![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রিয় মা,
কেমন আছ তুমি? অনেক দিন তোমাকে চিঠি লেখা হয় না। অনেক দিন কোথায় বহুদিন, এই বহুদিন যে কতো দিন তা আমার মনে নেই। তোমার কী মনে আছে? প্রযুক্তির আবিষ্কার আজ তোমার আর আমার দুরত্ব কমিয়ে দিয়েছে। ইচ্ছা করলেই টেলিফোনে কথা বলা যায়, স্কাইপে তোমাকে দেখা যায়। তার পরেও সব সময় দেখা হয় না, কথা হয় না। কেমন যেনো যান্ত্রিক হয়ে গেছি। না হয়েই বা উপায় কী বলো, যান্ত্রিক সভ্যতার দেশে থাকতে থাকতে আমরা যে যন্ত্রমানুষে বদলে গেছি।
ভাবছো এতদিন পর হঠাৎ কেনো চিঠি লিখতে ইচ্ছে হলো? তেমন কোনো কারন নেই, কিন্তু বিশেষ একটা কারন আছে। আজ বিশ্ব মা দিবস। এই দিবস নিয়ে অনেকে বিতর্ক করে, বলে মাকে ভালোবাসতে আবার দিবস লাগে নাকি! আমি তাদের সাথে একমত হই না, হতে পারি না। আমি মনে করি অবশ্যই একটা দিবস থাকা উচিৎ। এতএত দিবসের ভিড়ে একটা দিবস আমার মার জন্য, ভাবতেই তো ভালোলাগে। মা দিবস যদি না থাকতো যান্ত্রিক এই জীবনে তোমাকে কী আর চিঠি লেখা হতো? হতো না।
জানো মা, এখনো প্রতিদিন আমি পত্রিকার উপসম্পাদকীয় লেখাগুলো পড়ি। অনেক অভ্যাসের মতো এ অভ্যাসটাও তোমার কাছ থেকে পেয়েছি। আমার ছোট সময়ে তুমি সারাদিনের কাজ শেষ করে বিছানায় শুয়ে ওই কলামগুলো পড়তে, আমিও শুয়ে থাকতাম তোমার পাশে। তখন এতকিছু বুঝতাম না, তোমার গায়ে গা লাগিয়ে শুয়ে থাকাটাই ছিল মহাআনন্দের। তোমার মনে আছে, মাঝে মাঝে তোমার গায়ের ওপর উঠে শুয়ে থাকতাম। হঠাৎ হঠাৎ কেউ দেখে ফেল্লে লজ্জা পেতাম। ধীরে ধীরে আমি যখন বড় হতে থাকি, তোমার উৎসাহেই পত্রিকা পড়তে শুরু করি। এক সময় বিভিন্ন লেখকদের লেখা কলামগুলো নিয়ে আমরা কথা বলতাম। মাঝে মধ্যে আব্বাও আমাদের সাথে যোগ দিতেন। তবে অধিকাংশ সময় তিনি শুনতেই বেশি পছন্দ করতেন। আমরা যদি কোনো বিষয়ে একমত হতে না পারতাম বা ভুল ব্যাখ্যা করতাম তখন তিনি কথা বলতেন। আমরা বুঝে যেতাম, যে লেখা নিয়ে আমরা কথা বলছি তা তিনি আগেই পড়ে ফেলেছেন।
এতদিন তোমাকে বলা হয়নি, আজ একটা সত্যি কথা বলি- পত্রিকার লেখা পড়ে তোমার সাথে আমি যখন বিতর্ক করতাম, তোমার ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে আমার কাচা ব্যাখ্যা দাঁড় করাতাম, তুমি ভীষণ রেগে যেতে, তোমার ওই রাগটুকুর জন্যই আমি অমন করতাম। আসলে তোমার সাথে আমার কোনো ভীন্নমত ছিলনা, এখনো নেই। তুমি যখন অনেক রাত পর্যন্ত বই পড়তে তোমাকে নিয়ে আমরা (ভাই বোনরা) অনেক হাসি মশকারি করতাম। রাতে যখন দেরি করে বাড়ি ফিরতাম, প্রায়ই দেখতাম তোমার ঘরে আলো জ্বলছে অথচ আব্বা গড়গড় করে নাক ডাকছেন। আমি জানালার ফাকা দিয়ে দেখতাম, আব্বা বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন আর তুমি তার পাশেই শুয়ে আছ কোনো একটা বই মুখের সামনে ধরে। রাত জেগে তোমার বই পড়া নিয়ে আমরা মজা করে বলতাম, সকালে তোমার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা।
আমি জানি, তুমি উপন্যাস খুব পছন্দ করতে। উপন্যাসের কোনো বই পেলেই তোমার নাওয়া খাওয়া বন্ধ হয়ে যেতো। যত বড় বই’ই হোক তুমি একটানে শেষ না করে ছাড়তে না। আমিও উপন্যাস পড়ি, কিন্তু তোমার মতো এতবড় পাঠক হতে পারিনি মা। তারপরও যখন কোনো বই পড়ি, পত্রিকা পড়ি তোমার কথা মনে পড়ে। তোমার সাথে আলোচনা করার, বিতর্ক করার সময়গুলো অনুভব করি। জানো মা, আমি একবার মনস্থির করেছিলাম উপন্যাস লিখবো। শুরুও করেছিলাম। কপাতা লিখার পরে বুঝতে পারি ওকাজ আমার না। গল্প বানানোর বিন্দুমাত্র ক্ষমতা আমার মধ্যে নেই। গোপনে ওইচ্ছার কবর খুড়ি।
মা, আজ রাতে তুমি কী খেয়েছো? আমি জানি, অনেক বছর হলো রাতে কোনো ভারী খাবার খাওনা তুমি। আমিও তোমাকে অনুস্মরণ করতে চাই, রাতে ভারী খাবার বন্ধ করতে চাই, কিন্তু পারি না। কী ভাবে পারবো বলো, এখানে যে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। না খেলে কাজ করবো কী করে! এক্ষেত্রে তোমাকে অনুস্মরণ করা হয় না আমার। যখনি খাবার সামনে নিয়ে বসি, তোমার আর বাবার কথা মনে পড়ে। তুমি বড় মাছ, দুধ, এগুলো খেতে খুব পছন্দ করো, আমি যখন এসব খেতে যাই মাঝে মাঝে গলা দিয়ে নামতে চায় না। মনে হয়, আমি এত ভালো ভালো খাবার খাচ্ছি, এই মুহুর্তে আমার মা কি খাচ্ছে? বাংলাদেশে তো টাকা থাকলেও স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া যায় না, পাওয়া যায় না। দুধ দিয়ে এদেশে কতো যে হাজার পদের খাবার তৈরী করা হয় তা বলে শেষ করা যাবে না। শুধু পনিরই বানানো হয় কয়েক শ পদের। সমুদ্রের বড়বড় মাছ পাওয়া যায়। তুমি তো দেখেছো, দুবছর আগে যখন আমার কাছে এসেছিলে তখন তোমাকে আমি সবকিছু দেখাতে, খাওয়াতে চেষ্টা করেছি। ইচ্ছা থাকার পরেও তোমাকে অনেক কিছু খাওয়াতে পারিনি, ডাক্তারের নিষেধ ছিল। এখনো আমি ওই খাবারগুলো মুখে দিতে পারি না। বুকের মধ্যে খচখচ করে, যা তোমাকে খাওয়াতে পারিনি তা নিজে খাই কী করে বলো!
জানো মা, তোমার জন্মদিনে আমার ফেসবুকের পাতায় তোমার ছবি দিয়ে একটা ছোট্ট লেখা পোষ্ট করেছি। অনেক মানুষ তাতে লাইক দিয়েছে, কমেন্ট করেছে, তোমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছে। আমার কী যে ভালো লেগেছে তা বলে শেষ করতে পারবো না। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এখনো অনেক আবেগ ভালোবাসা শ্রদ্ধা সহমর্মিতা রয়েছে, যা ইউরোপের মানুষদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। এরা বড় বেশি বস্তুবাদী। এতটা বস্তুবাদ আমার ভালো লাগে না। এদেশের ছেলে মেয়েরা তাদের মাকে 'মাম্মা' বলে ডাকে। আমার কী যে রাগ লাগে তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না। মা কে 'মা' বলে ডাকার মধ্যে যে তৃপ্তি, শান্তি, সুখ তা কী এরা বুঝবে কোনো দিন? বুঝবে না। জীবনে এরা হয়তো অনেক কিছু পেয়েছে, পাবে, কিন্তু মাকে 'মা' বলে ডাকার সুখ পাবেনা কোনো দিন। একজন মাকে কেন্দ্র করে যে এক জীবন পার করে দেয়া যায় তা এরা বুঝবেনা কোনো দিন, আমাদের মতো করেতো না'ই।
তুমি তো আমার নতুন বাসা দেখনি। তুমি দেশে চলে যাওয়ার পর আমি বাসা বদল করেছি। নতুন বাসার নিচ তলায় একজন বৃদ্ধা থাকেন। বৃদ্ধাকে দেখভাল করার জন্য একজন কাজের মেয়ে রাখা আছে। ওই বৃদ্ধার ছেলের বাসা আমাদের এই বাসা থেকে মাত্র তিন শ গজ দুরে। ওখানে সে আলাদা বাসা নিয়ে থাকে। সপ্তাহে একদিন বৃদ্ধা মাকে দেখতে আসে। এটা কোনো জীবন হলো বলো! আমার কাছে এমন জীবনকে শুধু বস্তুবাদী জীবন না, পশুবাদী জীবন বলে মনে হয়। গেল বছর আমার এক বন্ধুর শাশুড়ি মারা গিয়েছে। তার শেষকৃত্যে আমিও গিয়েছিলাম। আমার বন্ধু এবং তার স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার সময় খুব অবাক হয়ে দেখলাম, বন্ধুর স্ত্রী অর্থাৎ মৃতমানুষটার মেয়ে খুব স্বাভাবিক ভাবে আমাদের সাথে গল্পগুজব করছেন। কোনো ভাবেই বোঝার উপায় ছিল না, তার মা মারা গিয়েছে। তিনি হাসপাতালের হিমঘরে যাচ্ছেন মার মৃতদেহ দেখতে। হিমঘরে ঢোকার পরে মেয়ে তার মার মৃতদেহ ছুয়ে কিছুটা কান্না করলেন, ব্যাগ থেকে মার ব্যবহৃত একটা টুপি বের করে বললেন, মা এটা তোমার টুপি। তোমার টুপিটা আমার কাছে রয়ে গেছে। তুমি বাসা থেকে আসার সময় এটা নিতে ভুলে গেছো, ইত্যাদী। তার কান্না এবং সংলাপের দীর্ঘতা ছিল সর্বসাকুল্যে তিন মিনিট। এর পর লাশের সৎকারীরা কফিনের শেষ পেরেক ঠুকে দেয়। আমরা চলে যাই গীর্জায়। আমাদের আগেই এজেন্সির সৎকারীরা লাশ নিয়ে গির্জায় পৌছে যায়। গীর্জার পুরোহিত তার কার্য সম্পাদন করেন। লাশের বাক্স ধরে কটা সেলফি তোলেন আমার বন্ধুর স্ত্রী। সৎকারীরা লাশের বাক্স নিয়ে চলে যায় গোরস্থানে। আমরা চলে আসি বন্ধুর বাসায়। সব কিছু আগের মতোই স্বাভাবিক, কিছু সময় আড্ডা দিয়ে যে যার বাসায় চলে যাই। বন্ধুর এক ছেলে এবং এক মেয়ে, হাসপাতালে বা গীর্জায় কোথাও বাচ্চাদের যেতে দেখলাম না। বন্ধুর শাশুড়ি মারা যাওয়ার সপ্তাহ দুই আগে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে যে কদিন বেঁচে ছিলেন প্রতিদিন একবার তার মেয়ে তাকে দেখতে যেতেন। মেয়ে বাদে মৃতমানুষটার আরো দুই ছেলে আছে, তারা থাকেন অন্য শহরে। সময় করে তারা মাকে এক নজর দেখতে আসেন নিই বা আসতে পারেন নিই। এজেন্সিতে ফোন করে বলে দিয়েছেন, দুইটা ফুলের তোড়া মার কফিনে দিয়ে দেয়ার জন্য।
বলো মা, এটা কী কোনো জীবন হলো? এও নাকি এক ধরনের কালচাল। আমাদের দেশেও নাকি ধিরে ধিরে মানুষ এসব কালচালে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। মা বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। খোজ খবর রাখে না। আমি খুব অবাক হই, আমাদের দেশের মানুষগুলো এমন কেনো? অপসংস্কৃতিতে এত আগ্রহ কেনো? কথার বেলায় সবাই নীতি কথার খৈ ফোটায়, কাজের বেলায় করে ঠিক উল্টোটা। যারা বেশি বেশি ধর্ম বিরোধী কাজ করে তারাই কথায় কথায় আল্লাহ খোদার দোহাই দেয়। একই মানুষ মসজিদ কমিটির সভাপতি আবার যাত্রা দলেরও সভাপতি হয়। এমন অদ্ভুত বিরল বিচিত্র প্রাণী পৃথিবীর অন্য কোথাও আছে বলে আমার মনে হয় না। বাংলাদেশের যার সাথেই কথা বলি, সবাই বলে- আওয়ামীলীগ বিএনপির শাসন কালের অবসন হওয়া দরকার। এই দুই দল এবং এর নেতানেত্রীরা ধড়িবাজ, দূর্নীতিবাজ। এদের মধ্যে দেশপ্রেম নেই। অথচ ভোটের সময় এই দুই দলের বাইরে কেউ ভোট পায় না। গড়পত্তায় জামানত খোয়া যায়। আমাদের দেশে কেউ তার কাজ সঠিক ভাবে করতে চায় না। সবাই সবাইকে ঠকানোর জন্য, ল্যাং মারার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে। তুমি তো ইউরোপ দেখেছো, এরা আমাদের থেকে অনেক কিছুতে খারাপ হলেও আমাদের মতো খারাপ না, ভন্ড না। নীতি, নৈতিকতা, ভদ্রতা, সামাজিক লজ্জাবোধ আমাদের চেয়ে এদের মধ্যে অনেক বেশি। এরা আর যাই হোক আমাদের মতো ভন্ডামী করে না। মুখে এক কথা বলে কাজে তার উল্টোটা করে না।
মাগো, তোমাকে খুব অনুভব করছি। তোমার গার সাথে গা মিশিয়ে শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে। ছোট সময় আমি তোমার হাত না ধরে ঘুমাতে পারতাম না। অনেক বড় হওয়ার পরেও ওই অভ্যাস আমার মধ্যে ছিল। অথচ এখন দেখো দিব্বি ঘুমাতে পারি, তোমার সাথে কথা না বলেও থাকতে পারি। সময় এবং পরিবেশ মানুষকে কতোটা বদলে দিতে পারে আমিই তার বড় উদাহরণ। অথচ তুমি কিন্তু একটুও বদলাওনি। গেল বছর যখন দেশে গেলাম তুমি হন্যে হয়ে আমড়া খুঁজে বেড়াতে লাগলে। অসময়ে আমড়া না পেয়ে তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন। তালের আটির শাস বের করে ফ্রিজে রেখে দিয়েছিলে সারা বছর। আমি দেশে গেলে তালের আটির শাস এবং আমড়ার সাথে নারকেলের দুধ দিয়ে তোমার যাদুকরি খাটা রেঁধে খাওয়াবে। তোমার সেই ইচ্ছা পুরণ করতে না পেরে খুব মন খারাপ করেছিলে।
জানো মা, যখন একা থাকি, একটু নিরিবিলি থাকি তখন এই কথাগুলো বেশি বেশি মনে পড়ে। মনে হয় একদৌড়ে ছুটে যাই তোমার কাছে। তোমার গায়ে গা লাগিয়ে শুয়ে থাকি। কিন্তু পারি না। দুরত্বের ডান্ডাবেড়ি আমাকে থামিয়ে দেয় বারবার।
ভালো থেকো মা, অনেক ভালো।
১২ ই মে, ২০১৫ সকাল ৯:১৭
পলাশ রহমান বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
২| ১২ ই মে, ২০১৫ রাত ১২:৪১
জাকারিয়া জামান তানভীর বলেছেন: অনেকটা আবেগতাড়িত হয়ে পড়লাম। আপনার মাকে আমার সালাম দিবেন। লেখাটা ভালো লাগল। ধন্যবাদ।
১৩ ই মে, ২০১৫ রাত ৩:৩১
পলাশ রহমান বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই, ভালো থাকবেন।
৩| ১৩ ই মে, ২০১৫ সকাল ৮:৫০
Rukhshad Priyo বলেছেন: লেখাটা দারুন
১৪ ই মে, ২০১৫ ভোর ৪:০৭
পলাশ রহমান বলেছেন: ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১|
১১ ই মে, ২০১৫ দুপুর ২:৫৯
কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: খুব ভালো লেগেছে আপনার লেখা!!