![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
তুর্কির ইস্তাম্বুলে আমার যাত্রাবিরতি ছিল সাড়ে তিন ঘণ্টা। এয়ারপোর্টের শুল্কমুক্ত বাজার দেখে দেখে সময় পার করলাম। মুসলিম ঐতিহ্যের কিছু স্যুভেনির কিনলাম। যথা সময়ে সব ধরনের নিয়ম কানুন রক্ষা করে এয়ারবাস টিকে ৭১২য় গিয়ে চড়লাম। আমার সিট ছিল জানালার পাশে। আগেই অনলাইন চেক করার সময় আমি পছন্দমতো সিট বুক করে রেখেছি। আমার আসনের সামনে গিয়ে দেখি সেখানে এক ষোড়শী বসে আছে। চেহারায় এবং পোশাকে বেশ আভিজাত্য। তার পাশে বসে আছেন মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক। আমি আরেকবার সিট নম্বর মিলিয়ে দেখলাম, সব ঠিক আছে। বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আপনাদের সিট নম্বর কত? মেয়েটি কোনো কথা বলল না। ভদ্রলোক বললেন, কেন?
-আপনাদের মনে হয় ভুল হচ্ছে, এটা আমার সিট।
তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, আপনার সিট নম্বর কত?
আমি বডিং টোকেন দেখিয়ে উনাকে নিশ্চিত করলাম, মেয়েটা যেখানে বসে আছে ওটা আমার সিট। ভদ্রলোকের গলার আওয়াজ এবার ছোট হয়ে এলো। মিনমিন করে বললেন, আমার মেয়েটা জানালার পাশে বসতে চায়, আপনি ইয়াং মানুষ একটু সেকরিফাইস করেন। আমি মেয়েটার দিকে তাকালাম। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আমি কোনো কথা না বলে মধ্য সারিতে মেয়েটার আসনে বসার উদ্যোগ নিলাম। জঘন্য রকমের বিরক্তিতে শরীর ঘিনঘিন করতে লাগল, কোনো কথা বলতে ইচ্ছা করল না। মেয়েটার আসনে গিয়ে দেখি সেখানে এক ছেলে বসে আছে। বললাম, ভাই এটা কি আপনার সিট? সে জানাল, ‘না’ বাম পাশেরটা তার, কিন্তু সে এই সিটে বসতে চায়। আমি কোনো কথা না বলে বাম পাশের সিটের ওপর নিজেকে ছেড়ে দিলাম। আমার ডান পাশে ওই ছেলেটা আর বাম পাশে অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা এক বয়স্কা মহিলা, মাঝখানে নিজেকে আবিষ্কার করলাম অনুরোধের ঢেঁকি গেলা একজন ‘আবুল’ হিসেবে।
ছেলেটা কেন নিজের সিট রেখে পাশের সিটে বসেছে, তা বুঝতে খুব বেশি সময় লাগল না। তার ডান পাশের সিটে বসেছে একজন সুন্দরী মহিলা। তারা পরস্পরকে হয়তো আগে থেকেই চেনে। সারা পথ তারা খুনসুটি করে কাটাল। ব্যাপক বিরক্তি নিয়ে আমি তাদের পুটুর পুটুর শুনতে বাধ্য হলাম। তাদের গল্পের সীমা শালীনতা অতিক্রম না করলেও আশপাশ দিয়ে ঘুরঘুর করেছে অনেকটা সময়। বুঝতে পারছিলাম, লাগাম ধরে রাখতে দুজনকেই বেশ কসরত করতে হচ্ছিল। এক সময় তারা মি. বিন দেখতে শুরু করলো। আমার কানের পর্দায় অনবরত ধাক্কা দিতে লাগলো খিলখিল হাসি।
বাম পাশের বয়স্কা মহিলা প্রথম দিকে বেশ চুপচাপ ছিলেন। তাকে দেখে কিছুটা অসুস্থ মনে হলো। কেবিন কন্যাদের কাছে দুবার গরম পানি চেয়ে নিলেন ওষুধ খাওয়ার জন্য। কিছুক্ষণ পর তিনিও কথা বলতে শুরু করলেন। আমি তার কথায় মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলাম। তিনি অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন প্রায় ৩০ বছর। স্বামী এখন অসুস্থ। হৃৎপিণ্ডে জটিল অপারেশন করতে হয়েছে দুইবার। এক ছেলে এবং এক মেয়ে, তারা দুজনই ডাক্তার। অস্ট্রেলিয়ার দুটি হাসপাতালে চাকরি করে। আলাদা সংসার পেতে ওখানেই থাকে। দেশে ভদ্রমহিলার অনেক সম্পত্তি আছে। জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ অনেক কিছু। ওগুলো নিয়ে কী একটা ঝামেলা হয়েছে। তিনি দেশে যাচ্ছেন ওই ঝামেলার নিষ্পত্তি করতে। ভদ্রমহিলা কিছুটা ক্ষোভ ঝাড়লেন বাংলাদেশের রাজনীতিকদের ওপর। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয় দলেই তার আত্মীয়স্বজন আছে। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। বরং তাদের দ্বারাই ঝামেলা আরও জটিল হচ্ছে। সহযোগিতার নামে তারা ভোগ-দখলের চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগের দুই-তিন জন মন্ত্রী এমপির নামও বললেন তিনি। যাদের ছেলে মেয়েদের সঙ্গে তার আত্মীয় স্বজনের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু কোনো উপকার হয়নি। তারাই এখন বিভীষণ।
আমি প্রশ্ন করলাম, আপনার ছেলে মেয়েরা কি বাংলাদেশে বসবাসের জন্য কখনো আসবে?
তিনি মাথা দুলিয়ে উত্তর দিলেন, ‘না’।
আপনাদের কি আসা হবে?
তিনি এবারও মাথা দুলালেন। আমি তার মাথা দুলানোর কোনো অর্থ খুঁজে পেলাম না। উত্তরের জন্য তাকিয়ে থাকলাম চোখের দিকে। মনে হলো তার বুকের গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। কিছুটা সময় নিয়ে তিনি বললেন, মনে হয় না। আমার হাজবেন্ডের শারীরিক যে অবস্থা তাতে আর দেশে ফেরা হবে বলে মনে হয় না। ছেলে মেয়েরাও আসতে দিতে চায় না। তারা বলে, অস্ট্রেলিয়ার মতো চিকিৎসা বাংলাদেশে পাওয়া যাবে না।
আমি বললাম, আপনি নিজেও তো অসুস্থ বলে মনে হয়।
তিনি আমার কথায় সায় দিলেন। আমি বললাম, আপনাদের শরীর এবং বিদেশে থাকার দীর্ঘ অভ্যাসের কারণে এখন আর দেশে ফেরা হবে না। আপনাদের বয়সও বারবার দীর্ঘ ভ্রমণের অনুকূলে নেই। ছেলে মেয়েরা আসবে না। তাহলে দেশের এত সম্পদ কী হবে? ওগুলো কেন করেছেন? আর কেনইবা এই বয়সে ছুটছেন তা রক্ষা করতে? আমি বিদেশে থাকি, আমি বুঝতে পারি বিদেশে আয় করে দেশে সম্পদ করা কত কঠিন এবং কষ্টসাধ্য কাজ। তা রক্ষা করার ঝক্কিও অনেক। অথচ এই সম্পদগুলো দেশে ফেলে না রেখে বিদেশে ইনভেস্ট করলে আপনারা আরও অনেক ভালো থাকতেন। আপনাদের জীবনযাপন অনেক সহজ এবং উপভোগ্য হতো। অযথা কষ্ট করেতে হতো না।
মনে হলো তিনি আমার কথাগুলো পছন্দ করলেন না। আবার অমতও করলেন না। আমি বুঝে গেলাম একেই বলে নাড়ির টান। একেই বলে সত্যিকারের দেশপ্রেম। দীর্ঘ প্রবাস জীবনে আমি হাজার হাজার প্রবাসীকে জানি, যারা নিশ্চিত করে জানেন জীবনে আর কখনো বসবাসের জন্য বাংলাদেশে ফেরা হবে না। তবু তারা বাংলাদেশে সম্পদ করেন। জায়গা-জমি, ফ্ল্যাট-বাড়ি কেনেন। ব্যাংকে টাকা জমান, বীমা করেন। কেন করেন তার সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর তাদের কাছে নেই। তারা প্রবাসে প্রতিনিয়ত কষ্ট করেন। কতভাবে যে পয়সা বাঁচানোর চেষ্টা করেন, তা বলে শেষ করা যাবে না। তারা যা আয় করেন, তা দিয়ে দিব্বি একা একটা বাসা ভাড়া করে থাকতে পারেন আরাম করে, কিন্তু থাকেন না। সাবলেট ভাড়া দিয়ে পয়সা বাঁচাতে চেষ্টা করেন। তাদের আয়ের পুরোটা বিদেশে খরচ করলে তারাও দামি গাড়ি চালাতে পারেন। জীবনকে নানাভাবে উপভোগ করতে পারেন, কিন্তু করেন না। পয়সা বাঁচাতে পুরনো গাড়ি কেনেন। দেশ থেকে জামা-কাপড় এনে গায়ে পরেন। ঘরের আসবাব কেনার দরকার হলে চলে যান পুরাতন মার্কেটে। শীতের সময় ঘরের হিটার কম চালান বিলের টাকা বাঁচানোর জন্য। কষ্ট করে ঠাণ্ডা পানি ব্যবহার করেন। এমনকি সন্তানদের পেছনেও প্রয়োজনের চেয়ে একটু কম খরচ করার চেষ্টা করেন। এই সবকিছুর পেছনে লুকিয়ে আছে পয়সা বাঁচিয়ে দেশে পাঠানোর অদম্য বাসনা। ইচ্ছা করলেও তারা রেস্টুরেন্টে গিয়ে দু’বেলা খান না। বাজারে গিয়ে ভালো-মন্দ কেনার আগে বারবার হিসাব করেন। বাংলাদেশের দামের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন কুড়িবার। তারা নিজেরাও জানেন, এই মেলানোর কোনো মূল্য নেই, তবু মেলান যদি দু’পয়সা বাঁচানো যায়। কাজের ফাঁকে যেটুকু সময় পান পার্টটাইম কিছু একটা করে বাড়তি ক’পয়সা রোজগারের চেষ্টা করেন। এত কষ্ট করে পয়সা আয় করেন, সেই পয়সা নিজে ভোগ না করে দেশে সম্পদ গড়েন। দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করেন। এদের চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক, এদের চেয়ে বড় সম্মানী মানুষ আর কে হতে পারে? অথচ এই মানুষগুলোর সঙ্গে এয়ারপোর্টে পশুর মতো ব্যবহার করা হয়। অসম্মান এবং হয়রানির একদম তলাতিনে নিয়ে যাওয়া হয়। এদের টাকা দিয়ে এয়ারপোর্টে ভিআইপি লাউঞ্জ নির্মাণ করা হয় যাদের জন্য, তারা বিদেশে টাকা পাচার করে। তারা শতশত সফরসঙ্গী নিয়ে বিদেশে যায়। বড় বড় ব্যাগ ভরে দেশের সম্পদ বিদেশে নিয়ে যায়। এদের পাঠানো বিদেশি মুদ্রায় তারা ইউরোপ আমেরিকায় সেকেন্ড হোম নির্মাণ করে। বাংলাদেশ যদি সত্যিকারের কোনো সভ্য মানুষের দেশ হতো, বাংলাদেশের চালকের আসনে যদি ন্যূনতম বিবেকবান মানুষ থাকত, তবে এই প্রবাসীরা দেশে গেলে বীরের মর্যাদা দেয়া হতো। সর্বোচ্চ নাগরিক মর্যাদা দেয়া হতো। এয়ারপোর্টের ভিআইপি লাউঞ্জ থাকতো প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য। কিন্তু হায়, অযোগ্যদের হাতে ঘুরেফিরে প্রিয় বাংলাদেশের ক্ষমতা যায়।
(চলবে)
০৭ ই মে, ২০১৫ দুপুর ২:৪৯
পলাশ রহমান বলেছেন: ১০০% সহমত!
২| ২৭ শে এপ্রিল, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২৮
কেএসরথি বলেছেন: মিনমিন করে বললেন, "আমার মেয়েটা জানালার পাশে বসতে চায়, আপনি ইয়াং মানুষ একটু সেকরিফাইস করেন"
এই রকম খুবই ছোট-খাট অন্যায় আবদার মেনে নিতে নিতেই কিন্তু আমাদের ভেতরে একটা নিয়ম চালু হয়ে গেছে। সবাই যদি নিয়ম মেনে চলত - তাহলে কোথাও কোন সমস্যা হতো না।
আর এসবের পেছনে দায়ী অভিভাবক রাই। এই বাবা আজ তার সন্তানকে বুঝিয়ে দিল, তার কিছু দরকার হলে, তার বাবা সেটা করে দিতে পারবেন, বেআইনীভাবে হলেও।
আজ সে আপনার সিট দখল করল। কাল সে আপনার পরে এসে, আপনার আগে লাইনে চলে যাবে, কাল সে পরীক্ষায় ফেল করার পরও পাশ করে যাবে - অথচ ছোটবেলা থেকেই যদি বাবা-মা তাদের সন্তান কে বোঝান যে, যার যার টা নিজের নিজের করে নিতে হবে, তাহলে সন্তানরাও কিন্তু এভাবে বড় হতো না।
আজ যদি এই মেয়েটা সঠিক শিক্ষা পেত, তাহলে সে কি করত?? সে তার সিটেই বসত, এবং আপনার জন্য অপেক্ষা করত। আপনি আসার পর সে হয়ত বলে দেখত, আপনি সিট বদল করতে চান কি না। আগে থেকেই আপনার সিট দখল করে রাখত না।
০৮ ই মে, ২০১৫ বিকাল ৩:৪৭
পলাশ রহমান বলেছেন: ঠিক কথাই বলেছেন কেএসরথি। বাবা মা'রাই পারেন সন্তানদের সঠিক শিক্ষা দিতে।
©somewhere in net ltd.
১|
২৭ শে এপ্রিল, ২০১৫ বিকাল ৪:১২
আকরাম বলেছেন: সুন্দর লিখা।
দীর্ঘ প্রবাস জীবনে আমি হাজার হাজার প্রবাসীকে জানি, যারা নিশ্চিত করে জানেন জীবনে আর কখনো বসবাসের জন্য বাংলাদেশে ফেরা হবে না। তবু তারা বাংলাদেশে সম্পদ করেন। জায়গা-জমি, ফ্ল্যাট-বাড়ি কেনেন। ব্যাংকে টাকা জমান, বীমা করেন। কেন করেন তার সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর তাদের কাছে নেই। তারা প্রবাসে প্রতিনিয়ত কষ্ট করেন।
বাংলাদেশ যদি সত্যিকারের কোনো সভ্য মানুষের দেশ হতো, বাংলাদেশের চালকের আসনে যদি ন্যূনতম বিবেকবান মানুষ থাকত, তবে এই প্রবাসীরা দেশে গেলে বীরের মর্যাদা দেয়া হতো। সর্বোচ্চ নাগরিক মর্যাদা দেয়া হতো। এয়ারপোর্টের ভিআইপি লাউঞ্জ থাকতো প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য। কিন্তু হায়, অযোগ্যদের হাতে ঘুরেফিরে প্রিয় বাংলাদেশের ক্ষমতা যায়।
১০০% সহমত