভিমানের ঘোমটা খুলে গেছে। তার লুকিয়ে থাকা বা নিভৃত জীবনের অবসান হয়েছে। এখন অপেক্ষা দেশে ফেরার। কবে ফিরবেন এই গুণী শিল্পী? আদৌ কি ফিরবেন? ফেরা হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে চন্দন বলেন, অভিবাসী জীবনে যে প্রশ্নটি আমাকে সবচেয়ে বেশি তাড়িত করেছে সেটা হলো, কবে দেশে ফিরব? আমার মনে হয় আমি জানি না। যেমন জানতাম না কোনো এক প্রদুসকালে আমার এই স্বেচ্ছা নির্বাসনে যাত্রা হবে। তবে এটা জানি যে, আমি অষ্টপ্রহর আমার দেশকে খুঁজে ফিরি। আমি মুখিয়ে আছি মায়ের কাছে তথা দেশের কাছে ফেরার জন্য। দেশে ফেরার সেই মাহেন্দ্রক্ষণটির জন্যই আমার যত প্রতীক্ষা। সেটা যত তাড়াতাড়ি হবে আমি ততো খুশি হব।
নরসিংদীর এক মায়াবী গ্রামে জন্ম নেয়া শফিকুল কবির চন্দন বেড়ে ওঠেন নিজ গ্রামের সবুজ ছায়ায়। সেখান থেকে মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে বেরিয়ে পড়েন। জয়দেবপুর থেকে ইন্টারমিডিয়েট করে ভর্তি হন চট্টগ্রামের সরকারি চারুকলা কলেজে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতক করে উচ্চ ডিগ্রির জন্য চলে যান ভারতের শান্তিনিকেতনে। সেখান থেকে ফাইবার আর্ট বিষয়ে মাস্টার্স করে দেশে ফেরেন এবং চারুকলা ইনস্টিটিউটের কারুশিল্প বিভাগে শিক্ষকতা করেন চার বছর।
অন্য পাঁচজন চারুশিল্পীর মতো চন্দনও ছবি আঁকেন। তবে রং তুলি দিয়ে নয়। তার ছবি আঁকার আয়োজন, উপকরণ ভিন্ন। তিনি ছবি আঁকেন পাট, সুতো, খড়, বিচালি, মেশম, পশম, উল, শন, হোগলা, চামড়া ইত্যাদি দিয়ে। সুতরাং বলাই যায় তিনি ছবি আঁকেন না, ছবি বোনেন। নির্মাণ করেন তন্তুভাস্কর্য। তাকে চারুশিল্পী না বলে তন্তুশিল্পী বললে মোটেও ভুল বলা হবে না। কিন্তু কেন তিনি তন্তুকে বেছে নিলেন শিল্পচর্চার মাধ্যম হিসেবে? চন্দন বলেন, আশির দশকে চারুকলা থেকে পি-ডিগ্রি সম্পন্ন করার একটা বিষয় ছিল। ঢাকার চারুকলায় যেসব ছাত্ররা বাইরে থেকে আসত তারা পরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন বিভাগে ভর্তি হতো। কিন্তু যারা ঢাকার চারুকলা থেকে পি-ডিগ্রি করত তাদের বেলায় পরীক্ষার দরকার হতো না। তারা প্রথমে বিভাগ পছন্দ করত। এর পর যে আসন ফাঁকা থাকত সেগুলোয় বাইরে থেকে আসা ছাত্রছাত্রীরা ভর্তির সুযোগ পেত। স্বাভাবিকভাবেই পেন্টিং বা ভাস্কর্য বিভাগে আমরা সুযোগ পেতাম না। যদিও ভাস্কর্য বা মৃৎশিল্প নিয়ে আমার পড়াশুনা করার ইচ্ছা ছিল প্রবল। সুযোগ না পাওয়ার কারণে আমাকে কারুশিল্প বিভাগে ভর্তি হতে হয়। অনেকটা অনিচ্ছায়। শুধু ঢাকায় পড়ার জন্য কারুশিল্পে ভর্তি হই। একদিন ভাস্কর্য বিভাগের প্রধান শিল্পী শামসুল ইসলাম নিজামী স্যার আমাকে ডেকে বললেন, তুমি খুব ভালো একটা বিভাগে ভার্ত হয়েছ। তোমার আশপাশে যতগুলো উপকরণ দেখ তার সব দিয়েই তুমি শিল্পকর্ম করতে পারবে। স্যারের কথায় ভাস্কর্যে ভর্তি হতে না পারার কষ্ট যেমন দূর হয়, তেমনি সেই থেকে কারুশিল্পের তন্তু এবং বয়ন নিয়ে সমান মেতে আছি আমি।
ছাত্র সময় থেকেই এশিয়ান আর্ট বিয়েন্নালে, ন্যাশনাল আর্ট এক্সিবিশনে শফিকুল কবিরের শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে চারুকলায় আয়োজিত প্রদর্শনী থেকে তাকে দেয়া হয়েছে বিশেষ অ্যাওয়ার্ড। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে প্রথম ট্যাপেস্ট্রি প্রদর্শনী হয় চন্দনের একক শিল্পকর্ম দিয়ে। এমন কি কলকাতায় ১৯৯৯ সালে প্রথম একক ফাইবার আর্ট প্রদর্শনী হয় শিল্পী শফিকুল কবির চন্দনের শিল্পচিত্র দিয়ে। ইতালির বিভিন্ন শহরে তার প্রদর্শনী হয়েছে ৮টি। গোটা ইতালির শিল্পপ্রেমী, শিল্প সমালোচক বা শিল্প ব্যবসায়ীদের কাছে চন্দন এখন উজ্জ্বল নক্ষত্র। যে শিল্পকর্ম তাকে এনে দিয়েছে আজকের শিল্পী সম্মান, সেই শিল্প কিভাবে বেড়ে ওঠে তার মধ্যে? কল্পনায় না অভিজ্ঞতায়? উত্তরে চন্দন বলেন, আমার কাছে শিল্পকর্ম বা সৃষ্টি একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ মনে হয়। ভাবনা চিন্তা, প্রকাশ, মনন একটা শিল্পকর্মের ভিত তৈরি করে। তবে বয়ন শিল্পের জন্য আগাম একটা কারিগরি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হয়। যেমন কোন তাঁতে কাজ করব, টানা এবং পোরেনটা কোন সুতায় হবে? তবে পূর্ব লিখিত কোনো দলিল বা অঙ্কিত কিছু থাকে না। কি করব তা তাৎক্ষণিকভাবেই গড়ে ওঠে। সে ক্ষেত্রে কল্পনা শিল্পকর্মের আঙ্গিক তৈরি করে বলে মনে করি। আসলে কল্পনা এবং অভিজ্ঞতা হাত ধরাধরি করে আগায়।
শফিকুল কবির ইতালির মতো একটি দেহজ সংস্কৃতির দেশে বসে শিল্প রচনা করেন। অথচ তার শিল্পকর্ম খুব স্পষ্ট করে জানান দেয় তিনি একজন বাংলাদেশি। তার শিল্পস্বত্বাজুড়ে খেলা করে গ্রাম্য তাঁতিদের বুনন কৌশল। বাঁশের ঘর, গোলপাতার ছাউনি, নল- হোগলার বেড়া, মাটির দেয়াল, কুলা, ডালা, শীতলপাটির বুননে যেন সব কিছু মোড়া। তবু জানতে চেয়েছিলাম, বিশেষ কোনো প্রভাব আছে কি আপনার শিল্প কাজে? চন্দন বলেন, আমি ইতালিতে ১০ বছর যাবৎ কাজ করছি, সবাই বলে আমার কাজ অনেক বেশি দেশজ। আর আমি বলি- যেহেতু জন্মেছি, বেড়ে উঠেছি একটা অজগাঁয়ে সুতরাং আমার প্রাণসত্তাজুড়েই বাংলা নামের গ্রামটার আসন পাতা। সেই শৈশবে অতি সামান্য এবং অসাধারণের যে বৈচিত্র্যের পরিপূর্ণতা সেটা কিন্তু আমাকে এখনো ভাবায়। যেমন ধরেন একটা রংচটা বয়সী বিকেলও কিন্তু সেই ভাবনার মধ্যে কলহাস্যে মুখরিত হয়ে ওঠে। সেই যে দড়ি-দড়া, খড় বিচালি, শন, পাটের আঁশের বিচিত্র একটা তন্তুময় জগৎ ছিল ছোটবেলায় এর প্রভাব আমি অহর্নিশ টের পাই। তাদের আমি সযত্নে লালনও করি। আক্ষরিক অর্থে আমার মা’ই আমার প্রথম শিল্প শিক্ষক। তার কাছেই প্রথমে নানা রঙ্গের পেন্সিল, ট্রেসিং পেপার, কার্বন পেপারের ব্যবহার দেখেছি। আর সন্তান হিসেবে তার কারুশিল্প প্রীতির মৌরশীর্ষ যে সম্পর্কটা আমার সঙ্গে, আমি মনে করি সেটাতেই সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত আমি।
চন্দন এক দশক সময় নিয়ে শিল্প চর্চা করছেন ইতালির মূলধারায়। শিল্পশিক্ষা নিয়েছেন এবং দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। গ্রাম্য তাঁতিদের বয়ন দেখেছেন, শিখেছেন কাছে থেকে। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, বাংলাদেশের চারুশিল্পের কোন বৈশিষ্ট্য ইউরোপের চারুশিল্প থেকে আলাদা? তিনি বলেন, পার্থক্যের বিষয়টা যে শুধু শিল্পকর্মে তা তো নয়, ইউরোপে এই কাজটিকে দেখার বা মূল্যায়নের যে রেওয়াজ, আর সামগ্রিক অর্থে শিল্পশিক্ষা, শিল্পব্যবসা, শিল্পপ্রেম তথা তার সাংস্কৃতিক বিকাশের এবং ভাবনার যে প্রবণতা, যে প্যাটার্ন ইউরোপে আছে সেটা এখনো আমরা অর্জন করতে পারিনি। আর এই ভুবন গ্রামের যেখানেই বসে আমরা শিল্পচর্চা করি না কেন আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য, তার বাধ্যবাধকতা নিয়ে কিন্তু বহু মত চালু আছে। দেশ ও আধুনিকতা এই সমন্বয়কে চিহ্নিত করা যায় এমন বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাংলার চারুশিল্প খুব একটা পথ হাঁটেনি বলেই আমার মনে হয়। ফলে সামগ্রিক অর্থে আজকে বাংলাদেশের চিত্রকলা বলে কোনো বৈশিষ্ট্য আছে বলে আমরা দাবি করতে পারি বলে আমার মনে হয় না।
১০ বছর আগে চন্দন নেদারল্যান্ডে এসেছিলেন এক শিল্প কর্মশালায়। সেখান থেকে তাকে প্রদান করা হয় ইউরোপীয় কালচারাল আর্ট ফেলোশিপ। তিনি কর্মশালা শেষ করে চলে আসেন ইতালির মিলানো শহরে। যে শহরে যৌবনের ৪০ বছর কাটিয়েছেন রেনেসাঁর শিল্পী লেওনার্দো দা ভিন্চি। চন্দনকে চুম্বকের মতো টেনে ধরে মিলানোর শৈল্পিক সৌন্দর্য। তিনি থেকে যান মিলানোয়। প্রথম ক’মাস ভালোই কেটেছে। সব কিছু স্বপ্নের মতো মনে হয়েছে। যখন স্বপ্নভঙ্গ হলো তখন আর পেছন ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই। শুরু হয় কষ্টের সময়। পকেটে টাকা নেই। মুখে ইতালির ভাষা নেই। তবু দমে যাননি তিনি। মিলানোর এমাথা থেকে ওমাথা চষে বেড়িয়েছেন তার শিল্পজগতের খোঁজে। এক রুমের সাবলেট বাসায় ভাড়া থেকেছেন। নিজের সোয়ার ঘরের বিছানায় বসে বুনেছেন তার স্বপ্নের তাঁত। নতুন সুতো কেনার আর্থিক সামর্থ্য ছিল না। বাজার থেকে পুরনো সোয়েটার কিনে তার উল খুলে বুনেছেন স্বপ্ন। কোথাও কোনো শিল্প প্রদর্শনীর খবর পেলেই ছুটে গেছেন। তুলে ধরেছেন নিজের শিল্পী পরিচয়। প্রথম দিকে কেউ খুব একটা পাত্তা দিতে চাইত না। এভাবে কেটে যায় ৩ বছর। এ সময় জীবন চালাতে অনেক কাজ করেছেন। যা কোনোভাবেই একজন শিল্পীর কাজ নয়। কিন্তু তিনি ভেঙে পড়েননি। তাকে ভাঙতে দেননি তার স্ত্রী। মনের শক্তি এবং সাহস দিয়ে আগলে রেখেছেন। স্ত্রী নিজে কাজ করে সংসার চালিয়েছেন। স্বামীকে উৎসাহ দিয়েছেন তার শিল্পচর্চায়। এভাবেই একদিন কষ্টের দিন শেষ হয়। ২০০৪ সালে এক ফাইবার আর্ট গ্যালারিতে পরিচয় হয় একজন কিউরেটরের সঙ্গে। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০০৬ সালে ইতালিতে প্রদর্শিত হয় তার প্রথম একক প্রদর্শনী। চন্দন কেন সেদিন মিলানোকে বেছে নিলেন তার শিল্পচর্চার জায়গা হিসেবে? কখনো কি তার মনে হয়েছে প্রবাসী না হলেই ভালো হতো? এ প্রশ্নের উত্তরে চন্দন বলেন, ইতালিকে বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে একটা বড় কারণ ছিল, ছোটবেলা থেকেই লিওনার্দো দা ভিনচির একটা প্রভাব বা প্রতিপত্তি আমার মানস জগতে ছিল। সুতরাং সেটা হয়ত প্রধান কারণ। সেই যে প্রথম দিন আমি মিলানো শহরে এলাম এর পরে মিলানোকে ছেড়ে আর কোথাও যেতে পারিনি। ইতালিতে যে প্রবাসী হব তার কোনো আগাম পরিকল্পনা আমার মধ্যে ছিল না। এমনকি আমি অভিবাসী হব সেটারও কোনো পরিকল্পনা ছিল না। তবে যেখানেই থাকি আমাকে যে শিল্পকর্মের সঙ্গে থাকতে হবে সেটা বিলক্ষণেই জানতাম। অবশ্য এছাড়া চলারও কথা নয়। সারা জীবন যে তাঁত বোনার জন্য নিজেকে তৈরি করেছি তার তো অন্য কোনো কাজ করা চলে না। এখন যা করছি প্রবাসী না হলে দেশেও হয়ত তাই করতাম। তবে এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায়, আসলে আমি করতে পারতাম কিনা? গত ১০ বছরের বিচ্ছিন্নতা আমার অনেক স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে। আপনজনদের হারিয়েছি এটা সত্যি। পক্ষান্তরে আমাকে যা দিয়েছে তা তো অনেক। কথায় আছে না, কিছু পেলে কিছু তো হারাতেই হয়। প্রবাসী না হলে আরও ভালো কিছু করতাম কিনা তার চেয়ে আমার নিজের প্রশ্ন হলো, প্রবাসী হয়েই কি ঢের ভালো হয়নি? প্রবাসী হয়েই বোধ করি দেশকে আরও বেশি জানা হয়েছে।
চারুকলা অনুষদের বর্তমান ডিন শিল্পী অধ্যাপক মতলুব আলী শফিকুল কবির চন্দন সম্পর্কে ভিনচি নোটস বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, নব্বই এর দশকে ভারতের বিশ্বভারতী থেকে উচ্চতর শিক্ষা সমাপন শেষে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে এদেশের শিল্পকলার আরও সমৃদ্ধি চেয়েছিলেন চন্দন। এ বিষয়ে যথাযথ অগ্রণী ভূমিকা নেয়ার আন্তরিক প্রয়াস ছিল তার। কিন্তু আমাদের মধ্যে আমরা তাকে আগলে রাখার অনুকূলতা সৃষ্টি করতে পারিনি বলে সেই সাধ স্বপ্ন অপূর্ণ রেখে শিল্প ঐতিহ্যের অন্যতম প্রধান বনেদি কেন্দ্র ইতালির মিলানোয় তিনি নিজের ঠিকানা রচনা করেছেন। এসব কথার সূত্র ধরেই শিল্পী চন্দনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, অনেকেই মনে করেন আপনার অবর্তমানে বাংলাদেশের তন্তুশিল্পে একপ্রকার শূন্যতা তৈরি হয়েছে, আপনি কি মনে করেন? কিভাবে এ শূন্যতা পূরণ হতে পারে? উত্তরে তিনি বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশের চারুকলার অন্যান্য শাখার মতো তন্তু শিল্পের প্রসার হয়নি বললেই চলে। আমি যখন শান্তিনিকেতনে মাস্টার্স প্রোগ্রামে যাই, সেখান থেকে ফিরে এসে এই মাধ্যমটিকে জনপ্রিয় করার একটা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। তার জন্য কয়েক বছর ঢাকার চারুকলায় শিক্ষকতা করেছি। বাংলায় এ বিষয়ে কোনো বই ছিল না। বয়ন বা তন্তুকলা বিষয়ে বই লিখেছি। কিন্তু আসলে যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ছাড়া এই ধরনের চর্চার আগ্রহ হারিয়ে যায়। ছাত্ররা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তাছাড়া অধিক জটিল এবং সময় সাপেক্ষ কাজ হওয়ার কারণে এটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠার জন্য একটা প্রতিবন্ধকতা আছে। আসলে শিল্পকলার ভুবনে এমন শূন্যতা শুধু নতুনদের দিয়েই পূরণ হতে পারে বলে আমার মনে হয়। চারুকলার এই বিভাগে মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু আছে, অথচ কোনো অভিজ্ঞ শিক্ষক নেই। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই, পরিবেশ নেই। এটা অনেক দিন থেকে চলে আসা বাস্তবতা। এই সব সাধারণ বিষয়গুলোর একটা সমাধান হলেই পরিবর্তন চোখে পড়তে পারে। তবে একটা বিষয় আমাদের বুঝতে হবে, একজন তথাকথিত পেন্টিং শিল্পীকে দিয়ে কিন্তু বয়ন শিল্প হবে না। দুটো পরিপূর্ণ আলাদা বিষয়।
একজন প্রবাসী শিল্পী হিসেবে চন্দন দেশের চারুশিল্পের বর্তমান অবস্থার মূল্যায়ন করেন কি ভাবে? ভবিষ্যতের চারুশিল্প কিভাবে দেখতে চান? দেশের চারুশিল্পের উন্নয়নের জন্য কি কি পদক্ষেপ নেয়া দরকার? এসব প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি আসলে ১০ বছর দেশে যাই না। শুনেছি গত ১০ বছরে বাংলাদেশে অনেক শিল্প শিক্ষার প্রতিষ্ঠান হয়েছে। কিন্তু একটা প্রশ্ন আমার খুব মনে আসে, কারণ চারুকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমি নিজে পড়েছি এবং পড়িয়েছি। প্রশ্নটা হলো, কারা পড়ান? কি পড়ান? কেন পড়ান? এই প্রশ্নগুলো খুবই জরুরি। চাকরিবাকরির একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, সেসব ঠিক আছে। কিন্তু দেশের শিল্প কাঠামোর বুনিয়াদ হিসেবে কিউরেটর, শিল্প সমালোচক, শিল্প ইতিহাসবিদ তৈরি করতে এই সব প্রতিষ্ঠান যে অপারগ তা পেছনের দিকে তাকালেই স্পষ্ট বোঝা যায়। আমাদের চারুকলা শিল্প প্রতিষ্ঠানের বয়স ৫০ বছরেরও অধিক, অথচ আমাদের আন্তর্জাতিক মানের শিল্প সমালোচক, শিল্প ইতিহাসবিদ, কিউরেটর নেই। ইতালিতে এত বড় একটা আর্ট মার্কেট অথচ এখানে বাংলাদেশের কোনো আর্ট গ্যালারি বা কিউরেটরের কোনো বাণিজ্যিক উদ্যোগ চোখে পড়ে না। জানি না, হয়ত বাংলাদেশের এত শিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুধু একটা আর্ট ফ্যাশনে পর্যবসিত হবে। তবে শিল্প বিপণন, সংগ্রাহক ইত্যাদি বিষয়ে পেশাদারি মনোভাব যদি তৈরি না হয় তাহলে আমাদের উন্নতি শুধু পরিবর্তনের হাওয়ায় সীমাবদ্ধ থাকবে বলে আমার মনে হয়। ব্যবহারিক অনুশীলনের পাশাপাশি আমাদের চারুকলা বিষয় নিয়ে প্রকাশনা হওয়া দরকার। পর্যালোচনা হওয়া দরকার। যেটা এখনো আমাদের দেশে যথেষ্ট কম।
চন্দন তার বুনন শিল্প চর্চার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি এবং গবেষণামূলক কাজ করেন। তন্তু ও বাংলার তাঁতিদের বয়ন শিল্প নিয়ে তার গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। তিনি বর্তমানে গ্রামবাংলার তাঁতিদের তন্তুবায় এবং স্বরূপ নিয়ে গবেষণার কাজ করছেন। যা বই আকারে প্রকাশিত হবে আগামী ফেব্রুয়ারির বইমেলায়। এর আগে তার আরও কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, শিল্পমনিষা (২০০০), তন্তুকলা ও ট্যাপেস্ট্রি (২০০৪), ভিনচি নোটস (২০১০), শিল্পদর্শন (২০১০), পরন কথা নগরদাইর (২০১০)। এছাড়া আগামী এপ্রিলে রোমে এবং জুনে ভেনিসে তার দুটি প্রদর্শনী হওয়ার কথা আছে। ‘রোমে বাংলার মসলিনের উত্তরাধিকার’ শিরোনামে এবং ‘কবিরের মৈত্রী বন্ধন’ স্লোগানে অনুষ্ঠিতব্য প্রদর্শনীর সকল আয়োজন ইতোমধ্যে প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। এখন চলছে হরদম বিজ্ঞাপনের কাজ। স্বাভাবিকভাবেই শিল্পী চন্দন এসব নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। তার পরও শিল্পীর মুখ থেকে সরাসরি জানতে চেয়েছিলাম তার এখানের কাজ সম্পর্কে। তিনি বলেন, আপাতত লিখছি। ‘বাংলার তন্তুবায় স্বরূপ সন্ধান’ নামে একটা বই লিখছি। একুশের বইমেলায় বইটি প্রকাশের সম্ভাবনা আছে। আগামী এপ্রিল মাসে রোমে ১৫ দিনব্যাপী একটা প্রদর্শনী আছে। যেখানে আমার তন্তু শিল্পকর্মগুলোই প্রদর্শিত হবে। আর খুব মনোযোগী হয়ে বয়ন বিষয়ে পড়ছি, লিখছি, কিছু গবেষণার কাজ করছি। আর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে দেশে গিয়ে গ্রামীণ বয়ন শিল্পীদের নিয়ে কাজ করার একটা প্রচণ্ড আগ্রহ আমার মধ্যে আছে। তবে বেদনাদায়ক হলেও সত্যি, দেশ-বিদেশে আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেকের সঙ্গেই একটা বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে চেনা জগৎ বার বার পরিবর্তন হয়েছে। অনাকাক্সিক্ষত হলেও এসব আমাকে পীড়া দেয়।
শফিকুল কবিরের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় দুটি বিষয় খুব পরিষ্কার বোঝা যায়। একটি হলো, তিনি বেশ অভিমানী। বুকের গভীরে জমে আছে বিন্দু বিন্দু ক্ষোভ আর অভিমান। যা তিনি কোনোভাবেই প্রকাশ করতে চান না। যে ক্ষোভ বা অভিমান তাকে প্রবাসী করেছে এ যাত্রায় তা অজানাই থেকে গেল। অপরটি হলো, বাংলার বয়ন শিল্পী তাঁতিদের প্রতি তার দুর্বলতা অকৃত্রিম। তিনি তাঁতিদের বুনন শিল্পকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসেন। একমাত্র সন্তানের নামও রেখেছেন ‘বয়ন’। তার ভাবনাকাশে সার্বক্ষণিক তাঁত আর তাঁতিদের মাকুর শব্দ রঙিন ঘুড়ি হয়ে উড়ে বেড়ায়। তাকে একজন প্রবাসী তন্তুশিল্পী না বলে যখন ‘প্রবাসী তাঁতি’ বলি তিনি আবেগী হয়ে বলতে শুরু করেন, অভিবাসনকে আমি বলি স্বেচ্ছা নির্বাসন। যেমনটি ছিল অভিবাসী হওয়ার শুরুর দিনগুলোতে। ভাষা না জানা একজন অদক্ষ শ্রমিকের এই জীবন। সে সময় হারিয়ে যাওয়া মূল্যবোধের জন্য হাহাকার ছিল। একদিন হাহাকার আর কান্নার প্রতিশব্দ হয়ে উঠল আমার শিল্প ভাবনা। ভাবনা থেকে নির্মাণ। নিজেকে খোঁজা। ফিরে গেলাম আমার রংবাহারি স্বপ্নে। আমার নতুন এক জগৎ সৃষ্টিতে। সেখানে আসলে আমার আমিকেই নির্মাণ করি। আর এই নির্মাণের পথ ধরেই আমি তাঁত বুনি। আমি আমার জীবন বুনি।
Click This Link
১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৫:২৭
পলাশ রহমান বলেছেন: মানে কি?
২| ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৩:৪৩
১১স্টার বলেছেন: ভালো লাগল আর কয়েকটা ছবি দেন।
১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৩ সকাল ৭:১৬
পলাশ রহমান বলেছেন: ধন্যবাদ, ছবি দেয়া হল।
©somewhere in net ltd.
১|
১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ২:২৯
পথহারা সৈকত বলেছেন: