নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মাদকের বিরুদ্ধে অবিরাম প্রতিবাদ....

পলাশ রহমান

লিখার মতো কিছু নেই।

পলাশ রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

নাড়ির টানে টানাটানি ৭

৩০ শে এপ্রিল, ২০১৫ দুপুর ১:২৪

নভো এয়ারলাইনের একটি লক্কড়-ঝক্কর এয়ারবাসে চড়ে যশোর এসে নামলাম। সময় লাগল মাত্র কুড়ি মিনিট। মনে মনে বললাম, আহারে- ছোট্ট একটা দেশ, এমাথা থেকে ওমাথা যেতে কতটুকই বা সময় লাগে! অথচ যোগাযোগ ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা এবং বেহাল দশার জন্য প্রতিদিন কত লক্ষ ঘণ্টা ব্যয় হয় পথে পথে অবহেলায়। ঢাকা থেকে প্লেনে না চড়ে যদি রাজপথে রওনা করতাম, গাড়িতে পেট্রলবোমা পড়–ক বা না পড়–ক, ভাঙা রাস্তার ঝাঁকুনিতে আধমরা হতে হতো। আর সময়? ইস্তাম্বুল থেকে ঢাকা আসতে যে সময় লেগেছে, তার চেয়েও বেশি সময় পড়ে থাকতে হতো ফেরিঘাটে।
প্লেন থেকে নেমেই দেখি আমার ভাই ইসমাইল হোসেন বাবু এবং বন্ধু ওহিদুজ্জামান রিপন দাঁড়িয়ে আছেন। তারা দু’জন একবারে নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছেন। কীভাবে তারা ওখানে গেছেন আমি জানি না। হয়তো এয়ারপোর্টের কাউকে ম্যানেজ করে তারা ওখানে ঢুকেছেন। কারণ আমার বন্ধু ওহিদুজ্জামান রিপনের ব্রাকেটে একটা নাম আছে যা আমরা (বন্ধুরা) সবাই জানি, তা হলো ‘ম্যানেজ মাস্টার’। যেকোনো কঠিন পরিস্থিতি তার কাছে যেন কিছুই না। উড়িয়ে দেয় কর্পূরের মতো। মানুষের কানের কাছে ফিসফিস করে কী যে বলে, কিছুই বুঝতে পারি না, সব ম্যানেজ হয়ে যায় মুহূর্তের মধ্যে। আমি আজ পর্যন্ত তাকে ব্যর্থ হতে দেখিনি। যেখানে শক্ত হওয়ার দরকার সেখানে সে লৌহদণ্ড, যেখানে ঝাড়-ফুঁক দরকার সেখানে তা-ই প্রয়োগ করে। অর্থাৎ যেখানে যে দাওয়াই দরকার তা প্রয়োগ করতে একটুও কার্পণ্য নেই তার মধ্যে। কী যেন একটা যাদু আছে পোলাটার মধ্যে। যেকোনো মানুষ তার বশ মেনে যায় মুহূর্তের মধ্যে। রাস্তার ফকির থেকে শুরু করে সমাজের উঁচু তলার মানুষগুলোও তার ভক্ত হয়ে যায়। আর মেয়েরা? দু’চারজন তো সারা বছরই প্রেমে ঝুলে থাকে। রিপনের যাদুসংক্রান্ত একটা ঘটনা বলিÑ এ বছর দেশে যাওয়ার পর আমার ভাই বললেন, দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ভালো না। এই সময়ে দেশের মধ্যে কোথাও ঘুরতে যাওয়া একদম নিরাপদ না। (দেশে গিয়ে আমরা প্রায়ই এদিক-ওদিক ঘুরতে যাই) চলো, আমরা ইন্ডিয়া থেকে ঘুরে আসি। ভাইর কথামতো খুলনার ভিসা অফিসে ইন্ডিয়ান ভিসার জন্য আমি পাসপোর্ট জমা দিলাম। পাসপোর্ট ফেরত দেয়ার তারিখ পড়ল দু’সপ্তাহ পরে। এর মধ্যে খবর পেলাম দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য যথা সময়ে পাসপোর্ট তারা ফেরত দিতে পারছে না। বেশ ক’জন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হলো, তাদের পাসপোর্ট ফেরত দেয়ার সময় পার হয়েছে বেশ আগে কিন্তু ভিসা অফিস বলছে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তারা ঢাকা থেকে পাসপোর্ট আনতে পারছে না। আমি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। সময়মতো পাসপোর্ট না পেলে ইন্ডিয়ায় যাওয়া তো হবেই না, আমার ইতালির ফ্লাইটও মিস হওয়ার সম্ভাবনা ব্যাপক। এ অবস্থায় করণীয় কী, তা জানতে একদিন আমি আর আমার ভাই গেলাম খুলনার ভিসা অফিসে। তারা আমাদের পাত্তাই দিলো না। অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম, দরজা খুলল না। সে কী বাজে ব্যবহার তাদের, আমি জীবনেও ভুলব না। অবশেষে বন্ধু রিপনের দ্বারস্থ হলাম। সে গেটে গিয়ে কী যেন বলল, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গেট খুলে গেল। ম্যানেজারের রুমে যেতেই তিনি সমাদর করে বসতে বললেন। ডিংডাং বাজিয়ে চা দিতে বললেন। আমরা আমাদের সমস্যার কথা বললাম। তিনি জানালেন, আগে থেকে এসে খুব ভালো করেছেন। সত্যিই যথাসময়ে পাসপোর্ট ডেলিভারি করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি পরামর্শ দিলেন, ঢাকা থেকে পাসপোর্ট তুলে নেয়ার জন্য। ঢাকা অফিসের একজন কর্মকর্তাকে আমাদের বিষয়টি ফোনে জানিয়ে দিলেন। আমরা ঢাকার গুলশানস্থ কার্যালয়ে গেলাম। সে কি এলাহি কাণ্ড! পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য। ভিসা অফিসের সামনের রাস্তা স্থায়ী লোহার বাঁশ ফেলে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সকল প্রকারের সাধারণ চলাচল বন্ধ। আমি বেশ অবাক হলাম, একটা ভিসা অফিসের জন্য এভাবে একটা রাস্তা বন্ধ করে দেয়া যায়? জনসম্পদ কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কাজে এভাবে ব্যবহার করা যায়? আমাদের দেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশে কি এটা করা সম্ভব হতো? সত্যিই সব (অপ) সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ। যে দেশে নদীর মাঝখানে বাঁধ দিয়ে ইন্ডিয়ান গাড়ি চলাচলের জন্য রাস্তা করে দেয়া হয়, পৃথিবীর একমাত্র ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন ধ্বংসের ঝুঁকি নিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়, দুই শতাংশ ভোট নিয়ে বহাল তবিয়তে সরকার দেশ চালায়, বক শিকারের মতো সরকার মানুষ শিকার করে, জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে বারবিকিউ করা হয়, সে দেশে একটা রাস্তা বন্ধ করে দেয়া এমন আর কী আপরাধ! ভিসা অফিসের সামনের রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অনেকেই রাস্তার ওপর বসে পড়েছে। গোটা পরিস্থিতি আমার কাছে রীতিমতো অমানবিক, অসম্ভব মনে হয়েছে। আমি একটা বিষয় কিছুতেই বুঝতে পারিনি, ইন্ডিয়ান ভিসা তো বিনে পয়সায় দেয়া হয় না। মোটা অঙ্কের ভিসা ফি নেয়া হয়। একজন মানুষ যখন ফি দিয়ে কোনো কাজ করতে যায় তার তো ন্যূনতম সুবিধা, নিরাপত্তা, মর্যাদা পাওয়া উচিত। টাকা খরচ করে ভিসা নিতে যাওয়া মানুষগুলো কেন অমানবিকভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে? কে নিশ্চিত করবে তাদের নিরাপত্তা? সেখানে কোনো অঘটন ঘটলে কে নেবে এর দায়? নেবে ইন্ডিয়ান ভিসা অফিস? তাছাড়া রাস্তার মালিকানাতো ইন্ডিয়ান ভিসা অফিসের না যে তারা তাদের কাজের জন্য রাস্তা দখল করে রাখবে! ভিসা প্রদান করা- না করা ইন্ডিয়ান ভিসা অফিসের কাজ, এ কাজ সম্পন্ন করার জন্য তারা তাদের জায়গা ব্যবহার করবে, রাস্তা কেন? (এই কথাগুলো শুধু ইন্ডিয়ান ভিসা অফিস নয়, ঢাকাস্থ অন্যান্য যেসব অফিস এমন কাজ করে সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য) ওই নগরে যারা ট্যাক্স দিয়ে বসবাস করে তারা কেন এই অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করে? তারা কেন তাদের নাগরিক অধিকার আদায়ের জন্য শক্ত হয় না? ইন্ডিয়া টাকার বিনিময়ে মানুষকে ভিসা দেয়। সুতরাং ভিসা প্রার্থীদের বসার ব্যবস্থা করা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তাদের দায়িত্ব। সম্মান এবং সুষ্ঠু সেবা পাওয়া এই মানুষগুলোর ন্যায্য অধিকার। তারা তা না করে একটা রাস্তা চলাচলের অযোগ্য করে রেখেছে। আমরা ভিড় কেটে কেটে সামনের দিকে এগুতে লাগলাম। গেট পর্যন্ত পৌঁছাতে আমাদের বেশ কসরত করতে হলো। দফায় দফায় কৈফিয়ত দিতে হলো। গেটে গিয়েও দাঁড়িয়ে থাকতে হলো অনেক সময়। তারা কোনো কথাই শুনতে চায় না। এক পর্যায়ে রিপন একটু জোর করেই তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, তোমাদের অমুক অফিসারের সঙ্গে আমার এপয়েনমেন্ট করা আছে। আমরা ভেতরে যাওয়ার অনুমতি পেলাম। অফিসারের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি অন্য একজনের কাছে পাঠালেন। অন্য একজনের পাট দেখে মনে হলো আমরা পাড়া-মহল্লার কোনো উঠতি মাস্তানের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। যাই হোক তিনি আমাদের বিকালে যেতে বললেন। বিকালে তার দেয়া সময়মতো আমরা অভিন্ন কসরত করে ভেতরে গেলাম। আমাদের আগমন বার্তা তার কাছে পাঠালাম। প্রায় দুই ঘণ্টা বসিয়ে রাখার পর তিনি আমার পাসপোর্ট দিলেন। পাসপোর্ট নিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে আমার মনে হলো- মানুষের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করতে এরা সবাই বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত।
এই হলো আমাদের ম্যানেজ মাস্টার ওহিদুজ্জামান রিপন। সে না থাকলে দফায় দফায় এত কৈফিয়ত দিয়ে এবং মাথা ঠাণ্ডা রেখে এত রুক্ষ আচরণ মোকাবিলা করে আমি কোনোভাবেই শেষ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারতাম না।
যশোর এয়ারপোর্টে নেমেই আমার ভাই এবং ম্যানেজ মাস্টারকে দেখে মনটা খুশিতে ডগমগ করে উঠল। তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে এলাম এয়ারপোর্ট থেকে। আমি তখনো জানি না এয়ারপোর্টের বাইরে আমার জন্য জীবনের অন্যতম এক বিস্ময় অপেক্ষা করছে। তারা আমাকে নিয়ে যে গাড়িতে তুললেন সেটা কোনো সাধারণ গাড়ি নয়, এম্বুলেন্স। আমার জীবনের অন্যতম এক স্মরণীয় ঘটনা হলো এই এম্বুলেন্স, কারণ এটাই আমার জীবনের প্রথম এম্বুলেন্সে চড়া।

(চলবে)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.