![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
খুলনায় আমাদের বাড়ির কাছে ‘এরফান মার্কেট’ নামে একটা মার্কেট ছিল, এখনো আছে কিন্তু অন্য নামে। ওই মার্কেটের নিচতলায় একটা ভিডিও গেম্সের দোকান ছিল। দোকানটা চালাতেন আনিসুর রহমান লিটু। আমি তাকে লিটু ভাই বলে ডাকতাম। সজ্জন এবং বন্ধু মানুষ। অবসরের অনেকটা সময় তার ওখানে গিয়ে আড্ডা দিতাম। লাল চা, পুরি, সিঙ্গাড়া আর আড্ডা, সব মিলিয়ে আমাদের সময় ভালোই কাটতো। মাঝে মাঝে দেখতাম লিটু ভাই তিন গোয়েন্দার বই পড়তেন। এই নিয়ে আমি এবং আমার অন্য বন্ধুরা অনেক হাসি-ঠাট্টা করতাম। বলতাম, লিটু ভাইর এখনো যৌবন আসেনি। যাদের যৌবন দেরিতে আসে, তারা বেশি বেশি ‘তিন গোয়েন্দা’ পড়ে। তিনিও ছাড়তেন না, সুযোগ পেলে আমাদের একহাত নিতে কার্পণ্য করতেন না। সন্ধ্যা ৮টা বাজলে (তখন ৮টাকে আমাদের কাছে সন্ধ্যাই মনে হতো) লিটু ভাইকে কোনোভাবেই ধরে রাখতে পারতাম না। তিনি দোকানপাট বন্ধ করে ছুটতেন বাসার দিকে। প্রথম দিকে বুঝতে পারতাম না, তার এই তাড়াহুড়ার হেতু কী? তখন লিটু ভাই বিয়েও করেননি যে বউয়ের কড়া শাসনে বেচারা দৌড়ের ওপর থাকবেন। মাঝেমধ্যে জিজ্ঞাসা করতাম, তিনি সঠিক উত্তর দিতেন না। বলতেন, কাজ আছে। একদিন ছাই দিয়ে ধরলাম, আজ বলতেই হবে। তিনি বললেন, দেখবেন কোথায় যাই, কী করি? চলেন আমার সঙ্গে। খুলনা নিউ মার্কেটের কাছ থেকে ছোট বয়রার ভাঙ্গাপোলে (পূজাখোলা) গেলাম লিটু ভাইর লক্কড়-ঝক্কড় সাইকেলে চেপে। তিনি আমাকে একটা প্রাইমারি স্কুলে নিয়ে গেলেন। স্কুলটির একটা কক্ষে আলো জ্বলছে। ভেতর থেকে হারমনিয়াম, তবলা, মন্দিরা বাজানোর শব্দ ভেসে আসছে। আমরা ওই কক্ষে প্রবেশ করলাম। দেখি ১০/১২ জন বিভিন্ন বয়সের ছেলে-মেয়ে মেঝের ওপর চট বিছিয়ে বসে আছে। তারা বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে রেওয়াজ করছে। তাদের রেওয়াজ ঠিক গানের রেওয়াজের মতো মনে হলো না। বেশ একটু অন্যরকম মনে হলো আমার কাছে।
লিটু ভাই সবার সঙ্গে আমাকে তার বন্ধু বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি একটা লম্বা টুলের ওপর বসলাম। তারা নাটকের মহড়া শুরু করলেন। সময়টা ছিল ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর মাস। আমার পরিষ্কার মনে আছে, সেদিন তারা যে নাটকের মহড়া করছিলেন তার নাম ‘বিষাক্ত অক্টোপাস’। এরপর থেকে প্রায়ই আমি ছোট বয়রার পূজাখোলায় যেতাম। তাদের মহড়া দেখতাম, গল্প করতাম, আড্ডা দিতাম। এভাবেই খুলনার ব্যতিক্রম সাংস্কৃতিক সংগঠন দ্রোহীর সঙ্গে আমার পরিচয় এবং হৃদ্যতা তৈরি হয়।
ছোট বয়রা, রায়ের মহল খুলনা শহরের মধ্যে হলেও ওই অঞ্চলটা অনেকটা পল্লী এলাকার মতো। বলা যায় শহরতলি। তখন অন্তত তা-ই ছিল। এখন সময়ের প্রয়োজনে অনেক কিছু বদলে গেছে। ইট পাথরের অট্টালিকা গ্রাস করে নিয়েছে পৌষ মাসের মৌ মৌ গন্ধ। এখন আর রাস্তার পাশে গোবরের নুড়ি দেখা যায় না। কুটোর (ধানের শুকনো খড়) গাদাও চোখে পড়ে না। ওই এলাকার মানুষের একটা সরল জীবন ছিল। তারা শহুরে কোলাহল এড়িয়ে একটু অন্যরকম জীবন যাপন করতেন। প্রতিবছর শীতের সময় ধান উঠলে একটা উৎসব উৎসব পরিবেশ বিরাজ করতো। নাটক, যাত্রাপালা, জারি গান, পালা গান, কীর্তন, ক্রীড়া প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন আয়োজনে মানুষ মেতে থাকতো। সময় এখন অনেক কিছু বদলে দিয়েছে। মানুষ এখন আমাদের লোক ঐতিহ্যকে অতীত করে আধুনিক (!) হতে শিখেছে। মানুষ তার জীবনযাপনের সরলতা ঝেড়ে জটিল, কঠিন, কুটিল হতে শিখেছে। পরিবর্তনের এই অস্থির এবং অসুস্থ ধারায় গা ভাসিয়ে দেননি ছোট বয়রার ভাঙ্গাপোল এলাকার ক’জন যুবক। তারা ব্যতিক্রম কিছু করতে চেয়েছেন। মানুষের নৈতিকতা বোধ এবং জীবনের সঠিক মূল্যবোধ ধরে রাখতে চেয়েছেন। ভাগ্যহত মানুষকে ভাগ্য বদলের স্বপ্ন দেখিয়ে যারা তাদের পণ্য বানায় তাদের রুখে দিতে চেয়েছেন। তারা মনে করেন সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদার এনজিওগুলো আমাদের সমাজ, সংসার, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। ক্ষমতালোভী শাসক শ্রেণিও অভিন্ন পথে হাঁটছে। এদের রুখতে ওই যুবকরা প্রগতিশীল সংস্কৃতি চর্চার পথ বেছে নিয়েছেন। তারা নাটকের মাধ্যমে মানুষকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন। তারা সর্বাত্মক সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলে ক্ষমতালোভী শাসক শ্রেণিকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। এই প্রত্যয় এবং প্রত্যাশা বুকে ধারণ করে তারা ‘দ্রোহী’ নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরি করেন ১৯৯৮ সালের ২৫ জানুয়ারি।
দ্রোহী গঠনে যারা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন তাদের নেতৃত্বে ছিলেন শামিম আকতার লিটু। দ্রোহীর প্রথম কমিটিতে তিনি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে সভাপতি নির্বাচিত হন। এখনো পর্যন্ত তিনি ওই সংগঠনের হাল শক্ত হাতে ধরে রেখেছেন। এর মধ্যে বহু ঝড়-ঝাপটা, চড়াই-উতরাই এসেছে, তিনি হাল ছাড়েননি। দ্রোহী এ যাবৎ ১৬টি নাটক, যাত্রা, পথনাটক, পথযাত্রার প্রদর্শনী করেছে। এগুলো খুলনা বেতারে, বিভিন্ন মঞ্চে, ঢাবির ভাষা ইনস্টিটিউটসহ দক্ষিণাঞ্চলের বহু জায়গায় বহুবার প্রদর্শিত হয়েছে। এর প্রায় সবগুলো নাটকই শামিম আকতার লিটুর লেখা। তিনি প্রগতিশীল সংস্কৃতি চর্চা, লেখালেখি ছাড়াও একটি কলেজে শিক্ষকতা করেন।
আমি যখন খুলনায় থেকেছি তখন বহু সময় কেটেছে শামিম আকতার লিটুর সঙ্গে। তিনি রাত দশটার দিকে নাটকের মহড়া শেষ করে বের হলে আমরা পূজাখোলার মোড়ে কোনো এক চায়ের দোকানে বসতাম। গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা হতো। চা-ওয়ালা অনেক সময় তার দোকান বন্ধ করে চলে যেত, আমরা বসে থাকতাম। আমাদের জন্য সে চুলার আগুনে এক কেটলি লাল চা রেখে যেত। চা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কথা ফুরাত না। বিভিন্ন লেখকের বই, পত্রিকার কলাম, রাজনীতি, সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের বেশি কথা হতো। আমরা প্রতিদিনের পত্রিকায় প্রকাশিত খবর নিয়ে পর্যালোচনা করতাম। তার মুখের দুটি শব্দ এখনো আমার মনে পড়ে, ফুলো এবং ফাকড়–। সাধারণত ফরমায়েশি লেখক, প্রগতিবিরোধী, অবৈজ্ঞানিক লেখকদের লেখা পড়ে তিনি ওই দুটি শব্দ ব্যবহার করতেন। বলতেন, ফুলো লেখক, ফাকড়– লেখক বা ফুলো লেখা, ফাকড়– লেখা।
দ্রোহীর মুখপত্র হিসেবে ‘অরিত্র’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো, এখনো হয়। তিনি সব সময় ওই পত্রিকার সম্পাদকীয় লিখতেন। একবার লিখেছিলেন, একটি আতঙ্কিত উপত্যকায় চরম বৈরী সময়ের মুখোমুখি আমরা। পত্রিকার পাতায় তাজা বীভৎস খুন এখন নৈমিত্তিক ঘটনা। আমাদের সবুজ প্রত্যাশাগুলো পরিণত হচ্ছে গভীর হতাশায়। বৈধতার মোড়কে সরকার নিয়ন্ত্রিত সন্ত্রাসে ক্ষুব্ধ মানুষ। দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদের ঘৃণ্য আগ্রাসন এবং দেশীয় দালাল শাসক শ্রেণির ক্ষমতার দ্বন্দ্বের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার, আকাশ সংস্কৃতি ও অবাধ তথ্যপ্রবাহের আবরণে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে নয়া ঔপনিবেশিক শক্তি। দালাল শাসক শ্রেণি বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের নিয়ন্ত্রিত নানা ধরনের পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশনে সিনেমা, নাটক প্রচারের মাধ্যমে তাদের হীন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। তারা উত্তেজক সংগীত, অশ্লীল নৃত্য ইত্যাদি প্রচার করে যুব সমাজকে একটি ঘোরের মধ্যে আচ্ছন্ন করে রাখছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো সাধারণ মানুষকে বিকৃত ও কৃত্রিম আকাক্সক্ষার আবর্তে নিমজ্জিত করা, যা শোষিত শ্রেণির শ্রেণিগত অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং শ্রেণি সংগ্রামের অন্তরায়। তাই শ্রমজীবী জনগণের মধ্যে প্রগতিশীল সংস্কৃতি চর্চার বিকাশ ঘটিয়ে তাদের বিপ্লবী চেতনাকে শাণিত করাই আমাদের লক্ষ্য।
‘অরিত্র’র এই সম্পাদকীয় খুলনার সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক মহলে বেশ আলোচনা সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। শাসক শ্রেণির অনেকেই সে সময় দ্রোহীকে চোখ রাঙ্গিয়ে ভয় দেখিয়েছিল। তারা বলেছিল, এদের উদ্দেশ্য ভালো না। এনজিওরা প্রথমে দ্রোহীকে ধমক দিয়ে বসিয়ে রাখতে চেয়েছে, ব্যর্থ হয়ে নানা প্রকারের প্রলোভন দেখিয়েছে। তারা দ্রোহীর জন্য পাকা ঘর তুলে দিতে চেয়েছে। সভাপতি শামিমকে মোটা বেতনের চাকরির লোভ দেখিয়েছে। কোনোভাবেই যখন তারা দ্রোহীকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করতে পারেনি, তখন দ্রোহীকে ভাঙার চেষ্টা করছে। দ্রোহীর দু’জন সদস্যকে দিয়ে বিকল্প সংগঠন দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে। রাজনৈতিকভাবেও দ্রোহীকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। খুলনার হাদিস পার্কে একবার দ্রোহীর নাটক মঞ্চায়নের সময় একজন পাগলীকে মঞ্চে তুলে দিয়েছিল শাসক শ্রেণির ভাড়া করা ছেলেরা। তারা অশ্লীল গালাগাল করেছিল। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পুলিশ পাঠিয়ে দ্রোহীর মাইক বন্ধ করে দিয়েছে। অনুষ্ঠানের অনুমতির নামে পুলিশ দিয়ে নানাভাবে হয়রানি করেছে। কিন্তু তারা সফল হয়নি। দ্রোহীরা আপস করেনি।
দ্রোহী তার নীতিমালার মুখবন্ধে লিখেছে, মুষ্টিমেয় কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট করছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে, বুর্জোয়া রাজনীতিকদের ভণ্ডামি এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। তাদের ভয়াল কালো থাবার শিকার অসহায়, ভুখানাঙ্গা মানুষ। ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রিক ব্যবস্থায় দালাল শ্রেণি সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের পদ চুম্বনে ব্যস্ত। এদেশের সংস্কৃতি রক্ষার ইজারা নিয়েছে সাম্রাজ্যবাদীদের মদদপুষ্ট সংস্থাসমূহ। তারা সুকৌশলে নিংড়ে নিচ্ছে রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি। সেবার নামে প্রতারণা করছে অহর্নিশ। গোটা দেশকে করে ফেলেছে পঙ্গু, অসহায়, মেরুদণ্ডহীন। স্বাধীনতা সংগ্রামের ২৭ বছর (যখন দ্রোহীর নীতিমালা লেখা হয় তখন স্বাধীনতার বয়স ২৭ বছর ছিল) অতিক্রান্ত হওয়ার পরও জোটেনি মানুষের আশ্রয়, মেটেনি ক্ষুধা, পায়নি শিক্ষা-চিকিৎসার নিশ্চয়তা। রাষ্ট্রিক অবকাঠামো বাইরে থেকে শক্ত ভিত্তির ওপর দণ্ডায়মান দেখানোর চেষ্টা করা হলেও আসলে তা উঁইয়ের ঢিবির মতো ভেতরে ফাঁপা ও ভঙ্গুর।
দ্রোহীরা শুধু নাটকের মধ্যেই নিজেদের ধরে রাখেনি। তারা সংস্কৃতির প্রতিটি শাখায় তাদের বিচরণ অব্যাহত রেখেছে। খুলনায় দ্রোহীরা প্রথম বৈশাখের শোভাযাত্রা শুরু করে। তাদের আগে সবাই বৈশাখকে মেলা এবং পান্তা ইলিশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছিল। দ্রোহীরা কোনো দিন ওই গতানুগতিক পথে পা বাড়ায়নি। খুলনায় প্রথম পথযাত্রা করে দ্রোহীরা। অভিজ্ঞ অনেকের মতে বাংলাদেশে পথযাত্রাপালার ধারণা দ্রোহীরাই আবিষ্কার করে। দ্রোহী তার শিশু সদস্যদের জন্য চিত্রাঙ্কন, সংগীত, নৃত্য, বাদ্যযন্ত্রসহ বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু কখনো এগুলোর প্রতি ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি দেখায়নি।
দেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবস দ্রোহীরা গোড়া থেকেই গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে। সভা, সেমিনার, নাটক, গণসংগীতসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে থাকে। প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্বসহ সত্যিকারের গুণী মানুষদের সম্মাননা প্রদান করে। কবিতা, গান, নাটক লেখার কর্মশালা করে। গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষার উপকরণ প্রদান করে। কৃতী ছাত্রছাত্রীদের সংবর্ধনা এবং পুরস্কার প্রদান করে। কৃতী খেলোয়াড়দের সংবর্ধনা প্রদান করে। সংগীত, চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তিসহ সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। আগামী ২৫ জানুয়ারি দ্রোহী দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম অগ্রগণ্য প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠার ১৬তম বার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তারা সেমিনার, নাটক, সংগীত এবং পুঁথি পাঠের আয়োজন করেছে। এবারের আয়োজনে তারা মূল প্রবন্ধ করেছে সুন্দরবন এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের ওপর। বনখেকো লোভী মানুষগুলো যে কতভাবে আমাদের পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাচ্ছে তা তুলে ধারা হবে ওই প্রবন্ধে। সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে কালো তেল ঢেলে দিয়ে যে ক্ষতি করা হয়েছে এবং তা নিয়ে ক্ষমতাসীনদের যে লজ্জাজনক ভূমিকা তার উল্লেখ থাকবে। বেশ ক’জন পরিবেশ বিশেষজ্ঞসহ খুলনার সচেতন মহলের বড় একটা অংশ দ্রোহীর ১৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন বলে দ্রোহীরা নিশ্চিত করেছে।
দ্রোহীরা আজ এতদূর এসেছে অনেক কষ্ট করে। তারা শুরু করেছিল একটি প্রাইমারি স্কুলের শ্রেণিকক্ষের ফ্লোরে বসে। এক সময় ওই স্কুলে আর নাটকের মহড়া করা সম্ভব হয় না। তারা একটা পুরনো বেড়া এবং গোলপাতার ছাউনি দেয়া ঘর কিনে সংগঠনের কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। সেখানেও বেশি দিন টিকতে পারেনি তারা। জায়গার মালিক তাদের ঘর সরানোর নোটিশ দেয়। তারা ওই ঘর ভেঙে সরকারি খাস জমিতে টিনের চাল এবং নলিবাঁশের বেড়া দিয়ে একটা ঘর বানায়। কিছুদিন পরে সরকারের লোকজন সেই ঘর ভেঙে দেয়। তারা ভাঙা বাঁশ-খুঁটি নিয়ে আরেক জায়গায় ঘর তোলে। বিড়াল যেমন তার বাচ্চা নিয়ে এঘর থেকে ওঘর করে, এবাড়ি থেকে ওবাড়ি করে তেমনি দ্রোহীরা তাদের সংগঠনের বাঁশ-খুঁটি নিয়ে এ জায়গা থেকে ও জায়গা করে বেড়ায়। কোথাও বেশি দিন টিকতে পারে না, টিকতে দেয়া হয় না। অবশেষে নিজেরা চাঁদা দিয়ে একখণ্ড জমি কেনে নিজস্ব ঘর করার জন্য। বছরখানেক ধরে কোনো রকমে জমির দাম মেটাতে পারলেও এখনো ঘর তুলে সেখানে যাওয়া সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। কারণ দ্রোহীরা অন্যের টাকায় ঘর তুলতে চায় না। তারা তাদের সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনায় কোনো ডোনেশন গ্রহণ করে না।
খুলনার সাংস্কৃতিক বলয়ে দ্রোহী এখন প্রচলিত ধারার বাইরে একটি ব্যতিক্রম সংগঠনের নাম। একদল উদ্যমী যুবক প্রতিমুহূর্তে নিজস্ব সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখায় গণমানুষকে। দ্রোহীরা মনে করে তারা সমাজের কাছে দায়বদ্ধ। আগামী প্রজন্মের কাছে দায়বদ্ধ। তারা দেশীয় সংস্কৃতির কাছে দায়বদ্ধ। তারা তাদের দায়বদ্ধতায় কোনো কৃত্রিম প্রলেপ দিতে চায়নি। তারা রঙিন আলো, মেকাপ ও ঝলমলে পোশাকের খোলসে মানুষের মধ্যে কোনো ঘোর সৃষ্টি করতে চায়নি। তারা চেয়েছে গণমানুষ যেন তাদের আলাদা জগতের কেউ না ভাবে। সাধারণ মানুষ যেন দ্রোহীদের প্রত্যেককে নিজেদের মানুষ মনে করে। দ্রোহীরা যা বলে, সাধারণ মানুষ যেন তা মনে রাখে। সাময়িক উত্তেজনাপূর্ণ বিনোদন নিয়ে তারা যেন সব ভুলে না যায়। দ্রোহীরা শুরু থেকে এ্যরিনা পদ্ধতিতে নাটক করলেও এখন এ্যরিনা এবং প্রসেনিয়ামের মিশেলে নাটক প্রদর্শন করে। দ্রোহীরা খুলনার সাংস্কৃতিক জগতে একটি স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টি করতে পেরেছে। সামান্য হলেও গণমানুষের ভেতরে কিছু প্রশ্ন জন্ম দিতে পেরেছে। কিছু মানুষকে তারা অধিকার সচেতন হওয়ার মন্ত্র শেখাতে পেরেছে। দ্রোহীরা বিশ্বাস করে এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে একদিন সফলতা আসবেই, গণমানুষের মুখে হাসি ফুটবেই।
http://www.shaptahik.com/v2/?DetailsId=9903
©somewhere in net ltd.