নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সুন্দর একটি পৃথিবী চাই

পিট পলাশ

নিতান্ত অলস একজন মানুষ

পিট পলাশ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভাষা ও সামাজিক স্তরবিন্যাস: কেন্দ্র বনাম প্রান্তের দ্বন্দ্ব

১৫ ই জুলাই, ২০২৫ রাত ১২:০৩

বাংলাদেশ একটি ভাষাগতভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ। দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব উপভাষা, উচ্চারণভঙ্গি এবং লোকজ শব্দভান্ডার রয়েছে, যা কেবল ভাষার মাধ্যমেই নয়, সংস্কৃতি, আত্মপরিচয় এবং সামাজিক শ্রেণি চেতনার সাথেও গভীরভাবে জড়িত। এই উপভাষাগুলো মানুষের মাঝে একধরনের গর্ববোধ বা লজ্জাবোধ – উভয়েরই জন্ম দেয়। এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সূচনা করা যায়: কেন কিছু জেলার মানুষ তাদের আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব অনুভব করেন এবং তা প্রকাশেও দ্বিধাহীন? অথচ অন্য অনেক অঞ্চলের মানুষ ঢাকাকেন্দ্রিক জাতীয় পরিসরে এসে নিজের আঞ্চলিকতা গোপন করতে চান বা চেষ্টা করেন প্রমিত ভাষায় কথা বলার মাধ্যমে নিজেকে উপস্থাপন করতে?

ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী পিয়েরে বুর্দো ভাষাকে বলেছেন “symbolic capital”। এটি এক প্রকার নীরব কিন্তু প্রচন্ড ক্ষমতাবান মুদ্রা, যার মাধ্যমে সমাজের বাজারে লেনদেন চলে। এই বাজারে ঢাকা-কেন্দ্রিক প্রমিত বাংলা যেন ডলার, যার দাপট সর্বত্র চলে। আর আঞ্চলিক ভাষাগুলো যেন একেকটি আঞ্চলিক মুদ্রা। এরা নিজ অঞ্চলে প্রাসঙ্গিক হলেও কেন্দ্রের দরবারে অবমূল্যায়িত। যার ফলে, রংপুর বা ময়মনসিংহ থেকে আসা একজন যুবক যখন ঢাকায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তখন সে শুধু নতুন জেলায় নয়, ভাষায়ও স্থানান্তরিত হয়। তার উচ্চারণ, টান, এমনকি নিঃশ্বাসের তালে তালে চলে এক আত্মপরিচয় নির্মাণ প্রক্রিয়া। যেন সে নিজের কণ্ঠকেই ‘শুদ্ধিকরণ’ করছে, যাতে ‘মানুষ’ হওয়া যায়।

এই রূপান্তর অনেকটা প্লেটোর গুহার উপমার মতো। মানুষ গুহার দেয়ালে ছায়া দেখে সেটিকেই বাস্তব ভাবে। মিডিয়া, শিক্ষা, সরকার–সমাজের কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলো আমাদের শেখায় যে প্রমিত ভাষা, পরিশীলিত টান, কর্পোরেট বাংলাই হলো বাস্তব, আধুনিক ও গ্রহণযোগ্য। আঞ্চলিক ভাষা তখন হয়ে পড়ে গুহার ছায়া। যেন তা একই সাথে অশুদ্ধ, অশোভন, এবং হাস্যরসের বস্তু। অথচ এই ছায়ার বাইরেই একটি বহুরৈখিক বাস্তবতা; যেখানে প্রতিটি উপভাষা তার নিজস্ব সৌন্দর্য ও অভিজ্ঞতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

থিওডোর অ্যাডোর্নো বলেছিলেন ‘Culture Industry’ এক ধরণের মানসিক নিয়ন্ত্রণ। যেখানে সংস্কৃতি আর মননের বিষয় থাকে না, বরং কারখানায় তৈরি পণ্যের মতো ধারাবাহিকভাবে তৈরি হয় ভোগ্যবস্তু হিসেবে। শিল্প তখন আর প্রশ্ন তোলে না, বরং স্বস্তি বিক্রি করে। বাংলাদেশে গণমাধ্যম, সিনেমা, নাটক কিংবা ইউটিউব কনটেন্টে প্রমিত ভাষার একাধিপত্য এবং আঞ্চলিক ভাষার কৌতুককর উপস্থাপন যেন সেই ‘সংস্কৃতি শিল্প’-এরই প্রতিচ্ছবি। এখানে ভাষাও হয়ে ওঠে বাজারজাত সংস্কৃতির অংশ। যেখানে ‘ভদ্রলোক’ হতে হলে শিখতে হয় কিভাবে ‘ভদ্র ভাষায়’ কথা বলতে হয়, অর্থাৎ, কীভাবে নিজের কণ্ঠের স্বরকে মুছে ফেলে একটি আদর্শ, নির্মিত ভাষার মুখোশ পরা যায়। ভাষা তখন কেবল ভাব প্রকাশের মাধ্যম নয়, বরং একধরনের সামাজিক কস্টিউম বা মুখোশ। যার পেছনে লুকিয়ে থাকে ব্যক্তির বাস্তব পরিচয়, ভাঙা টান, অপ্রস্তুত উচ্চারণ, কিংবা দীর্ঘদিনের সংস্কৃতির ভার।

তবে এও সত্য যে, ঢাকার ভাষাব্যবস্থা আজ এক জটিল কোলাজ। প্রমিত ভাষা, আঞ্চলিক টান, ইংরেজি শব্দের আগ্রাসন ও মিডিয়া-নির্মিত উচ্চারণ এখানে একসাথে সহাবস্থান করছে। বিশেষ করে ২০০০ সালের পরবর্তী সময়ে এফএম রেডিও, বিজ্ঞাপন আর কর্পোরেট সংস্কৃতির ছোঁয়ায় গড়ে উঠেছে একধরনের নতুন ভাষা। যাকে কেউ বলেন ‘Banglish’, কেউ বলেন ‘Urban FM Bengali’। এই ভাষায় "literally", "vibe", "chill", "update"– এই ধরনের শব্দ শুধু কথার মাঝে ঢুকে পড়েনি, বরং ভাষাকে একধরনের “গ্ল্যামারাইজড পারফর্মেন্সে” রূপ দিয়েছে। Judith Butler-এর “performativity” ধারণা অনুযায়ী, এ ভাষা এখন হয়ে উঠেছে নিজেকে 'আধুনিক', 'আন্তর্জাতিক' বা 'কুল' হিসেবে তুলে ধরার হাতিয়ার। বাউড্রিলার্ডে 'simulacra' ধারণার মতো, এই ভাষা বাস্তবতার অনুকরণ নয়, বরং মিডিয়া-নির্মিত এক বিকল্প বাস্তবতা; যেখানে ভাষা নয়, স্টাইল বা ফ্যাশনই মুখ্য।

তবে এই রূপান্তর নতুন এক ভাষাগত শ্রেণিবিন্যাসও তৈরি করছে। এই hybrid ভাষার প্রবেশাধিকার মূলত শহরের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত তরুণদের মধ্যেই সীমিত। ফলে, ভাষা আবার হয়ে উঠছে সামাজিক পুঁজির একচেটিয়া সম্পদ। প্রমিত বনাম আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব ছাড়াও এখন তৈরি হয়েছে কর্পোরেট বনাম লোকজ, Netflix টোন বনাম গ্রামীণ টান। যার ভিতরে কেউ নিজের কণ্ঠ সংরক্ষণ করছে, কেউ হারিয়ে ফেলছে, আবার কেউ নতুন এক কণ্ঠ গড়ে তুলছে। ভাষা তাই এখানে কেবল প্রকাশ নয়; তা হয়ে উঠেছে আত্মপরিচয়ের রাজনীতি, যেখানে প্রতিটি উচ্চারণ ক্ষমতার ছায়া বহন করে।

তবে সমাজ মানে শুধু নিয়ন্ত্রণ নয়, সমাজ মানে প্রতিরোধও। এডওয়ার্ড সাঈদের পরিভাষায়. “Counter-narrative” বা পাল্টা ভাষ্য। সেই পাল্টা ভাষ্য আজ চট্টগ্রামের চাটগাঁইয়া ভাষায় উঠে আসছে মঞ্চে, নোয়াখালীর আঞ্চলিক টানে ভাসছে ইউটিউব কনটেন্টে, বরিশালের লোকজ টানে ছড়িয়ে পড়ছে একধরনের লোকগর্বে। হেগেল বলেছিলেন ‘Recognition’ বা স্বীকৃতি মানুষকে মানুষ করে তোলে। তাই একজন নোয়াখালীর যুবক যখন তার ভাষায় কথা বলে, তখন সে কেবল তথ্য দিচ্ছে না, বরং দাবি করছে স্বীকৃতি,-"আমি যেমন আছি, তেমন করেই আমাকে জানো"। এই দাবিই Derrida-র “deconstruction”-এর মতো কেন্দ্রের ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, প্রান্তকে কেন্দ্র করে তোলে।

এই ক্ষমতার প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হয় কিছু অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল বা সিলেটের কিছু অংশের মানুষ তাঁদের আঞ্চলিক ভাষাকে একটি সাব-কালচারাল ব্র্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করেন। এটি শুধু ভাষার ব্যবহার নয়, বরং একটি “পলিটিক্স অফ রেজিস্ট্যান্স”। এটি ফুকোর ভাষায় হবে “counter-discursive performance”–একটি বিপরীত ডিসকোর্স যা ক্ষমতার কেন্দ্রকে চ্যালেঞ্জ করে।

গ্রামসি তাঁর "Cultural Hegemony" ধারণায় বলেছেন, ক্ষমতাশীল শ্রেণি কেবল বলপ্রয়োগ করে না, বরং সাংস্কৃতিক প্রভাব ও ভাষাগত আধিপত্যের মাধ্যমে নিম্নশ্রেণিকে তাদের আদর্শ স্বাভাবিক বলে মানতে বাধ্য করে। বাংলাদেশের ভাষা ব্যবস্থায় প্রমিত বাংলা তাই শুধু ‘শিক্ষিত’ ভাষা নয়, বরং ‘মান্য’ ভাষা হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে। এমনকি ঢাকাতেই যারা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন, তাঁদের অনেকে নির্দিষ্ট অঞ্চল বা শ্রেণিতে সীমাবদ্ধ থাকেন। যেমন, গার্মেন্টস শ্রমিক, রিকশাচালক, বাজারের বিক্রেতা বা নিম্ন আয়ের পেশাজীবী। অন্যদিকে একই এলাকার শিক্ষার্থী, সাংবাদিক বা কর্পোরেট কর্মী মুখে আঞ্চলিক টান থাকলেও চেষ্টার মাধ্যমে তা পরিশোধন করেন, কারণ সেটিই সামাজিক উত্তরণের অদৃশ্য প্রক্রিয়ার অংশ।

এই পরিস্থিতিকে আমরা হাবারমাসের "Communicative Rationality"-এর আলোকে দেখতে পারি। হাবারমাস ভাষাকে দেখেছিলেন পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যম হিসেবে, যা একধরনের মুক্তি দেয় সামাজিক বিকৃত যোগাযোগ (distorted communication) থেকে। কিন্তু আমাদের প্রসঙ্গে দেখা যাচ্ছে, ভাষাই হয়ে উঠছে একধরনের বিকৃতি; যেখানে মানুষ প্রমিত ভাষায় কথা বলেও নিজের অস্তিত্বকে গোপন রাখছেন; যেখানে ভাষা হয়ে উঠছে আত্মবিক্রয়ের প্রতীক। ভাষার এই অদলবদল ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে একধরনের আত্মপরিচয় সংকট তৈরি করে। যা শুধু ভাষাগত নয়; বরং একটি সামগ্রিক সাংস্কৃতিক উদ্বেগের প্রতিফলন।

কিন্তু এই প্রতিরোধ সর্বজনীন নয়। অনেকেই এখনও নিজের ভাষা গোপন করেন, হয়তো নিজের জেলা উচ্চারণেও দ্বিধা অনুভব করেন। এটি একটি অস্তিত্ব সংকট, যেখানে মানুষ তার শেকড় লুকিয়ে ফেলে যাতে ডালপালা সোজা হয়। যেন নদীর পানি নিজেই ভুলে যায় তার উৎস কোথায়। ভাষার এই অস্বীকৃতি আত্মপরিচয়ের এক তীব্র আত্মসংঘাত হয়ে দাঁড়ায়। ফলে একটি গলার স্বর নিজের উচ্চারণ হারিয়ে ফেলে। শুধু এই আশায় যে, অন্যরা তাকে গ্রহণ করবে।

ঢাকায় আজ ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে একধরনের সমাজ-সাংস্কৃতিক সার্কাসের কেন্দ্র। কেউ নিজের ভাষা পরিবর্তন করেন সামাজিক মর্যাদা অর্জনের আশায়। আবার কেউ নিজস্ব টান নিয়ে দাঁড়ান, যেন এক ব্যানার উঁচিয়ে বলেন, "আমি কোথা থেকে এসেছি, তা লুকাব না"। এই দ্বৈত ব্যবহারের তাত্ত্বিক নাম– diglossia। যা আমাদের শেখায় ভাষা এক প্রকার আত্মরক্ষার কৌশল, শ্রেণি উত্তরণের সিঁড়ি; আবার এক ধরনের আত্মসন্তাপও। এই বাস্তবতা একজন ব্যক্তিকে একই দিনে প্রমিত ভাষায় পাঠ লিখতে শেখায়, আবার রাতে বাড়িতে তার মায়ের ভাষায় কান্না করতে শেখায়।

আর এই কান্না যদি আমরা না শুনি, তবে আমরা শুধু ভাষার রাজনীতি বুঝি না। ভাষা তখন আর কেবল expression নয়, সেটা repression-এরও একটা রূপ। যেমন একটা পাখিকে শেখানো হয় মানুষের ভাষায় কথা বলতে, কিন্তু তার নিজের সুরটাকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়।

এই সংকট কেবল ব্যক্তিগত নয়, এটি সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিকও। কারণ ভাষার প্রশ্নে শ্রেণি যেমন উপস্থিত, তেমনি আছে ক্ষমতা। কেউ কেউ জন্মসূত্রে ক্ষমতাবান ভাষার অধিকারী, আবার অনেকেই আজীবন চেষ্টা করেন সেই ভাষা রপ্ত করতে, যেন সমাজের ভদ্রপঙক্তিতে জায়গা পাওয়া যায়। ফলে ভাষা হয়ে ওঠে শ্রেণিসীমার অদৃশ্য এক দেয়াল। এই দেয়াল টপকাবার জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করে উচ্চারণ, টান, আর শব্দ চয়ণ।

শেষ কথা হলো, আমরা যদি এমন একটি সমাজ গড়তে চাই যেখানে মানুষ তার নিজের কণ্ঠে নিজের গল্প বলতে পারে, তবে আমাদের এই ভাষা-ভিত্তিক শ্রেণি কাঠামোকে প্রশ্ন করতে হবে। আমাদের দরকার এমন এক চিন্তা, যেখানে ‘শুদ্ধ ভাষা’ নয়, বরং ‘নিজস্ব ভাষা’কে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। যেখানে কেউ তার নিজের অঞ্চলের টান নিয়ে কথা বললে তাকে বলা হবে ‘আঞ্চলিক’, কিন্তু অপমান নয়, ভালোবাসা নিয়ে।

কারণ ভাষা কেবল শব্দ নয়, ভাষা হচ্ছে আত্মার উচ্চারণ। ভাষা মানে, "আমি কে", "আমি কোথা থেকে এসেছি", এবং "আমি কিভাবে এই সমাজে নিজের জায়গা তৈরি করতে চাই"। যদি আমরা এই উচ্চারণকে শ্রদ্ধা না করি, তবে আমরা কেবল ভাষাকে হত্যা করি না; আমরা মানুষকেও এক ধরণের মৌনতার বন্দিত্বে পাঠিয়ে দিই।

ভাষা তাই শুধুই একটি কণ্ঠের প্রশ্ন নয়; এটি সমাজের আত্মার আয়না। এই আয়নায় আমরা কী দেখতে চাই, সেটাই আগামী দিনের শ্রেণির, মর্যাদার, এবং মানবিকতার সত্যিকারের প্রশ্ন।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.